চন্দ্রপুকুর পর্ব -৩৩

#চন্দ্রপুকুর
||৩৩তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
যুবক ভাবে সত্যিই তো এ কথা ভোরে শেষদিকে বলেছিল সে। তবে কথাটি শতভাগ মিথ্যে তাও নয়। একপ্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিবাহ হয়েছিল তাদের।

তার ভাবনার মাঝে আরও শব্দ করে কেঁদে উঠে যামিনী। মেহমাদ শাহ বিচলিত হয়ে সেদিকে তাকায়। তার বাচ্চা হরিণী নয়নযুগল রক্তিম, যেন টোকা দিলেই রক্ত ঝরবে। শুভ্র রঙা হলে নির্ঘাত এতোক্ষণে গাল, নাক, কানও লালচে হয়ে পড়তো।

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, তাই তো? আমি আপনার পথের কাঁটা। তবে আল্লাহর নিকট দোয়া করি আমার মৃত্যুতে আপনি আপনার ভালোবাসা পান।”

ক্রুব্ধ হয় যুবক। গণ্ডদেশ শক্ত হাতের ছোঁয়া পড়ে যায় দ্রুতোই।

শীতল কিন্তু হুমকির সুরে শুধায়,
“সাহসটা আজকাল অধিক হয়েছে তোমার যামিনী। স্পর্ধা কী করে হয় আমার উপস্থিতিতে এরূপ বাণী মুখ হতে বের করার?”

কষ্ট হয় রমণীর। তবুও চোখজোড়া স্থির রাখে মানুষটির দিকে।

“সত্যি বৈকী মিথ্যে তো বলিনি। আপনি তো নিজ মুখে স্বীকারোক্তি দিয়ে সত্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।”

এই নারীর অভিমানী, ছলছল চাহনির সামনে কোনো এক নিয়মবিরুদ্ধ কারণে ক্রোধ ধরে রাখতে পারে না মেহমাদ শাহ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

বস্তুত, সে রাগের মাথায় কথাটি বলে ফেলেছিল। ক্লান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে যামিনী ফ্যাচফ্যাচ করে বৃথা কান্না শুনে বিরক্ত ও রাগ হওয়া ব্যতীত কোনো প্রতিক্রিয়াই সেই মুহূর্তে আসেনি।

ললাটে আদুরে স্পর্শ পায় যামিনী। খেয়াল করে পুরুষটি একেবারে শান্ত এখন।

“শোনো যামিনী যতো যাই হোক বাস্তবতা তো এটাই তোমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছি। বাধ্য হয়েও বলা ঠিক হবে না। জেদ ও নিজের দম্ভ বজায়ে করেছিলাম। তবে হ্যাঁ, বিবাহের পর আমি তোমাকে পূর্ণরূপে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। দেহ, মন ও মস্তিষ্ক সবকিছুর ক্ষেত্রেই।

মেহনূরকে আমি ভালোবাসি না। বরং, তাকে আমি ফুপাতো বোন বৈকী অন্য কোনো চরিত্রে কল্পনা করিনি। এ কথাটা ছিল বিরক্তির প্রকাশ মাত্র। বাকি রইলো তাকে চন্দ্রপ্রভা ডাকার কারণ। মেহনূর অর্থ চাঁদনি বা চন্দ্রপ্রভা। ছোটোবেলায় ও জন্মের পর বোন হিসেবে এ নাম দিয়েছিলাম, এতোটুকুই।

নিজের মাথায় এ কথাগুলো পরিস্কার ভাবে এঁটে নেও। আমি বারবার তোমায় সংশোধন করব সে কল্পনা কোরো না। আর হ্যাঁ, তোমার এই আচারণে প্রচুর পরিমাণ ক্ষুব্ধ আমি। সম্পর্কে বিশ্বাস না থাকলে সম্পর্ক টিকে না।”

মেহমাদ যামিনীকে রেখে গায়ে পোশাকটা কোনোরকম পরে বেড়িয়ে যায়। রমণী এবার প্রশান্ত নিজের ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। তবুও যুবকের বলা কথায় থাকা চাপা ক্রোধের অনল তাকে ভীতিগ্রস্তও করছে।

___

যামিনী শিক্ষিকার হতে পড়ার পাঠ চুকিয়ে ফিরে আবার বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছে। তাকে অবাক করে বেগম লুৎফুন্নেসা তার সাথে যথেষ্ট পরিমাণ ভালো আচারণ করেছেন।

অবশেষে দুপুরের ভোজন শেষে কক্ষে ফিরে সে। ফিরে যার কথা তার পূর্বে মনে হয় সে হলো চাঁদনি। তার অতিপ্রিয় পোষা চন্দনা টিয়া পক্ষীটি।

“চাঁদনি! চাঁদনি! কোথায় তুমি?”

নিস্তব্ধ পরিবেশ। কোনো সাড়া নেই চাঁদনির। অথচ, যামিনী বা মেহমাদ শাহের কণ্ঠ শুনলেই সে উচ্চস্বরে ডাকে।

তবুও কিশোরী ধ্যান দেয় না তাতে। আনন্দিত মনে পা বাড়ায় বারান্দার দিকে। কিন্তু এ কী মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পায় সে! খাঁচা তো বিদ্যমান, তবে পাখি দু’টো অদৃশ্য।

“দিলরুবা! দিলরুবা! আমার চাঁদনি কোথায়? কে নিয়ে গিয়েছে তাকে?”

তার অশান্ত ও উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে দিলরুবা ও মোহিনী তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সেদিকে। সেও অবাক।

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। কিন্তু আমরা তো চাঁদনিকে দেখিনি। আপনার সাথেই তো ছিলাম আমরা।”

যামিনী ক্রুব্ধ হয় নিজের কক্ষ হতে বের হয়। চেঁচাতে শুরু করে সে।

“আমার চাঁদনিকে কে নিয়েছো? ফিরিয়ে দাও, বলছি। আমার নজরে পড়লে আল্লাহর শপথ জান নিয়ে নিব।”

সকল দাস-দাসী মাথা নত করে রাখে। তার একজন বাঁদী ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,

“বেগম আমাদের মাঝে তো কেউ নেয়নি। আর আমরা দেখিনিও ঐ পক্ষীকে।”

“তাহলে বসে বসে কী কাজ করছিলে তোমরা! ধ্যান কোথায় থাকে তোমাদের? আর প্রহরীরা কোথায়?”

ছুটে আসে তার দোয়ারের প্রহরীরা।
“ক্ষমা করুন বেগম। ক্ষমা করুন। আমরা দুপুরের আহার করতে গিয়েছিলাম।”

“আজকে আমার পোষা প্রাণীকে অপহরণ করা হয়েছে, তোমরা কেউ সাড়া অবধি পেলে না। কাল আমাকে অপহরণ করলেও তো তোমরা হাতে হাত রেখে বসে থাকবে।”

সবার আড়ালে কেউ হাসে তৃপ্তির হাসি। বিড়বিড়ায়,
“তোমার ঐ প্রিয় পক্ষীটিকেও যেমন নিজের অধীনস্থ করেছি, তেমন তোমার সবকিছুই আমার হবে।”

চেঁচামেচি শুনে বেড়িয়ে আসেন নবাব পরিবার। মেহমাদ শাহও কাছে আসে।

“কী হচ্ছে এখানে?”

যুবকের কণ্ঠ শুনে অনুভূতি পূর্ণরূপে বাঁধনহারা হয়ে পড়ে রমণী। ছুটে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অভিযোগ করে,
“দেখেন না বাবু মশাই, আমার চাঁদনিকে কে যেন অপহরণ করেছে। আমি পাচ্ছি না তাকে কোথাও। ওকে এনে দেন না।”

যামিনীর পিঠে হাত রাখে সে। দিলরুবাকে আদেশ করে,
“চন্দ্রমল্লিকাকে কক্ষে নিয়ে যাও।”

আদেশ মোতাবেক কর্ম করে দিলরুবা। মোহিনীও পিছন পিছন যায় তার।

মেহমাদ শাহ এবার মিনারকে ডাকায়।
“চাঁদনিকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করো। আর কে এই অপকর্ম করেছে তার নাম আমার চাই।”

“যথা আজ্ঞা, জমিদার বাবু।”

এদিকে যামিনী নিজের কক্ষে মন খারাপ করে বসে কামরায় বসে আছে। পোষা পক্ষীটির সাথে তার সখ্যতা গড়েছিল, গড়েছিল মায়ার এক অনড় বন্ধন। ব্যথিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

“বেগম চন্দ্রমল্লিকা, আপনি অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলতে চাই।”

ভ্রু কুঁচকে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে। ইশারায় অনুমতি দেয়।

“ভুল-ত্রুটি মার্জনা করবেন বেগম। তবে আমার মনে হয় এ কাজ শাহাজাদি মেহনূর ছাড়া অন্য কারো করার নয়।”

“এ কী করে সম্ভব? তিনি তো নজরবন্দী আছেন।”

“বেগম, আপনার যেমন এ অন্দরমহলে খাস বাঁদী আছে, নিজস্ব লোক আছে। তেমন তাঁরও আছে হয়তো আপনার হতেও অধিক।”

কিশোরী কিছু একটা ভাবে। অতঃপর তার মুখশ্রীতে ফুটে উঠে ভয়ংকর এক হাসি, যা আগে কখনও দেখা যায়নি তার মাঝে। তবে কি ভয়ংকর কিছুই অপেক্ষা করছে শাহাজাদি মেহনূরের উদ্দেশ্যে?

___

মেহমাদ শাহ বেগম লুৎফুন্নেসার কক্ষে বসে আছে। উদ্দেশ্য তার দাদার মরহুম নবাবের উদ্দেশ্যে মিলাদ ও দান করার কথাবার্তা বলা।

যদিও এতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। নিজের দাদীজানের আদেশ পালনে উপস্থিত হয়েছে শুধু।

“ভাবছিলাম পনেরোটা গরু কুরবানি দিব গোটা শেরপুর বাসীকে আহার করাতে। আর পাঁচটা ছাগল মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করে দিব। এগুলো তো যথেষ্ট হবে, তাই না আমার সিংহ?”

“হ্যাঁ, দাদীজান।”

“আর গরীব-মিসকিনদের মাঝে কতো পরিমাণ অর্থ বিলিয়ে দেওয়া যায় না কি কাপড়-চোপড় বা অন্ন দিব? এ নিয়ে বড়োই বিড়ম্বনায় ভুগছি।”

“জী, বেগম।”

বিরক্ত হন বেগম লুৎফুন্নেসা। ধমক দিয়ে বলে উঠেন,
“এমন হ্যাঁ, জী করছো ক্যানো মেহমাদ? তোমাকে আলোচনা ও নিজের মতামত দিতে ডাকানো হয়েছে, আমার সাথে সায় দিতে নয়।”

এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না মেহমাদ শাহ, উঠে দাঁড়ায় নরম গদি হতে। চোখজোড়া হতে উপচে বিরক্তি, তিক্ততা, ক্রোধ।

“আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই দাদীজান, এমন একজন নির্দয় মানুষের কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার। যা ইচ্ছে করুন আপনি।”

“মেহমাদ! তোমার দাদাজান হন তিনি! এরূপ তাঁর উদ্দেশ্য অসম্মানজনক বাণী উচ্চারণ কীভাবে করো তুমি? আজও গ্রামবাসীর মুখে মুখে আমাদের বংশ ও তোমাদের দাদাজানের প্রশংসাবাণী থাকে।”

“এই নবাব বাড়ির বাস্তবতা জানলে এই গ্রামবাসী থুঁথু ছিটাতে আসবে। আর তিনি হয়তো শাসক হিসেবে খুব মন্দ কেউ ছিলেন না তার লোকদের নিকট। তবে তার বাস্তবতা আমার দেখেছি। কতোটা নির্দয় ছিল আমি নিজ চোখে দেখেছি।

যে নিজের পুত্রকে খুন করে তা মাটি চাপা দিতে পারে তার চাইতে জঘন্য ব্যক্তি আর হয় না। আর কোনো না কোনো ভাবে না বুঝে আমিও এই অপরাধে অংশীদার হয়েছি।”

অপেক্ষা করে না যুবক। দ্রুতো পদচারণায় বেড়িয়ে যায়। তার অপছন্দের যদি তালিকা করা হয়, তবে প্রথম নামটি তার দাদাজানেরই হবে।

বেগম লুৎফুন্নেসা স্তব্ধ হয়ে আছেন। তাঁর আঁখিজল ভিজিয়ে দেয় গণ্ডদেশ। যে সত্য সে ভুলে থাকতে চায় তা আবার ক্যানো মনে করিয়ে দিলো মেহমাদ?

পুত্রের কথা মনে করে গা কাঁপিয়ে কেঁদে উঠেন। শেষবারের জন্য ছেলেকে ছুঁয়েও দেখতে পারেননি। স্বামী নামক মানুষটি সেই সময় টুকুই দেননি। এতোটাই অভাগী তিনি যে স্বীয় পুত্রের কবর কোথায় তাও জানা নেই। শুধু জানে জঙ্গলের কোনো এক প্রান্তে মাটির তলে নিদ্রারত তাঁর মানিক রতন।

“লুকমান! আমার লুকমান! আমার রত্ন!”

তাঁর ক্রন্দন গ্রাস করে নীরবতাকে। এ আর্তনাদ শুধু চার দেওয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ। তবে কী এমন পাপ করেছিলেন লুকমান, যার জন্য এতো বড়ো শাস্তি পেতে হলো তাঁকে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here