চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ১২

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ১২

আলোকজ্জ্বল সকাল। দুদিন কুয়াশায় আকাশ দেখা যায়নি। আজ একেবারে ঝলমল করছে। আমি রাঙামাটি এসেছি আজ সাতদিন। পাহাড়ি মানুষ নামের একটা সমবায় সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিতিন রয়, গ্রামীণ ও পাহাড়ি জনপদের অর্থনীতি ও জীবিকা নিয়ে গবেষণা করছেন। ‘পাহাড়ি মানুষ ‘ তার গবেষণার বাইরে প্রাণ বলা যায়। এই প্রত্যন্ত, বিলাসবর্জিত জীবনে তিনি আমার মতো কয়েকজন ফ্রেশার ধরে নিয়ে এসেছেন। আমাদের কাজ তার গবেষণার ডাটা কালেক্ট করা, সেগুলো এনালাইজ করে দীর্ঘসময় আলোচনা আর বিতর্ক করা, ডাটা সংরক্ষণ করা আর পাশাপাশি ‘পাহাড়ি মানুষ’ এ আসা সুবিধাবঞ্চিত নারী, শিশু আর কিশোর কিশোরীদের উপযুক্ত সাহায্য করা। ডাটা কালেক্ট করতে প্রায়ই পায়ে হেঁটে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে যেতে হয়, জুমচাষীদের খবর নিতে হয়, মাল্টাচাষি, আনারসের ফলন, ভুট্টা বা ধানচাষির ফসল আর পিনন-হাদির বুনন দেখা, অশিক্ষা আর বাল্যবিবাহ দুরীকরণে প্রচার চালাতে হয়। স্থানীয়দের কাছে নিতিন স্যার দেবতা সমান হলেও আমাদের জন্য কাঠখোট্টা লিডার, যে শুধু খাটাতেই জানেন, বিনিময়ে অতি সামান্য সম্মানি দেন। তবুও এই পাহাড় আর ছোটো নদীবেষ্টিত অসমতলে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হবে শুধু ক্যারিয়ারের আশায়। নিতিন রয়ের এসিট্যান্টশিপ নামেই একটা আলাদা কোয়ালিফিকেশন, সিভির ওজন বাড়াতে। আর দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিতিন স্যারের রেফারেন্স নিয়ে যেতে পারলেই স্কলারশিপ বাগানোর সুযোগ কাছাকাছি এসে যাবে। তাই ভালো ভালো জব অফার পেয়েও এই পাহাড়ে জঙ্গুলে মশার কামড় খেতে উপস্থিত আমিসহ আর সবাই।

শুধু অফিসবাড়িটাই পাকা বাড়ি। আমাদের থাকার ব্যবস্থা টিলার উপরে ছোট ঘরগুলো যার মেঝে শুধু পাকা। বেড়া চারপাশে আর মাথার উপর ছনের চাল। পানির ব্যবস্থা করুণ। পানি টেনে এনে ওয়াশরুমে জমিয়ে রাখতে হয়। একটা মেয়ে আছে ঝুম্বোবি নামে, সকালবেলাতেই পানি এনে ঘরে ঘরে দিয়ে যায়। খাওয়ার পানি আলাদা করে বোতল আসে। কয়েকদিনের ভেতরই নাকি পানির লাইন ঘর অব্দি আসবে।

‘পাহাড়ি মানুষ’ একটা সমবায় সংস্থা। আড়ালে পুরোদস্তুর ক্ষুদ্র ঋণের কারবার। নিতিন স্যারের গবেষণা কাজ এখানে একটা আড়াল দেয় সবকিছুতে। আমার মতো আরেকজন আছে ওয়াহিদা। সেইম ব্যাচ আমরা। আমার ছুটি ছিলো, ও আরো পাঁচদিন আগেই জয়েন করেছে। সবকিছু দেখেশুনে ওর অসন্তোষ তীব্র হয়েছে। আমি শুধু শুনেছি ওর কাছে। আমার কাছে এমন কিছু খারাপ লাগেনি এখনো। আসলে কাজই পাইনি তেমন। শুধু ঘুরেফিরে আশপাশটা দেখলাম।

রাঙামাটির একটা উপজেলা নানিয়ারচর। পাহাড় আর অগভীর খরস্রোতা নদীর খেলা। প্রকৃতির সুন্দরটুকু দেখতে হলে এখানে অবশ্যই আসতে হবে। বিশেষ করে সূর্যোদয়ের সময়টা। দূর পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্যমামা কেমন একটু একটু করে উঁকি দেয় আর ঝিকিমিকি করে ওঠে জলপাই, কমলালেবু আর নাম না জানা বুনো ফুলে মোড়ানো সবুজ পাহাড়টা! সবুজ অক্সিজেনে বুক ভরে সকালটা সুন্দর কাটে; প্রিয়াঙ্কা চাকমা, দীপায়ন চাকমা, বিরো চাকমা, মনু খীসা, অনন্য খীসা এদের সাথে ব্যস্ততা বিহীন সুন্দর একটা দিন কিভাবে চলে যায় টেরই পাইনা। রাতটা নামে ঝুপ করে। হঠাৎ করে একা হয়ে যাই। ইলেকট্রিক আলোতে আঁধার যেন কাটতে চায়না। ওয়াহিদা যতটা বিরক্ত এই চাকরি নিয়ে ততটা আগ্রহী না আমার সাথে কথা বলতে। ও সন্ধ্যা হলেই নিজের ঘরে চলে যায়, ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আমার বন্ধুত্ব খুব একটা সুখকরও না। মিতাভাই ছাড়া অন্য কিছুতেই আমার ইন্টারেস্ট ছিলো না কোনোদিনও, তাই কোনো বিষয়েই চালানোর মতো গল্প করতে পটু নই একদমই। একটানা ঝিঁঝির ডাকের সাথে মিশে যায় নাম না জানা পাখি বা পালা শুয়োরের হঠাৎ ডাক। আমার একলা লাগে কিন্তু নির্ভার মনে হয়। আমার আর মিতাভাইকে মনে পড়ে না। বেতালের মতো যে মাথায় চেপেছিলো তাকে এবার নামিয়ে এসেছি আমি। আর খুব খুব ভালো লাগছে। প্রতিটা মানুষকে খুঁটিয়ে দেখছি, জানতে ইচ্ছে করছে তাদের জীবন, পাখির ডাক, গাছের সবুজ, ঘাসের শিশির – যাদেরকে দেখা হয়নি কোনোদিন চক্ষু মেলিয়া, সব উপভোগ করছি এখন। এইযে রাতের বেলা টুপ টুপ করে বৃষ্টির মতো শিশির পড়ছে বাদাম গাছের পাতা হয়ে, কী সুন্দর সঙ্গীত হয়ে যাচ্ছে!

আমি চমকিত হয়ে উপলব্ধি করি মিতাভাইকে ছাড়াই জীবনটা সুন্দর!
আমার এই পঁচিশ বছর বয়সে এতোটা আনন্দে আমি কখনো ছিলাম না কোনোদিন। পেটানো বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকছে ঘরে, তবুও এই ঘরটা আমার নিজের অর্জন। উজানা নামের এগারো বছরের মেয়েটা যখন তার মায়ের হাতে বোনা পিনন ওড়না এনে আমার গায়ে জড়িয়ে আমাকে ওদের একজন বানিয়ে ফেলে একদিনের পরিচয়ে, এই ভালোবাসাটুকুই আমার অর্জিত বলে গর্ববোধ হয়।

পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তুলে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ঐন্দ্রিলা, আমি আমাকে খুঁজে পেয়েছি।’

*****

‘পাহাড়ি মানুষ’ অফিসের সামনে ছোট ছোট কাঠের বেঞ্চ পাতা আছে, বসার জায়গা। অন্যদিন খালি থাকলেও আজ বেশ ভিড়। আজ সাপ্তাহিক কিস্তির টাকা জমা দেওয়ার দিন। কেউ কেউ কিস্তির টাকা জমা দিতে এসেছে। কেউ কেউ এসেছে এই সপ্তাহে কিস্তিমাফের মৌখিক দরখাস্ত নিয়ে। দিদিমণি বলে ওয়াহিদা, অজন্তাকে ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে। অজন্তা ওদের নিজেদের লোক, কড়া সুরে জমাবই নিয়ে তলব করছে একে একে। ওয়াহিদা বেশ বিরক্ত। একটা জার্নালে কো-অথর হিসেবে নিজের নাম দেখার লোভ না থাকলে ও এখুনি ছুটে বেরিয়ে যেতো। এই ঋণের নাগপাশে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ব্যর্থ, অসহায় মুখের আকুতি দেখার চাইতে বেকার থাকাও নাকি অনেক ভালো। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অনির্বান বাঁকা হাসি দিয়ে বলে প্রথম প্রথম সবাই নাকি এরকম আদর্শে উজ্জীবিত থাকে, মানবিকতায় ভরপুর থাকে। কদিন গেলেই দ্বিগুণ উৎসাহে ঘুষবাবদ জুমের বাদাম, পিননের শালে নাকি পোটলা ভরে সবাই। ওয়াহিদা ক্রুদ্ধ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আর পাহাড় কেটে সিঁড়ি বানানো রাস্তা বেয়ে উঠে আসা মানুষটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। আনন্দ গলায় এসে পৌঁছুলো আমার। বাচ্চা মানুষের মতো চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এলাম। ছাইরঙা ডেনিম, মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ‘এডাম’ বুকে আঁকা টিশার্ট, চোখঢাকা ক্যাপ আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে জাবির হাজির! হলে থাকলেও বাড়ির খুব কাছাকাছি ছিলাম, বড়চাচা প্রতিদিনই আসত – এসব মিস করছিলাম খুব। জাবির, নওমি, জ্যোতি – প্রাণ খুলে কখনো মিশিনি এদের সাথে, এই সাতটা দিনে যেন প্রাণ দিয়ে মিস করেছি৷ ওকে দেখে চোখে শান্তি হলো, মনে শান্তি এলো।

‘তুই?’

‘হুম। চাকরি বাকরি ছেড়ে আসিনি কিন্তু, তিনদিনের ছুটি আছে। রাগ করবি না একদম। রাঙামাটি তোর একার না।’

আমি চোখ সরু করে, কোমরে হাত দিয়ে তাকালাম। ‘রাগ করার মতো কিছু করেছিস? বলে ফেল। বুঝে দেখি, রাগ করব কীনা?’

‘তার মানে এখানে আমি গ্রান্টেড? আমাকে দেখে রাগ করিসনি?’

‘রাগ করব কেন? আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে। মিস করছিলাম তোকে।’

‘দাঁড়া, দাঁড়া, আগে তোকে দেখি? তুই আসল তো? নাকি আসল ইলা পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছে আর এটা তার ভুত?’

‘যাহ! কখন এসেছিস? নাস্তা করবি তো? আমি ব্যবস্থা করি?’

‘হু হু। নাস্তাফাস্তা করেই এসেছি। তুই খেতে দিবি এমন আশা তো স্বপ্নেও করিনি। লাঠি দিয়ে দৌঁড়ানি দিচ্ছিস না এই বেশি!’

‘আমি ভেবেছিলাম তোদের আসতে বলব। এতো সুন্দর পাহাড়, পাহাড়ি নদী, পাহাড়ের মানুষ… ‘

‘সত্যি? সত্যি আসতে বলতি?’

‘হ্যাঁ। জ্যোতিরও তো খুব পাহাড়ে পাহাড়ে ফ্যান্টাসি!’

‘শুধু আমাকে বলা যায় না?’

আমি উত্তর দিলাম না দেখে ওই আবার বলল ‘এভাবে তাকাবি না। আমি কোনো এক্সপেক্টেশন থেকে আসিনি, খুব কিছু একটা করে তোর মন জয় করে নেব এমন কিছু ভাবিওনি। পরশু রাতে হঠাৎ মনে হলো, তোকে দেখিনা অনেকদিন। তাই হুট করে চলে এসেছি। তুই তো আবার অনেকখানি ভেবে নিস…’

‘তাই নিজেকে এতোখানি ডিফেন্ড করে নিলি আগে থেকেই? এডভোকেসি ভালো করিস তো? নিজেরটা নিজেই।’

‘তুইতো এখন অনেক কথা বলছিস।
আগে তো সাইলেন্ট মুডে থাকতি।’

‘বেশ কয়েকদিন পরে দেখা হলো তো, তাই!’ মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কাটলাম আমি। ‘তুই কিন্তু সবসময়ই অনেক বেশি কথা বলিস।’

‘হাহাহা। চল, আমি তোর মেহমান আজকে। তোর মুড ভালো থাকতে থাকতেই পাহাড় ঘুরিয়ে দেখা।’

‘আচ্ছা আমি চট করে কাজ গুছিয়ে ফেলি। আমারও কিছু দেখা হয়নি।’

আমরা সারাদুপুর আর সারাবিকেল পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরলাম। বাঁশ আর বেতের কুটির শিল্প দেখে মুগ্ধ হলাম। রত্নাঙ্কুর বৌদ্ধবিহারে বুদ্ধমূর্তির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। অবশেষে সন্ধ্যা নামার খানিক আগে চেংগি নদী ছাড়িয়ে এক পাহাড়ের ঢালে বসে শিক্ষাসফর শেষ হলো আমাদের। আমার পা ব্যথা করছে, জুতো খুলে নরম ঘাসের উপর বসে পড়লাম। পাহাড়ি বাতাস। হালকা করে ছুঁয়ে যাচ্ছে কিন্তু একেবারে চামড়া, মাংস, হাড় ভেদ করে সূচের মতো বিঁধছে। শীতের কাপড়েও উষ্ণতা দিচ্ছে না। দূরে অপরূপা চেংগি নদী কুয়াশায় ঝাপসা হতে শুরু করেছে। জাবির সেদিকে তাকিয়ে একটা একটা করে ঘাস টেনে তুলছে আর হালকা করে সুর তুলেছে –

“যেই না আঁকবে পাহাড়
যেই না ঢালবে নদী,
ছোট্ট পাতা বাহার
কীভাবে রোদ লুকাবে।

যেভাবে মেঘেরা ঘামে
যেভাবে হাত ঠান্ডা হয়,
তুমিতো হলদে খামে
কী আর বলো পাঠাবে ?

যা কিছু আর যত ছিল বলার
সব মুলতবি হয়ে যাক,
বোকা পাহাড় জানে সবই মায়ার
শীত চাদরেও ঠান্ডা পাক ..

না, নানা না, নানা নান্না না না না

বোকা হওয়া যে সহজ নয়
বোকা হয়ে জানতে নেই,
লুকানোতে যে সাহস চাই
ভয় পেয়ে বলতে নেই।

বরফেরা নেমে রাস্তায়
থেমে হেসে যদি হাত মেলায়,
বোকা পাহাড় জানে সবই হাওয়ার
ভালোবাসা হোক অবেলায় ..”

পাহাড় কি আসলেই বোকা হয়? অটল দাঁড়িয়ে কারও প্রতীক্ষায় থাকে – যে আসবে না কোনোদিন? আমি দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলাম। জাবির গাঢ় হয়ে বসল। আমার ঠান্ডা হাত টেনে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।

‘আমি পারব না, জাবির।’

‘আমি তো তোকে কিছু বলিনি। আমি জানি এটা খুব কঠিন।’

‘তবে, তুই কেন এসেছিস?’

‘এমনিই! তোকে দেখতে ইচ্ছে করল খুব। আমার ইচ্ছে হতেই পারে। আমি তোর দুয়ারে এসে দাঁড়াতেই পারি। একপায়ে ভর দিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। রাতে তোর উঠানে চিৎ হয়ে আকাশের তারা গুণতে পারি। তুই দয়া করে সানকিতে করে দুটো ভাত খেতে দিবি। আমি তোর দয়ার শরীর মনে করে তোকে আশীর্বাদ করে তোর আঁচলে এঁটো মুখ মুছে, খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে যাব। এক ঝাঁক জোনাকি আমায় ঘিরে ধরে অলিক দেশে নিয়ে যাবে কিংবা বুনো হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইবে অন্য কোথাও। তাদের মিনতি করে জলপাই গাছের মাথার পাতা আঁকড়ে আমি আবার ঠাঁই নেব তোর দুয়ারে। নিশুতি রাতে দূর পাহাড়ে কোনো এক আদিবাসী ছোকড়া তার চিকন বাঁশিতে বিচ্ছেদের সুর তুলবে, আমার পাশে এসে সেই সুরে মুগ্ধ হবে কোনো এক নাম না জানা পাখি বা দলছুট পাহাড়ি পশু! তাদের সাথে নিয়ে আমি অপেক্ষা করব কখন ভোর হবে, তুই দ্বার খুলবি আর আলোটা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে আসবি। আমি কিন্তু একবারও কড়া নাড়ব না। একবারের জন্যও না।’

আমার মুখ দুহাতের তালুতে তুলে ধরে জাবির। আধো আঁধারে ওর চোখ জ্বলছে। আমি ওর হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসি।

‘যাহ, এতো কাব্য করতে হবে না।’

‘করলাম না। তুই একটা গান কর, ইলা?’

‘গান করতে ভালো লাগে না। সুর বসে না। তুই কেন এলি জাবির? না এলেই ভালো হতো?’

‘কী ভালো হতো?’

‘আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারতাম।’

‘ভাবাভাবির কিছু নেই ইলা। আমি জানি হাজার ভেবেও লাভ নেই। তুই একটা মেইজ এ আটকে গেছিস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেইজটা তোর নিজের তৈরি আর তোর ইচ্ছাই নেই মেইজটা গুটিয়ে বেরিয়ে আসার। বাকি সব যা তুই করছিস, তা ছলনা। মায়েরা যেমন বাচ্চাকে ‘বর্গি এলো’ বলে ঘুম পাড়ায় তেমনি তুই ছেড়ে এসেছিস নাটক করছিস। বর্গি যেমন আসেনা কোনোদিন তেমনি তুইও ভুলবি না সেসব কোনোদিন।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। রুক্ষ শোনাচ্ছে ওর কথাগুলো। আমিও থমথমে গলায় বললাম ‘তবে তুই কোন আশায় আছিস?’

‘নিরাশায়।’

‘তবে আমি নিরাশায় থাকলে তা দোষের কেন, জাবির, বলতে পারিস? আমি মেয়ে বলে? এইযে কত শোনা যায়, অমুক ছেলে হাত কেটেছে অমুক মেয়ের জন্য। আমাদের ব্যাচের রাজনের কবজিজোড়া সিগারেটের ছ্যাঁকা দাগ সুমাইরার প্রেম না পেয়ে। সাইদ ইয়ার ড্রপ দিয়ে দিলো সুতপার জন্য। কত ছেলে দিব্যি বর্ষায় ভিজে গোলাপ হাতে ভরসন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকে প্রেমিকার বাড়ির সামনে, নইলে চাতক পাখির মতো কলেজ গেইটে মুখ উঁচু করে বসে থাকে কতশত প্রেমিক, প্রেমাস্পদের মুখ দেখবে বলে। আমার বেলায় এসে তা হ্যাংলাপনা হয়ে যায়? আমি মেয়ে বলে? আমি মেয়ে বলেই কি আমার ডিজায়ার বেহায়াপনা হয়ে যায়, আমি এগিয়ে প্রথম চুমু দিতে চাইলেই কি আমি নির্লজ্জ হয়ে যাই? তুই আমার দিক থেকে আশ্বাস না পেয়েও ছেড়ে যেতে পারছিস না, আমিও বিনা চাওয়ায় যদি ভুলতে না পারি আমায় কেন বোকা ঠাওরাবি? আমি বারবার কেঁদে ফিরে গেলে আমায় কেন শুনতে হবে সাইকো, আত্মসম্মানহীন? ভালোবাসার কাছে এসে যে ওইসব সম্মান, মর্যাদা পায়ে লুটিয়ে পড়ে তা কি কেউ জানে না? পুরুষের বেলায় একতরফা প্রেম মহান হয়ে যায় আর শুধু মেয়ে বলে আমি কারো সহানুভূতি কেন পাই না? বলতে পারিস?’

আমি কেঁপে কেঁপে উঠতেই জাবির দুহাতে জড়িয়ে নেয় আমাকে। ওর আলিঙ্গনে আমি অনুভব করি বন্ধুত্বের উষ্ণতা। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বলি ‘জাবির তুই আর আসিস না। তুই আরেকটা ছুটি হয়ে যাচ্ছিস। আমি দেখতে পারছি না। ছুটি হওয়াটা খুব যন্ত্রণা। বারেবারে তাকে ঐন্দ্রিলার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়।’

‘আমি তো তোকে কিছু বলিনি।’

‘আমি তো বুঝতে পারি। নওমি দিনে তিনবেলা ফোন করে। মা সারাদিন ফোন করতে থাকে। বাবাও উপদেশ দেয়, আমার ভালো লাগে না। ফোনের সিমকার্ড পালটে ফেলেছি। আমি জানি আমার উচিত, অনুচিত। সব জানি। কিন্তু বুঝতে পারি না, বোঝাতেও পারি না। মন আর মস্তিষ্কের লড়াইয়ে কে হারে আর কে জেতে হিসেব বুঝি না।’

দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের দিকে মুখ করে আমি চিৎকার করে উঠি, ‘অংকের মাস্টার, আমার হিসেবের সমীকরণ মিলিয়ে দেবেন? আমার অংক যে মেলে না। আমার দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে দেবেন প্লিজ? অংকের মাস্টার?’

পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরে আসে আমার শব্দগুলো ‘অংকের মাস্টার?’

*****

আমরা যখন রেসিডেন্সে পৌঁছেছি রাত আটটা বেজে গেছে। পাহাড়ে অনেক রাত এখন। রাতের খাবার খেয়েই এসেছি আমরা। আমাকে পৌঁছে দিয়ে জাবির চলে যাবে ছায়াবীথিতে। ছোটো মোটেল৷ ওখানেই উঠেছে ও। রুম খালি থাকলে আমাদের রেসিডেন্সেই থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম। নিতিন স্যারের রুম ছাড়া আর কোনোটা খালি নেই। রেসিডেন্স শুনতে যেমন এমন আহামরি কিছু না। টিলার উপর ছোটো ছোটো ঘর, কাঠের ফ্রেমে বাঁশের বেড়া বাঁধা। সামনে কাঠের রেলিঙ দেওয়া টানা বারান্দা। দশজনের জন্য দশটা রুম এই টিলায়। আর সুন্দর করে সাজানো এক চিলতে উঠোন। বেতের চেয়ার টেবিলে সাজানো। হলুদ বালবের আলোয় মোহোনীয় দেখাচ্ছে। আলো ঘিরে কুয়াশা হালকা হয়ে আছে। দুটো একটা মরিচ বাতিও জ্বলজ্বল করছে। বারান্দা ঘেঁষে পাতাবাহার, গোলাপের গাছ। নিয়ন্ত্রিত ঝাউগাছে শৈল্পিক কাঁচির ছোঁয়া। ভালো লাগে বেশ।

বারান্দায় ওঠার কাঠের সিঁড়িগুলো অতিক্রম করে নিজের ঘরের তালা খোলার জন্য হাত দিয়েছি, খুট করে ওয়াহিদা তার দরজা খুলে বেরুলো। বেরুলো না, খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে বলল ‘আজ কী শীত, বলো? আমিতো ঠকঠক করে কাঁপছি। তুমি ফোন নিয়ে যাওনি কেন? কতবার করে ফোন করেছি। তোমার হাজবেন্ড এসেছে৷ সেই দুপুরে। অনির্বান দাদার রুমে ফ্রেশ হয়েছে। খেয়েছেও আমাদের সাথে। তারপর থেকে লনে বসে আছে।’

খবর দিয়েই ও দরজা বন্ধ করে দিলো আবার। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হাজবেন্ড শব্দটার আকার প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করলাম। জাবিরের দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকালাম। জাবিরের চোখও ভাষাহীন।

লনের চেয়ার টেবিলে চোখ যায়নি আগে, দুটো দেবদারু গাছের আড়াল ছিলো। এখন তাকালাম, মিতাভাই বসে আছে, সামনে তার ল্যাপটপ। খুটখুট করে বোতাম চাপছে। আমি নেমে এসে আর নিজের ভার রাখতে পারলাম না। ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। মিতাভাই তাকালো। একগাল হেসে বলল ‘ঐন্দ্রিলা? এতো দেরি করে এলি?’

আমি চাপাকন্ঠে বললাম ‘মিতাভাই? কেন এসেছেন?’ তার কানে পৌঁছুলো না আমার কন্ঠ। মিতাভাই জাবিরের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তুমিতো ঐন্দ্রিলার বন্ধু? বসো? তুমি করে বলছি। তোমাকে দেখেছিলাম মনে হচ্ছে মিলার বিয়েতে। পরিচয় হয়নি। আমি মিফতাহুল ইসলাম।’

জাবির উত্তর দিলো ‘আমি জাবির আহমেদ। ক্লাসমেট আমরা। আপনাকে আমি চিনি। আপনি ইলা’র এক্স।’

‘এক্স?’ মিতাভাই আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।

মিতাভাই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘দারুণ জায়গা কিন্তু ঐন্দ্রিলা? তিনদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। বেশিদিনের জন্য এলেই ভালো হতো!’

‘আপনি রাতে খেয়েছেন মিতাভাই?’

‘হ্যাঁ। অনির্বাণ ছাড়ল না। বলল আটটার পরে বাইরেও কিছু পাওয়া যাবে না। তোরা খেয়ে এসেছিস তো?’

‘হ্যাঁ।’ আমি মাথা নাড়লাম।

‘ভালো হয়েছে। আমার ব্যাগ অনির্বানের ঘরে রয়ে গেছে। তুই গিয়ে নিয়ে আসবি?’

আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। ব্রেইন ফাংশন করা বন্ধ করে দিয়েছে। টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম, জাবির ধরে নিলো। জাবিরের দিকে কৃতজ্ঞচোখে তাকিয়ে আমি অনির্বান দাদার রুমের দিকে চললাম। ছোটো একটা ট্রলিব্যাগ। ঠেলেঠুলে এনে আমার রুম পর্যন্ত এসে দেখি দুজনেই লন ছেড়ে উঠে এসেছে। জাবির আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল ‘আমি তবে যাই, ইলা? এরপরে তো দেরি হয়ে গেলে পায়ে হেঁটে হোটেলে পৌঁছাতে হবে।’
মুখ পাংশু, ম্লান হয়ে গেছে ওর। আমিও চোখের পাতা নামিয়ে নৈশব্দে বিদায় দিলাম ওকে। ও নামতে নামতে আমিও রুমের দরজা খুলে ফেলেছি। একমুহূর্ত কী ভাবতেই জাবিরকে পিছু ডাকলাম ‘জাবির? মিতাভাইকেও সাথে নিয়ে যা। এখন গেলে ওনার জন্য হয়তো একটা রুম পাবি।’

মিতাভাই হতভম্ব গলায় বললেন ‘মানে? আমি কোথায় যাব?’

আমি গলায় জোর এনে তাড়া দিয়ে বললাম ‘এখানে রুম খালি নেই মিতাভাই। জাবির হোটেলে যাচ্ছে। আপনি ওর সাথে চলে যান। সকালে কথা বলব, যদি কিছু বলার থাকে।’

মিতাভাই ছেলেমানুষী জেদ করল ‘আমি তোর সাথে থাকব। তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। এটা তো নতুন না।’

সর্বশক্তি দিয়ে ‘না’ বলে ঘরে ঢুকেই দরজা দিলাম আমি। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম।

মিতাভাই দুবার আলতো টোকা দিলো দরজায়। ফিসফিস করে বলল ‘তুই কি আমাকে ভয় পাচ্ছিস? আমাকে বিশ্বাস নেই? আমি কি কিছুতে তোকে জোর করি?’

আমি আরও জোরে দরজা চেপে রাখলাম। মনে মনে চিৎকার করে বললাম ‘আপনাকে ভয় নেই মিতাভাই। আমি আমাকে ভয় পাই। ছুটিকে অবিশ্বাস করি। আপনাকে খুব কাছে পেয়ে যদি আবার একবার বেহায়াপনা করে ফেলি? নির্লজ্জ হয়ে যাই?’

চলবে…

afsana asha
(কপি করা যাবে না)

ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেটের একপাশে হাতদুটো বুকের উপর ভাঁজ করা ঝিলিককে দেখলেই আমার মন নেচে ওঠে। কাছে এসে দেখি মুখটা আষাঢ়ের মেঘ। আমি এসেছি খেয়ালই করে না, তাকায়ই না। এর আবার কী হলো? আমাকে দেখেইনি এভাবে রোডক্রস করে লেকসাইডের সাইডওয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকলো।
কি হলো বাবা? ডানে- বাঁয়ে চিন্তা করতে লাগলাম কী এমন করলাম আমি যে বাবু রাগ দেখাচ্ছে আমায়! না পেরে ওর টিশার্ট খামচে ধরলাম। খেঁকশিয়ালের মতো খেঁকিয়ে উঠলো ‘কি হয়েছে? জামাকাপড় টানাটানি কীসের?’

‘কি হয়েছে, বলবা তো?’

‘কি বলবো? কিছু হয়নি।’

‘আরেহ বলোনা, শুনি।’

‘তোমার বলার, শোনার লোকের তো অভাব নেই, আনন্দিতা।’

‘মানে কি?’

‘কোনো মানে নেই।’

‘ওই উল্লুক, নটাঙ্কি কম। সমস্যা কি?’ বদ ছেলেটা উত্তর দেয় না, হাত ছাড়িয়ে নেয় আমার। আমি রেগে যাই এবার, এমনিতেই আমার অবস্থা কেরোসিন সেমিস্টার ফাইনালের চিন্তায়! আমি লেকপাড়ের সিমেন্টের বেঞ্চে বসে পড়ি। যা তুই যেখানে যাবি। দশসেকেন্ডের মাথায় ও এসে পাশের জায়গা দখল করে।
লেকের পানি ময়লা। চিপসের প্যাকেট, বাদামের খোসা ভাসছে। সেইদিকে তাকিয়ে বলতে থাকলো ‘ওই ছেলেটার সাথে এতো কি কথা হচ্ছিলো?’

‘কার সাথে?’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

‘দেখলাম তো। ওইযে সাদা শার্ট পরা।’

‘ওহ এইজন্য এতো নাটক?’
ঝিলিক চুপ করে থাকলো।

‘দিতা?’ গাঢ় হলো ওর স্বর। ‘তোমার চোখে আমি অন্য কাউকে দেখতে পারবো না। আমি সহ্যই করতে পারি না। এক মূহুর্তের জন্যও না। হতে পারে আমার পাগলামি কিন্তু যা আমি পারিনা তা পারিইনা।’

আমার হাতটা ধরে নিজের হাতের ভিতর মুঠো করে ছোট ছোট চুমু দিতে থাকলো। আপাদমস্তক শিরশির করে উঠলো আমার। ভালোলাগায় বিভোর হতে থাকি…

“আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।”

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here