#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
part:20
এই ছেলের প্রতিটা স্পর্শ অন্তিকে কাঁপিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এই যে এখন অন্তির ভেজা ভেজা চোখের পাতা দুটোতে চুমু দিয়ে, আঙ্গুল দিয়ে গাল বেয়ে নেমে আসা পানি টুকু মুছে দিলো, এই যত্নটুকুও মেয়েটাকে ভেতরে বাহিরে আবেগে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
অন্তি ভার হয়ে যাওয়া ঝাপসা চোখ দুটো আরশানের চোখ বরাবর রেখে শান্ত গলায় বললো
-আমি না তোমাকে হারাতে পারবো না শান। একদম আপন করে তোমাকে আমার চাই। হবে আমার?
এই মেয়েটার পুরোটা জুড়েই বাচ্চামি। যেনো কোনো এক চকলেট দেখে দাবি করছে এটা তার চাই। আরশান হেসে দিয়ে বললো
-আমি তো তোমারই অন্তি। নতুন করে তো হওয়ার কিছু নাই।
-চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি৷ তারপর আর আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।
অন্তির কথায় আরশান যেনো ভাবনায় পড়ে গেলো। মেয়েটাকে এখন কি বলবে। যদি না করে দেয় তাহলে কি অন্তি ভুল বুঝবে? কিন্তু এভাবে পালিয়ে, লুকিয়ে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে যে আরশানের নেই।
অন্তির গালের দুই পাশ আরশান তার হাত দিয়ে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো
-তুমি আমায় ভুল বুঝো না অন্তি। প্লিজ। পরিবার ছাড়া এভাবে বিয়ে করলে যে আমরা সুখি হবো না। আমাদের উপর কারোরই কোনো দোয়া থাকবে না, আর আমাদের বাবা মাকে ছাড়া এতো বড় একটা কাজ কিভাবে করবো বলো? আমাদের জীবনের সব থেকে বড় ডিসিশন এটা অন্তি।
এক ঝটকায় উঠে বসলো অন্তি। ফজরের আজান কানে ভেসে আসছে৷ শেষ রাতে এমন একটা স্বপ্ন, মেয়েটাকে কেমন যেনো দম বন্ধকর একটা অনুভূতি দিচ্ছে।
সেদিন কটেজে দ্বিতীয় রাতে যখন অন্তি কাঁদতে কাঁদতে আরশানের সামনে দাড়িয়েছিলো, আরশান নিজে বলেছিলো অন্তিকে বিয়ের কথা। কিন্তু অন্তি সেদিন পরিবারের সম্মানের কথা, বাবা মার কথা ভেবে না করে দিয়েছিলো। স্বপ্নটা দেখার পর কেনো যেনো মনে হচ্ছে আরশানের কথা মেনে নিয়ে বিয়ে করে নিলে হয়তো আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হতো৷ হয়তো অারও খারাপ হতো অথবা সব ঠিক হয়ে যেতো।
অন্তি একপা একপা করে এগিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাই গ্লাস টা খুলে দিলো। কেমন একটা দমকা হাওয়া বইছে। আকাশটা একটু একটু করে পরিষ্কার হয়েও যেনো হচ্ছে না। চারপাশ মেঘ করেছে। এমন বৃষ্টি মুখরিত পরিবেশ যেনো অন্তির মনে আরও অশন্তি এনে দেয়। আরশানের সাথে দেখা হওয়া, একসাথে কাটানো সময়, তাদের সম্পর্ক, আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও আবার কোনো এক বৃষ্টিতে এক হওয়া সব সবকিছু অন্তির মনে ভর করে।
ফজরের নামাজ পড়ে অন্তি তার ওয়ারড্রব থেকে কাপরের ব্যাগটা বের করে একে একে কাপর গুলো ভাজ করে তুললো ব্যাগটাতে।
মনের উপর কেমন যেনো জোড় খাটানো যায় না। এই যে এতো এতো কিছু অন্তি জানে অন্তুি বোঝে, বাবা মার প্রতি এতো টান, এতো ভালোবাসা। তবুও অবাধ্য মন টা থেকে থেকে যেনো শান বলেই শ্বাস ছাড়ে।
সকাল হতে না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আরশান আর তার বাবা এখন শুধু বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি টা থেমে গেলেই তারা অন্তিদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।
অারশান এদিক ওদিক পায়চারি করছে। সময় যেনো একদমই কাঁটছে না। বৃষ্টি হলেই আরশানের মন কেমন যেনো খুশি তে ভরে উঠে। এই বৃষ্টিই যে অন্তিকে সঁপে ছিলো অারশানের কাছে। কিন্তু আজ কেমন যেনো অসহ্য লাগছে এসব।
সকাল থেকেই আরশানের মার মন টা ভার। কারও সাথে তেমন কথা বলছেন না। তিনি নিজে সৃজাকে ফোন দিয়ে সবটা জানিয়েছেন। তবে মেয়েটার তেমন কোনো উত্তর তিনি পান নি। হয়তোবা অধিক মন খারাপ তাই কিছু বলে নি, অথবা সে নিজেও এমনটা চেয়েছিলো। আরশানের মা তেমনটা বুঝতে না পারলেও উনি নিজে এসব কেনো যেনো মানতে পারছেন না।
বারান্দার ফ্লোরে ছিটা ছিটা বৃষ্টিতে বসে আপন মনে অন্তির কথা ভাবতে লাগলো আরশান।
“মেয়েটা আরশানের এতোটুকু অবহেলা সহ্য করতে পারে না। কেমন যেনো ছিচকাদুনে স্বভাবের। কটেজে অন্তির উপর একটু রাগ করতেই মেয়েটা কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে।
মাত্র চোখে ঘুম আসতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনো এলো মেলো পায়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই আরশান কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্তি আরশানকে জড়িয়ে ধরলো।
একেতে ঘুমে ভার হওয়া চোখ আর এক দিকে বুকের মাঝটায় পাগলিটার ছটফটানি, আরশান যেনো আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদো কাঁদো গলায় অন্তি বললো
-তুমি এভাবে অবহেলা করো না। আমার কষ্ট হয় শান। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি সব ছেড়ে তোমার কাছে আসতে পারবো নাকি? তাইতো?
আমার তোমাকে চাই শান। কিন্তু সবাইকেউ যে চাই। কি করবো আমি?
-চলো বিয়ে করে নেই।( আরশান খুবই স্বাভাবিক গলায় বললো)
কিন্তু এই কথাটার জন্য অন্তি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কিছুক্ষন চুপ থেকে আরশানকে ছেড়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললো
– এভাবে বিয়ে করলে আমরা সুখী হবো না শান। আমাদের বাবা মার দোয়া থাকবে না। তাদের ইচ্ছা, স্বপ্ন সব শেষ হয়ে যাবে৷ আমার সত্যি তোমাকেই চাই। কিন্তু সবাইকে রাজি করিয়ে।
অারশান নিজের হাত মুঠি করে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললো
-অসম্ভব কিছুই কেনো তোমার পেতে মন চায় বলো তো?
অন্তি আর কিছু বললো না। সত্যিই তার এই কথার কোনো উত্তর জানা নেই।
বেশ কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আরশান বললো
-ঘুম পাচ্ছে খুব৷ মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে একটু?
অন্তি চুপচাপ কোলে বালিশ নিয়ে বসতেই আরশান বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।
অন্তির আঙ্গুলের স্পর্শে চোখে ঘুম ভর করলেও সেরাতে যেনো দুজনের মন অশান্ত ছিলো।”
আরশানকে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখেই নুন আরশানের পাশে বসে বললো
-ভাইয়া বাবা তোমায় ডাকছে। এখনই যেতে বললো। আর পান্জাবি পায়জামা পড়ে যাবে বুঝলে?
আরশান ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি দিলো। ওর মন বলছে যতো যাই হোক অন্তি ওকে ফিরাবে না। যে মেয়ে একটু অবহেলা সহ্য করতে পারে না, সেই মেয়ে সারাজীবন দূরে থাকার মত সাহস দেখাবে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে, এখন বৃষ্টিটা থেমে গেলেও পুড়ো এলাকায় এদিক সেদিক কাঁদা আর পানি। কলিং বেলের শব্দ হতেই হাসনাত সাহেব চশমাটা ঠিক মতো পড়ে দরজা খুলতেই একজন সুদর্শন যুবক আর একজন মাঝবয়সী মানুষকে দেখে বেশ অবাক হলেন। ছেলে টার হাতে কার্টুন বোঝাই করা মিষ্টি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আভিজাত ফ্যামিলির লোক এরা। ছেলেটাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে উনার।
হাসনাত সাহেবকে যুবকটা সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে তিনি বললেন -কাকে চাই?
মুরুব্বি টাইপের লোকটা বললেন
-জ্বী আপনি কি হাসনাত সাহেব?
-হ্যা।
-আপনার কাছেই এসেছি।
মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিতেই হাসনাত সাহেব হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতই লোকটা বললেন
-আমি আরশানের বাবা। আর ও আমার ছেলে আরশান।
মুহূর্তেই যেনো হাসনাত সাহেবের চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেলো। মিষ্টির প্যাকেট গুলো দরজার বাইরে রেখেই তিনি বললেন
-এখানে কি চাই?
আরশানের বাবা বেশ বিনীত সুরে বললেন
-ভাই সাহেব, আমরা ঘরে বসে ঠান্ডা মাথায় আলাপ করি।
-নতুন করে আলাপের কিছু নেই। আমি এই লম্পট ছেলেকে নিয়ে কোনো আলাপ করতে চাই না।
দরজায় এমন কড়া গলায় কথা বলা শুনে অন্তির মা আর অন্তি যে যার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে বসার ঘরে দাঁড়ালো।
আরশানের বাবা বললেন
-বুঝলাম না ভাই, কি বলছেন এসব?
-হ্যা ঠিকি বলছি। আপনার ছেলে পথে ঘাটে মেয়েদের উক্তত্ব করে। শুধু তাই নয়, মেয়েদের থ্রেড দেয়। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনার যেমন আপনার ছেলের সুখের চিন্তা আছে, আমারও আমার মেয়ের সুখ নিয়ে ভাবতে হবে। আমি ওদের সম্পর্ক আছে জানার পর নিজে আপনার ছেলের খোজ নিতে যেয়ে পথেই দেখি সে আর এক ছেলে মিলে একটা মেয়ের সাথে যাচ্ছে তাই ব্যাবহার করছে। আমি নিজে এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করতেই আমার সাথেও খুব খারাপ ব্যাবহার করেছে।
আপনি কি আপনার মেয়েকে এমন একটা বেয়াদব ছেলের সাথে বিয়ে দিতেন? অথবা আমার মেয়ের সম্পর্ক এমন একটা ছেলের সাথে মানতে পারতেন?
আমি তখন উপায়ন্তর না পেয়ে আমার পরিবারসহ শহর পাল্টে ফেললাম। বিশেষ কোনো লাভ হয়নি এতে।
আরশানের বাবা বেশ অবাক হয়ে গেছেন এসব শুনে। সম্পর্ক মেনে না নেয়ার যে এমন একটা কারনও হতে পারে উনার জানা ছিলো না। আর আরশানে মাথা নিচু করে চুপ থাকতে দেখে তিনি নিজেও বুঝে গেছেন যে হাসনাত সাহেব যা বলছেন তা সত্যি। তিনি রাগী গলায় আরশানকে বললেন
-তোমার কি কিছু বলার আছে?
-বাবা ওই মেয়েটা তো আদ্রর বোন ছিলো, আর সাথে ছিলো আদ্র।
আরশান অন্তির বাবার সামনে ঘটনাটা তুলে ধরার খুব চেষ্টা করলো, সবটা বলার জন্যও আকুতি দেখালো, কিন্তু অন্তির বাবা খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না।
অন্তির বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন
-এখন আরও কি কোনো গল্প বানাবে? আমি এই ঘটনা যেদিন ঘটেছে সেদিনই আমার মেয়েকে বলতে পারতাম। কিন্তু ও তোমায় অন্ধ বিশ্বাস করে। তাই বললেও খুব একটা লাভ হতো না। এখন বলেও যদিও খুব একটা লাভ হয়নি। ওর চোখে এখনও পর্দা টানা।
আর আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। তোমরা আসতে পারো।
আরশানের বাবা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বললেন
-আমি কি আপনার মেয়ের সাথে কথা বলতে পারি?
-শুধু কথা নয়, চাইলে ওকে নিয়ে যেতেও পারেন। ও এক কাপড়ে যেতে চাইলেও নিতে পারেন, আর সকালে দেখলাম কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে, চাইলে ওইটা সহও নিতে পারেন। তাছাড়া ওর বিয়ের জন্য কিছু গহনা গড়িয়েছি, ওই গুলা সহ ও নিতে পারেন। তবে যেভাবেই নেন না কেনো, ও একবার দরজা পেড়িয়ে গেলে আর জীবনে এ ঘরে ফিরতে পারবে না।
আরশানের বাবা তবুও অন্তির সাথে দেখা করার আগ্রহ দেখালে অন্তির বাবা দরজায় দাড়িয়েই অন্তিকে ডাকলেন।
অন্তি দরজা থেকে একটু সামনে দাড়াতেই অন্তির বাবা ঘরের ভেতর চলে গেলেন। আর যাওয়ার আগে বললেন
-চলে যেতে চাইলে যেতে পারো, কিন্তু থেকে গেলে আমি আর এসব ঝামেলা চাই না।
আরশানের বাবা নিরাশ চোখে অন্তির দিকে তাকিয়ে বললেন
-যাবি মা?
এমন সময়ই পিহু অন্তির পা জড়িয়ে ধরে বসলো। বিড়ালটাও কেমন যেনো। মায়ার আটকে রেখেছে। এই ছোট্ট বিড়ালের মায়ায় অন্তি কাটাতে পারে না, আর মা বাবার প্রতি এতোটা ভালেবাসা কিভাবে উপেক্ষা করে, নিজের ছোট ভাইটাকে রেখে কিভাবে চলে যাবে?
অন্তিকে নিরব থাকতে দেখে আরশানের বাবা আর এ বিষয়ে কিছু বললেন না। অন্তির মাথায় হাত রেখে বললেন
-তোর জন্য আমার দরজা সব সময় খোলা। ইচ্ছে হলেই চলে আসিস।
আর আরশান, কথা শেষ হলে চলে আসো আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
এটুকু বলেই আরশানের বাবা চলে গেলেন।
আরশান অন্তির দিকে তাকিয়ে বললো
-তুমি আমাকে বিশ্বাস করো অন্তি? আমি জানি বিশ্বাস কর। ওই মেয়েটা আদ্রর বোন ছিলো৷ ওকে তো আমি আমার বোনও মনে করতাম। তাই ওকে শাসন করেছিলাম। ও একটা বাজে ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো। আর বিষয়টা ওর বাসায় জানাজানি হোক তা আমি বা আদ্র কেউ চাই নি। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়েই সবটা সমাধান করতে চেয়েছিলাম। আর আদ্রও ওকে তেমন কিছু বলতে পারছিলো না। তাই আমিই। এই সামান্য বিষয় যে এতো বড় হয়ে যাবে আমি কল্পনাতেও ভাবি নি। আংকেলকে বললে আংকেল কক্ষনোই বিশ্বাস করবেন না। তুমি বিশ্বাস করছো তো অন্তি?(এক দমে কথাটা শেষ করলো আরশান)
-শান আমি যদি না যাই আমাকে কি মাফ করতে পারবে?
-অন্তি?
-আমাকে মাফ করে দিও শান।
(চোখের পানি যেনো বাধ মানছে না। সকালেও ভেবেছিলো সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে আরশানের কাছে। কিন্তু এখনই কেমন যেনো মনে হচ্ছে বাবা মা কে ছেড়ে পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো সাহস অন্তির নেই)
আরশান আর কিছু বলতে পারলো না, গাড়ির কাছে শূন্য হাতে এসে দাঁড়ালো। পায়জামা কাঁদা পানিতে ভিজে আছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। এখান থেকেই হয়তো তার শূণ্য হাতে পথ চলা
#চল তবে শূন্যতা ধরে হাঁটি
Zannatul ferdaous zannat
last part
জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অন্তি। কাল তার গায়ে হলুদ। পাশের রুমেই বাচ্চারা নাচ করছে। অরুণ দের বাড়ির কিছু মেয়েছেলেও নাচের প্রেকটিস করছে। গায়ে হলুদের সমস্ত আয়োজন অন্তিদের এখানে করা হয়েছে। এ বাড়ির ছাদ মোটামুটি সাজানো শুরু করা হয়েছে। পাশের রুম থেকে নাচ আর গানের আওয়াজ আসছে। অন্তি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে গানটা। ওর যেনো দম বন্ধ হয়ে যাবে এখনই।
“হাঁটি হাঁটি পা পা শুরু হয়
ভয় হয় শুধু ভয়, ভয় ভয়
চায় চায় উড়তে উড়তে
মন চায় উড়তে উড়তে
আশা আশা চারপাশে কুয়াশা
আয়নার কোল জুড়ে দুরাশা
চায় চায় উড়তে উড়তে
লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প
তারপর হাতছানি অল্প
লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প
তারপর হাতছানি অল্প
চায় চায় উড়তে উড়তে
মন চায় উড়তে উড়তে”
এইগানে এক তালে চারটা বাচ্চা নাচের প্রেকটিস করছে।
গনের কথা গুলো শুনার পর অন্তির মনে হচ্ছে তার যদি পাখা থাকতো এখনই যেনো সব ছেড়ে ছুড়ে দূরে কোথাও উড়ে যেতো। হঠাৎই রুমে কারও ঢোকার আওয়াজে অন্তি গ্রিল ছেড়ে দাঁড়ালো।
অরুণ প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হালকা কাশি দিয়ে অন্তির মনোযোগ নেয়ার চেষ্টা করলো। তারপর একটা হাসি দিয়ে বললো
– কি খবর বিয়ের কনে? কাল তো গায়ে হলুদ। কিভাবে সাজবে কি করবে ভেবে রেখেছো?
অন্তি কোনো জবাব দিলো না। তারপর অরুণ আবার বললো
-আমি কিন্তু সব সিলেক্ট করে আন্টির হাতে দিয়ে এসেছি। একদম আমার মন মতো করে সাজবে বুঝলে? একটু এদিকে ঘুরে তাকাও তো দেখি কতোটা সৌন্দর্য বাড়লো তোমার? শুনেছি বিয়ের আগে কনে দের সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুন হয়।
অন্তি এবারও কোনো উত্তর দিলো না, পিছন ফিরেও তাকালো না। অরুণ বেশ আশাহত মুখে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেয়েও আবার দাঁড়িয়ে গেলো। দরজার দিকে তাকিয়েই বললো
-অয়ন্তি তুমি খুব ভালো। খুব বেশি ভালো। এ যুগে তোমার মতো মেয়ে খুব কম আছে, যে কিনা বাবা মার কথা রাখতে যেয়ে নিজের স্বপ্ন নষ্ট করে দেয়।
সত্যি বলতে বাবা মা দের ধারনা হলো কি জানো, যাকে তাদের ছেলে বা মেয়ে পচ্ছন্দ করবে সেই হলো পৃথিবীর সব থেকে অযোগ্য মানুষ। সেই তার সন্তানের ধারের কাছেও না। তাই কখনও সৌন্দর্য, কখনও যোগ্যতা অথবা চরিত্র যে কোনো একটা ভুল বের করে সেই সম্পর্ক টাকে তারা মানতে চায় না। একটা বার এটা ভেবে দেখেন না যে, সেই ভালোবাসার মানুষটার সাথে তাদের সন্তান সত্যি সুখি হবে কিনা। হ্যা, এমনও হয় যে সন্তানের সিলেক্ট করা মানুষটা অনেক সময় ভালো হয় না। কিন্তু সব সময় তো আর এমনটাও হয় না। তুমিও জানো আমিও জানি আরশান কতোটা ভালো ছেলে।
কথাটা শুনেই অন্তি চট৷ করে অরুণের দিকে তাকালো। কিন্তু অরুণ দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ সে আবার বললো
-আর এটাও সত্য যে সেদিন সে আদ্রর বোনকেই বকাঝকা করছিলো। তবে ওর ভাগ্য খারাপ বলে বিষয়টা আংকেল খারাপ চোখেই দেখেছে৷ এই দেখো না ওর বাগদত্তা সৃজনী হায়াৎ, অর্থাৎ সৃজার সাথে ওর অনেক সুযোগ থাকতেও সে সৃজাকে একটা টোকা দিয়েও দেখে নি। এযুগে এমন লয়াল ছেলেও রেয়ার বুঝলে। আমি হলে কিন্তু এমন সুযোগ জীবনেও হাতছাড়া করতাম না। যতোটুকু কথা হয়েছে আশা করি তুমি তো আমায় চেনো। (বলেই একটা নোংরা হাসি দিলো)। আমার কিন্তু দুইটা গার্লফ্রেন্ড আছে। ইভেন একজন মেরিড। বুঝতে পারছো তো বিষয়টা? তবে চিন্তা করো না বিয়ের পর সব বাদ দিয়ে দিবো। আমি আবার আরশানের মতো এতো সাধু হয়ে থাকতে পারিনা, আর আমি খারাপ বলেই কিন্তু তোমাকে আমার চাই জোড় করে হলেও।
অন্তির শরীরটা কেমন জানি করছে। একটা মানুষ কিভাবে এতোটা খারাপ হতে পারে?
দরজার পর্দার পাশ থেকে একটা ছায়া সরে যেতেই অরুণ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
আরশান ছাদে বসে একমনে সিগারেট টানছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর হালকা বাতাস। সিগারেট টাও নিভো নিভো। আজ বৃষ্টিটাকে খুব বেইমান লাগছে তার কাছে।
দুজন মানুষ৷ এক সাথে কতো কতো সময় কাটিয়েছে অথচ কাল দিন টা পেড়িয়ে গেলেই অন্তি অন্য কারো৷ চিরো দিনের জন্য অন্য কারো। তার সাথে কথা বলার আর কোনো অধিকার থাকবে না, হয়তো আর কোনোদিন দেখাও হবে না। ওই ছেলেটা অন্তির উপর অধিকার খাটাবে ভাবতেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।
কি অদ্ভুদ দুটো মানুষ এতো দিন এক সাথে থাকলেও একজন আরেকজন সম্পর্কে কতো কিছু জানে না। আজ অজানা গুলা খুব জানতে মন চাচ্ছে অারশানের। আচ্ছা অন্তি তো চুমু চেয়েছিলো, আরশান দিয়েছিলোও ওই চুমু কি এখনও অন্তিকে কাপিয়ে রাখে?
আজ রাতটা অন্তির বাবার কিছুতেই ঘুম পাচ্ছে না। অসস্থি হচ্ছে খুব। কাল একমাত্র মেয়ের গায়ে হলুদ । হুট করেই বিয়েটা ঠিক করে বড় কোনো ভুল করে ফেললেন না তো। আর আরশান সম্পর্কে আজ সন্ধার পর যতোটা খোজ নিয়েছেন তা জানার পর মনে হচ্ছে ছেলেটাকে একটু বেশিই ভুল বোঝা হয়েছে। খুব অপরাধ হয়ে গেছে৷ এই খোজ টা যদি আরও আগে নিতে পারতেন। এসব ভাবতেই যেনো উনার খুব বেশি খারাপ লাগছে। অরুণ কে মেয়ের বর হিসেবে ঠিক করাটা কি খুব বড় ভুল হয়ে গেলো?
সারাদিন এই সেই কাজে হাসনাত সাহেব ব্যাস্ত থাকলেও বিকালে দেখলেন অন্তিকে সাজানো হচ্ছে।
মেয়েটার মুখটা শুকিয়ে এতোটুকুনি হয়ে গেছে। হলুদ শাড়িতে অপূর্ব লাগলেও চেহারার মলিনতা যেনো হাসনাত সাহেবের বুকে বিধছে।
অন্তির ইচ্ছার কোনো মূল্য কি দিয়েছেন কোনোদিনো হাসনাত সাহেব? যখন যা বলেছেন মেয়েটা মুখ বুজে মেনে নিয়েছে এতোটা প্রতিবাদ করে নি কোনো দিন। তার জীবনের এতো বড় একটা বিষয়েও তাকে জোড় করা হচ্ছে ভাবতেই হাসনাত সাহেবের কান্না পাচ্ছে।
পিহুকে অন্তির কোলে দিয়ে হাসনাত সাহেব অন্তির মাথায় হাত রেখে বললেন
-আমি যা বলি সব কেনো মেনে নেও তুমি? কেনো সহ্য করো সব? আচ্ছা আমি এখন একটা কথা বললে রাখবে?
অন্তি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি আবার বললেন
-তুমি চলে যাও অন্তি। আরশানের কাছে যাও।ভেবো না আমার দরজা খোলা আছে। ওকে নিয়ে আসো এ বাড়িতেই গায়ে হলুদ হবে। বিয়ে যেদিন ইচ্ছে৷ হয় করো। পড়ালেখা শেষ করে করতে৷ ইচ্ছে হলেও সমস্যা নেই।( হাসনাত সাহেবের চোখ৷ দিয়ে পানি পড়ছে)
অন্তি কিছু বলতে পারছে না। শুধু ফেলফেল করে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।
হাসনাত সাহেব আবার বললেন
-তাড়াতাড়ি যাও, আমি এদিকটা সামালে নিবো।
অন্তি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো
-এভাবেই?
-হ্যা এভাবেই যাও।
খুশিতে যেনো অন্তির চোখটা চিকচিক করে উঠলো। অন্তি পা বাড়াতেই হাসনাত সাহেব আবার ডাকলেন অন্তিকে। তারপর হাতে দু’শ টাকা গুজে দিলেন। অন্তির জীবনের প্রথম নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। সে তার বাবাকে অনেক বছর পর খুশিতে ঝাপটে ধরলো।
অন্তি পিহুকে নিয়েই৷ এক ছুটে সিড়ি দিয়ে নেমে গেইটের বাইরে এসে রিক্সায় উঠলো। পথটা যেনো ফুরায় না। খুব অসস্থি লাগছে অন্তির। এমন কিছু হবে সে কল্পনাতেও ভাবে নি।
কনে যে বাড়িতে নেই কথাটা শুনেই অরুণ মুখে একটা বাকা হাসি দিলো। ও নিজেও এমনটা চাচ্ছিলো। কেনো জানি হঠাৎ মনে হয়েছিলো এই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে? তাই তো কাল হাসনাত সাহেবকে অন্তির দরজার সামনে আসতে দেখেই এতো এতো কথা শোনালো।
আরশানদের বাড়ির সামনে একটা মিনি ট্রাক দাড় করানো৷ আর বেশ কিছু লোক দাড়িয়ে আছে। কেউ কেউ তো বলছে
-আহারে এভাবে চলে যাবে ভাবি নি।
কথাটা শুনেই অন্তির কেমন যেনো বুকে মোচড় দিচ্ছে। আর এদিকে এমন সাজে অন্তিকে দেখে সবাই তাকিয়ে আছে। আরশানদের গেট পার করে ঘরে দিকে এগিয়ে যেতেও কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন একটা পরিবেশ আজ। ঘরে ঢুকতেই অন্তি দেখলো আরশানের মা সোফায় বসে বসে কাঁদছেন।
অন্তি যেনো৷ আর নিজেকে বোঝ দিতে৷ পারছে না। অনেক বড় ভুল৷ হয়ে গেলো না তো? আরশান কোথায়?
এদিক সেদিক তাকিয়ে নুনকে দেখেই অন্তি জিজ্ঞেস করলো
-তোমার ভাইয়া কোথায়?
অন্তিকে দেখে নুন যেনো কোনো কথায় বলতে পারলো না। শুধু আঙুলের ইশারার আরশানের রুমটা দেখালো।
অন্তি পিহুকে রেখেই আরশানের রুমের দিকে ছুটে যেতেই আরশানের মা কান্না থামিয়ে বললো
-এই মেয়ে আমার ছেলের রুমে যায় কেনো?
নুন বিরক্ত মুখ করে বললো
-মা তুমি তো ঘর, ফার্নিচারের মায়ায় কাঁদছো, সেটাতেই মন দাও। অবশ্য কেঁদেও লাভ নেই৷ এই বাসা তো আর ছাড়া হচ্ছে না।
-কেনো?
-এইযে বাড়ির বউ চলে এসেছে। তোমার ছেলে এখন একদম ঠিক হয়ে যাবে।
-এই অন্তি?
-হ্যা।
-ওওও, আর এই বিড়াল?
-এটা তোমার নাতি।
-কিহ!
আরশানের মা আবার কান্না শুরু করলেন। এবার কেনো কাঁদছেন তিনি নিজেও জানেন না।
অন্তির চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। চশমাটা খুলে আরশানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অন্তি। কিছু জিনিস হয়তো ঝাপসা দেখেও শান্তি। আরশান চোখ বন্ধ করে বারান্দার দরজায় হেলে দাড়িয়ে আছে।অন্তি কিছু না বলেই আরশানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
এই মুহূর্তে অন্তি এখানে এটা ও ভাবতেও পারছে না। আকস্মিক ভাবে অন্তিকে আবার জড়িয়ে ধরলো। যেনো ছেড়ে দিলেই নাই হয়ে যাবে। কিভাবে এলো কেনো এলো এসব যেনো জানতে মন চাইছে না আরশানের।
বেশ কিছুক্ষন পর অন্তি বললো
-বাবা তোমাকে যেতে বলেছে।
-হুম। আর?
-আন্টি কাঁদছেন কেনো?
-বাবা বলেছেন আমার পরিবেশ চেন্জ হলে আমি ভালো থাকবো তাই বাসা পাল্টাতে চেয়েছিলেন। আর মা বাসার মায়ায় কাঁদছেন।
এবার অন্তি বুঝলো বাইরের মনুষ গুলা তাদের চলে যাওয়ার কথা বলছিলো।
অন্তি বললো
-ইশ চেহারাটা কি করেছো? উহম কি গন্ধ, সিগারেট খেয়েছো তাইনা?
আরশান কথাটা এড়িয়ে অন্তির চোখের পানি মুছে বললো
-জানো তো অন্তি রুদ্র গোস্বামী বলেছিলেন,
“চল হাত ছেড়ে শূণ্যতা ধরে হাঁটি।
-তারপর? তারপর ঠিক করে নেবে, আজীবন শূণ্যতা, না আমি।”
অন্তি একটা হাসি দিয়ে বললো
-তুমি।