চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ৩৯

0
397

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৩৯

🍂🍂🍂

দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমেছে। সূর্যের আলো জানালা দিয়ে সারা ঘরময় জুড়ে। কেবিনের সোফায় তিলোত্তমা শুয়ে আছে। হয়তো বসে থাকতে থাকতে চোখ লেগে এসেছে। বেডে শুভ্রতা শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

~তোমাকে আমি কতবার বলেছি আমার হয়ে যাও। দেখলে তো এখন তোমার কি হাল।

পরিচিত কণ্ঠ কানে বাজতেই শুভ্রতা চোখ মেলে তাকালো। সামনে সকাল পকেটে দু হাত গুজে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি। শুভ্রতা বহু কষ্টে উঠে বসলো। সকাল দাড়িয়ে দেখছে তাকে।

~আপনি যা ই করেন না কেনো। এই শুভ্রতা আপনার হবে না।
~আহনাফ চন্দ্রের জন্য রিজেক্ট করছো আমাকে?
~চন্দ্র না থাকলেও আপনার মত মানুষকে কখনো আপন করতাম না আমি। আর না কখনো করবো।
~তোমাকে ভালো ভেবেছিলাম আমি। তুমি তো দেখছি বেশ স্বার্থপর। নিজের বান্ধবীর ভালোবাসাকে কেড়ে নিয়ে বসে আছো।

শুভ্রতা এবার নিঃশব্দে হাসলো। বললো,

~আদৌ কি আমি তাকে কেড়ে নিয়েছি? নাকি সে নিজেই আমার সাথে বাঁধা পড়তে চায়।
~এতটাও স্বার্থপর হয়ে উঠো না শুভ্রতা। আহনাফকে মুক্তি দাও। আমি এখনও তোমায় চাই। তুমি ওকে ছেড়ে আমার কাছে চলে আসো। আমি তোমাকে রানীর মত করে রাখবো।
~আপনার অন্ধকার রাজ্যের রানী হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আপনি এখান থেকে যান।

সকাল ক্রোধান্বিত হলো। কালো চশমার আড়ালে থাকা রক্ত চক্ষু শুভ্রতার দেখা হলো না। সকাল নির্দ্বিধায় বেশ সুন্দর। ফর্সা গায়ের রং, চেহারার আদলও সুন্দর। যে কোনো মেয়ে দুর থেকে দেখলেই হয়তো তার প্রেমে পড়বে। কিন্তু তার মন তো কুৎসিত। দুর থেকে যেমন প্রেমে পড়বে, কাছে গেলে তেমনি ঘৃণায় মুখও ফিরিয়ে নিবে। এমন মানুষের সাথে দু চারদিন প্রেম করতে পারলেও সারাজীবন সংসার করা অসম্ভব। সব ধরনের নেশাই সকাল করেছে। রোজ মদ না খেলে তার দিন যায় না। রাস্তায় মেয়েদের টিজ করে বেড়ায়। প্রাক্তন এমপির ছেলে বলে কেউ সাহসও করতে পারে না ওকে কিছু বলার। সকাল শুভ্রতার পায়ের কাছে বসতেই শুভ্রতা ফট করে পা সরিয়ে নিলো। সকাল মুখ চেপে হাসলো। শুভ্রতার চোখে ঘৃনা স্পষ্ট। এই চাহনিতেই সকাল নিজের মন হারিয়ে বসেছে।

~আপনার নাম সকাল হলেও আপনি মানুষটা অন্ধকারে ঘেরা। আমি কেনো, কোনো মেয়েই চাইবে না আপনার সাথে নিজের জীবন জুড়তে। এখনও সময় আছে সকাল। ভালো হয়ে যান।
~তুমি আমার হয়ে যাও শুভ্রতা। আমি তোমার জন্য পৃথিবী ছাড়তেও রাজি। আমি নেশা এসব ছেড়ে দেবো। শুধু তুমি আমার হয়ে যাও।

শুভ্রতা নড়েচড়ে বসলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একবার তিলোত্তমার দিকে চাইলো। মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। গত কয়েকদিন ধরে শুভ্রতার সাথে এখানেই থাকছে। শুভ্রতা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো।

~আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না সকাল। এমন মিথ্যা বলে এই পর্যন্ত তিনটে বিয়ে করেছেন। একটা বিয়েও ১ মাসের বেশি টিকেনি। এখন আমার পেছনে পড়েছেন। আপনার মত মানুষ কখনো ভালো হবার নয়।
~আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি শুভ্রতা। তুমি শুধু আমার হয়ে যাও। আমি সত্যি ভালো হয়ে যাবো।
~আপনার মত মানুষকে বিয়ে করার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।
~শুভ্রতা…
~গেট আউট!

শুভ্রতার চিল্লানোর আওয়াজ শুনে তিলোত্তমা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। কেবিনে অচেনা এক ছেলেকে দেখে অবাক হলো। শুভ্রতার চিল্লানোতে সকালও ভড়কালো। সে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা বিরক্ত হয়ে তিলোত্তমাকে বললো অরণ্যকে ডাকতে। সকালের রাগ উঠলেও নিজেকে শান্ত করলো। বললো,

~চলে যাচ্ছি। তবে তুমি আমার না হলে আমি আর অন্য কাউকে বিয়ে করবো না শুভ্রতা।
~যাক, আলহামদুলিল্লাহ্। কোনো মেয়ের জীবন বাঁচবে এই উসিলায়।

সকাল হন হন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। সকাল যেতেই শুভ্রতা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। খেয়াল করলো নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। হাত বাড়িয়ে বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে দ্রুত নাক চেপে ধরলো। তিলোত্তমার দৃষ্টি এখনও দরজার দিকে। শুভ্রতা সন্তপর্নে রক্তমাখা টিস্যুটা ময়লার ঝুড়িতে ফেললো। শুভ্রতা ডাকলো তাকে। তিলোত্তমা শুভ্রতার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো তবে চোখ তার দরজার দিকেই।

~ওদিকে চেয়ে আছিস কেনো? ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে নাকি?
~বাজে কথা রাখতো! আগে বল এই লোক কে?
~রুপার পার্টনার।
~মানে কি?

শুভ্রতা মুচকি হাসলো। প্রত্যুত্তর করলো না। তিলোত্তমা পাশের চেয়ার টেনে বসলো।

~আহনাফ ভাইয়ার সাথে রুপাকে কেমন মানাবে রে তিলো? সুন্দর না?

হটাৎ এমন প্রশ্নে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো তিলোত্তমা। কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,

~এটা আবার কেমন প্রশ্ন?
~ওদের খুব মানাবে। একদম পারফেক্ট জোড়া। ভাবছি অরণ্য ভাইয়া কে বলে রুপার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো আহনাফ ভাইয়ার বাসায়।
~আর আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করবো। তাও খুব বাজে ভাবে। (চন্দ্র)

তিলোত্তমা আর শুভ্রতা দরজার দিকে তাকালো। চন্দ্র আর মাহতাব এসেছে। তিলোত্তমা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও শুভ্রতা একদম স্বাভাবিক।

~কেনো প্রত্যাখ্যান করবেন ভাইয়া? রুপা যথেষ্ট সুন্দরী আর ভালো মেয়ে।
~সে কতোটা ভালো তা আমার জানা আছে। আর কোন জন্মের ভাই হই আমি তোমার?
~বান্ধবীর হবু বরকে ভাইয়া বলবো না তো কি বলবো? ভাইয়া…

চন্দ্র রাগী দৃষ্টিতে মাহতাবের দিকে তাকাতেই মাহতাব তিলোত্তমাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

~চলো তমা। সারাদিন ভাবির সাথে বসে থাকো। না নিজে প্রেম করো আর না আমার ভাই ভাবীকে। এভাবে থাকলে আমার আর বিয়ে হবে না। চলো দ্রুত।

তিলোত্তমা আর শুভ্রতা হা করে মাহতাবের কান্ড দেখছে। মাহতাব যেতেই চন্দ্র দরজা আটকে শুভ্রতার গা ঘেঁষে বসলো। শুভ্রতা যথাসম্ভব দূরে সরে বসলো। ভাবখানা এমন যেন তার পাশে জ্বলন্ত কয়লা রেখে দেওয়া হয়েছে। একদিকে শুভ্রতা হাসফাস করছে অন্যদিকে চন্দ্র চুপ করে ফোন টিপছে।

~ভাইয়া আপনি চেয়ারে গিয়ে বসুন। এখানে দুজন মানুষের বসার যথেষ্ট জায়গা নেই।

কথা শেষ করতেই চন্দ্র তাকে কোলে বসিয়ে নিলো। শুভ্রতার চোখ এবার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার পালা। সে নামার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলো। চন্দ্র অনেকক্ষণ পর ফোন রেখে শুভ্রতার দিকে তাকালো।

~সমস্যা কি তোমার?
~আমাকে ছাড়ুন।
~আমাকে ছেড়ে কোথায় যেতে চেয়েছিলে?
~অলরেডী দুই থাপ্পড় খেয়েছি। গাল দুটোই রিজার্ভ হয়ে গেছে।আপনি আর থাপ্পড় মারতে পারবেন না। চাইলে মাথা ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করতে পারেন। যেনো এক বারিতেই টাটা বায় বায় হয়ে যাই।

চন্দ্র শুভ্রতাকে শক্ত করে চেপে ধরতেই শুভ্রতা চোখ মুখ কুচকে নিলো। সে যে এক সপ্তাহ আগে অ্যাকসিডেন্ট করেছে সেই খেয়াল কি নেই চন্দ্রের? শুভ্রতা মুখ ফুটে বললো,

~ব্যাথা পাচ্ছি।
~প্রাপ্য তোমার। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাওয়ার প্ল্যান করেছিলে তার উত্তর দাও।
~আপনার হাত ধরেছিলাম কবে যে আপনাকে ছেড়ে যাবো?
~ফাইজলামি হচ্ছে আমার সাথে। তোমাকে আমি কত ভালোবাসি জানো না তুমি? আম্মু তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে গেছে সেই কথাও কি অজানা তোমার? আম্মু তোমাকে আমার দায়িত্বে দিয়ে গেছে শুভ্রতা। তুমি একান্তই আমার। ফার্দার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করলে ডিরেক্ট খুন করে ফেলবো তোমায় আমি।
~মা চলে গেছে আহনাফ ভাইয়া। তার সাথে সাথে তার সব কথাও। ভুলে যান সে সব।

চন্দ্র শুভ্রতাকে নিজের আরো কাছে এনে প্রশ্ন করলো,

~কি বলতে চাইছো তুমি? সোজাভাবে বলো।
~রূপ আপনাকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করে নিন আপনি। ওর মতো আর কেউ আপনাকে ভালোবাসবে না চন্দ্র।

চন্দ্রের হাতের বাধন হালকা হয়ে এলো। চোখে মুখে তার ঘোর অবিশ্বাস। শুভ্রতা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,

~নুর ভাবে আমি অরণ্য ভাইয়ার প্রেমিকা। তাই সে আমাকে ছেড়ে দিলো। রূপ ভাবে আমি আপনাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়েছি তাই সে আমাকে ঘৃনা করে। বন্ধুমহলের চোখে নিজের জন্য ঘৃনা দেখা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে উঠছে চন্দ্র। মা বাবার পর ওরা আমার খুব প্রিয়। ওদের এভাবে হারাবো আমার কল্পনায়ও ছিলো না। নুরকে বুঝালে সে বুঝবে। কিন্তু রূপ, তাকে কি করে বুঝাবো। সে আপনাকে দেখলে কষ্ট পাবে। আপনি তার হয়ে যান ভাইয়া।

চন্দ্র শুভ্রতাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের মাথার চুল টেনে সারা কেবিন জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে বাজছে না শুভ্রতার।

~আপনি কি রেগে যাচ্ছেন? আমার কথা শুনুন প্লিজ! রূপ অনেক ভালো মেয়ে। আপনাকে খুব ভালো…

চন্দ্র হটাৎই পায়চারি থামিয়ে শুভ্রতার দিকে তেড়ে আসলো। শুভ্রতার গাল চেপে হিসহিস করতে করতে বললো,

~তোর পুতুল মনে হয় আমাকে? বান্ধবীর পছন্দ হলো বলে তাকে উপহার দিয়ে দিবি এমন পুতুল মনে হয় আমাকে? তোর শুধু বান্ধবীর ভালোবাসাটাই নজরে এলো আর আমার? আমার ভালোবাসা নজরে এলো না শুভ্রতা? তোর পা কাটাতে যেই আমার জান বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল। তুই আমাকে বলিস তোকে ছেড়ে তোর বান্ধবীর কাছে যেতে? আমার ভালোবাসা কি এতই তুচ্ছ তোমার কাছে?

শুভ্রতা শান্ত চোখে চেয়ে আছে চন্দ্রের চোখের দিকে। কেমন হিংস্র লাগছে মানুষটাকে। শুভ্রতার জবাব না পেয়ে চন্দ্র শুভ্রতাকে ছেড়ে দাড়ালো।

~তোর শুধু হাতটা ঠিক হোক। যেদিন তোর হাত সম্পূর্ণ ঠিক হবে সেদিনই তোকে আমি বিয়ে করবো। একচুয়ালি তোর হাত ঠিক হওয়ারও প্রয়োজন নেই। কবুল তো মুখে বলবে। সাইনটা হাত ঠিক হলেও নেওয়া যাবে।

বলেই চন্দ্র কেবিনের দরজা খুলে জোরে মাহতাবকে ডাক দিলো। মিনিট দুয়েক এর মধ্যেই মাহতাব হাজির। চন্দ্রের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে।

~কাজী ডাক। আজকেই ওকে বিয়ে করবো আমি। মা ওনাদের বল জলদি এখানে আসতে। এক ঘণ্টার মধ্যে বিয়ে করতে চাই আমি।

মাহতাব শুকনো ঢোক গিলে কেবিনের ভেতরে একবার উকি দিলো। শুভ্রতা থ হয়ে বসে আছে। তিলোত্তমা আর মাহতাব চন্দ্রের ডিসিশনে খুশি হলেও শুভ্রতার চেহারা দেখে কিছুটা খারাপ লাগছে। চন্দ্র ধমকে উঠতেই মাহতাব হকচকিয়ে উঠলো,

~আচ্ছা শুন, ওর বান্ধবী রূপ না কি যেনো ওকেও ডাকবি।
~ওই মীরজাফর এখানে এসে কি করবে ভাইয়া? (তিলোত্তমা)
~বিয়ের সাক্ষী দেওয়াবো…
~~~
চলবে~

(বিয়েতে সবাই গিফট্ নিয়ে আসবেন 👽 নয়তো রুপার সাথে নায়কের বিয়ে করিয়ে দিবো 😒 হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here