চরিত্রহীনা ২ পর্ব ২

‘চরিত্রহীনা২’ পর্ব-২
.
লেখক : Mahian Khan
.
(২)
.
এই নিয়ে আজকে ১৯ টা সিগারেট টানা শেষ করল রনি, শেষ করে ডায়েরিতে ডেট সহ আজকে দেহের মধ্যে প্রবেশ করানো মোট সিগারেটের সংখ্যাটা লিখল। বেশ ভালোভাবে ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে এই সপ্তাহে দেহের মধ্যে প্রবেশ করানো মোট সিগারেট সংখ্যাটা মনযোগ সহকারে হিশেব করল। সর্বমোট ১০৭ টা। প্রায় ৩ বছরের কাছাকাছি হতে চলল রনি নিজের লেখাপড়া বন্ধ করেছে। বাবার ব্যবসায় মাঝে মাঝে একটু ইচ্ছে হলে সাহায্য করে এছাড়া প্রায় দিনের ১৩-১৪ ঘন্টা রুমের মধ্যে বসে গিটার বাজানো আর সিগারেট টানা ছাড়া খুব একটা কাজ রনির নেই। অবশ্য প্রতিদিন বাহিরে ২-৩ বার বের হলেও সেটা হয় সিগারেট টানার জন্য আর নাহলে একা একা অজানা কোনো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য, যেই গন্তব্যে রনির কোনো সঙ্গি নেই, সে সম্পুর্ন একা থাকে আর মুখের মধ্যে থাকে একটা উত্তপ্ত তামাক দন্ড। বন্ধু-বান্ধব এখন আর প্রায় কেউ নেই বললেই চলে, দুই একসময় কোনো বন্ধু-বান্ধব স্বেচ্ছায় খোজ নিতে আসা ছাড়া প্রায় কোনো বন্ধু-বান্ধবের সাথেই খুব একটা সম্পর্ক নেই। বন্ধু বলতে রনি এখন শুধু বোঝে তামাক আর গিটারকে। রনির বিশ্বাস, সিগারেটের ধোয়াগুলো শুধু ধোয়া নয় বরং এই অদ্ভুত নকশা করা ধোয়াগুলো হল, আমাদের দু:খ, কষ্ট আর ইতিহাস। সিগারেট মানুষের কলিজার মধ্যে প্রবেশ করে তার দু:খ, কষ্টগুলোকে নকশা করে দেহ থেকে বের করে দেয়। রনির বিশ্বাস, ক্ষনিকের জন্য হলেও সিগারেট মানুষকে সুখ দিতে পারে, মানুষের দু:খ,কষ্ট বুঝতে পারে, যা কোনো মানুষ দ্বারা পৃথিবীতে সম্ভব না।হয়ত, সেজন্য রনি প্রতিদিন শরীরে প্রবেশ করানো মোট সিগারেটের সংখ্যাটা লিপিবদ্ধ করে। হয়ত দেহ থেকে মোট বের করে আনা কষ্ট,দু:খ পরিমাপের জন্য এই ডায়েরিটা ব্যবহার করা হয়। আর গিটার হল রনির একমাত্র বন্ধু যে সবসময় রনির প্রতিটা কথা শুনতে রাজি থাকে। এই ২ বন্ধুর বাইরে পৃথিবীর সব বন্ধুত্বকেই রনি মিথ্যা মনে করে।
.
ডায়েরিটা বন্ধ করে খাটে চুপচাপ শুয়ে নিজের ফেইসবুক একাউন্টে লগইন করে। এখন আর রনির সেই পুরানো ফেইসবুক একাউন্ট নেই সেই একাউন্ট আরো প্রায় আড়াই বছর আগেই রনি ডিএক্টিভ করেছে। এখন একটা ফেইক একাউন্ট আছে অবশ্য নিজের নামেইই তবে তার একাউন্টের সব বৈশিষ্ট্য ফেইক আইডির মত। সমগ্র একাউন্টে শুধু একটা ছবি তাও আবার একটা গিটারের ছবি, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট প্রায় ৪০-৫০ টা ঝুলে আছে তবে এই একাউন্ট থেকে কাউকে রনি রিকোয়েস্ট পাঠায়নি আর কারো রিকোয়েস্ট এক্সেপ্টও করেনি। সমগ্র একাউন্টটাতে শুধু একজন ফ্রেন্ড সেটাও একটা ফেইক আইডি। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল, সেই ফেইক আইডিটাও আবার নিজের তৈরী! ফেইক আইডিটার নাম হল, ‘Ti nni’ এই ফেইক আইডিতে একগাদা ছবি মিনিমাম ৪০-৫০ টা তো হবেই। সব কটা ছবি তিন্নির শুধু তিন্নির আর সবকটা ছবির ফ্রেন্ডস করা। হয়ত এই ছবিগুলোকে কাউকে দেখতে দিবে না রনি। হয়ত ছবিগুলো শুধু একান্ত নিজস্ব, ব্যক্তিগত বলেই রনির বিশ্বাস। প্রতিদিন ছবিগুলো অন্ততপক্ষে ১০-১২ বার বেশ ধীরে সুস্থে ছবিগুলোকে প্রচন্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। একটা সাধারন ছবি এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করা কোনো শিল্পির পক্ষেও সম্ভব না। কে জানে হয়ত ছবিগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অদ্ভুত গল্প যেটাকে রনি বেশ অল্পঅল্প করে ধীরে ধীরে পড়ে। কেনো এভাবে করে পড়ে তা জানা নেই, হয়ত তিন্নির সৌন্দর্যকে অল্প করেই সে উপভোগ করতে চায়, হয়ত একবারে সম্পুর্নটা উপভোগ সে করতে পারবে না তাই ধীরে ধীরে বেশ অল্প অল্প করেই তিন্নির ছবিগুলোকে মস্তিষ্কের গহীনে শুষে নিতে থাকে। হঠাৎ দরজাটা ঠক করে ওঠে। মুহুর্তেই অন্যমনস্ক নেশায় বিভোর মস্তিষ্কের মাথায় যেন কেউ একবালতি পানি ঢেলে দিল। বিরক্ত মানে চরম বিরক্ত হল রনি। দরজাটা খুলে দেখে, চাচাতো ভাই দাড়ানো।
.
– কি ব্যাপার ভাইয়্যা,তুই এখনো ঘুমাও নাই?
.
– নারে, ব্যাটা ঘুম আসে না, নেশা করতেছিলাম। তুই এত রাতে দরজা টাকালি কেন?
.
– এমনি, তোকে দেখতে আসলাম, নেশা? পাগলের মত কি বল?
.
– পাগল? নেশা করা তো পাগলামি না।
.
– মানে কি? সিরিয়াসলি বল।
.
– আর কি সিরিয়াসলি বলব? বললাম তো, নেশা করতেছিলাম।
.
– কোথায় দেখি তো?
.
– এই নেশা এমন নেশা, যা চোখের মাধ্যমে করে। এই নেশার বোতল এতটা মারাত্মক যে, একবার দেখলে হয়ত খোদ যমদূত নেশাগ্রস্ত হয়ে যাবে। আর আমি কি বলদ যে তোকে দেখাবো?
.
– মানে? রনি তোর পাগলামি একটু কমা। লেখাপড়া,
ছাড়ছো, কোনো কাজ-টাজ কিচ্ছু কর না, শুধু এই ৪ দেয়ালের মধ্যে আটকা থাকো সারাদিন, তাহলে কি এভাবেই কাটবে চিরদিন?
.
– আমি নেশা করি আজ প্রায় ৩ বছর। মদ, গাঞ্জা হলে হয়ত ফিরে আসতে পারতাম। নাক, মুখের নেশা তো ক্ষণিকের। চোখের নেশা তো সবচেয়ে ভয়াবহ।
.
– মানে? ভাই তুই কি ঐ তিন্নিকে নিয়ে কিছু বলতেছো? ভাই জীবন শেষ করতেছো আর কিছু না। একবার খেয়াল করছো, চাঁচি কত কাদে শুধু তোর জন্য?
.
– কান্না তো নোনাপানি, সাগরে আছে নোনাজল! ভেবে পারো কতটা কেঁদেছ কোনো এক মা, যে বানিয়েছে এই সাগর!
.
– কী যে বল ভাই, তোর কথার কোনো মূল্য নাই। মায়ের কান্নাকে যে সন্তান করে উপহাস তার জীবনটা তো বাতাস।
.
– বাতাস কেনো? বাতাস স্থির থাকে না, এক মুহূর্ত! কখনো ধীরে অথবা কখনো দ্রুত। আমি তো নেশাখোর যার মস্তিষ্ক স্থির প্রায় সবকিছু ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে , আজকে প্রায় ৩ বছর।
.
– কিন্তু কথা উত্তর দে, তুই তো বলেছিলি ঐ মেয়ে নাকি চরিত্রহীনা,তাহলে?
.
– করেছিলাম বিশাল ভুল আমার ভুলকে যে নিজের মধ্যে বহন করেছে তাকেই ভেবেছিলাম ভুল! বুঝিনি তিন্নি শুধু কোনো নারী না, ও তো দেবী! দেবীর সাথে বেয়াদবির ফল, আজও হয়ে আছি অচল।
.
– কিছুই বুঝি না, এগুলা কি বলো?
.
– দেখ, একটু ইতিহাস বলি। যেই জাভেদের কথা বলেছিলাম মনে আছে?
.
– হুম, আছে।
.
– সেই জাভেদের কাছে গিয়েছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম তিন্নির ইতিহাস। টানা ৪ ঘন্টা সেই জাভেদের সাথে কথা বলেছিলাম। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর, ছেলেটা একেবারে সুক্ষ্মভাবে দিয়েছিল। প্রতিটি উত্তরের পিছনে কঠিন যুক্তি আর প্রমাণ দিল। তারপর আমি বুঝলাম কতবড় পাপী আমি। আমার সন্তানকে শত কষ্টের মধ্যে যে, নিজের মধ্যে করেছে বহন, তাকেই চরিত্রহীনা বলে করেছি দহন। আজ সেই পাপের ফল, হয়ে গিয়েছি সম্পুর্ন অচল। ভেবেছিলাম, খুঁজে পাবো মেয়েটাকে কিন্তু ততিদিনে সে চলেগিয়েছিল কোনো এক অজানা জায়গাতে।
.
– তার মানে, সেই মেয়েটা অন্য কোনো এক ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল, সেগুলো কি তাহলে মিথ্যা?
.
– শুধু মিথ্যা না সেগুলো ছিল আমার পাপ যেই পাপ আজ আকড়ে ধরেছে আমার জীবনের প্রতিটি ধাপ।
.
– ভাই, তুই এমন করিস না, এরকম অগনিত ভালো-খারাপ ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে আর সেগুলো নিয়েই মানুষকে বাচতে হয়। কোনো এক অতীতের ঘটনা নিয়ে আজীবন পরে থাকলে কি পৃথিবী চলে?
.
– হয়ত আমার পৃথিবী চলতে পারত যদি এটা শুধু অতীত হত। তিন্নি তো আমার জীবন। অতীত, ভবিষৎ, বর্তমান! তুই বলতে চাও, আমি যেন জীবনকে ভুলে থাকি? এখন চলে যা,কথা বলার ইচ্ছে নেই।
.
– দাড়া ভাই শোন….
.
ঠাস করে রনি দরজাটা লাগিয়ে দেয়। এখনো চরম বিরক্ত! সিগারেটের প্যাকেটও খালি। মুডটাও চাচাতো ভাই নষ্ট করে ফেলেছে। বারান্দায় গিয়ে পুর্নিমার চাঁদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে রনি তাকিয়ে থাকে। মনের গহীন কোনো এক কোণে লুকিয়ে থাকা ব্যাথাটা চাঁদের উজ্জ্বল আলোর সংস্পর্শে আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাঁদ তো অনেক কিছু জানে! সে জানে, আজ থেকে ৭ বছর আগে এই তরুণ এভাবে একা দাড়িয়ে তাকে দেখত না। তার সাথে একটা চঞ্চল কিশোরী থাকত! তখন এই তরুণও কিশোর ছিল। দুই কিশোর-কিশোরী একে অপরের হাত চেপে ধরে তাকে দেখত সেই স্মৃতি হয়ত চাদের বেশ স্পষ্ট মনে আছে। হয়ত চাঁদের মনেও প্রশ্ন জাগে,
.
– এই তরুণ আজ ৭ বছর ধরে একা দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমায় দেখে কেনো?
.
(৩)
.
পুরো এক প্যাকেট সিগারেট দোকান থেকে কিনেই দুটো শেষ করে ফেলেছে। তৃতীয়টা দুই ঠোটের ফাঁকে ঢুকিয়ে আজ বহুদিন পর আবারো অজানা পথে হাটা শুরু করল রনি। পকেটে এক হাজার টাকার একটা নোট, তাই মাথায় কোনো টেনশন নেই। আশেপাশে চোখ যেতে দেখে শুধু পাখি আর পাখি। কিছু পাখি আকাশে উড়ছে আবার কিছু পাখি প্রেমের অদৃশ্য পাখা পরে প্রেমের জগতে ভাসছে। একটা প্রশ্ন রনির মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
.
– এত প্রেম,জগতে? মানুষ কি শুধু প্রেম করেই জীবন কাটিয়ে দেয়?
.
মাথায় হরেক রকমের প্রশ্নের ঘুরপাকে হঠাৎ রনির পা দুটো থেমে যায়। তাকিয়ে দেখে পাশেই একটা নামি দামি হোটেল। ক্ষুধায় পেটে নানা উদ্ভট রকমের শব্দ হচ্ছে। পকেটে ১০০০ টাকা আছে। পেটকে এখন শান্ত না করলে আর হাটা সম্ভব হবে না এই ভেবেই সিগারেটটা রাস্তায় ফেলে দিয়ে হোটেলের ভিতর ঢুকে পড়ে। এই সকালেও হোটেলটার আগা টু গোড়া প্রায় ভর্তি তবুও কপালের জোরে একটা খালি টেবিল পেয়ে গিয়েছে। ওয়েটারকে ডাক দিয়ে লটপটি আর পরাটা অর্ডার দিয়ে গালে হাত দিয়ে চারপাশের দৃশ্য মনযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। বেশ অবাক হয় এই ভেবে যে, এই সকালেও হোটেলটা পাখিতে পূর্ন! আসলেই প্রেম বাদে বোধহয় মানুষের কোনো কাজ নেই। জগ থেকে এক গ্লাস পানি খাওয়ার ফাকে হঠাৎ চোখ যায় হোটেলের দরজার দিকে। প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত হওয়া সত্বেও গ্লাসের পানিতে হালকা চুমুক দিয়েই গ্লাসটা, টেবিলে রেখে দেয়। চোখের আয়তন হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
.
সেই চুল, সেই চোখ, সেই হাসি, শুধু হালকা পরিবর্তন তবুও সবকিছু প্রায় একই। হয়ত নিজের চেহারা দেখে নিজেকে চিনতে ভুল হতে পারে তবে এই চেহারা কোনভাবেই ভোলার পাত্র নয় রনি। কিন্তু এটা কল্পনা না বাস্তব, সেই বিতর্কে রনির মস্তিষ্ক জড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা কিভাবে অবাস্তব হবে? হাটা চলা সব কিছু এতটা বাস্তব! নিজেকে বারবার চিমটি কাটতে থাকে।
.
– নাহ! এটা কোনোভাবে অবাস্তব না।
.
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here