চন্দ্রাণী(০৬)

#চন্দ্রাণী(০৬)
একটা সিএনজি করে শুভ্রকে বাড়িতে নিয়ে এলো।শাহজাহান তালুকদারের মাথার রগ দপদপ করছে প্রচন্ড ক্ষোভে।
শাহজাহান তালুকদার জানে এটা নিশ্চয় কাদেরের কাজ।কাদের শুভ্রকে ঘুঁটি বানিয়ে তার সাথে খেলতে চাইছে।
শাহজাহান তালুকদারের ফর্সা মুখে বিরাজ করছে রাজ্যের ক্ষোভ।দুই কান লাল হয়ে গেছে।

বাবুল দাশ কড়া লিকারের চা বানাচ্ছে স্যারের জন্য। তার ও মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। শুভ্র সবার আদরের,সবার নয়নের মণি।

শাহজাহান তালুকদার চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে কাচারি ঘর থেকে বের হলো। তার পরনে খাদি কাপড়ের সবুজ রঙের পাঞ্জাবি। গতকাল বড় মেয়েটা আসার পর থেকে ছেলেটা ভীষণ খুশি ছিলো।অথচ কোন সুযোগে শুভ্রর সাথে এরকম করলো কেউ?
ছেলের যেই অবস্থা জানতে ও পারবেন না তিনি কোনো দিন কে করেছে,কিভাবে করেছে।

এক বুক আক্ষেপ নিয়ে চা শেষ করে চা’য়ের কাপটা আছড়ে ভেঙে ফেললেন তিনি।
চেয়ারম্যান বাড়ির পথটার চারপাশে নানা ধরনের ফুল গাছ লাগানো আছে।শাহজাহান তালুকদার নাম জানেন না এসব গাছের,এসব বাবুল দাশই দেখাশোনা করেন।

মনের অস্থিরতা কমাতে শাহজাহান তালুকদার পায়চারি করতে লাগলো বাড়ির রাস্তায়।
পায়চারি করতে করতে দেখতে পেলো টগরকে। বিড়বিড় করে টগরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”রাস্কেল। ”

টগর হাসতে হাসতে এসে শাহজাহান তালুকদারের পায়ের কাছে বসে বললো, “দিন তো,চেয়ারম্যান সাব,একটু পায়ের ধূলো দিন।কে জানে চেয়ারম্যান থাকাকালীন এটাই হয়তো শেষ বার আপনার থেকে পায়ের ধূলো নিচ্ছি।”

রাগে শাহজাহান তালুকদারের পিত্তি জ্বলে উঠলো। গমগমে গলায় বললো, “গেট লস্ট ইডিয়ট। ”

টগর শার্টের ভেতরে বোতলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, “আমি কিন্তু দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম,আর মাস্টার্স ও করেছি ইংরেজিতে। তবে কি স্যার,গালি দিলে বাংলায় দেন।ইংরেজিতে গালি দিলে তেমন একটা গায়ে লাগে না,কেমন আলগা আলগা একটা ভাব আছে তাতে।বাংলা গালিতে কেমন কেমন একটা মাখামাখা ভাব আছে বুঝলেন।”

শাহজাহান তালুকদার অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,”এই মুহূর্তে এখান থেকে যাও তুমি, নাহলে খুব খারাপ হবে।”

টগর মাটির রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসলো। তারপর হেসে বললো, “স্যারের কি মেজাজ অত্যধিক খারাপ? আমার কাছে তো আর কোনো বোতল ও নাই,আমি আবার নিজের বোতল কাউরে শেয়ার করি না। আমি আবার রুলস মেনে চলি।আপনি চেয়ারম্যান হোন আর এমপি হোন।আমি আমার বোতল কাউকে দিই না।”

শাহজাহান তালুকদারের মাথা গরম হয়ে গেলো। রাগে তেড়ে গেলেন টগরের দিকে। টগর মাটিতে শুয়ে পড়লো, তারপর হেসে বললো, “কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে। সময় খুব কমে আসছে।”

শাহজাহান তালুকদার বিস্মিত হয়ে বললো, “কিসের কাউন্ট ডাউন?”

টগর এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দূরে সরে গিয়ে হেসে বললো, “আপনি এতো বোকা হয়ে কিভাবে এতো কিছু সামলান?এতো বছর ধরে কিভাবে রাজত্ব করছেন কুসুমপুরে? আমি তো আপনার হাতের মার খাওয়ার ভয়ে বললাম যাতে আপনি থমকে যান আর আমি সরে যেতে পারি। ”

আর না দাঁড়িয়ে টগর বোতল চেপে ধরে এক ছুটে পালিয়ে গেলো।শাহজাহান তালুকদার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন।তার মন বলছে অন্য কথা। কাদের খাঁন নিশ্চয় কোনো কিছু করার তাল করছে, সেজন্যই টগর এই কথা বলছে।ও নিশ্চয় কিছু শুনেছে।

বিড়বিড় করে শাহজাহান তালুকদার বললো, “কাদের খাঁন,এবার আমি ও আটঘাট বেঁধে নেমেছি।এতো সহজে ময়দান থেকে সরবো না আমি।”

নিয়াজ বসে আছে তার বাবার রুমে চেয়ারের উপর। বাবাকে তার ভীষণ ভয়।
কাদের খাঁন গম্ভীরমুখে একটা বই পড়ছেন মনোযোগ দিয়ে। নিয়াজ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললো, “সামনে নির্বাচন আর উনি বসে বসে হ্যামলেট পড়ছে। ”

সাহিত্য চর্চা দেখে নিয়াজের শরীর জ্বলতে লাগলো।কিছু সময় পর নিয়াজ উঠতে গেলে কাদের খাঁন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,”আমি তোমস্কে যেতে বলেছি এখানে থেকে?”

নিয়াজ আবারও ধপ করে বসে পড়লো। কাদের খাঁন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলেন আবারও।
প্রায় ১৫ মিনিট পরে বই বন্ধ করে বললেন,”তোমার আর আমার দু’জনের পথ আলাদা।আমার নির্বাচন নিয়ে তোমাকে অযথা মাথা ঘামাতে হবে না।তোমার কাজ হচ্ছে তোমার অফিসে।তোমার নিজের কাজে মন দাও,আমার নির্বাচনের কাজে নিজেকে জড়িয়ো না।”

নিয়াজ বিড়বিড় করে বললো, “আমার স্বার্থ আপনি বুঝবেন না আব্বা।”

কাদের খাঁন গম্ভীরমুখে বললেন,”আর যেনো তোমাকে কোথাও না দেখি।”

নিয়াজ বাবার ঘর থেকে গম্ভীর হয়ে বের হয়ে এলো।কাদের খাঁন চেয়ারম্যান হলে নিয়াজের অনেকগুলো প্লাস পয়েন্ট আছে।নির্বিবাদে গ্রামে ড্রাগের বিজনেস করতে পারবে সে।আরো যেসব বিজনেস করার জন্য ভাবছে সব পথ ক্লিয়ার হয়ে যাবে তার।
বস ইদানীং আরেকটা প্রজেক্ট শুরু করেছে , নিয়াজ চাইছে নিজেও সেই কাজে যোগ দিতে।
নিজের বাবা চেয়ারম্যান হলে যেই সুযোগ সুবিধা হবে তা এখন তো পাওয়া যাবে না।নিজের স্বার্থে নিয়াজ বাবার নির্বাচন নিয়ে ভাবছে,তার বাবার স্বার্থে না।

চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। টগর ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে হেঁটে আসছে।
কুসুমপুরের শেষ প্রান্তে কুশী নদী। নদীর পাড়ের দিকটায় সবগুলো ঘর জেলেদের। এই দিকটায় কেমন মাছের আঁশটে গন্ধ।
জায়গায় জায়গায় জাল শুকাতে দেওয়া, মাছ শুকাতে দেওয়া। হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে টগর জেলেপাড়ায় এলো।নিয়াজ পাঠিয়েছে তাকে এগুলো নিয়ে।

বারবার মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখ টেনে খোলার চেষ্টা করছে টগর। তারপর এগিয়ে গিয়ে বটতলায় গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নিয়াজ এই বটতলার কথা-ই বলেছে তাকে।ভুল হয়ে গেছে, বের হবার আগে বোতলটা না খেলেই হতো। তাহলে হেঁটে আসতে এতো কষ্ট হতো না। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলো টগর।

বেশ খানিকক্ষণ পরে একটা ছায়া মূর্তি এগিয়ে এলো। টগরের নাকের সামনে হাত দিয়ে পরখ করে নিলো ঘুমে কি-না টগর। ঘুমিয়েছে নিশ্চিত হয়ে ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিলো। তারপর দ্রুত পা চালিয়ে পালিয়ে গেলো।

টগর যখন উঠে বসলো তখন রাত্রি দশটার বেশি বাজে।সারা শরীর কেমন নির্জীব লাগছে তার।ইদানীং খুব বেশি মদ খাওয়া হচ্ছে।
একবার উঠে দাঁড়ালো টগর বাড়ির উদ্দেশ্যে, কিন্তু শরীর জানান দিলো তার পক্ষে সম্ভব না এখন এতো দূর যাওয়া।
আবারও আগের জায়গায় শুয়ে পড়লো টগর। মশার ঘ্যানঘ্যানানি উপেক্ষা করে ঘুমিয়ে গেলো সেখানেই।একে বলে যেখানে রাইত,সেখানে কাইত।
পুরুষ মানুষ বন্ধনহীন হয়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।নারীর সংস্রব ছাড়া পুরুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, নারী তবুও পারে পুরুষ ছাড়া থাকতে।
পুরুষের কাউকে না কাউকে লাগে সে মা হোক বা বোন অথবা বউ।

গভীর রাতে টগর জেগে গেলো। রাত্রি কয়টা বুঝতে পারলো না। দূরে নদীর পাড়ে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। টগর সেদিকে এগিয়ে গেলো।ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে তার।নদীর পাড়ে গিয়ে দেখে অনেকগুলো নৌকা ঘাটে এসেছে। নৌকা ভর্তি মাছ প্রদীপের আলোয় চকচক করছে।

টগর তখন অতীতের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে লাগলো। ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খেতে চাইতো না বলে মা এরকম কতো মাছ কিনে নিয়ে আসতো ঘাটে গিয়ে। মাছ নিয়ে ফিরে মা যখন ডিশে করে নিয়ে টগরকে দেখাতো টগরের দুই চোখ চকচক করতো আনন্দে।
আজ মা কোথায়,সেই আনন্দ কোথায়,টগর কোথায়?
মা কি জানে তার টগর কেমন আছে?
মায়ের বাধ্য ছেলে,ভদ্র ছেলে,ক্লাসের টপার ছেলে টগরের জীবনটা কেমন মা কি জানে?
মায়ের কথা মনে হতেই সব হতাশা, ক্লান্তি, ক্ষুধা সব হারিয়ে গেলো টগরের।শুধু অনুভব করলো দুই চোখের জল টপটপ করে ঝরছে।

টগর মুছল না চোখের পানি। বহুদিন পর আজ একটু কান্না এসেছে, আরো আসুক।মন খুলে কাঁদতে চায় টগর।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here