চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা পর্ব ১০

#চাতকের_তৃষ্ণা_তুমুল_বর্ষা – ১০

জাবিরের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। আমার দিক থেকে ওকে কোনোরকম আশা দিইনি বা ধোঁয়াশাও রাখিনি। পরিস্কার করে বলে দিয়েছি আমার মনের আনা কানা গলিতেও অন্য কারো বসবাস আর নামে নামে হলেও অন্য কারো বিবাহিতা স্ত্রী আমি। তবুও কোন আশায় আমাদের বাড়ি এসে উঠেছে বুঝছি না। সৌজন্যবোধে মৌখিক দাওয়াতটুকু দিয়েছিলাম শুধু বুবুর বিয়েতে আসার জন্য, একেবারে জুড়ে বসবে সত্যি সত্যিই তা একেবারেই ভাবিনি। আর বাড়ির সবাই ওকে খুব আপন করেও নিয়েছে, শুধু বড়চাচা বাদে। বড়চাচার কী হয়েছে জানিনা, সে জাবিরকে সহ্যই করতে পারছে না। কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য আমাদের দুজনকে তলব করা হয়েছে।

বড়চাচার দোকানে গেলাম আমি জাবিরকে সাথে নিয়ে। চাকরি ছাড়ার পর এই দোকানটা বড়চাচার অবসরের সঙ্গী। আমি দোকানে ঢুকতেই দুইপাশের সাটার নামিয়ে দিয়ে বজ্রকঠিন হুংকার ছাড়লেন ‘ছুটি?’

আমি হেসে ফেললাম বড়চাচার পাকানো চোখ দেখে। আমার হাসিতে বড়চাচা বিব্রত হলেন। আরও রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে কঠিন করে বললেন ‘এই ছেলে কে?’

আমি সহজ গলায় বললাম ‘আমাদের পূর্বপুরুষ যখন বানর ছিলো তখন নাকি আমাদের আস্ত একখানা করে লেজ ছিলো। সবার লেজ খসে গেছে, আমারটা আমার পেছনেই ঘোরে। এইটা হচ্ছে আমার সেই ল্যাজ, বড়চাচা।’

বড়চাচা বিভ্রান্ত হলেন। আবার ধমকে উঠলেন ‘ঠিক করে বল?’

‘বড়চাচা, সাদেকের কুলফি খাবো। এখন পাওয়া যায় না?’

‘চোপ? আগে প্রশ্নের উত্তর দে?’ দোকানঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলেন আবার বড়চাচা। জাবির পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমি হাই তুলে বললাম ‘কে আবার? বন্ধু হয়। জাবির আবার বন্ধু বড়চাচা!’

‘কেমন বন্ধু?’

‘বন্ধু আবার কেমন হবে? বন্ধুর মতোই। ভালো বন্ধু। পরীক্ষার সময় নোটফোট করে দেয়। ঘুম পেলে ওর কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যাই। টুকটাক কাজটাজ করে দেয়। কথা শোনে ভালোমতো৷ ঘুরতে গেলে সিকিউরিটির কাজ করে। এইতো! একটু বোকা তো, ভাঙানো যায় সহজে!’

আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম জাবিরের মুখটা সত্যি সত্যি বোকাবোকা হয়ে আছে।

‘আমাদের বাড়িতে ছেলেমেয়ে বন্ধুত্ব এলাও না, সেইকথা তুই জানিস না?’

‘আমাদের বাড়িতে না, বড়চাচা, বলেন আমার জন্য না। এইবাড়িতে সব এলাও। পিউ আপার বিয়েতেও তো আমার সব বন্ধুরা এসেছে, মিজাভাইর বান্ধবীরা এসেছে। বুবুর বন্ধু-বান্ধবী মিলেই তো পনেরো জন ছিলো পিউ আপার বিয়েতে। আমার সাথে জ্যোতি আর নওমি নামে দুটো মেয়েও এসেছে। শুধু জাবিরকে নিয়ে আপনার সমস্যা হলো কেন?’

‘সমস্যা দেখেছি বলেই সমস্যা মনে হচ্ছে। এখন কি তোর কাছে আমার জবাবদিহি করতে হবে যে কেন আমার সমস্যা মনে হলো?’

‘বড়চাচা আপনি চিৎকার করবেন না। আপনি চিৎকার করেন বলেই সবাই আপনাকে ভয় করে আর সবকিছু জটিল করে ফেলে। সেইদিন আপনি যদি আমার পাগলামোতে সাপোর্ট না করতেন তো আজ সবকিছু এরকম অস্বাভাবিক হতো না! আপনার অকারণ চিৎকার ভয় পেয়েই কেউ সেদিন আপনার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি, কোনোদিন পারেও না।’

আমি যেন সবকিছুতে বড়চাচাকেই দায়ী করলাম। মানুষ যখন নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারেনা তখন তার দায় অন্য কারো মাথায় চাপিয়ে নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বড়চাচার মুখ কালো হয়ে গেলো। আস্তে করে বললেন ‘ছুটি, এখন এটা আমার দোষ? আমি ওই গাধার বাচ্চারে দেখতেছি, ওর কী সমস্যা তাও দেখতেছি!’

‘না বড়চাচা, আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু এখনো আপনি স্নেহে অন্ধ আচরণ করছেন। আপনি জাবিরকে দেখে ভাবছেন, আমি আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। শুধু শুধু ওকে অপমান, অসম্মান করছেন। এমন কিছু না। আমি সবসময় আপনার কাছাকাছি থাকব যেন প্রতিদিন আপনি আমাকে ডাব খাওয়াতে পারেন।’

‘তুই মিথ্যে বলছিস ছুটি। আমাকে, নিজেকেও। তুইতো দূরে যাচ্ছিস, আবার পালাচ্ছিস। নইলে এতোদূরে চাকরি নিয়ে যেতি না।’

আমি বড়চাচার কথায় চোখ নামিয়ে নিলাম। কুলফি চলে এসেছে। এই কুলফির লোভে সেদিন পর্যন্ত আমি দিনে তিনবার বড়চাচার দোকানে এসে বসে থাকতাম। টনসিলের ব্যথা বাড়লে বড়চাচা রামধমক দিতেন কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে হাজারটা বকুনি দিতেন, তারপর ব্যথা সেরে গেলে আবার কুলফির বায়না ধরতাম। না পেরে বড়চাচা সাদেকের কুলফির দোকান এখান থেকে উঠিয়ে নিজখরচে মোড়ের মাথায় বসিয়ে দিয়েছিলেন।

‘কিন্তু এই গাধার সমস্যা কী? ও জানে তোর সবকিছু? তাও তোর পেছনে ঘুরছে কেন?’ বড়চাচার হঠাৎ প্রশ্নে জাবিরের মুখ থেকে কুলফি পড়ে গেলো। আমি হেসে বললাম ‘ও বাস্তবতা বোঝে না বড়চাচা। পাগলামির বয়স লাগে না। আমি আঠারোতে যে ভুল করেছিলাম, ও পঁচিশেও এসে সেই পাগলামি করছে। লোকে বৃথাই টিনেজকে দোষে! ও জানে না, কাগজে কলমে হলেও, পাগলামি করে হলেও আমি বিবাহিত। সমাজে আমাকে মানানসই করা একটা বিপ্লবের সমান। ওর বাবা মার জন্য একটা ডিভোর্সি মেয়েকে পুত্রবধূ করা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার হবে। ওসব কিছু ও ভাবছেই না। কিন্তু জীবনে চলার পথে আসন্ন সব সম্ভাবনা হিসেব করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাতে আবেগকে আশ্রয় করা চলে না।’

‘তুই তো অনেক বড় হয়েছিস। বড় বড় কথা বলছিস। তুই পেরেছিস, সব ভুলে যেতে?’

আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। আমার চোখের অশ্রু আমি কাউকে দেখাতে চাইনা, না জাবিরকে, না বড়চাচাকে! আমি কিছছু ভুলিনি, আহত যন্ত্রণা আমাকে প্রতিমূহুর্তে কুরে কুরে খায়। আমি অনেকটা পথ চলেছি, অনেকটা হেঁটেছি কিন্তু এক বিন্দুও আগাইনি।

আমি বেরিয়ে আসার সময় বড়চাচা খুব আস্তে করে বললেন ‘বড় দোষ দিলিরে ছুটি, বুড়োমানুষটাকে, সেদিন আমি যদি সাপোর্ট নাও করতাম, তুই কি থেমে যেতি?’

বড়চাচাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য খুব অপরাধবোধ হলো। তার চোখের দিকে না তাকিয়েই বললাম ‘হয়তো থামতাম না, তবে অতটা ডেসপারেটও আর হতাম না; ক্ষণিকের ধোঁকাবাজিতে মিতাভাইও মনে হয় আমার ফাঁদে পা দিতো না। একটা না পাওয়া থেকে যেতো আমার, সেটা তো এখনো আছে কিন্তু অপমানিত হতাম না বড়চাচা। ছোটরা ভুল করে, আমি ভুল করেছি। আপনি আমার ভুলে সায় দিয়ে গেছেন আর অন্যরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। কেউ আমার ভুলটুকু ভালোবেসে বুঝিয়ে দিতে আসেনি। রাগ করেছে, বকেছে কিন্তু কেউ বোঝেনি আমার মনকে। আমার একটা শক্ত হাতের খুব দরকার ছিলো। কেউ আসেনি তখন। একজন এসেছে, কিন্তু অনেক পরে। তার জন্যই হয়তো এতোখানি পথ চলেছি, নইলে জানিনা আরও অনেক বড় ভুল করে ফেলতাম হয়তো বা!’

*****

মেইন ব্রাঞ্চ অফিস থেকে পাঁচদিনের ছুটি নিয়েছি আমি। শুক্র শনি মাঝখানে ফেলে সাতদিন। মকর সংক্রান্তিও পড়বে মাঝে। বুবুর হলুদের আগেরদিন। পাঁচবছর পরে বাড়িতে আমার সাকরাইন। তবে আগের মতো ঘুড়ি ওড়ানো, ফানুস জ্বালানোর কেউ নেই। আমরা সবাই বড় হয়ে গেছি। সাকরাইন ছোটদের উৎসব! আশেপাশের বাড়ির ছাদে অবশ্য ছেলে-বুড়ো সবার উপস্থিতি আছে। রঙ বেরঙের ঘুড্ডি মাথার উপরে। কী সুন্দর রঙিন আকাশ!

আমি ছাদে এসে দাঁড়িয়েছি। বিকেলের শেষবেলাটা। কনক আপাদের ছাদে নতুন মানুষ। নতুন ভাড়াটিয়া হয়তো। ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরেই নানারকম শারীরিক কসরত করছে আমাকে দেখিয়ে। বয়স কম, কলেজপড়ুয়া হয়তো। দূর থেকে আমার বয়স বোঝা যাচ্ছে না সম্ভবত তাই ফ্লার্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি খুব মজা পাচ্ছি।

মিতাভাই এসে পাশে দাঁড়ালো। আমি তাকালাম। মিতাভাইকে বয়স্ক দেখা যাচ্ছে। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, চশমার পাওয়ারও বেড়েছে। আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

শাড়ির আঁচল ছাড়া ছিলো, ভালো করে জডিয়ে নিলাম আবার। একগাল হেসে, চোখের উপর নেমে আসা চূর্নকুন্তল কানের পাশে গুঁজে দিয়ে বললাম ‘ভালো আছেন, মিতাভাই?’

‘তুই ভালো আছিস, ঐন্দ্রিলা?’

আমার কেমন করে উঠলো সারা শরীরে। আমার এই নামটা প্রথম শুনলাম যেনো। পাত্তা দিলাম না নিজের এই অনুভূতিকে। মিতাভাই আবার বললেন ‘তুই কি উপরেই থাকছিস? তোর সাথে কথা ছিলো আমার।’

‘আস্তে মিতাভাই। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ানতো।’ মিতাভাইর কথা যেনো শুনলামই না আমি। একটু ঘাড় কাত করে সামনের ছাদের ছেলেটার দিকে চোখ টিপলাম।

মিতাভাই মনে হয় আমার কাণ্ডে অবাক হলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন ‘কী করছিস তুই? চিনিস ছেলেটাকে?’

‘ধুরো, চিনতে হবে কেন? অল্পবয়সী ছেলে একটা। যতসব পাগলের দল। কলেজে উঠেই সিনেমার হাওয়া লাগে এদের। প্রেম প্রেম লাগে সবসময়। বেহায়া আর নির্লজ্জ হয় খুব এই বয়সের ছেলেমেয়েরা, জানেন? তাই মজা করলাম একটু। শিক্ষা পাওয়ার দরকার আছে এদের। দুদিন পেছন পেছন ঘুরাবো, আকাশে উড়বে এরা তখন, তারপর কষে এক থাপ্পড় মেরে মাটিতে আছাড় মারব।’

আমি যেন আমার জীবনের গল্পটাই বলে দিলাম পুরোপুরি। মিতাভাই কি বুঝলো সেসব? না বুঝুক বা বুঝুক, কিছু আসে যায়না। তবে মুখ কালো হয়ে গেলো তার। মাগরিবের আজান পড়ছে। মাথায় কাপড় দিয়ে বললাম ‘মিতাভাই নামাজ পড়িগে, আপনি থাকেন।’

মিতাভাই চটপট করে বললেন ‘তোর সাথে কথা ছিলো তো?’

‘বললাম তো কথা?’

‘আরও কথা আছে আমার।’

‘আরও?’

‘আজকে রাতে আমার ঘরে আসবি একটু? বা আমি আসি তোর ঘরে?’

‘আজকে তো হবে না মিতাভাই। আমরা আজকে মেয়েরা সবাই একসাথে ঘুমাবো। বুবুর হলুদে কার কী পারফরম্যান্স সব ঝালাই হবে আজকে।’

‘তবে কালকে?’ ব্যাকুলতা মিতাভাই’র গলায়।

‘আমাদের কাউকেই বুবুর বিয়ে পর্যন্ত ফ্রি পাওয়া যাবে না মিতাভাই। এইযে ফাঁকি দিয়ে ছাদে এসেছি, পিউ আপা পেলে মারবে আমাকে। আচ্ছা আসেন নিচে, আমরা এখন হলুদ বাঁটব। আপনি চটপট করে বলে ফেলবেন কী বলতে চান।’

‘সবার মাঝে হবে না। তোর সাথে আমার আলাদা দরকার।’

কিন্তু আপনার সাথে আমার কোনো দরকার নেই মিতাভাই, কিছু দরকার নেই, মনে মনে বললাম আমি। ছাদের গেইট থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললাম ‘মিতাভাই? সবার জন্য গিফট এনেছি আমি। আপনার জন্যও এনেছি। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার পছন্দ হবে।’

মিতাভাই হাসলেন, সেই সুন্দর দেবদূতের হাসি, ‘আমার জন্য?’ বলে আবার ডাকলেন ‘ঐন্দ্রিলা?’

আমার বুক ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসতে চাইল কিন্তু এবারে আর তার ডাক শুনলাম না। বুক চেপে ধরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে এলাম।

নিচে নেমে এসে অনেকটা সময় আমি স্থানু হয়ে বসে রইলাম। অনেকদিন পরে মিতাভাই কতগুলো কথা বলল আমার সাথে। কত সুন্দর করে জানতে চাইল কেমন আছি আমি। কত সুন্দর করে ডাকল আমায় ‘ঐন্দ্রিলা?’ এখনো কানে রিনরিন করে বাজছে মিতাভাইর কন্ঠ। চারিদিকে যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে ‘ঐন্দ্রিলা?’ আমি শুনব না এই ডাক। আমার পায়ের নিচে অনেক সাধনায় জমা করা পলির স্তর যেন ভেসে যাচ্ছে এই সামান্যতেই। কান চেপে বালিশ ধরে কেঁদে ফেললাম আমি।

‘ছুটি?’ বড়চাচি এসে ডাকলেন আমাকে। মুখ তুলে, চোখ মুছে, উঠে বসলাম। বাড়িতে এসেছি তিনদিন হলো, বড়চাচির সাথে সেভাবে কথা হয়নি, শুধু একটু কুশল জিজ্ঞাসা ছাড়া। গত চারবছরেও বড়চাচির সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি মিতাভাইর সাথে দেখা হওয়ার ভয়ে দোতলায় যাইনি। বড়চাচিও আমাকে এড়িয়ে গেছেন। আজ নিজের থেকেই এসেছেন।

‘কেমন আছো, মাগো? অনেকদিন পর দেখলাম তোমারে। সুন্দর হইছো, বড় হইছো আগের চাইতে। শাড়িও পরো দেখি। তোমার মায়ের শাড়ি এইটা না? সুন্দর শাড়িটা।’

‘বসেন বড়চাচি। ভালো আছেন আপনি?’

‘কই আর ভালো? ডায়াবেটিস, প্রেশার সবই বাড়তির দিকে। খাওয়াদাওয়া বাদই, একদম খাইনা এখন। তাও দুইবেলা ইনসুলিন নেওয়া লাগে। হাত পায়ে জোর পাইনা। দুর্বল লাগে। রান্নাবাড়া করতে ইচ্ছা করে না। তোমার বড়চাচা শুধু চিল্লায়। ছেলেটারেও ঠিকঠাক খাবার দিতে পারিনা। যত্নআত্তি করতে পারি না।’

‘ঠিক হয়ে যাবেন, চিন্তা করবেন না।’

‘সে চিন্তা করিও না। ছেলেপেলে মানুষ করে ফেলেছি। এখন ছেলের বউরা আসবে, নাতিপুতি দিয়ে ঘর ভরে যাবে। মিজা বড় ডাক্তার হয়ে গেছে। আমার এখন বয়স হয়েছে। রোগশোক থাকবেই। মিজা সামলায় নিতে পারবে। কিন্তু মাগো, আমার সংসার যে ভেসে গেলো! তুমি তো আগাও ও না পথও ছাড়োনা! এক আজাইরা বিয়া আর আজাইরা বউ। আবার শুনতেছি, চাকরি করতে যাবা। তা এইভাবেই কি ঝুলায়া রাখবা? তোমার বড়চাচার মাইয়া নাই সে তোমারে মাইয়ার মতো ভালোবাসছে সবসময়। আমিও তোমার খারাপ চাইনা। তুমি পড়াশোনা করছ। বিদ্যাবুদ্ধি আছে। এইবার একটু বিবেক করো মা। মিজারও তো বিয়ের বয়স যায় যায়। তারেও তো বিয়া করাইতে হবে। তা তার নাকি পছন্দের মেয়ে আছে। সেই মেয়ে ডাক্তার। সমান সমান। সমান সমান না হলে সংসার করা যায়না। বিদ্যাবুদ্ধি, বয়সেও কাছাকাছি হওয়া লাগে। তুমি মনে কষ্ট নিও না, আমি কিন্তু তোমার কথাও ভাবছি। তোমারও সংসার, বাচ্চাকাচ্চার দরকার আছে তাই না? একটু বুইঝা, ব্যবস্থা করো মা।’

আচ্ছা, এই তবে ব্যাপার। বড়চাচি যে কারণে এসেছেন মিতাভাইরও আমার সাথে সেই দরকার। তিনি হয়তো সংকোচ করেছেন, নিজে মুখে বলতে পারেননি। তাই বড়চাচিকে পাঠিয়েছেন। আমাদের সেই ভুল বিয়েটার সমাপ্তি ঘোষণার অনুরোধ এনেছেন। বেশ, আমিও তো তাকে মুক্তি দিতেই চাই। তবুও তার দুটো কথায় আকাশপাতাল ভেবে বসেছিলাম! হায়, মন! সোনার পাথর বাটির স্বপ্ন দেখতে মনে হয় কোনোদিন ক্লান্ত হবে না! এমন কোনো অস্ত্র কেন তৈরি হয়নি যা দিয়ে বেহায়া মনটা কেটে কুচো করা যায়, বোম মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায়!

‘বেশ বড়চাচি। আপনি ভাববেন না। আমি আর কাউকে আমার জন্য কষ্ট পেতে দেব না।’

‘ভালো। দোয়া করি, তোমার মতিগতি ঠিক হোক! সুখে থাকো! তুমি মনে কিছু নিও না। আমি কিন্তু তোমার ভালোর জন্যও বললাম। মিলারও বিয়ে হয়ে যাইতেছে। তোমার সাথে আসছে ছেলেটা, শুনলাম তোমাদের সম্পর্কে। বেশ ভালো ছেলেটা কিন্তু!’

আরও একরাশ দোয়া আর শুভেচ্ছা মিলিয়ে মিশিয়ে আমার কপালে চুমু দিলেন বড়চাচি!

*****

ঠান্ডা পড়ছে বেশ। গায়ে একটা শাল জড়িয়ে ঘর থেকে বাইরে এলাম। হলুদ বাটাবাটি চলছে। পাঁচজনে বসে গেছে হলুদ বাটতে। এই হলুদ বরের বাড়ি যাবে। পিউ আপার মেয়ের পেট খারাপ হয়েছে। সে মন খারাপ করে বসে রয়েছে, বরের বাড়ি যেতে পারবে না বলে। সতেরো হাজার টাকা দিয়ে নাকি দুটো লেহেঙ্গা কিনেছে হলুদে পরবে বলে, এখন বরের বাড়িই যদি না যেতে পারে তবে সেই লেহেঙ্গা দিয়ে ও কী করবে? কাঁদল কিছুক্ষণ। এখন আমার পেছনে লেগেছে আমিও যেন না যাই। আমরা তিনবোন, তিনবোনের একসাথে থাকার মাহাত্ম্য, আনন্দ বোঝাতে থাকল আমাকে। বাধ্য হয়ে আমিও গেলাম না।

বসার ঘরে বুবুকে নিয়ে গোল হয়ে বসেছি আমরা। আমি, বুবু, পিউ আপা, জ্যোতি, নওমি, জাবির সবাই ফ্লোরে বসে গল্প করছি। মিজাভাই ফোন করেছিলো, রওনা হয়ে গেছে, রাতেই পৌঁছে যাবে। ওর গার্লফ্রেন্ডও আসছে সাথে। শিপু আপা। দারুণ একটা মেয়ে। প্রায় মিজাভাইর নামে নালিশ করতে ফোন করে আমাকে। মিজাভাই নাকি সারাক্ষণ মেয়েদের নিয়ে সার্কাজম করতে থাকে, এইসব হাবিজাবি কথা হয় আমাদের।

পিউ আপাকে আমাদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ দিয়ে দুলাভাই ওর মেয়ে সামলাচ্ছে। আমরা পিউ আপাকে ক্ষেপাচ্ছি ‘এতো প্রেম?’

পাঁচতলায় নতুন ভাড়াটিয়া পাখি ভাবি, বিজ্ঞের মতো রায় দিলেন ‘যে মেয়েদের নাক ঘামে সেই মেয়েদের বরেরা বউপাগল হয়।’

‘এসব ফালতু কথা, সে তো আমাদের ছুটিরও নাক ঘামে, তা ওর বর কই ওকে ভালোবাসে?’ মুখ ফসকে কথাটা বলেই বুবু আমার সামলে নিলো ‘ওর তো বিয়ের ফুলই ফুটল না, এখনো।’

‘হুম এবারে আমাদের ঐন্দ্রিলার বিয়ের সানাই বাজবে, তাই নারে জাবির?’ নওমি পিঠ চাপড়ে দিলো জাবিরের।

জাবির গভীরচোখে তাকালো আমার দিকে। সেই মিনতিভরা দৃষ্টি! আমি পুরোপুরি উপেক্ষা করলাম ওকে আর এই শীতেও ঘেমে ওঠা নাকের ডগা শাড়ির আঁচলে মুছে নিলাম!

নওমি ফুট কাটলো ‘আমাদের ইলার তো পছন্দ কাসৌটির রিশভ বাজাজকে। ওই বুডডা এখন কই পাবো আমরা?’

জাবির হেড়ে গলায় গেয়ে উঠলো ‘বুড়া হইলাম তোর কারণে…!’

পিউ আপাও যোগ দিলো ওদের সাথে ‘তোমাদের ইলার পছন্দ বরাবরই হটকে, ছোটবেলায় কসম সে নাটক দেখে সেই বুড়া নায়কের উপরও ক্রাশ ছিলো ওর!’

হেসে গড়িয়ে পড়ল সবাই। জ্যোতি হেসেকেশে বলল ‘সিরিয়াসলি ইলা, ওই পেটমোটা রাম কাপুর?’

‘কসম সের রাম কাপুর মোটেও পেট মোটা ছিলো না। আর পরে ভুড়ি বাড়লেও আরও কিউট হয়েছে!’ আমি যুক্তি দেখালাম আমার পছন্দের পেছনে।

জাবির নিজের পেট মেপে বলল ‘ইলা, আর কত ইঞ্চি হলে আমাকেও তোর কিউট লাগবে?’

আমি রেগে গেলাম।

জাবিরকে এবার কঠিন করে বোঝাতে হবে আমাকে। ছেলেটা বাড়াবাড়ি করছে। নিজের ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। ওর মাঝে আমি পাঁচ বছর আগের সেই অপরিণামদর্শী ছুটিকেই দেখতে পাচ্ছি৷ আমি ওকে নিয়ে ভাবছি না। কোনোদিন ভাবব কীনা জানিনা। আবার অন্য কাউকে নিয়েও তো ভাবতে পারি! জগতে কিছুই তো স্থিতিশীল না। মন না হাওয়াই মিঠাই – এই খেয়াল আছে তো এই মিলিয়ে যাবে! আগে শুধু মনকেই শুনেছি এবারে সব পিছুটান মুক্ত হয়ে, শান্ত হয়ে, মন আর মস্তিষ্কের সমন্বয় করে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবো। আগের থেকে কাউকে ঠিক করে, পুরোনো জাল ছাড়াতে যাওয়া ঠিক না। না ওটা ছাড়তে পারব পুরোপুরি, না এটা আঁকড়ে ধরতে পারব ঠিকঠাক!

দশটার আগে আগে মিজাভাই ঢুকলেন
শিপু আপাকে নিয়ে। মিজাভাইকে দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। জীবনের খাদের কিনারা থেকে আমাকে টেনে এনেছে সে। কিন্তু সেইকথা মিজাভাই স্বীকার করে না। সে বলে, আমি নাকি অবচেতন মনে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো, মন তৈরি ছিলো মিতাভাইর কাছ থেকে দূরে সরার জন্য তাই মিজাভাইর কাউন্সেলিং খুব দ্রুত এডপ্ট করেছি। নইলে অবসেসড লাভ বা ইনফ্যাচুয়েশন স্টেজের কেউই কারো ঝালাই ফালাই নাকি শোনে না। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।

ইনফ্যাচুয়েশন – বাংলায় কী বলে এটাকে? মোহ? কই আমার তো মোহ না। মোহ হলেতো কবেই কেটে যেতো। আমার তো এখনও শিরশির করে শরীরটা মিতাভাইর পাশে দাঁড়াতেই। মিজাভাই ঢুকতেই যখন বলল ‘ছুটি? দৌঁড়ে নিচে যা তো, মিতাভাই ডাকছে তোকে!’ তখনওতো দুটো হার্টবিট পরিস্কার মিস করলাম আমি।

‘মিতাভাই? সে যায়নি হলুদ নিয়ে বরের বাড়ি?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।

‘গিয়েছিলো, চলে এসেছে নাকি? যা তো কী বলে দেখ। জরুরি নাকি?’ চোখ মারল মিজাভাই।

পিউ আপা, বুবু, জাবির সবগুলো চোখে অবাক জিজ্ঞাসা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। আমি উঠে সিঁড়িঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আশ্চর্য, সিঁড়িটা কোনদিকে? আমি খুঁজে পাচ্ছি না কেন?

চলবে…

afsana asha
কপি করা যাবে না

(আমি সচেতনভাবে গল্পে কোনো শিক্ষনীয় মেসেজ রাখি না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা গল্প পড়ে কেউ কিছু শেখে না। যদি শিখত তবে টেক্সট বইগুলো পড়ার পরেও এতো এতো নীতিবোধবিবর্জিত মানুষ পাওয়া যেতো না। তবুও কিভাবে কিভাবে আমার মিরু, আনন্দিতা, মিষ্টি, জিনিয়া বা তিথির কাছ থেকে মেসেজ চলে আসে নাকি পাঠক খুঁজে নেয় আমি জানিনা। আমি লিখি শুধুই বাস্তবতার কঠিন হিসেবনিকেশ থেকে পাঠককে একটু ছুটি দিতে, শুধুই নির্মল বিনোদনের জন্য। আমার জিনিয়ার গাঁজাপাতার ভর্তার গল্পে একটু হাসলেন বা মিষ্টির গল্পে একটু কাঁদলেন! ছুটির গল্পটা আমি টিনেজের একদম কমন প্লটে লিখেছি, আগেই বলেছি এ সব মেয়ের গল্প। ছুটিকে লিখতে গিয়ে একসময় মনে হচ্ছিলো আমি কি একটু বেশি লিখে ফেলছি কীনা! অন্তত বিশটা ইনবক্স আর অসংখ্য কমেন্টে পাঠক আমাকে জানিয়েছেন তারা পুরোপুরি ছুটির মতো করে ভাবেন, ছুটির মতোই জীবন তাদের। অনেকে অপেক্ষা করে আছেন গল্পে ছুটির পরিণতি দেখতে। তারপর তারা নিজেদের জীবনে সিদ্ধান্ত নেবেন। অনেকে নিজের টিনেজ বোন, বান্ধবি, মেয়েকে মেনশন করে গল্পটা পড়তে বলেছেন। সাদামাটা গল্পটা সর্বোচ্চ শেয়ার হয়েছে। পাঠক, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি। ভয় পাচ্ছি, যেন কাউকে মিসলিড না করি। গল্পের পরিণতি আর জীবনের গল্প এক হয়না। গল্পের শেষটা লেখকের হাতে, আমি পরিকল্পনা অনুযায়ীই সমাপ্তি টানব। কিন্তু জীবন আলাদা। তার ব্যাপ্তি আলাদা। যদি এইগল্প থেকে কিছু শিখতেই চান তবে মিজাভাইর ওইটুকু কথা শুধু শিখে নিন, আমরা বাঁচার জন্য খাই, বাঁচার জন্য নিঃশ্বাস নিই, বাঁচার জন্য ভালোবাসি, ভালোবাসার জন্য বাঁচি না। তবে ভালোবাসা না পেলে মরব কেন?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here