চন্দ্রাণী(০৭)

#চন্দ্রাণী(০৭)
বটগাছের পাতার ফাঁক গলে সূর্যের আলো এসে টগরের চোখে পড়তেই টগর জেগে গেলো।
মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।

রাতে বাড়িতে ফেরা হয় নি, টগর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তার মনে পড়ে সে ছিলো নদীর পাড়ে অথচ সকালে নিজেকে বটতলায় পেলো।
মাথায় অসংখ্য হিসাবনিকাশ মিলানোর চেষ্টা করছে।

জায়গায় জায়গায় থকথকে কাদা মাড়িয়ে টগর চললো বাড়ির দিকে।
পরনের টিশার্টে রাজ্যের ময়লা।

চন্দ্র বের হয়েছে শর্মীকে নিয়ে হাঁটতে। দুই বোনের মাথায় ঘুরছে ভাইয়ের ব্যাপারটা।

চন্দ্র বললো, “কাদের মিয়ার লোক ছাড়া এই কাজ কেউ করবে না শর্মী।দেখলি না আব্বা রাতে বললো যে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত শুভ্র যাতে বের না হয়।”

কাদের খাঁনের নাম শুনে শর্মির গলা শুকিয়ে গেলো। এক সময় কতো স্বপ্ন দেখেছে বাবা আর শ্বশুরকে এক করবে তারা দুজন মিলে। সব দ্বন্দ,প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব কিছুর অবসান হবে।
অথচ আজ ভাগ্যের কি খেলা!

তবুও আমতাআমতা করে বললো, “কিন্তু আব্বা তো বলে নি কেনো এরকম কথা বলছেন তিনি,কি হয়েছিলো কিছুই তো জানি না।”

চন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললো, “বোকা মেয়ে,এটুকু ও বুঝস না?আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু কে আর?কে করবে এসব?”

শর্মী বিড়বিড় করে বললো, “অন্য কেউ তো হতে পারে, হয়তো তৃতীয় কেউ এই কাজটা করেছে আব্বার আর কাদের আংকেলের মধ্যে ঝামেলা আরো বাড়ানোর জন্য তো কেউ করতে পারে।
এই যে হাশেম আলীও তো আছে আরেক প্রার্থী। সে হয়তো করেছে দুজনকে দুজনের শত্রু করার জন্য। ”

চন্দ্র হেসে বললো, “না না,হাশেম আলী এরকম লোক না।আল্লাহ ভীরু লোক উনি।তাছাড়া হাশেম আলী হলে আব্বা এতো গম্ভীর হয়ে যেতো না।হাশেম আলীর খুটির জোর কম।”

শর্মী মুগ্ধ হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুই কতো কিছু বুঝিস আপা,কতো কিছু জানিস।আব্বা তোকে অনেক ভরসা করে। এজন্য তোর কাছে সব সিক্রেট শেয়ার করে যা হয়তো মা ও জানে না।”

চন্দ্র হাসলো। শর্মী মিথ্যে কিছু বলে নি। আব্বার সকল একাউন্টের নমিনি চন্দ্র,সম্পত্তি যা আছে তার সব ডকুমেন্টস চন্দ্রর কাছে।যত গোপন তথ্য আছে সব মেয়েকে বলেন তিনি।
বিয়ের ১২ বছর পর আল্লাহ তাকে চন্দ্রকে দিয়েছিল, তাই সব কিছু আগে মেয়ের জন্য করেন।

চন্দ্র একটু হেটে বললো, “কাদের মিয়াকে আজ হঠাৎ আংকেল বলছিস যে?”

শর্মী চমকে উঠলো। নিয়াজের সাথে বলতে বলতে ভুল করে বলে ফেলেছিলো।তাই শুকনো হেসে বললো, “একজন বয়স্ক লোককে কি নাম ধরে বলা মানায় না-কি? ”

চন্দ্র তীর্যক হেসে বললো, “তাহলে হাশেম আলীকে কেনো আংকেল বললি না?উনি কি ছোট বাচ্চা?”

শর্মীর গলা শুকিয়ে গেলো। তবুও জোর করে বললো, “দূর আপা,ভুক ধরতে বসেছিস না-কি। বাদ দে।”

চন্দ্র বললো, “যা ই বলিস,কাদের খানের একটা ছেলে আছে না কি যেনো নাম?
ও নিয়াজ নাম,ওরে দেখলেই কেমন ষণ্ডা মতন লাগে তাই না?”

শর্মীর হার্টবিট বেড়ে গেলো। বুকের ভেতর চুরমার হয়ে গেলো যেনো মুহূর্তে। আহা নিয়াজ!কতো ভালোবাসার নিয়াজ!
কি জবাব দেবে শর্মী এই প্রশ্নের?
আপা তো ভুল বলে নি।

হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে এলো দুজন। আবারও ঘুরে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

চন্দ্র মনে মনে ভাবছে শর্মী কখন বলবে তার সমস্যা কি,কি হয়েছে তার!

টগর বাড়ি গিয়ে গোসল করে নাশতা বানাতে কিচেনে গেলো। ময়দা মেখে রেডি করে নিলো পিৎজা বানানোর জন্য। আজ হঠাৎ করে পিৎজা খেতে ইচ্ছে করছে।
মা যেভাবে বানিয়ে দিতো সেভাবে। মা মারা যাবার পর কতো নামি-দামি রেস্টুরেন্টের পিৎজা খেয়েছে টগর অথচ কই,মায়ের বানানো পিৎজার স্বাদ পায় নি।

ময়দার ডো করে টগর সোফায় গিয়ে একট্য কাত হলো। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে অনেকটা পথ হেটে আসায়।
কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলো টগর বুঝতে পারলো না। ঘুম ভাঙলো বাহিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে।

টগরদের বাড়ির নাম সুখ নিবাস। অথচ এখানে বাস করা মানুষটার জীবনের সুখ নেই।
নারিকেল সুপারি গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়িতে ১৫০ টি নারিকেল গাছ আছে আর সুপারি গাছের কোনো হিসেব নেই।

টগর দরজা খুললো চোখ কচলাতে কচলাতে। দরজা খুলে যাকে দেখলো তাকে দেখে কয়েকটা হার্টবিট যেনো মিস করে ফেললো সে।
পুলিশের ইউনিফর্মড হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর নির্ঝরচ, ।
চোখের কালো সানগ্লাসটি যেনো এখনো আগেরটি রয়ে গেছে। ঠোঁটে খেলা করছে ক্রুর হাসি।
ক্লীন শেভ করা লোকটার ফর্সা মুখটায় কঠোরতা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

টগরের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো,”তো,কি অবস্থা টগর সাহেব?আফটার এ লং টাইম, উই মিট এগেইন।
বলেছিলাম না,ঠিকই নজর রাখবো।
পালিয়ে এসে ও বাঁচলে না দেখলে।”

টগরের মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। এই লোকটা কিভাবে এলো এখানে?এর পোস্টিং কুসুমপুরে হলো কেনো হঠাৎ করে?

টগরকে চুপ থাকতে দেখে নির্ঝর বললো, “আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে টগর। ”

টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “কোন অপরাধে?”

নির্ঝর হাসলো। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে পকেটে ভরে বললো, “জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। ”

টগর আগের মতো একরোখা হয়ে বললো, “কেনো?”

নির্ঝর টগরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এঘর ওঘর সবকটা রুম খুঁজলো কিছু একটা। এলাকার যারা নির্ঝরের সাথে এসেছিলো তারাই জানিয়েছে টগর ভীষণ মদ খায়,ওর বাসায় অনেক মদ আছে।
টগর নাম শুনে নির্ঝরের যদিও এই টগরের কথা মাথায় এসেছিলো কিন্তু সত্যি সত্যি যে এ হবে তা নির্ঝর ভাবে নি।
নির্ঝরকে এঘর ওঘর ঘুরতে দেখে টগর মুচকি হাসলো। মনে মনে বললো, “কোনো লাভ নেই নির্ঝর বেবি,তোমার মতো দুই পয়সার ইন্সপেক্টরের কর্ম নয় টগরের মদের আস্তানার খোঁজ নেওয়া।টগর এতো কাঁচা মাছ খায় না।”

টগরের সামনে এসে নির্ঝর বললো, “গতরাতে কোথায় ছিলে?”

টগর বুকে দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বললো, “যেখানেই থাকি,নান অফ ইওর বিজনেস। ”

নির্ঝর হেসে বললো, “আমার বিজনেসটাই এটা টগর। তোমার অতীত রেকর্ড আমার অজানা নয়,সবাই তোমাকে না জানলেও আমি জানি তুমি কতটা ডেস্পারেট। যা জিজ্ঞেস করছি তা জবাব দাও।গতরাতে কোথায় ছিলে?”

টগর আগের মতো শান্ত স্বরে বললো, “আপনার নাকটা ভীষণ বড় হয়ে গেছে দেখছি,সব জায়গায় ঢুকে পড়ছে তাই।আমি কোথায় ছিলাম,কার সাথে ছিলাম তাতে নাক গলাচ্ছেন কেনো?পুলিশ হলেই কি এতো লম্বা নাক থাকা লাগে?মানুষের পার্সোনাল ব্যাপারে ও ঢুকে যায়।”

নির্ঝর আগের মতো শান্ত স্বরে বললো, “এখনো উত্তরটা পাই নি আমি।”

টগর বললো, “আগে আমাকে বলুন কি হয়েছে, কেনো জানতে চাচ্ছেন?”

নির্ঝর বললো, “গতরাতে কুশি নদীর পাড়ে নৌকায় দুইজন জেলে খুন হয়েছে। ”

চমকে উঠলো টগর। খুন!
কই সে তো সকালে এলো ওখান থেকে, কোনো কিছু শুনে নি তো সে।তাহলে কিভাবে কি হলো, কখন হলো?

নির্ঝর সোফার হাতলে বসে বললো,”জবাবটা এখনো পাই নি।”

টগর শান্ত স্বরে বললো, “গতরাতে আমি কুশি নদীর ওখানেই ছিলাম,রাত ওখানেই কাটিয়েছি।”

নির্ঝরের মুখটা হাসিহাসি হয়ে গেলো। টগরের হাত চেপে ধরে বললো, “বাকি কথা থানায় গিয়ে হবে,বাঘবন্দি খেলা অনেক হয়েছে। এবার সময় এসে গেছে। ”

টগর এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে পরনের জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিলো।হতভম্ব অবস্থায় নির্ঝরের সাথে রওয়ানা দিলো থানার উদ্দেশ্যে।

চলবে……
রাজিয়া রহমান
জয়েন করুন আমার ফেসবুক গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here