#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ৩ ও ৪
আমাদের বাড়িটা আর দশটা যৌথ পরিবারের মতো সাধারণ। আগের বড় বাড়ি ভেঙে উঁচু ইমারত হয়েছে, ছাদ আলাদা হয়েছে, ভাতের হাড়ি আর ভাত রান্নার চুলা সংখ্যায় বেড়েছে। বাবা আর চাচাদের মধ্যে মনের মিল থাকলেও সম্পদ আরা টাকা বাড়ানোর চাপা প্রতিযোগিতা আছে। অঘোষিত যুদ্ধের মতো। বড়চাচা যখন টঙ্গিতে জায়গা কিনলেন, বাবা শনির আখড়ায় মার্কেট পজিশন নিয়ে নিলেন। মেজচাচা গাড়ি কিনলেন। বাবা ঘরে চল্লিশ হাজারের কেবিনেট বেসিন লাগালেন তো, মেজচাচা পুরো বাসায় সেন্ট্রাল এসি লাগিয়ে দিলেন। বড়চাচা তখন অকারণ ঘরে হোম থিয়েটার খুলে নিলেন। পায়ের জুতোর দাম থেকে শুরু করে কোরবানির গরু পর্যন্ত এদের শো অফ চলে। কেউ কাউকে বুঝতে দিতে চাননা কিন্তু কেউ কিছু করলেই আরেকজন সেটাকে টেক্কা দিতে অন্য একটা কিছু করেন। তাদের বউরা আরও অদ্ভুত। মা আর চাচিদের ভেতর কখনো ঝগড়াঝাটি হতে দেখিনি তবে খুললাম খুল্লা হিংসা, পাল্লা চলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। এদিক দিয়ে বড়চাচি এগিয়ে আছেন। তার দুইছেলে। দুইজনই স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র। ব্রিলিয়ান্ট বলে পাড়া, স্কুল কলেজে সুনামের পাত্র সবসময়ই। উপরি হিসেবে ছেলেসন্তানের জন্মদাত্রি একমাত্র তিনিই। গর্বে আসলেই তার মাটিতে পা পড়েনা। মেজচাচি আর আমার মা এদিক দিয়ে পিছিয়ে আছেন। পিউ আপার জন্মের পরে চাচির কীসব জটিলতা তৈরি হওয়ায় আর বাচ্চা হয়নি। সবেধন নীলমনি এই পৃথথিলা, আমাদের পিউ আপা, মিশরের রাণির চাইতেও বেশি সুন্দরী। রীতিমতো লুকিয়ে রাখতে হয় পিউ আপাকে আমাদের। লোকে দেখলেই নিজের ছেলের বউ করতে চায়। আমার মা একটু পিছিয়ে এদিকে। দুটোই কন্যাসন্তান। বড় আপা মিথিলা মারমার কাটকাট রূপসী হলেও আমার কাছে এসে ঠিলে খালি হয়ে গেছে। আমি চলনসই সুশ্রী। তবে আমার মনে হয় আমি এখনও শুঁয়োপোকা, প্রজাপতি হবো হবো করছি! আমার রূপ নিয়ে প্রতিযোগিতায় একটু পিছিয়ে থাকলেও মায়ের অবশ্য তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কারণ বাবা ধনী। ফার্স্টক্লাস কন্ট্রাক্টর। বড়চাচা, মেজচাচাকে দশবার বেঁচে কিনে নিতে পারে আমার বাবা। আমাকে পার করা নিয়ে মায়ের চিন্তা নেই তাই। প্রতিযোগিতায় জিততে ‘মেয়ে হলো ঘরের লক্ষি’ ‘যার তিনটে কন্যাসন্তান, তার বেহেশত নিশ্চিত’ এরকম কথাবার্তা বলতে প্রায়ই শোনা যায় তাকে।
মিতাভাই আমাকে বিয়ে করতে চাইছে এইকথা আমি সবার আগে পিউ আপাকে শোনালাম। মিতাভাই আমার জন্যই বিষ খেয়েছে এই কথাটা ওকে বোঝাতে আমার বেগ পেতে হয়নি, সুন্দরীরা মাথামোটা হয় এইকথা আমার বোনেদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য৷ পিউ আপা ওইমূহুর্তেই হাসপাতাল মাথায় করে নিলেন। বড়চাচি তার ছেলের জন্য কুইন অফ সেবা, নিদেনপক্ষে বলিউড সুন্দরী চাইছিলেন আর আমার মা তো জানেনই আমার মতো রাজ্যসহ রাজকন্যা পেতে রাজপুত্ররা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই রাজপুত্র কোনোভাবেই মিতাভাই না। দুইজনেই ভেটো দিলেন সাথে সাথেই। ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে আত্মিয় হয়ে গেলে, প্রতিদ্বন্দ্বী দুইজা আম-দুধের মতো মিলে গেলে, আমের আঁটি হয়ে যাওয়ার ভয়ে মেজোচাচিও বিপক্ষে ভোট দিলেন।
এটা যে হাসপাতাল সেই মান্যিগন্যি কেউ আর করল না। হাউকাউ লেগে গেলো।
আমি আশা হারালাম না। তখনও জানি প্রবল পরাক্রমশালী একমাত্র পরাশক্তি আমার পক্ষে। সে আমি চাঁদ পেড়ে দিতে বললেও তিনি মিস্ত্রী লাগিয়ে দেবেন চাঁদে যাওয়ার মই বানানোর জন্য! তিনি আমার বড়চাচা। যতই মানে গুণে টাকায় ক্ষমতায় তাকে ছাড়িয়ে যাক অন্য দুইভাই, তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস কারো নেই।
বড়চাচা হুংকার দিলেন মিতাভাইকে উদ্দেশ্য করে।
‘গাধার বাচ্চা, তুই করছিস কী? এই মেয়ে তো আন্ডারএইজ। তুই গাধা তা আমি জানতাম। কিন্তু একেবারে ইংরেজি ডংকি তা জানা ছিলো না।’
মিতাভাইর নিচু মাথা উঁচু হলো না একবারও। কিন্তু তা দেখার সময় আমার নেই। আমি ডেসপারেট। কনক আপাকে নিয়ে তো আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। আমি মেনেই নিয়েছিলাম। শুধু মিতাভাইকে চোখের দেখা দেখেই আমি শান্তিতে ছিলাম। মিতাভাই ভালোবাসে বলে কনক আপাকেও আমি ভালোবেসেছিলাম। কনক আপাকে ধরে রাখা গেলোনা, সেটা আমার দোষ? এখন অন্য কেউ আসবে মিতাভাইর জীবনে।
তাকে তো মিতাভাই ভালোবাসবে না। আমাকেও ভালোবাসবে না। তবে আমিই কেন নই? আমিই শুধু ভালোবাসি, আমিই শুধু ভালোবাসব। আমার আর কোনো চাওয়া নেই তার কাছে। অন্য কেউ মিতাভাইর জীবনে আসার আগেই, তাকে আমার করে নেওয়ার জন্য আমি অস্থির হয়ে গেছি।
বড়চাচা এবার গলা নামিয়ে হুংকার দিলেন, ‘ছুটি?’ হুংকারের চাইতে আহলাদ বেশি সেই ডাকে। আমি হেসে ফেললাম।
বড়চাচা বিভ্রান্ত হলেন আমার হাসি দেখে। ছোটবেলা থেকেই তার সব সিরিয়াস হুংকারের মুখে দাঁত বের করে ফিক করে হেসে ফেলে তাকে ঘেঁটে দেই আমি।
বড়চাচা রেগে গেলেন। ‘ছুটি? তুই এই গাধার বাচ্চাকে বিয়ে করবি?’
আমি বড়চাচার প্রশ্নের উত্তরের ধার দিয়ে গেলাম না। বললাম ‘বড়চাচা, গাধা বলেন শুধু। গাধার বাচ্চা বললে নিজেকেই তো গালি দিচ্ছেন।’
‘ঠিক বলেছিস এটা গাধা, অনলি গাধা। বড়গাধা, মেজগাধা, ছোটগাধা। গাধার গাধা। বই পড়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে দিয়েছে। কাশির সিরাপ খেয়ে বসে আছে। কার জন্য? ঘরের মেয়ের জন্য। গাধা কোথাকার!’
আমার মনে হচ্ছে গাধা নামের লম্বা কানওয়ালা প্রাণিটার প্রেমেও পড়লাম আমি। যার সিমিলারিটি মিতাভাইর সাথে তাকে ভালো না বেসে কি আমি পারি? আমাকে উদাস চিন্তায় মগ্ন দেখে বড়চাচা আবার হুংকার দিলেন।
‘ছুটি?’
‘জি বড়চাচা?’
‘এই গাধা তোকে বিয়ে করার জন্য কফসিরাপ গিলেছে?’
‘হুম’
‘কেন?’
‘আমি জানিনা।’
‘কি জানিস না?’
আমার মুখ লজ্জায় লাল হলো। যতই হোক বাবা, চাচারা সবাই উপস্থিত আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
বড়চাচা আবার গর্জন করলেন। ‘তুই বিয়ে করবি ওকে?’
এখন লজ্জা পেলে হবে না। মিতাভাই ক্যানুলা লাগানো হাতটা কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। তার পেট ফাঁটিয়ে দিলেই ট্যা ফো করবে না। আমারই মুখ খুলতে হবে। আমি বড়চাচার চোখের দিকে তাকালাম না। আস্তে করে মাথাটা সম্মতিসূচক উপর-নিচ করলাম।
‘কত্তবড় সাহস তোর? বিয়ের বয়স হয়েছে? তের, চৌদ্দ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে!’
‘বড়চাচা, আমি আঠারো।’
‘আঠারো? কবে হলি? সেইদিনও আমার অফিস যাওয়ার সময় দরজায় হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকতি তুই, অফিস যেতে দিবি না বলে। আঠারো কবে হলি?’
‘হ্যাঁ ভুলে তো যাবেনই। এইটিনথ বার্থডেতে স্কুটি কিনে দেওয়ার কথা ছিলো। সেই ভয়ে উইশও করেননি। আপনি কিং মাইডাসের চাইতেও বড় মাইজার।’ ঠোঁট ফোলালাম আমি।
‘কী? এতোবড় কথা? যাহ আজই তুই স্কুটি পাবি। বিয়েতে মেয়ের বাবা ছেলেকে মোটর সাইকেল দেয়। এখানে উলটো হবে। আমি ছেলের বাবা মেয়েকে স্কুটি উপহার দেবো।’
ব্যস বিয়ে পাকা হয়ে গেলো!
বাবা, মা, বড়চাচি চুড়ান্ত রকমের হতাশ হলেন। উপস্থিত প্রতিটি প্রাণির অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেইসময়েই হাসপাতালে বসেই বিয়ে হয়ে গেলো আমার আর মিতাভাইর। আমি আনন্দে হাঁফ ছেড়ে মনে মনে বললাম ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’
*****
“সানাইয়ের বাঁশির যে মাতোয়ারা সুর সেতো সংসারের উঠোনেই মাথাকুটে মরে পড়ে থাকে। ভিতরে প্রবেশের সুযোগ তাঁর কোথায়? অতৃপ্তি, অপমান, অবহেলা, অবসাদ এতদিনের চেনা তানপুরার সুর একটানে ছিঁড়ে ফেলে। শুভদৃষ্টিতে মিশে থাকে শুভঙ্করের ফাঁকি।”
শুভঙ্করের ফাঁকি বলে গণিতে অনেকগুলো ধাঁধা আছে। খুব ভালো হিসেব না জানলে এই ধাঁধার সমাধান করা যায়না। শুভঙ্কর দাস নামে এক বিখ্যাত বাঙালি গণিতবিদ মুখে মুখে জটিল হিসাব সমাধান করার জন্য আর্যা বা সুত্র তৈরি করেন। একে মানসাঙ্ক বা মৌখিক গণিত বলে।
“কুড়বা কুড়বা লিজ্যে, কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্যে,
কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ, বিশ ধুলে হয় কাঠার প্রমাণ,
গণ্ডা যদি থাকে বাকি কাঠা নিলে পর,
ষোল দিয়ে হরে তারে সারা গণ্ডা ধর।”
পরবর্তীতে এই গণিতের সুত্র বিকৃত করে বা অপব্যবহার করে মানসাঙ্কে পারদর্শী পণ্ডিতরাই লোক ঠকাতে শুরু করে। কালক্রমে দারুণ এই গণিত শাস্ত্র ফাঁকিবাজির অস্ত্র হয়ে যায় আর প্রচলিত হয় শুভঙ্করের ফাঁকি নামে।
কোনো সুন্দর জিনিসের ভেতরেও ফাঁকিবাজি দেখলে বা ফলাফল শূন্য হলে এই বাগধারাই প্রচলিত।
মিতাভাইকে মুগ্ধ করার প্রাণান্তকর চেষ্টার অংশ হিসেবে আমি গণিতে পটু হয়ে উঠলেও হিসেবে একেবারেই কাঁচা। আমার বিয়েটা তাই হয়ে উঠল পুরোটাই মস্তবড় ঠকবাজি। নিজেকেই যে ঠকালাম আমি নিজেই!
#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ৪
এরকম অদ্ভুত বিয়েতে আমার অন্য কোনো লাভক্ষতি হলো কিনা তা যাচাই করতে গেলাম না আমি। এসব মায়েদের কাজ। নিমরাজি তো দূর অস্ত, কেউ এই বিয়ে মানেই না। বড় বোনেরা এখনও অবিবাহিত এই অজুহাত দেখিয়ে বাইরের লোকের কাছ থেকে আমাদের বিয়েটা লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সর্বসম্মতিক্রমে। আসলে সবাই বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার আরেকটা সুযোগ নিলেন।
আমি কাউকে জিজ্ঞাসা করলাম না, অনুমতির আশায় থাকলাম না, উপর থেকে নিচে থাকতে চলে এলাম। মিতাভাই আমার চোখের সামনে থাকবে, এক বিছানায় ঘুমাবে, আমি তাকে ছুঁয়ে থাকব – আমার চাওয়ার যে গন্ডিটা আছে এসব তারও অনেক অনেক বাইরে। আমার শুধু মাথার ভেতর বাজছে ‘সব পাওয়া শেষ হলো আমার, আর কিছুই চাইনে।’
মিতাভাইর ঘরে শিফট হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু এতোবড় ঘটনাতেও তার যেন কোনো পরিবর্তন হলো না। তার ঘরে, তার জীবনে আমি হুট করে ঢুকে গেলাম, একদম ইনভিজিবল হয়ে। আমাকে মিতাভাই দেখে না, ছোঁয় না, কথাও বলে না। গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগলেই শুধু একটু বিরক্ত হয়। আমার তাতে কিছু মন খারাপ হয় না। তার বিরক্তিতেও আমি মুগ্ধ হই। আমার মুগ্ধতা অন্যদেরকে বিরক্ত করে। বড়চাচি আমাকে এড়িয়ে চলে, মা আমার সাথে কথা বলে না। দুজনের সালিসির মাধ্যম মেজচাচি। মেজচাচি পিউ আপাকে বলে, পিউ আপা আমাকে ফিসফিস করে বলে ‘কতদিন তোদের মধ্যে এইসব? আমি কিছু বুঝলাম না! বড়চাচি বলছে, সরল পেয়ে তুই তার ছেলের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছিস!’ আমি চোখ বড় করে পিউ আপার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আবার পিউ আপা ছুটে আসে, ‘ছুটি, মিতাভাই তোকে ছোট পেয়ে ভুলিয়েছে, তাই না?’
আমি মাথা ডানেবাঁয়ে নাড়াই।
পিউ আপা অবাক হয়। ‘তবে যে ছোটচাচি বলল মাকে?’
আমি কিছু বলি না কাউকে। আমার মাথার উপর বিরাট অপরাধবোধের চাপ আর এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকের ভেতর পাশাপাশি চেপে রেখে দেই। যত্ন করি ওদের। কি করতাম আমি? আমার মনের ভিতর মিতাভাইর জন্য যে তীব্র ভালোবাসা তা আমি কিভাবে লঘু করতাম?
সবার কাছে অস্পৃশ্য হয়ে উঠলাম আমি। কেউ কথা বলে না, চায়না আমাকে আর। এড়িয়ে যায়, আড়াল রাখে সবকিছুতে। আমি আর মিতাভাইর জন্য আমার মুগ্ধতা, ভালোবাসা এই থাকল শুধু আমার। আমি তাতেই মহাখুশি। এই ছাড়া আমি কি আর কিছু চেয়েছি? আমি শুধু ভালোবাসতে চেয়েছি, মিতাভাইর ভালোবাসা তো কখনও চাইনি। সে যদি অন্যের হয়ে যেত তবে তাকে ভালোবাসার মতো পাপ আমি কি করে করতাম? তার ভালোবাসা আমি চাইনে, চাইনে, চাইনে, শতবার নিজের মনকে বোঝাই, বলি হাজারবার। আমিই শুধু লক্ষকোটিবার ভালোবেসে মরে যাব।
পাওয়ার হয়তো সীমা থাকে। চাওয়ার কি কোনো সীমানা আছে? আমার চাহিদাও বাড়তে থাকে। মনে হয়, আরও চাই, আরও চাই। যত পাই তত চাই। আমি সাহসী হতে থাকি। অনেক না, মিতাভাইর একটু ভালোবাসা পাওয়ার কাঙাল জেগে ওঠে মনের ভেতর।
আমি মিতাভাইর ঘর গুছিয়ে দেই। ওড়নার আঁচলে বইয়ের ধূলো মুছি। বিছানা টানটান করে দেই। কাপর পরিপাটি করে রাখি। মিতাভাই ক্লান্ত চোখে ঘরে ফিরলে, ঠান্ডা লেবুর শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তার পিপাসা মেটে, আমি তৃষ্ণার্ত হই। আগে মিতাভাই দুটো কথা হয়তো বলত, এখন তাকায়ই না। আমার কষ্ট হয়। কি হয় মিতাভাই, একটু কথা বললে? একটু গালে হাতটা ছুঁইয়ে দিয়ে জানতে চাইলে ‘ভালো আছিস?’ এইটুকুনই তো, শুধু একটুখানি এইটুকুন!
মিতাভাই শাওয়ার নেয়, আমি ঘরে পরার পোশাক, টাওয়েল গুছিয়ে দেই। রাতের খাবার খেতে বড়চাচি ডাকে মিতাভাইকে। আমাকে কেউ ডাকে না। আমি আস্তে করে উপরে আসি। মা ও দেখেনা আমাকে। আমি বুবুকে ডাকি ‘বুবু, খেতে দিবি?’ বুবু মায়ের চোখ চুরি করে খাবার দেয় আমাকে। আমার নিজেকে কুকুর মনে হয়। তাও মনে কষ্ট নিইনা আমি। বুবু কাছে এসে কপালে চুমু দেয়। ‘ছুটি? আমাদের সবার ভুল হয়। আমরা সবাই ভুল করে ভুল করি। ভুলটা সময় থাকতে শুধরেও নেওয়া যায়।’
‘কি বলবা বুবু?’
‘ছুটি, এখনো সময় আছে, মিতাভাইকে ছেড়ে দে। মা বাবা কেউ খুশি না এতে। আগের মত হয়ে যা। আমরা সবাই আগের মতো আদর করব তোকে।’
আমি ভাতের ভেতর পানি ঢেলে উঠে পড়ি। চিৎকার করি ‘চাইনে আমি তোমাদের আদর। যে বোন, বোনের মন বোঝে না, যে মা মেয়ের বিয়ে ভাঙতে চায়, তাদের আদর ভালোবাসা চাইনা আমি।’
আমার চিৎকার শুনে মা আসে, আমার দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকায়। বুবুকে বলে ‘মিথিলা? এই শয়তান আমার বাসায় কী করে? ও তো নিজের পছন্দে শশুরবাড়ি গেছে। ওরা কি খেতে দেয়না? আর যেন ওর মুখ আমি না দেখি?’
আমি এঁটোহাতে দুমদাম সিঁড়ি ভাঙি। দৌঁড়ে মিতাভাইর ঘরে ঢুকি। মিতাভাই বই থেকে মুখ তুলে তাকায়। চোখে একরাশ বিরক্তি। ওপাশ থেকে বড়চাচির কন্ঠ শুনি ‘হস্তিনী মেয়েমানুষ! চলার শব্দেও ঘর কাঁপে।’
আমাকে কেউ বুঝতে চায়না, সম্পর্কছেদ করেছে সবাই অথচ তিক্ত কথা বলার অবাধ লাইসেন্স পেয়ে গেছে। আমিও পেয়েছি অবাধ স্বাধীনতা। আগে পড়তে বসতে, খাওয়ার সময়, বাইরে যেতে গেলে কত বাধ্যবাধকতা ছিলো, এখন হঠাৎ করে আমি যেন মুক্ত হয়ে গেছি। এতোটাই মুক্ত যে আশেপাশে কেউ নেই আমার! কেউ কিছু বলে না, কেউ কিছু মানা করেনা, কেউ কোনো শাসন করে না।
আমি বাথরুমে ঢুকে যাই। সবগুলো ট্যাপ ছেড়ে দেই। তুমুল বর্ষার অঝোর পানি পড়ার শব্দের সাথে মিশে যেতে যাই, কিন্তু কান্না পায়না আমার। কেন পাবে? আমিতো শুধুই মিতাভাইকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। উপরি হিসেবে আস্ত মানুষটাকেই আমার নামে পেয়ে গিয়েছি। তাকে পাওয়ার বিনিময়ে সব ছাড়তে হচ্ছে আমাকে। ছেড়ে দিলাম সব। মিতাভাইর ঘর ছেড়ে কোথাও যাইনা এখন। সারাদিন ঘরের ভেতর বসে থাকি আর তাকে মুগ্ধ করতে পড়ার বইয়ে মুখ গুঁজি, অংক করি। মিতাভাইর ঘরটাকেও ভালোবাসি আমি। কলেজে গেলে ছটফট করি, কখন ওই ঘরটাতে ফিরব। মিতাভাইর চেয়ারটা আয়োজন করে ছুঁয়ে দিই। আমার প্রিয় বান্ধবী নোরা, আমাকে সাইকো বলে, আমার সবটাই প্রচণ্ড অবসেশন বলে জ্ঞান দেয়। আমি ওর সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দেই।
মিতাভাই ঘরে আসলে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে যাই। তার সব কাজ গুছিয়ে দেই। সে পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ রেখে খুটুস খুটুস করে কীবোর্ড এর বোতাম চাপে। আমার কীযে ভালো লাগে। বিছানায় বসে বসে বই পড়ি আমি, আর মাঝে মাঝে কাজে নিমগ্ন মিতাভাইকে দেখি। একমিনিটও ঘর থেকে বেরোতে ইচ্ছা করে না। মিতাভাই বিরক্ত হয়। ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলে ‘ছুটি? সারাদিন ঘরে কী করিস? এভাবে ঘরে থাকতে বোর হোস না? একা থাকার অভ্যাস আমার। তুই আশেপাশে থাকলে বিরক্ত লাগে।’
আমার গলায় কান্নার দলা পাকায়। মন খারাপ করাকে দূরে পাঠাই আমি। ঠিকই তো, মিতাভাই তো বিরক্ত হবেই। সে তো আমাকে ভালোবাসে না! আমি উপরে আমার ঘরে আসি। বারান্দায় ঘুরি। একা একাই ভালো আমার। রাত নামলে আবার মিতাভাইর ঘরে যাই। তাকে চোখে হারাই তো! বকেছে? বকুক। আমাকে তো শুধু সেই বকতে পারে। এক আকাশ বকুক সে আমাকে। দরজাটা লাগিয়ে মিতাভাইর ঘরে ঢুকি। সে বিরক্তগলায় বলে ‘আহ। দরজাটা খুলে রাখ না? সাফোকেশেন হয় আমার।’
আমি দরজা হাট করে খুলে দেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলি ‘মিতাভাই, কনক আপা হলেও কি আপনি দরজা খুলে ঘুমাতেন? নাকি নিজের হাতে দরজাটা বন্ধ করে কনক আপাকে কাছে টেনে নিতেন? তাকে কি খুব আদর করতেন? আমাকে আদর করে দেন না? আমাকে একটু আদর করলে কী ক্ষতি হয়?’
মিতাভাইর নিঃশ্বাস ভারি হওয়ার শব্দ পাই। ঘুমিয়ে গেছে সে। আমি দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আলোটা জ্বেলে দিই। ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলি ‘এই মুখটা কি আমার অবসেসন? তবে অবসেসেনই ভালো আমার।’
অনেক সাহসী হই আমি। অনেক বেশি। সাহস করে মিতাভাইর গালে আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়াই।
তৃষ্ণা মেটে না আমার। আবার আলতো করে চুমু দেই তার গালে।
তাতেও তৃষ্ণা মেটে না আমার। গভীর একটা চুমুর তৃষ্ণায় গলা বুজে আসে আমার। গোলগাল মুখটার লালচে ঠোঁটে আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়াই। একপাক্ষিক ভালোবাসা আমার, একপক্ষীয় চুমু! ছোটো খাটটায় মিতাভাইর পায়ের কাছের একটুখানি জায়গায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ি আমি।
আস্তে আস্তে সবার কাছেই পরিস্কার হতে থাকে আমাদের সম্পর্কটা। মা আদর করে বলে ‘ছুটি? সোনা আমার। যা হইছে, ভুলে যাও মা। আমরা আবার তোমারে বিয়ে দেব। ভালো ঘর হবে, ভালো বর হবে। অনেক ভালোবাসবে তারা তোমারে।’
‘আমি কেন বিয়ে করব, আবার?’
‘আচ্ছা বিয়ে করতে হবে না। চলো আমরা এইখান থেকে চলে যাই। দূরে কোথাও। তুমি যদি বিদেশে যাইতে চাও, তোমার বাবা তাই করবে। অন্য কোনো দেশে ঘর পাতব আমরা।’
আমি আঁতকে উঠি। অন্য কোথাও গেলে মিতাভাইর মুখটা কিভাবে দেখব আমি? ছুটে চলে আসি মায়ের কাছ থেকে আমি।
সবাই আমাকে পাগল বলে। বড়চাচি ইনবিন করে কাঁদে আর আমাকে শাপ-শাপান্ত করে। মিতাভাইর জীবন নাকি আমি নষ্ট করে দিয়েছি। আমি মনে মনে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলি ‘বড়চাচি গো, তোমার ছেলের জীবন কিছু নষ্ট হয়নি। তাকে শুধু বলো আমায় চোখ তুলে দেখতে। তার সব পূর্ণতা হবো আমি।’
সবার কাছেই আমার মিথ্যেটা ধরা পড়তে থাকে। আমি আরও বেশি মিতাভাইর ঘরে ঢুকে যাই। আমাকে দেখেই মিতাভাইর ভুরু কুঁচকে যায়। আমার রাগ লাগে। এতো কেন বিরক্ত আমাতে? আমি কি এতোই খারাপ? একটু না হয় চাপা গায়ের রঙ, একটু পাতলা চুলের গোছা – তাই বলে একটুও কি ভালোবাসা যায় না? আবার নিজেকে বোঝাই, তারতো আমাকে ভালোবাসার কথা না, আমিইতো শুধু আছি ভালোবাসার জন্য। তার ভাগেরটাও না হয় আমিই বেসে দেবো!
বড়চাচা ডাকেন আমাকে। মাথায় হাত রেখে বলেন ‘গাধাটা খরচ টরচ দেয় তোকে?’
আমি হেসে ফেলি। ‘আমার কিসের খরচ, বড়চাচা?’
‘কি? তুই এখনো তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিস? আমাকে এতো ছোট করিস তুই? আজ থেকে দোকানে যত খুচরো টাকা থাকবে, রাতের বেলা সব তোকে দিয়ে যাবে। আর কলেজের যত খরচ সব আমার কাছ থেকে নিবি।’
‘আচ্ছা।’
‘আর সবসময় আমার খাওয়ার সময় আমার সাথে খেতে বসবি তুই। তোর বড়চাচি আমার খাওয়ার কোনো খেয়াল রাখে না।’
‘আচ্ছা’। মাথা নাড়ি আমি।
‘তোর ঘরের খাটটাও তো বদলাতে হবে। গাধার বাচ্চা ঘুমায়ও গাধার মতো। ওই খাটে তোর জায়গা হয়? আমি আজকেই খাটের বায়না দেব। অরিজিনাল বার্মা সেগুনের খাট দেখেছি একটা। খুব পছন্দ হয়েছে। তুই যাবি দেখতে?’
‘আমার দেখা লাগবে না বড়চাচা।’ বড়চাচা একটু আগে বলেছে ‘তোর ঘর’, ওতেই মত্ত আমি। আমার ঘর, আমার ঘর, আমার মিতাভাই। সব আমার, ভালো লাগায় মন ছেয়ে যায়। সুখি সুখি লাগে নিজেকে।
বড়চাচা পেছন থেকে ডাকেন আবার ‘ছুটি?’
আমি তাকাই তার দিকে।
‘তুই কি কিছু বলবি, ছুটি? বলে ফেল। মনের ভিতর যে ভার বয়ে নিয়ে যাচ্ছিস, আমাকে অন্তত বল। আমি সবাইকে বকি। তোকে কি কখনো বকেছি? আমাকে বল। আমি সব ঠিক করে দেবো।’
আমি বুঝতে পারি, এই লোকটার চোখ এড়ায়নি কিছু। আমার বুকের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পান বড়চাচা।
আমি কিছু বলিনা। এ আমার একান্ত সুখ, একার দুঃখ। আমি পেলেপুষে একে বড় করি। আমি ভালবাসা পালি, দুঃখ পালি। কখনো ভালোবেসে সুখ পাই। কখনো প্রতারণা করে ভালোবাসা নিজের করে নেওয়ার দুঃখে ভাসি। আমি সুখি, আমিই দুঃখবিলাসি!
চলবে…
afsana asha
(কপি করা যাবে না।)
ভালো লাগছে গল্পটা? তাহলে চট করে পড়ে ফেলুন আমার প্রথম বই, প্রেমের উপন্যাস ‘অপ্রেমের রাতগুলো দীর্ঘ হয়’ থেকে কয়েক পাতা। অনেক যত্ন নিয়ে লিখেছি বইটা। নিঃসন্দেহে আমার সেরা লেখা। লিংক পেইজেই পাবেন। আর অর্ডার করে ফেলুন এশিয়া পাবলিকেশন্স, রকমারি, দূরবীন ও বইপরী বুকশপে। আমাকে ইনবক্সে ও এড্রেস ফোন নাম্বার দিতে পারেন।
ব্যবহৃত কবিতাটি ফারহানা রহমানের লেখা ‘বাইশ গজ’ থেকে নেওয়া।