চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ১৩

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা শেষপর্ব(ক)

আরেকটা নির্ঘুম রাতের শুরু। মিতাভাই কেন এই রাঙামাটিতে এসেছে আমি জানিনা। তবে আমার একটু সময় দরকার নিজেকে সামলে নিতে। তাই আজ রাতে কোনোভাবেই না, যা কথা হবার কাল হবে।

ঘুমের একটা অদ্ভুত সমস্যা আছে। যেসব রাতে খুব করে ঘুমাতে চাই, ঘুম আসেনা। ঘন্টার পর ঘন্টা সারা দুনিয়ার চিন্তা মাথার ভেতর পাক খায়, কিন্তু ঘুমের দেখা পাওয়া যায়না। আবার যেদিন না ঘুমিয়ে সকালের অপেক্ষা তীব্রতর হয় সেদিন রাজ্যের ঘুম নেমে আসে দুচোখ ভরে। আমারও চোখ লেগে এসেছিলো। তন্দ্রার ভিতর লাফ দিয়ে উঠলাম দরজার কড়া নাড়ার শব্দে। তার সাথে প্রিয়াঙ্কার কন্ঠ। প্রিয়াঙ্কা পাহাড়ি মেয়ে, চাকমা। বিয়ে করেছে বাঙালি ছেলে বিদ্যুৎকে। বেশ ভালো বাংলা বলে। এখানে সবাই কমবেশি ভালো বাংলা বলে। নিজেদের ভেতর কথা হলে তখন মাতৃভাষার ব্যবহার দেখা যায়। বিদ্যুৎ কম্পাউন্ডের সিকিউরিটি গার্ড। আমি ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু দরজা খুললাম না। প্রিয়াঙ্কা কড়া নাড়তে নাড়তেই বললো, ‘দিদিমণি, বাইরে আসো। দেখো তোমার বন্ধুরা কী করছে? কম্পাউন্ডের গেটের বাইরে মারামারি করছে।’

মাথা ঘুরে গেলো আমার। মারামারি করছে? কে? মিতাভাই? জাবিরের সাথে? এ কি বাংলা সিনেমা চলছে? আমি ঝুপ করে দরজা খুলে বাইরে আসলাম। আওয়াজ কানে আসছে, গালাগাল করছে নাকি এরা? শব্দের উৎস খেয়াল করে দেখলাম টিলায় ওঠার খাড়ায় দুজনকে, একজন বসে আছে উবু হয়ে আরেকজন দাঁড়ানো। আমি একহাতে চাদরটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কুয়াশায় মেটে রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে আছে। সাবধানে পা ফেলা লাগছে। বিদ্যুৎ এর হাতে লাঠি। প্রিয়াঙ্কা মুখচাপা দিয়ে হাসছে। আমি পাঁচগজ দূর থেকেই শুনলাম মিতাভাই ক্লাস এইটের বইয়ের পিথাগোরাসের উপপাদ্য আওড়াচ্ছে ‘কোনো সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল অপর দুই বাহুর ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রদ্বয়ের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান । ধরা যাক এ বি সি একটি সমকোণী ত্রিভুজ যার কোণ এ সমকোণ…।’ নির্ভুল বিবৃতি। কিন্তু সময়টা আর জায়গাটা পিথাগোরাস সাহেবের জন্য ঠিক নয়। তার মানে অবস্থা খারাপ। কতটা খারাপ অবস্থা, ভেবে আমি আতঙ্কিত হলাম।

আমি কাছাকাছি যেতেই জাবির লাফিয়ে উঠল ‘ধুর কাকে ধরিয়ে দিয়েছিস? যত্তসব পাগলের দল।’

‘কী হয়েছে? করেছিস কী?’

‘আমি কী করব? বলে ঘুম আসে না। ঘুম আসে না! হোটেলের বাইরে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। তাতেও নাকি ঘুম আসে না। আরেহ বাবা এমন লুতুপুতু হলে হয় নাকি? ঘুম আসে না। না আসুক একদিন ঘুম, কি অসুবিধা তাতে? ছোকরা একটা এসে প্রস্তাব দিলো প্রাইং চলবে নাকি? আসল জিনিস আছে নাকি তার কাছে।’

আমি বাধা দিলাম কথায় ‘প্রাইং কী?’

‘হাট? কথার মাঝে বাগড়া দিস শুধু। বিভিন্ন পাহাড়ি হার্বস টার্বস দিয়ে বানায় পাহাড়িরা একরকম এনার্জি ড্রিংক।’

‘এনার্জি ড্রিংক নাকি হার্ড ড্রিংক? মানে কী, মদ?’

‘হুম। ঐটাই। তবে রিফাইন করা না। আরও কড়া জিনিস।’

‘তাই তুই গিললি? আর মিতাভাইকেও খাওয়ালি?’

‘আরে ধুর! পাগল একটা!’

‘কী পাগলামি করেছে শুনি?’

‘দুনিয়ার কথা। ওইযে উপপাদ্য, সম্পাদ্য, ত্রিকোণমিতির সুত্র, ডিফারেন্সিয়েশন তো বুঝলাম, বাকি অংক তো মাথার উপরের এন্টেনা দিয়ে যাচ্ছে।’

‘তুইও খেয়েছিস? তুইও তো স্বাভাবিক নেই মনে হচ্ছে।’

‘আমি কি ওইরকম ননীর পুতুল নাকি? আমিও টেস্ট করেছি। কি হয়েছে তাতে?’

প্রিয়াঙ্কা হেসেই যাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। কাকে সামলাতে হবে বুঝতে পারছি না। জাবিরও যে হুঁশে নেই ওর কথায় সেটা স্পষ্ট।

‘শোন, যে মেয়ে এই মালকে ভালোবাসতে পারে তার সাথে আমার তিন তালাক। বুঝেছিস, এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক।’

‘তোর সাথে আমার বিয়ে হলো কবে?’

‘বিয়ে হয়নি প্রেম তো হয়েছে। প্রেমের তিন তালাক।’

‘প্রেম কবে হলো?’

‘ওই যা হয়েছে তারও তিন তালাক। ত আকার তা, ল আকার লা, ক, তালাক। তোকে ভালোবাসা আর বাঙ্গিফল প্রিয় বলে কচকচ করে খাওয়া একই কথা। খবরদার তুই আমাকে আর কখনো ডাকবি না।’

‘আমি কী করলাম?’

‘কী করেছিস? আবার চোপা করছিস? এইরকম ছিঁচকাদুনে, ক্যাবলা, রামগড়ুরের ছানা, হাট্টীমা টিম টিমকে ভালোবাসিস এইটা কি কম অপরাধ? শালার মাল একটা। সারারাত ভেউ ভেউ করে কানতেছে। কী, ঐন্দ্রিলা কি তোমাকে ভালোবাসে? আমি যত বলি না ভাই, আমার সাথে ওর ওইসব কিছু নাই। এই মাল তত বলে, না আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঐন্দ্রিলা কে হারিয়ে ফেলেছি। ওহ, মাথাটাই খারাপ করে দিলো।’

এদিকে মিতাভাই কাদার ভেতর বসে পা দোলাচ্ছে, আর ওদিকে জাবির তেড়ে আসছে প্রায় আমার দিকে, ঝগড়া করতে। দুটোর একটাও স্বাভাবিক না। কাকে কী করব ভাবতে না ভাবতেই জাবির লম্বা পা ফেলে নামতে শুরু করল। আমি প্রাণপণে পেছনে ডাকলাম ফিরে আসতে। এভাবে এতো রাতে হোটেলে ফেরা লাগবে না। কে শোনে কার কথা! আমি বিহবল অবস্থা সামলে নিয়ে মিতাভাইর দিকে নজর দিলাম।
সে অনেকটা সময় ধরে ঝিম ধরে আছে। আস্তে করে ডাকলাম, ‘মিতাভাই?’

সে তাকালো। ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়েই থাকলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়েছে এমনভাবে বললো, ‘ঐন্দ্রিলা? বস না পাশে? কী সুন্দর বাতাস?’
আমার হাত টান দিয়ে সেই কাঁদায় আমাকেও বসিয়ে দিলো।

‘ঘরে চলেন?’

‘ঘরে তো দরজা নেই।’

‘আছে। চলেন।’

‘না, আমি হারিয়ে ফেলেছি।’

‘চলেন, দুজনে মিলে খুঁজব।’

‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ।’

মিতাভাই রাজি হলো।
অনেক কষ্টে বিদ্যুতের সাহায্য নিয়ে মিতাভাইকে ঘরে আনলাম। সারা গায়ে কাঁদামাটি। সেসব পরিস্কার করার মতো ধৈর্য্য আমার আর নেই। আমি নিজে মুখে, মাথায় বরফঠান্ডা পানির ঝাঁপটা দিয়ে চুপ করে বসলাম বিছানায়। বিছানা ছাড়া আর কোনো বসার জায়গা নেই ঘরে। একটা আলনা আছে কাপড় রাখার জন্য। কিছু লাগলে কিনে নিতে হবে। আমি সময় পাইনি এখনো কেনাকাটার। নিজের কাপড় এখনো ট্রলিব্যাগে। মিতাভাইর ট্রলিব্যাগ জাবিরের কাছে, হোটেলে। নইলে কাপড় পালটে দিতাম। উটকো একটা গন্ধ পাচ্ছি। জাবিরের জন্য মন খারাপ করছে। পৌঁছাতে পারল কি ঠিকঠাক? এখানেই বা এসেছিলো কিভাবে?
ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে আমার। খাটজুড়ে মিতাভাই চারদিকে চার হাতপা ছড়িয়ে আছে। অনেকদিন আগেকার মতো আমি তার পায়ের কাছে একটুখানি জায়গায় গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ আসে খুব সুন্দর করে। সমান্তরাল আলোর রেখার মতো। শীতের অলসতায় ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে। আর আজ ছুটির দিন তাই অফিস করার তাড়াও নেই। ছুটির দিন দেখেই জাবির আর মিতাভাই একই সময়ে উপস্থিত হয়েছে আর দুদিক থেকেই আমাকে একেবারে হজবরল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমার তো এখন বাইরে যেতেও লজ্জা করছে। প্রিয়াঙ্কা এতক্ষণে সব ঘরে ঘরে গরম খবর পৌঁছে দিয়েছে।

এদের দুজনকেই আমার তিনহাজার একশো চৌদ্দ ফিট উঁচু তুমলং পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। মরুকগে দুটোই! সংকোচ ঠেলে দরজা খুলে বাইরে আসতেই সুন্দর সকাল চোখে ধাক্কা দিলো। রোদ ঝলমল করলেও দূর পাহাড়ে যেন কুয়াশা বাসা বেঁধে আছে এখনো। ওয়াহিদা চায়ের কাপ হাতে পাশে এসে দাঁড়ালো।

‘চা খাবে?’

‘না ফ্রেশ হইনি এখনো।’

‘যদিও আমার অধিকারের আওতায় পড়ে না বা তোমার সাথে আমার সম্পর্ক অতোখানি ক্লোজ না যে আমি তোমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু বলব। তবুও পাশাপাশি রুমে থাকছি, সব দেখতে পাচ্ছি এইজন্য বলছি, কিছু মনে করো না প্লিজ। আলফা মেল সিনড্রোম বলে একটা টার্ম আছে জানো? সাধারণত মেটিং সিজনে চিতাবাঘেরা ফিমেল পার্টনারকে এট্রাক্ট করতে নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন করে নিজেকে সেক্সুয়ালি বেস্টফিট প্রমাণ করতে যায়। পশুদের ক্ষেত্রে এটা শারীরিক শক্তির প্রদর্শন দিয়ে হলেও মানুষের ভিতর ভালোবাসা, প্রেম, সৌহার্দ্যর কম্পিটিশন হয়। সব আলফা পুরুষ নিজেকে সেরা প্রমাণ করে সঙ্গিকে জিতে নিতে চায়। কিন্তু একটা ব্যাপার কি জানো, ভালোবাসার শোডাউন হয় না। আলফা মেল ফিজিক্যাল ইন্টারকোর্স এর জন্য বেস্ট, কিন্তু মনের মানুষ কখনো সেরা হয় না, সে প্রিয় হয়। তার সমস্ত ভুলভাল, ভয়ংকর সব দুর্বলতা নিয়েই সে প্রিয়জন হয়। হোপ ইউ উইল টেইক এ ক্লিয়ার পাথ, রিপেন্ট করার মতো কিছু ভাববার বয়স আর আমাদের নেই, কী বলো? আহ, চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাই দ্য ওয়ে, তোমার ওই বন্ধুটি কিন্তু অনেকক্ষণ লনে বসে আছে।’

আমি সচকিত হয়ে তাকালাম। জাবির দুইহাত বুকের উপর ভাঁজ করে বসে আছে। আমার কান্না পেলো ওকে উদাস তাকিয়ে থাকতে দেখে। ফ্রেশ হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। মিতাভাই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। একবার কফসিরাপ খেয়ে হাসপাতালে নিয়েছিলো আমাদের গুষ্টিশুদ্ধ সবাইকে। এবারে এই হাবিজাবি খেয়ে আবার কতটা ভোগাবে কে জানে? তার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো বুকের ভেতর থেকে। ব্লাংকেটটা তার বুকের উপর তুলে দিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম জাবিরের মুখোমুখি হতে।

‘বাহ৷ ফাইন দেখাচ্ছে তো তোকে? নববধূ, ফুলসজ্যার লাজুক আভা চোখমুখ জুড়ে?’

প্রশংসা করলেও জাবিরের গলায় শ্লেষ। আমি চুপ করে থাকলাম। জাবিরই আবার বলল ‘তো কী ভাবলি? কী সিদ্ধান্ত নিলি?’

‘কী ভাবব জাবির? আমি তো কখনোই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলাম না। দ্বিধায় ছিলাম না।’

‘বাহ একরাতেই সব কনফিউশান দূর! ভ্যাবলা হলে কী হবে, বুড়ার এলেম আছে। একরাতেই পূর্ণ স্যাটিসফেকশন! তো, একডোজ নাকি সারারাত?’

আমার মনে হলো একটা কষে থাপ্পড় মারি ওর গালে। তারপর মারতেই থাকি। কিন্তু ওর ভেতর সেই আঠারোর উন্মাদ, মোহাচ্ছন্ন ছুটিকে দেখলাম, মনের ভেতরের একটা বদ্ধ জানালা খুলে গেলো। আমিও কি কনক আপার সাথে আলফা মেল যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম? তাহলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়াটাও তো মিতাভাইর দিক থেকে আমাদের সম্পর্ককে দেওয়া জাস্টিস ছিলো। আজ সেইরকমই ধাক্কা জাবির পাচ্ছে আমার কাছ থেকে। আমার আক্কেল হয়নি, ওর যদি হয়!

‘এইযে ভদ্রলোকের ব্যাগ। আমার কাছে তোর আর কোনো পাওনা নেই।’

‘ভালো থাকিস জাবির।’

ও দুইপা এগিয়ে আবার পিছনে ফিরলো ‘সত্যিই আমাকে দেওয়ার মতো কিছু নেই তোর? আমাকে ফিরতে বলবি না? আমার এতোদিনের অপেক্ষার কোনো দাম নেই? আসলে আমারই ভুল, সেকেন্ডহ্যান্ড মালকে জাতে ওঠাতে চেয়েছিলাম!’

আমি অবাক চোখে অপলক তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ও বলেছিলো আমার কাছে ওর কোনো আশা নেই। কিন্তু ওই নিরাশার ভেতর কোথাও ঘাপটি মেরে বিন্দু আশার অপেক্ষায় ছিলো ও। আজ মিতাভাইকে দেখে ওর সেই অবচেতন মনের আশাবাদী চিন্তা ধাক্কা খেয়েছে। আশাহত হয়ে ছটফট করছে আর আহত ব্যথার আক্রোশ মেটাচ্ছে এভাবে।
মানুষ ভালোবাসে কোনোকিছুরই আশা না করেই, ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসে। হৃদয় দিয়ে আগলে রাখে, পাবে না জেনেও সেই না পাওয়া মেনে নিয়েই ভালোবাসে। সেইখানে যদি অন্য কারো ঢুকে পড়ার বিন্দুমাত্র আভাস পায় তো সেই আগলে রাখা হৃদয়টাকেই সীমাহীন যন্ত্রণা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিতেও পিছু হটে না!

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জাবির নিজের ভুল বুঝতে পারল, চোখ নেমে এলো ওর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সোজা হেঁটে চলে গেলো। পাহাড়ি পথে ধীরে ধীরে ওকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম একটু একটু করে আর মন বিষাদে ভরে গেলো। শেষটা এমন তেতো করে না হলে কী হতো না? হয়তো হতো না। শেষ হতে গেলেই হয়তো সব বিষাক্ত হতে হয়। কিছুক্ষণ রোদ পোহালাম আমি। জাহানারা নামে একটা বাঙালি মেয়ে আছে, রাঁধাবাড়া করে আমাদের। দুবার ডেকে গেছে। খাবার দিয়েছে ঘরে। আমার খিদেতেষ্টা লোপ পেয়েছে। তবুও আস্তেধীরে টেনে টেনে ঘরে এলাম। মিতাভাই এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় বসে তার দিকে তাকিয়ে চুপ করে ভাবছি আমি, আমাদের ভেতর তিক্ততা কি আরো বাকি আছে? সেটুকু সম্পূর্ণ করতেই কি তার হঠাৎ এই আগমন?

*****
মিতাভাই উঠল বিকেলশেষে। উঠে কতক্ষণ মাথা চেপে ধরে বসে থাকল। আমাকে বলল ‘মাথাটা একটু টিপে দেতো? ভার হয়ে আছে। চুলগুলো টেনে দে না?’

‘আমি ছোটো নেই মিতাভাই। আমার সাথে আহ্লাদী করবেন না। আর মাথায় চুল আছে যে টেনে দেব?’

‘তোর সাথে ছাড়া কার সাথে আহ্লাদী করব? একটামাত্র বউই তো তুই।’

‘জোর করে মজা করার চেষ্টা করছেন? এসব বিটকেলে ডায়লগ আপনার সাথে যায়না। মনে হচ্ছে মদের ঘোর কাটেনি এখনো। যান তো, তাড়াতাড়ি করে ঝুপঝাপ মাথায় পানি ঢালেন আর এই বোঁটকা গন্ধের কাপড় ছেড়ে বাইরে গিয়ে বসেন। এমনিতেই যে এম্বেরাসিং সিচুয়েশনে ফেলেছেন আমাকে, একটু তো ইমেজ রিকভার হোক।’

দুপুরের খাবার সন্ধ্যেয় শেষ করে অনির্বান দাদা, ওয়াহিদা, দীপায়ন, অনন্য আর অজন্তার সাতে চায়ের আড্ডায় বসলাম। সন্ধ্যা মিলাতে মিলাতে দীপায়ন, অনন্য আর অজন্তা নিজেদের বাড়ি চলে গেলো। অনির্বান দাদা আর ওয়াহিদাও দুটো একটা কথা বলে বিদায় নিলো নিজেদের ঘরে যাওয়ার জন্য। খোলা জায়গায় শীতে জুবুথুবু হতে হতে মিতাভাই জিজ্ঞেস করল ‘তুই কি অন্য কাউকে পছন্দ করিস?’

আমি কড়াচোখে তাকালে সে একটু থমকে গেলো। তারপর আবার বলল ‘দেখ আমি হয়তো ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলতে পারি না। সম্পর্কগুলো খুব জটিল মনে হয় আমার কাছে, তাই কোনোদিন সম্পর্কে জড়াতে চাইনি। তুই কি জাবিরকে নিয়ে কিছু ভাবছিস? ফ্র‍্যাঙ্কলি বলতে পারিস। এরকম হতেই পারে। দোষের কিছু না।’

‘অবশ্যই দোষের। নিজে নিজের প্রথম প্রেম ভুলতে পারেন নি বলে আমাকে দিয়ে সেই কাজটা করিয়ে নিতে চাইছেন? আপনি পেরেছেন তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে যে এখন জাবিরের সাথে জড়াতে চাইছেন আমাকে? সম্পর্ক জটিল লাগে? ভং যত্তসব। তো কনক আপার সাথে সম্পর্ক হলে সেটা ঢেউটিনের মতো সোজা হয়ে থাকত বুঝি?’

‘ঢেউটিন কী সোজা?’ চিন্তিত দেখা গেলো মিতাভাইকে। ‘কিন্তু কনক কে?’

‘কনক কে মানে? কনককে চেনেন না? মিথ্যে বললে ভালো হবে না একেবারে!’

‘না সত্যি বলছি। কনক কে? আর তোর আমার কথার ভেতর কনক এলো কোথা থেকে?’

‘মানে, সিরিয়াসলি? কনক আপাকে চিনছেন না আপনি? যার জন্য কফসিরাপ গিলেছিলেন, আমাকে বিয়ে করে ফেললেন যাকে বদনামের হাত থেকে বাঁচাতে?’

মিতাভাই সুন্দর করে হাসলো ‘আহ ওই কনক? আমাদের সামনের বাড়ির মোকাররম সাহেবের মেয়ে? হ্যা তো? আর কফসিরাপ খেয়েছিলাম তো ঘুম আসছিলো না বলে। তখন থিসিস করছিলাম। ভালো ঘুম না হলে মাথা কাজ করবে না তাই রাকিব বলল কফসিরাপ খেলে ঘুম আসবে! কাশি হচ্ছিলো বলে কফসিরাপ কেনা ছিলো ঘরে। এখানে কনক আসবে কেন?’

‘তবে? হাসপাতালে বসেই আমাকে বললেন কেন আপনাকে বিয়ে করতে?’ আমার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না।

‘সে তো তুই বলেছিলি, আমার জন্য কনকের বদনাম হবে, ওকে শশুরবাড়ি অত্যাচার করবে সবাই। আর তুই তখন এমন ভয় দেখালি যে আমি কিছু ভাবতেই পারছিলাম না। এমনিতেও সাধারণ সাংসারিক বুদ্ধি আমার নেই। অংক আর লজিক ছাড়া আর কিছু আমার মাথায় সহজে ঢোকে না। আর তোর লজিকও দারুণ ছিলো! আমার নির্দোষ কফসিরাপ খাওয়াতে কারো বিরাট ক্ষতি হবে, সেটা কিভাবে হতে দিতাম?’

‘তবে কারণে অকারণে আপনি যে কনক আপার কথা বলতেন, ওর পরীক্ষা পাশের কথা, এটা সেটা! ছাদে দাঁড়াতেন, জানালায় দাঁড়ান ওকে দেখতে!’

‘তা তো মনে নেই আমার। হয়তো কথার পিঠে বলতে পারি। আর নিজের জানালায় দাঁড়ানো যাবে না?মিজবাউল বলে, তুই অসম্ভব কল্পনাপ্রিয়। এমন অনেক কিছু ভেবে নিস যা আদৌ ঘটেইনি।’

‘মিজাভাই বলে?’

‘দেখ, আমি বেশি কথা বলতে পারিনা বা ঠিকঠাক করে বুঝাতেও পারি না। কিন্তু তোর সাথে আমার খোলামেলা কথা হওয়াটা খুব দরকার। সেই সবটুকু তোকে বলা দরকার যার পরে কল্পনা করে নতুন কোনো লাইন আর তোকে তৈরি করতে হবে না। তাই আমি এখানে এসেছি। আর দেখ, কত কথা বলছি। কাল থেকে যত কথা বলেছি আমি, আমার সারাজীবনের কথা মেলালেও কি এতো হবে, বল?’

আমি ডানেবাঁয়ে মাথা নাড়লাম।

‘ঐন্দ্রিলা? অনেক কিছু না বলার কারণে একটা বড় গ্যাপ হয়ে গেছে। কিছুটা আমার বুঝাতে পারার অযোগ্যতা বা অনিচ্ছা, কিছুটা তোর বেশি বোঝা বা ভুল বোঝাতে। আমি সবকিছু বলতে চাই, বুঝতে চাই, তোর কাছ থেকে শুনতে চাই। সমাধান না হোক, খেদ থাকবে না। আমি কত বেশি কথা বলছি, তুই একটু আমায় বলতে দে শুধু।’

চলবে…

afsana asha
(কপি করা যাবে না)

(এক পর্বে শেষ করা গেলো না। আগামী পরশুদিন শেষ পর্ব ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here