চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ১১

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ১১

এই সম্পর্কহীন সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই আর। আমার জন্য না, মিতাভাইর জন্য। আমাকে বললে আমি আজীবন তার নামটা আমার নামের সাথে যোগ করে চলতে পারব, কোনোরকম প্রত্যাশা ছাড়াই। কোনো অধিকার, দাবি ছাড়াই। একবার ভুল করে অধিকারের সীমানা পার করে ফেলেছিলাম, তার শাস্তি আমি পেয়েছি। আমি জানি মিতাভাই আমাকে কেন ডাকছে, কী জরুরি কথা তার! আমি সব জানি। সব ছাড়ার তরীতে আমিও পাল উড়িয়ে দিয়েছি। তবু এই অপ্রিয় আলোচনা চাইছিলাম না। নিরব প্রস্থান চেয়েছিলাম। মিতাভাই নিজের মুখে বলবে তার সাথে আমার বিচ্ছেদের কথা, এ আমি চাইনি। এই চাওয়াটা আমার। কিন্তু মন বলে অন্য কথা। মন বলে ‘মিতাভাই আমি আপনার বিরহ বুকে নিয়ে আমৃত্যু আপনাকে ভালোবাসার বৈধ দাবিদার হয়ে থাকতে চাই। এইটুকু দেবেন না?’

মন আর চেতনার লড়াইয়ে আমি বিধ্বস্ত হই আমি, চেতনাকে জিতিয়ে দিয়ে। মিতাভাই তার জীবনে সত্যিকারের সঙ্গীর অপেক্ষায় আছেন। আমি পথের কাঁকর, গলার কাঁটা। আমাকে গিলতে পারেননি কোনোদিনই, এখন উগরে দিতে চাইছেন। ঠিকই তো, আমার জীবন থেমে আছে। তার তো আগাতে হবে। বড়চাচি তো বলল, বউ,বাচ্চা – পুরো সংসার। আচ্ছা সেই বউ কি তাকে আমার চাইতে বেশি ভালোবাসবে। পারবে আমার চাইতে বেশি চাইতে?

আবার মন ঘুরে যাচ্ছে। মনের ভিতর সবসময় দুটো স্রোত বয়। তাকে আমি মন থেকে দূরে সরাতেও চাই আবার আঁকড়ে নিতেও চাই।

প্রতিসেকেন্ড গুণতে পারছি আমি। অনেক কঠিন সময় গেছে আমার, মিতাভাইকে ভালোবেসে। যেদিন থেকে ভালোবাসা বুঝলাম, প্রেম টের পেলাম সেদিন থেকেই সে আমার মাথায় আনাগোনা করে, দিবানিশি অহর্নিশ! আমি খেতে পারতাম না। ঘুমাতে পারতাম না। কারো সাথে দুটো ভালো করে কথা বলতে পারতাম না। ভয় পেতাম কেউ আমার চোখের দিকে তাকালেই আমার এই মাতাল প্রেম টের পেয়ে যাবে। নামাজে বসে দুহাত তুলে আকুল হয়ে মোনাজাত করতাম ‘হে আল্লাহ, মিতাভাইকে আমার করে দাও, আমি পাঁচশো নফল রোজা রাখব, প্রতিদিন একশো রাকাত নফল নামাজ পড়ব, একশো এতিম খাওয়াবো!’ বিধাতাকে ঘুষ দিয়ে হলেও যেন তাকে পেতে চাইলাম আমি, আর কোনো রাস্তা সামনে খোলা ছিলো না। তাকে ভালোবাসি এইকথা সামনাসামনি বলার সাহসও তো ছিলো না। আর সবকিছুও ছিলো প্রতিকূলে। মিতাভাই বয়সে কত বড়, বড়বোনদের বিয়ে হয়নি, আর যাকে ভাই ডাকি তাকে বর করার মতো নির্লজ্জ চিন্তা মাথায় আসে কী করে? মিতাভাইকে কোনোদিন বলা হয়নি ভালোবাসি। আজ শেষবেলা একবার কি বলব? নাহ, কী লাভ বলে। আল্লাহ তো দিয়েছিলো তাকে আমার ঝুলিতে ভরে। আমিইতো নির্বোধের মতো সব পেতে চাইলাম। নাকি মানতের নামাজ-রোজা করে দেইনি বলে সব হারালাম? আচ্ছা, পাঁচশো রোজা করতে কতবছর লাগে? না, এগুলো সব আমার সেই কিশোরী মনের বাতুলতা, বাস্তবে নামাজ, রোজা শুধুই স্রষ্টার নিকটবর্তী করে ভক্তকে। কাউকে পাওয়া না পাওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মিতাভাইকে তো আমি কোনোদিন পাইই নি, তবে হারানোর প্রশ্ন কেন আসবে? সে তো কনক আপাকেই চাইত। এখনো হয়তো তাই চায়। কনক আপা আর তার স্বামীর বাড়িতে ফিরে যায়নি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। এখানেই থাকে এখন। অনলাইনে স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট আর বিউটি প্রডাক্টের শপ আছে। সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবেও বেশ পপুলার। কোনো না কোনো ব্রান্ডের হয়ে লাইভ করছেই প্রতিদিন।

তাকেই হয়তো ফিরিয়ে নেবে আবার মিতাভাই। আচ্ছা, ডিভোর্সি মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে দিতে বড়চাচির আটকাবে না? সমস্ত সমস্যা কী আমার সাথে? মায়ের সাথে পাল্লা চলে বলেই কী আমি বাদে অন্য যেকোনো মেয়েকে মেনে নিতে পারেন তিনি? নাকি মিতাভাই আমাকে চায়না জেনেই আমাকে ঘৃণা করেছেন বড়চাচি? কনক আপাকে মিতাভাই ভালোবাসে, সেই হয়তো বুঝিয়েছে বড়চাচিকে। ম্যানেজ করাটা কি খুব সহজ হয়েছে? নাকি অনেক শক্ত ছিলো? এতোটা কষ্ট তো অনেক ভালোবাসলেই করা যায়! অনেক ভালোবাসে মিতাভাই, কনক আপাকে? তাই বুঝি আমাকে দূর করার জন্য এতো ব্যস্ত! জরুরি তলব?

এতো কেন ভালোবাসে মিতাভাই কনক আপাকে? ভালোবাসতে না জানা মানুষটাও এতো কিভাবে ভালোবাসে? অল্প কথার মানুষ ছাদে দাঁড়িয়েও তো কত কথা বলল আমার সাথে! ভালোবাসা এভাবেই বদলে দেয় সবাইকে…

বিয়েবাড়ি। চারিদিকে আত্মিয় পরিজন, প্রতিবেশি, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত লোকে গিজগিজ করছে। বড়চাচার ঘর ভরাও লোক। এর ভিতর মিতাভাই আমাকে মিটিংয়ের জন্য ডেকেছে। প্রি ডিভোর্স সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট! বাঃ, ভালো তো টার্মটা। আমাকে রক্তাক্ত করে তারপরেই মিতাভাই শান্ত হবে। আমি আসতে চাইনি, কথা বলতে চাইনি এসব নিয়ে, তাই বলেছিলাম মিজাভাইকে। জানতে চেয়েছিলাম ‘আমার যাওয়াটা ঠিক হবে,মিজাভাই?’ মিজাভাই স্বভাবসুলভ ঝাঁড়ি মেরেছিলো ‘সেটা তুই ঠিক করবি। এখনো কী তুই নাইনটিনে আটকে আছিস যে আমি তোকে পথ দেখাব! অবশ্যই কথা বলবি। আমার তো মনে হয় তুই এখন যথেষ্ট পরিণত আর স্ট্রং মানসিকতার মেয়ে। মিতাভাইর প্রতি বলে ছক্কা পিটাবি। তোরই তাকে বোল্ড আউট করার চান্স বেশি, বান্দা তো মুখ থেকে কথা বের করতে করতেই কট বিহাইন্ড হয়ে যাবে হাহাহা।’

আমি সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিলো ‘ছুটি, যারা অল্প কথা বলে তাদের মুখের কথায় মন জানা যায় না, মনের কথা তারা বলতেই পারে না, জানেইনা বলতে। চোখের ভেতর দিয়ে তাদের মনকে পড়তে হয়।’

মিজাভাইর অনেক কথাই আমি বুঝি না।

দোতলায় বড়চাচার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। আজ কয়েকদিন ভাড়াটিয়া পরিবারগুলো ছাড়া আমাদের সব ঘরের দরজাই খোলা। অনেক জোড়া জুতা খোলা দরজার সামনে। তার মানে ভিতরে অনেক মানুষ। দরজার বাইরে স্লিপার জোড়া খুলে আস্তে করে ঢুকলাম। চারবছর পরে ঢুকলাম এই বাসায়। একদম আগের মতো আছে সবকিছু। কোনো জানালায় পর্দা নেই। সোফাগুলো এলোমেলো করে রাখা। দেয়ালে ছোটো ওয়ালমেটগুলো বাঁকা হয়ে আছে। কোণায় কোণায় মাকড়সার জাল। বড়চাচি ঠিক বলে, তার বয়স হয়েছে। ঘরের শ্রীবৃদ্ধিতে কোনো ভূমিকা আর তিনি নিতে পারছেন না। তার ঘরে বউ দরকার। আমি শুধু শুধু কাগুজে বউ হয়ে সম্পর্কটা জবরদখল করে আছি। এবারে সরে যাওয়াই সমীচীন। সব পরিচিত মুখ ভেতরে। বড়চাচির বাপের বাড়ির আত্মিয়রা, পিউ আপার শশুরবাড়ি থেকে আসা লোক, আমার মামা, খালা আর কাজিনরা। মেজচাচির আত্মিয়রা অনেকেই আছে এখানে। বড়চাচি আমাকে দেখে মুখ কালো করে ফেললেন। আমাকে দেখলেই তার দুই ভুঁরুর মাঝখানে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে যায়। আমি কথা বললাম না আর, সোজা আমার সেই ঘরটার দিকে চললাম। মনে হচ্ছে অনেক পথ। শরীরের উপর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পাখির পালকের মতো ওজনহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। মিতাভাইর ঘরে ঢুকতেই দেখলাম সে সেই বাগানবিলাসের আড়ালে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে। মূহুর্তে যেন নিজেকে ফিরে পেলাম। ছুটির আড়াল থেকে ঐন্দ্রিলা বেরিয়ে এলো। ‘ইনফাইডেল’, সৌম্যসুন্দর মুখের পেছনের মানুষটাকে গালি দিলাম। যতই অনাকাঙ্ক্ষিত আর অপছন্দের হোক না কেন – বিয়ে তো বিয়েই! আমার সাথে সব চুকেবুকে যাওয়ার আগেই সে কিভাবে অন্য কারো জন্য ব্যকুল হয়? আর তার জন্য মরি আমি! ছিঃ! মুখটা তেতো হয়ে গেলো। এই প্রথম মন থেকে ঘৃণা করলাম আমি মিতাভাইকে!

দরজায় টুক টুক করে আঙ্গুল দিয়ে আওয়াজ করলাম। মিতাভাই ঘুরে তাকালো, হাসলো। সুন্দর করে বললো ‘এসেছিস? কখন থেকে ডাকছি!’

তার বলা প্রতিটি শব্দ আমার কানে আগুন দিলো যেন। হায়, একসময় একটা কথা শোনার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। আমি যেন হারানো সব শক্তি ফিরে পেলাম, সাথে সাথে সেন্সও। এই ঘরটাতে থেকেই কীসব পাগলামি ছাগলামি করেছি সব চোখের উপর ভেসে উঠে আমাকে খুব লজ্জা দিতে থাকল। কতটা ছোট করেছিলাম নিজেকে! আচ্ছা, তখন কি আমি আমাকে দেখতে পেতাম না? সত্যিই তো, এমন নির্লজ্জ আর বেহায়াপনা আমি কি করে করেছিলাম?

খোলা জানালার বাতাসে শীত করছে। শালটা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম আমি। মিতাভাই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে লক উঠিয়ে দিতে গেলেই আঁতকে উঠলাম আমি।

‘আহা, করেন কী? দরজা দিচ্ছেন কেন?’

মিতাভাইকে বিব্রত দেখা গেলো। মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন ‘বাড়ি ভরা লোক, কে কখন না কখন ঢুকে পড়ে?’

আমি হাত চাপা দিয়ে হাই তুললাম। ‘বাড়িভরা লোক বলেই তো। কে, আবার কী ভেবে বসবে! আমাদের এতো কোনো কনফিডেনসিয়াল কথাও তো কিছু নেই। আহ দরজাটা খুলে দেন না, আমার সাফোকেশন হয়।’

বোকার মতো তাকিয়ে থেকে দরজাটা খুলে রেখেই সামনের চেয়ারে এসে বসে মিতাভাই আস্তে করে বললো ‘তো, কী করবি এখন?’

‘আমি? এইতো, ছোটোখাটো চাকরি একটা পেয়েছি। দেখি আর কী করা যায়!’

‘কই আমাকে তো বললি না?’

আমি উত্তর দিলাম না। মনে মনে বললাম, মিতাভাই আমার কথা শোনার সময় আর ইচ্ছে কোনটাই কী কোনোকালেই ছিলো আপনার? এখন কথা শুরু করার জন্যই কথা বলা।

‘কী চাকরি?’

‘প্রফেসর নিতিন রয় গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তাকে এসিস্ট করব।’

‘কোথায় পোস্টিং?’

‘রাঙামাটি। ওখানে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে একটা ক্লাবের প্রকল্প চলমান আছে স্যারের। সেখানেই যাচ্ছি এখন।’

মিতাভাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।

‘এনজিও? কিন্তু ঢাকায় তো আরও ভালো কিছু করতে পারতি?’

‘ঢাকায় থাকতে ইচ্ছে করছে না। যখনই শুনলাম রাঙামাটি, ওমনি পাহাড়, ভাসা মেঘের আকাশ, স্বচ্ছ পানির অগভীর নদী আর একদল সরল মানুষ চোখের উপর দেখতে পেলাম, যাদেরকে ভালোবাসা দিলে তারাও বিনিময়ে ভালোবাসবে, ফিরিয়ে দেবে না কখনো। তাই আর না করার প্রশ্নই আসেনি।’

‘কবে যাবি?’

‘কাল বুবুর বিয়ে। পরশুদিন আমি যাবো।’

‘কিভাবে?’

‘কিভাবে মানে?’

‘এভাবে কিভাবে যাবি?’

‘আপনার প্রশ্ন আমি বুঝিনি মিতাভাই। বুঝিয়ে বলেন। আর একটু তাড়া করে বলেন। শীতের রাতে আমার ঘুম পায় আগে আগে। আর আপনারও তো ঘুমের সময় হয়ে গেছে।’

মিতাভাই খোলা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না। হয়তো কথা গোছাচ্ছে। ভাবছে আমার জন্য কঠিন হবে কীনা কথাগুলো। তাই এতো ইতস্ততা। আমি হাসলাম মনে মনে। সব কঠিন কথা শোনার জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি আমি। যোদ্ধা যেমন অস্ত্রসজ্জায় সেজেও ঢাল নেয়, শিরস্ত্রান পরে।

মিতাভাই কথা বলছে না দেখে আমি টুক করে ঘরটা ঘুরে নিলাম। আমার গোলাপ আলমারির গোলাপের পাঁপড়িতে হাত বুলালাম। দরজাটা টান দিলাম। ক্যাঁচক্যাঁচ করল কিন্তু খুলল না। ‘এটার চাবি কোথায়, মিতাভাই?’

‘তোর কাছেই তো!’

‘এক্সট্রা ছিলো তো!’

‘জানিনা।’

‘লক খুলিয়ে নেননি কেন?’

‘আমি ভেবেছিলাম তুই আসবি।’

বুকে ধাক্কা লাগল যেন আমার। ‘আচ্ছা আমি চাবি দিয়ে যাব। আমার কিছু জিনিসও আছে এটাতে।’

আমি আবার চেয়ারে এসে বসলাম। শালটা দিয়ে গলা, বুক ভালো করে ঢেকেঢুকে বসলাম। কোনোভাবেই যেন আগের সেই বেহায়া ছুটি বেরোতে না পারে।

‘মিতাভাই, সময় কম। ঘুমে পড়ে যাচ্ছি আমি। তাড়াতাড়ি করে বলেন।’
মিতাভাইর অল্প কথা বলাটা আজ খুব বিরক্তি ধরালো আমাকে।

‘ঐন্দ্রিলা, তোর মনে হয় না, আমরা একজায়গায় থেমে আছি। সবকিছু পেছনে ফেলে আমাদের আগানো দরকার?’

আমি উত্তর দিলাম না, চুপ করে থেকে উঠে পড়লাম। আসলেই তো আমার জন্য দুটো জীবন আটকে আছে, এক হতেই পারছে না।
ঘুরতে ঘুরতে জানালার কাছে গেলাম আমি। বাগানবিলাসের পাতা হালকা হয়ে এসেছে। এখন অনেকটা কম কষ্টে কনক আপার জানালা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো লাইট জ্বলছে ভিতরের ঘরে। কোনো প্রডাক্টের লাইভ প্রোমোশন হচ্ছে হয়তো৷ রাউন্ড স্টান্ডেও আলো জ্বলছে। কনক আপাকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও, তার ছায়া অবয়ব দেখা যাচ্ছে। প্রেমিক পুরুষের জন্য প্রেমিকার ওই কায়াই যথেষ্ট। আমি হুট করে বললাম ‘কনক আপার আবার জীবন শুরু করা উচিত। তাই না, বলেন? শুধুশুধু কষ্ট পাচ্ছে বেচারি। মাঝখানের আপদটা বিদায় হলেই বেঁচে যায় সে! নতুন উদ্যোমে এগোতে পারে, নতুন করে বাঁচতে পারে।’

মিতাভাই কিছু বললেন না। মাথা নাড়লেন শুধু। মাথা নাড়তে নাড়তেই বললেন ‘অনেকটা সময় চলে গেছে। তুইও বয়সে, বুদ্ধিতে ম্যাচিউরড হয়েছিস, আমি যা বলছি বুঝছিস তো?’

আমি জোরে জোরে মাথা নাড়লাম বাধ্য ছাত্রির মতো। আস্তে আস্তে বললাম ‘ভাববেন না। আমি সব ঠিক করেই এসেছি। সব ঠিক করে দেব এবার। আর ভুল হবে না। সব সুন্দরমতো হবে।’

মিতাভাই সুন্দর করে হাসলেন। ‘তাহলে বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে কয়টাদিন পরে যা রাঙামাটি।’

‘আমার যাওয়াতে কোনো অসুবিধা হবে না, মিতাভাই। কোনো ঝামেলা রেখে যাব না আমি, ঠিকাছে? আর যদি আরও লাগে আমাকে তবে না হয় ছুটি বাড়িয়ে নেব। আর দরকার পড়লে রাঙামাটি থেকেও আসতে পারব। বাংলাদেশেই তো থাকছি, অন্য কোনো দেশে তো না, যে দরকারে আসতে পারব না!’

আনন্দে মিতাভাইর চোখ চকচক করতে লাগল। আমার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য তার এতো আনন্দ? একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখলাম ফুসফুসের ভেতরে।

‘আমি যাই এখন। কথা তো ফাইনাল হলোই। সব ব্যবস্থা করে ফেলব আমি।’

মিতাভাই মাথা নাড়ল। আমি বেরোতেই বলল ‘উপরে তো অনেক মানুষ থাকছে। জায়গা হচ্ছে? তুই দোতলায় থাকতে পারিস তো?’

আহ, দয়া দেখানো হচ্ছে আমাকে! আমার থাকার অসুবিধা ভাবা হচ্ছে? আমি আস্তে করে বললাম ‘দেখি? আপনার জন্য পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। দেওয়া হয়নি। আমি নিয়ে আসছি। আর আলমারির চাবিটাও খুঁজে দিয়ে যাচ্ছি।’

‘তাড়াতাড়ি আসিস। আমি অপেক্ষা করব…।’

আমি হাতঘড়িটার দিকে তাকালাম, ঘন্টার মোটা কাঁটাটা বারোটা ছুঁয়েছে। সামনের সবকিছু লাথি মেরে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করল আমার।

আমি উপরে এসে সোজা ঘুমাতে চলে গেলাম, পিউ আপার হাতে মিতাভাইর জন্য কেনা পাঞ্জাবিটা ধরিয়ে দিয়ে। মিজাভাইর চোখে জিজ্ঞাসা, জাবিরের কৌতুহল কিছুই পাত্তা দিলাম না। কাল বুবুর বিয়ের অনুষ্ঠান। ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান হয়তো হবে বা হবে না। কিন্তু আমার বোনের বিয়ে তো বারবার হবে না। আমার একটা সাউন্ড স্লিপ দরকার। এখানে এদের মাঝে বসে থাকলে আমার ঘুম তো হবেই না, এরা কারণে অকারণে আমার আর মিতাভাইর প্রসঙ্গ টেনে আনবে। যেমন, কেউ যদি শিপু আপার পরিচয় জেনে বলে বিয়ে কবে তো মিজাভাই সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলবে ‘এই ছুটি আর মিতাভাইর জন্যই তো আমি ঝুলে আছি। মিলার পরেই ছুটির সিরিয়াল, আর এদিকে বড়ভাই হিসেবে মিতাভাইর সিরিয়াল। মাঝখানে আমি মন্দিরের ঘন্টা। যে পারে একটা বাড়ি দিয়ে যায়। এরা দুটো বিয়ে করে নিলেই আমি বিবাহিত জীবন শুরু করতে পারি।’

আদতে, নির্দোষ কথাবার্তা, এবং যে কেউ স্বাভাবিক ভাবেই নেবে। কিন্তু উদ্দেশ্য তো আমি জানি। আমাকে রক্তাক্ত করে এসব কথা। আহত আমি ব্যথায় উহ করতেও ভুলে যাই। মাঝেমাঝে মিজাভাইকেও আমার রক্তমাংসের দলা মনে হয় যার হৃদয়টা পাথরের তৈরি, শুধু সংকোচন প্রসারণে রক্ত পাম্প করাই এর কাজ। নইলে আমার জন্য সহানুভূতির কমতি হতো না কারোই। এর চেয়ে ঘুমাতে যাওয়া ভালো।

বিয়ের অনুষ্ঠানে মিতাভাই আমার কেনা পাঞ্জাবিটাই পরল! আমাকে স্বান্তনা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে যেন। আমার আরো মেজাজ খারাপ হলো। নীল রঙের পাঞ্জাবির গলায় ছাইরঙা সুতোর কাজ – তাকে দেখতে অসাধারণ লাগলেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। শরীর থেকে কেটে ফেলে দেওয়া নখের মতো বাতিল আর বিশ্রী! মসৃন, পলিশ করা নখ যতক্ষণ শরীরের অংশ থাকে ততক্ষণই সুন্দর, নেইল কাটারের এক চাপে তা বিশ্রী আর নোংরা আবর্জনা। আমার জীবন থেকেও তাকে বাতিল করে দিয়েছি। তবুও মরার চোখ চুম্বকের মতো সেদিকে টানছে আর বিতৃষ্ণায় আমি বিড়বিড় করছি ‘বাতিলুন, বাতিলুন, বাতিলুন!’ মানে মিতাভাই আপনি বাতিল, বাতিল, বাতিল!’

আজকাল বিয়েতে ফটোগ্রাফি, সিনেমাটোগ্রাফি নামে যেগুলো হয় তা কোনো সিনেমার চাইতে কম না। হিরোর মতো বরের এন্ট্রি হয়, রাজকন্যার মতো ঢোকে বঁধু । তারপর বউকে কোলে নিয়ে, বুকে নিয়ে, পিঠে বেঁধে হাজারটা ঢঙের ছবি। এর ভেতর সেলফি কর্ণার, ফটোবুথ – হাজাররকম করে ছবি তোলা। বরের সিঙ্গেল, কণের সিঙ্গেল হাজারটা, কাপল ছবি, ফ্যামিলি পিক। বোনেদের সাথে ছবি, বান্ধবিদের সাথে ছবি! কে যেন ফটোগ্রাফারদের বলে দিয়েছে আমাদের ছবি তোলার জন্য। কে আবার কী? অবশ্যই মিজাভাই। ফটোগ্রাফার নানারকম ভাবে মিতাভাইকে নানান পোজ দিতে বলল। মিতাভাই তাদের কথা শুনে সত্যি সত্যি হাসিমুখে এমনকি আমার হাতও ধরল! আমার একটুও ভালো লাগল না। তাকে আমি ভালোবেসে চেয়েছিলাম, লোকদেখানো ছবি তোলার জন্য নয়।

সাতদিনের ছুটি, আমি পাঁচদিন কাটিয়েই রাঙামাটি পাড়ি দিলাম। তবে বড়চাচিকে সব বলে, বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। স্পষ্ট করে বলে এসেছি, তাদের পথ আমি ছাড়লাম। যা যেভাবে মন চায় তারা করতে পারে। আমাকে প্রয়োজন হলে, খবর দিলেই চলে আসব…

চলবে…

afsana asha

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here