চুপি চুপি ইচ্ছেরা
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি
৫
রাতে ডিনারের জন্য ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে Candlenust এ চলে এলো। সিংগাপুরের একমাত্র অত্যাধুনিক এশিয়ান রেস্টুরেন্ট Candlenust। এখানে এসে প্রায় অনেক বাংলাদেশির সাথে দেখা হলো ওদের।এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক, হাতে গনা দু’তিন জন্য এখানে স্থায়ি। এদের সাথে কিছুক্ষন আড্ডাও দিয়ে নিলো ষশ্মিথ। ইন্ডিয়ান আছে প্রায় দশ বার জন।
তিতির সিংগাপুর আসার পর পুরো দু’দিন পর রাইস খেলো। পোলাও, মাংস আর সাথে কয়েকরকম মাছের আইটেম ছিল। যেহেতু আগস্ট মাস চলছে তাই প্রত্যেক খাবারের শেষে পর্যটকদের জন্য একটা দুটা ফলের আইটেম থাকছেই। তা রেস্টুরেন্ট কর্তিপক্ষ কর্তিক। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে পর্যটকেরা বেশি ভ্রমণে আসে সিংগাপুরে। এসময়টাতেই মূলত সকল ফেস্টিবলস গুলো উদযাপিত হয়। এর মধ্যে ফুড ফেস্টিবল গুলো হালকা ছোঁয়া রেস্টুরেন্ট গুলোতেও পাওয়া যায়।
ডিনার কম্প্লিট করে হোটেলের থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটা ফেস্টিবলে এটেন্ড করলো তিতির আর ষশ্মিথ। ফেস্টিবলটা মূলত এখানের সকল পর্যটকদের ঘিরে। সকলেই সিংগাপুরের কিছু আদিবাসীদের পোশাক আষাক পড়েছে। মাত্র দশ সিংগাপুরীয়ান ডলার দিয়ে যে যার মতো এখানকার পোশাক কিনে নিয়ে ফেস্টিবলে অংশগ্রহন করছে। বেশ লেগেছে ব্যাপারটা তিতিরের কাছে। তিতিরও কিছু পোশাক কিনে পড়ে নিলো। এগুলো দেখতে কিছুটা চাকমা আদিবাসীদের পোশাকের মতো। তবে তিতিরকে পুরো চাইনিজদের মতোই দেখাচ্ছে। ওদের সাথে নৃত্য,গান,গল্পের মধ্যেই অনেক রাত হয়ে যায়।
–
বারান্দায় দাড়িয়ে ভেজা চুল তোয়ালে ছোঁয়াচ্ছিল তিতির। ষশ্মিথ খালি গায়ে এসেই পেছন থেকে হাত দুটো আলতো করে ছোয়ায় তিতির হাতে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবায় তিতিরের ভেজা চুলে। পানি আর চুলের ঘ্রাণ মিশে এক অদ্ভুত ভালোবাসার ধাক্কাদেয় ষশ্মিথের বুকে। সাথে সাথে তিতিরকে ছেড়ে শার্ট গায়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় ষশ্মিথ। তিতিরও বুঝে ওঠতে পারলো না ব্যাপারটা। ও এই আশা করেছিল ষশ্মিথ আরো কিছুক্ষন থাকবে ওর পাশে। কিন্তু এভাবে কেনো চলে গেলো? তবে তিতির নিজের অজান্তেই অনেকটা দূর্বল হয়ে পরেছে ষশ্মিথের উপর। বিষয়টা হয়ত স্বাধীনতার। যেটা সে তার এতটুকু জীবনে কখনোই পায়নি। আর নিঝুম তো সব সময়ই তাকে কন্ট্রোল করতো!
রুমে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো তিতির। কাল ভোরে ওরা এই হোটেল ফেকে শিফ্ট হচ্ছে ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’ এ। সিংগাপুর সবচেয়ে আকর্ষনীয় অত্যাধুনিক রিসোর্ট কমপ্লেক্স। বাকি দিনগুলো সেই রিসোর্টে থাকবে। শুনেছে এই রিসোর্ট নাকি সিংগাপুরের দর্শনীয় আকর্ষণের মধ্যে প্রথম। তিতিরের তো ভীষণ খুশি হচ্ছে।
চুপচাপ বেডে শুয়ে পড়লো তিতির। রাত হয়েছে ষশ্মিথ এখনো ফিরেনি। কেনো যেনো চরম রকমের খারাপ লাগছে তিতিরের। ইদানিং ষশ্মিথ একটু রাগ করে তাকালেও সহ্য হয়না তিতিরের। বুকটা হাহাকার করে। কষ্ট হয়। সে যে আর কারো অবহেলা চায় না। সারাক্ষন ইচ্ছা করে ষশ্মিথের ভালোবাসার সাগরে ঘাপটি মেড়ে পড়ে থাকতে। মাঝে মাঝে কেনো করে ও এমন বুঝে পায় না তিতির। এখনো খারাপ লাগছে। বিশেষ করে ঘুমানো সময় খারাপ বেশি লাগে। এতদিনে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর কড়া ডোজ দিয়েছে ষশ্মিথ ওকে। এমন কোনো রাত নেই যে ও বালিশে শুয়েছে। তিতির ওকে বকেছে, অপমান করছে, দূরে থাকতে বলেছে। শুনেছেও ছেলেটা। কিন্তু একা ঘুমাতে ঠিইইক দেয়নি। এখন অভ্যাশ হয়ে গেছে তিতিরের। ওই বুক ছাড়া ঘুম আসেনা, ওই বুকের উষ্ণতা ছাড়া ঘুম আসেনা, ওই বুকে গন্ধ ছাড়া ঘুম আসেনা।
একমাস দশ দিনে আর যাই হোক কাউকে ভালোবাসা যায় কিনা তিতিরের তা জানা নেই, তবে নিঝুমের থেকে বেশি টান অনুভব হয়। কারণটা ষশ্মিথ নিজে। যতটুকুই ফিলিংস ওর ষশ্মিথের জন্য হয় সবটুকুই ষশ্মিথ নিজ হাতে কেড়ে নিয়েছে ওর থেকে। ওর ভালোবাসায় পৃথিবীর সব ভুলিয়ে দিয়েছে তিতিরকে।
কিছুক্ষনের মধ্যে চোখ দুটো জলে ভরে এলো তিতিরের। কি করে ঘুমাবে ওই এখন, তাছাড়া একা থাকতেও কেমন ভয় করছে। এর মাঝে দরজা খুলার শব্দ হয়। ষশ্মিথ চাবি দেয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। তিতির ও চুপচাপ ওঠে পড়লো খাট থেকে। ষশ্মিথ ঘরে ডুকেই লাইট অফ করে দিলো। তিতির অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ষশ্মিথ আপনি লাইট কেনো অফ করলেন? আর এভাবে হুট করে চলেই বা গেছিলেন কেনো? ‘
কোনো উত্তর না পেয়ে তিতির আবার বলতে লাগলো,
‘ ষশ্মি…। ‘
‘ হুসস… ‘
ষশ্মিথ নিজের আঙ্গুল দিয়ে তিতিরের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো। তিতিরের কাধে হাত রেখে আস্তে করে এগিয়ে নিয়ে বসিয়ে দিলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে। অগোছালো চুলগুলোকে আচড়ে খোঁপা করে দিলো। তারপর খোঁপে গাঁজরা লাগিয়ে দিতে দিতে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো,
” তুমি যাকে ভালোবাসো স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়।।
তোমার কথার শব্দ দূষন তোমার গলার স্বর,
আমার দরজায় খিল দিয়েছি আমার দারুন জ্বর।
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেধো ঘর।।”
তিতির ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে বললো,
‘ গান তো বেশ গান আপনি! ‘
‘ কারো কারো জন্য গাইতে হয়। ‘
তিতির সত্যিই বুঝেনা এই ছেলেকে। সে কোথায় গেলো, কি হলো না হলো ভেবে ও কত কষ্ট না পাচ্ছিল। অথচ ষশ্মিথ শুধু গাঁজরা আনার জন্য গেছিলো।
‘ আপনি এখানে কোথায় পেলেন এগুলো। ‘
‘ খুব কষ্ট করে পাওয়া কারোর জন্য খুব কষ্ট করেই আনাতে হয়েছে। ‘
‘ তাহলে কেনো আনলেন? ‘
ষশ্মিথ কোনো কথা না বলে তিতিরকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। বাহুডোরে আবদ্ধ করে রাখলো মায়াবিনীকে।তিতিরও আয়েশিভাবে মুখ গুজে দিলো ষশ্মিথের বুকখানায়।
পরদিন সকালে এশ কালারের একটা সিভলেস শাড়ি পড়ে নিলো তিতির। সাথে কালো রঙ্গের মধ্যে সূক্ষ লাল রঙ্গের কম্বিনেশনে একটা ব্লাউজ। চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করে নিয়েছে। আর তাতে গাঢ় লাল রং আর হালকা হলুদ রঙ্গের দুটো গোলাপ গেঁথে নিয়েছে। আর কানে গোল্ডেন পাথরের দুল।
ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পরই ষশ্মিথের চোখ আটকে গেছে ড্রেসিং টেবিলের কর্ণারে। তিতিরের একটা কানের দুল তখন নিচে পড়ে গেছিল।নিচু হয়ে দুলে হাত দেয়ার আগেই ষশ্মিথ তুলে নেয় সেটা। তারপর নিজ হাতে পড়িয়ে দিয়ে, তিতিরের মাথায় আলতো করে একটা চুমু দেয়।
হোটেল থেকে তিতির আর নিঝুম সোজা চলে আসে ‘মেরিনা বে স্যান্ডস’এ। আসার পথে এখানকার জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড চিকেন আর ‘Lobster’ তৈরী একটা মুখোরোচক খাবার খেলো। মেরিন বে স্যান্ডস এর ভিতর প্রবেশ করার পর যেনো এক মুহূর্তের জন্য নিজের ভেতর ছিল না তিতির। কোনো স্থান এতটা সুন্দর কি করে হতে পারে?
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থান হলো মেরিনা বে স্যান্ডস (Marina Bay Sands)। এটি সিঙ্গাপুরের একটি অত্যাধুনিক রিসোর্ট কমপ্লেক্স। ২০১০ সালে নির্মিত এই মেরিনা বে স্যান্ডস বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিল্ডিংগুলোর মধ্যে একটি। এখানে আছে একটি হোটেল, বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ড এর শোরুম, আর্টসায়েন্স মিউজিয়াম (ArtScience Museum), রেস্টুরেন্ট, কনভেনশন সেন্টার, থিয়েটার, একটি শপিংমল – যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল, এবং মেরিনা বে স্যান্ডস স্কাইপার্ক (Marina Bay Sands Skypark) – একটি উঁচু স্থান যেখান থেকে সমগ্র সিঙ্গাপুর দেখা যায়। সমগ্র সিঙ্গাপুর দেখার এই ডেক এবং ইনফিনিটি পুল অবস্থিত একটি জাহাজের মধ্যে। মেরিনা বে স্যান্ডস স্কাইপার্কের উপরে অবস্থিত এই জাহাজ। কেবল হোটেল গেস্টরা এই ইনফিনিটি পুল ব্যবহার করতে পারলেও যে কেউই পর্যবেক্ষণের ডেক দেখতে পারে এখানে কৃত্রিম বরফের তৈরি একটি স্কেটিং কোর্টও আছে।
তিতিরের মনে হচ্ছে ও কোন এক স্বপ্ন নগরিতে চলে এসছে। রিসোর্টটা ঘুরে রুমে যেতেই দেখে ওদের জন্য সম্পূর্ণ ঘরটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ঢোকার সময় একটি মেয়ে তিতিরের হাতে এক ঝুড়ি চকলেটস ধরিয়ে দিলো। ব্যাস, ওর আর কি লাগে?
পুরো রুমটা ভালো করে দেখে নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে এলো লাঞ্চ করতে। লাঞ্চ সেরে পুরো এলাকাটা ভালো মতো দেখে নিলো। সাথে অনেক কিছু শপিংও সেরে নিলো। টুকটাক ভালোবাসার মধ্য দিয়েই কেটেছে সিঙ্গাপুরের ট্যুর ষশ্মিথ আর তিতিরের। এর পর লিটল ইন্ডিয়া, সিংগাপুর জু’, ফোরলিয়ানো, জুরং পাখির পার্ক, সাইলোসা বীচ, ক্লার্ক কুয়ে, সেন্টোসা আইল্যান্ড, রেফেল্স হোটেল, এসপ্লান্ডে পার্ক সবটাই ভালোভাবে ঘুরা হয়েছে তিতিরের।
আর মাত্র দু’দিন পর বাংলাদেশে ফিরত আসছে তিতির আর ষশ্মিথ। মন খারাপের পাল্লাটা একটু ভারী লাগলেও খুশিও কম হচ্ছেনা। কতোদিন পর আবার দেখবে নিজ দেশ,আবার সেই আবহাওয়া,সেই বাতাস, সেই নিজস্বতা! তবে এবার যেন তিতিরের ফিরে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ অত্যাধিক বেশি। এর কারণটা তার শ্বাশুড়ি মা আার ভাবী। শ্বশুর একটু রাগ করে থাকলেও প্রচন্ড স্নেহ করেন। এটা তিতির তার আচরণেই বুঝতে পারেন। এমন সুন্দর গোছানো প্রেমপূর্ণ পরিবারই তো সে চেয়েছিল। তবে কেনো পেয়েও পায়ে ঠেলে দিয়েছিল? মানুষগুলোকে সে কতোই না কষ্ট দিয়েছে! তাও এমন কারো জন্য যারা তাকে ভালোই বাসে না!
বিকেলের দিকে ষশ্মিথ তিতিরকে নিয়ে যায় ‘সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ারে’। তিতির খুব ছোটো বেলা থেকে এটাকে দেখেছে টিভিতে। চড়ার খুব শখ ও ছিল। আজ ষশ্মিথের জন্য এই শখটাও পূরণ হবে! এতদিন ঘুড়ার সময় তিতির ভালোভাবে দেখেছে ফ্লাইয়ারকে, আজ ও নিজেই ওঠবে। খুশির থেকে এক্সাইটমেন্ট বেশি।
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে দর্শনীয় ও আকর্ষণীয় স্থান সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার (Singapore Flyer)। এটি একটি ফ্যারিস হুইল বা নাগরদোলা। তবে ২০০৮ সালে চালু হওয়া এটি যেনতেন ফ্যারিস হুইল বা নাগরদোলা নয়, এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু (১৬৫ মিটার) ফ্যারিস হুইল যার মাধ্যমে আপনি পুরো সিঙ্গাপুর দেখতে পারবেন। এর অবস্থান মেরিনা বে। সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার এর মেঝে ৩ টি স্তর নিয়ে গঠিত যাতে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, দোকান এবং অন্যান্য সেবা। ফ্লাইয়ারের প্রতিটি রাইড ৩০ মিনিট স্থায়ী হয় এবং তা খুব সকাল থেকে গভীর রাতে পর্যন্ত।
সেখান থেকে ঘুরে এলো বোটানিক গার্ডেন্স (Botanic Gardens)। এটি সিঙ্গাপুরের প্রথম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মনোনয়নপ্রাপ্ত স্থান। সিঙ্গাপুরের পুরোটা কংক্রিট জঙ্গল মনে হলেও এই বোটানিক গার্ডেন্সই সেই ধারনাকে বদলে দেয়। এটি যেন ইট পাথরের জঙ্গলের মাঝে এক টুকরো সত্যিকারের জঙ্গল। এখানে হাঁটতে হাঁটতে আপনি দেখতে পারবেন সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও পশু-পাখি। এখানে প্রায় ৬০,০০০ প্রজাতির গাছ ও পশু-পাখি রয়েছে। বোটানিক গার্ডেন্স এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন প্রজাতিভেদে বাগান রয়েছে। যেমন: অর্কিড গার্ডেন, ইকো বাগান, ইকো হ্রদ, বনসাই বাগান, ভাস্কর্য ইত্যাদি।
সিংগাপুর থেকে ফিরে আসার একমাসের মাথায় তিতিরের এডমিশন-টেস্টের রেজাল্ট ও দিয়ে দিলো।তিতির কুমিল্লা মেডিক্যালে চান্স পেয়ে যায়। মিসেস শৈলী তো সেই নিয়ে ভীষন খুশি। ছেলে, ছেলের বউ দুজনেই ডাক্তার। কয়েকদিনের মাঝে ক্লাস ও শুরু হয়ে গেলো। ওখানেই একটা ফ্ল্যাটে থাকবে তিতির। সাথে আরবা নামের আরেকটা মেয়ে।
কেটে যায় আরো অনেকটা সময়। কাল ভোরেই কুমিল্লা দিয়ে আসবে ষশ্মিথ তিতিরকে। সারাটা দিন তিতিরের ভেতরটা কেমন কেমন যেনো করেছে। অনেক খারাপ লাগা কাজ করছে।
মায়া পড়ে গেছে এই মানুষগুলোর উপর। এখন নতুন জায়গায় গিয়ে কি করে থাকবে? বিশেষ করে ষশ্মিথের যে অভ্যাসটা ওর হয়েছে সেটা? মন আরো খারাপ হয়ে গেলো তিতিরের। আজ সারাদিন একবার ও ষশ্মিথের সামনে যায়নি ও। গেলেই কান্না কান্না পাবে। কিন্তু কেনো কাঁদবে তার উত্তর নেই। তার চেয়ে না যাওয়াই ভালো। ইরিনা ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে বিষয়টা। না তিতির সকাল থেকে নিজের ঘরে যাচ্ছে আর না ষশ্মিথ বের হচ্ছে। দুপুরের খাবার শেষে টেবিল গোছাতে গোছাতে ইরিনা বললো,
‘ তিতির তুই একটু ঘরে যা তো। ভাইয়া ডাকছিলো তোকে। ‘
তিতির ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
‘ কে…কেনো ডাকছে? আমি এখন যাবো না। তোমাকে সাহায্য করি আগে। ‘
‘ আমি পারবো যা তুই। ‘
তিতিরের হাত ধরে পরম আদরের সাথে আবার বললো,
‘ কাল তো চলেই যাচ্ছিস। এই সময়টুকু নাহয় ভাইকেই দিলি। এর পর তো অনেকগুলো বছর আর চাইলেও পারবিনা একসাথে থাকতে। ষশ্মিথ কিন্তু অনেক বেশি ভালোবাসে তোকে। দূরে থাকতে কষ্ট হয়ত ওর নাকি? কেনো বুঝিস না পাগলি মেয়ে! ভালোবাসার মানুষকে খুব শক্ত করে বুকের মাঝে বেঁধে রাখতে হয় বুঝলি। এর আগে যা হওয়ার হয়েছে। এখন যেহেতু এই সংসারে ফিরে এসছিস, সব ভুলে কাছে টেনে নে তাকে। আমি বলছি আর ঠকবি না। আমার ভাই বলে না, সে সত্যিই তোকে সবচেয়ে সুখী করবে। ভেবে দেখিস কি বললাম। ‘
‘ হুম। ‘
‘ কি হুম? সময় থাকতে ষশ্মিথকে বেঁধে নে নিজের আঁচলে। ভালোবাসা জীবনে প্রত্যেকবার উঁকি দেয় না। আভাস পেতেই আকড়ে ধরতে হয়। আর ভালোবাসা ভালোবাসাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসতে পারে তার কাছেই শুধু ধরা দেয় ভালোবাসা। বুঝলি? যা ঘরে যা। ষশ্মিথ একা আছে। ‘
তিতির চুপচাপ চলে আসে ঘরে। ইরানির কথাগুলো আজ খুব ভালোলাগছে তিতিরের। ভালোবাসতেও ইচ্ছা করছে ষশ্মিথকে। সত্যিই তো! নিঝুমকে ভালোবেসে কি পেয়েছিল সে? শ-খানিক অবহেলা! এই কদিনে তো শে একটি বারের জন্যও তার খোঁজ নেয়নি! তিতির বেঁচে আছে না মরে গেছে। অথচ ষশ্মিথ তার জন্য কি না করেছে।
ঘরে ডুকেই সোফায় গাঁ এলিয়ে দিলো তিতির। প্রায়ই করে এমন। ষশ্মিথ রেগে যায় সব সময় ওর এমন কর্মকান্ডে। বেশ ভালোই লাগে ব্যাপারটা তিতিরের। তাই ইচ্ছে করেই করে। আজও ব্যাতিক্রম হলো না। খাটে বসে সবটাই পরখ করেছে ষশ্মিথ। তারপর দাঁত কটমট করে বললো,
‘ ওখানে কেনো গেলে তুমি? ‘
‘ এমনি খাটে শুবো না তাই। ‘
ষশ্মিথ এবার হংকার ছেড়ে বলল,
‘ আসতে হবেও না। আর কক্ষনো আসবে না খাটে তুমি। মান্ড ইট। ‘
তিতির অবাকের চুরান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। এতো বড় ইন্সাল্ট! আর ও কিনা ভেবেছিল এসে কোলে করে নিয়ে যাবে খাটে। তিতির রাগ সামলে নিয়ে তাচ্ছিল্য সুরে বললো,
‘ হুহ,আসব নাই তো। আমি ষান্দ্র ভাইয়ার ঘরে গেলাম। ভাইয়া তো আজ রাতেও আসবে না বলেছিল! ও ঘরেই থাকব আমি। ‘
ষশ্মিথ তিতিরের দিকে ঠিক বাঘের মতো তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে বললো,
‘ এই রুম থেকে খালি বের হও না! পা ভেঙ্গে কুমিরকে খাইয়ে দিব। খাটে আসবা নাকি আমি…। ‘
কথাটা বলার আগেই ভয়ে তিতির সোফা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে খাটে চলে এলো। এসেই তিতির বললো,
‘ আচ্ছা দেখুন তাহলে আপনি কিন্তু একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না বলে দিলাম। ‘
ষশ্মিথ হাসতে হাসতে কুটি কুটি হয়ে বললো,
‘ ওহ রিয়েলি? আমি কাছে যাবো? তাও আবার তোমার? আর ইউ গন মেড? ‘
‘ এই দেখুন আপনি কিন্তু সেই পরিমানে ইন্সাল্ট করে যাচ্ছেন আমার তখন থেকে। হবে না! ‘
ষশ্মিথ তিতিরের দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো,
‘ কি হবে না শুনি? আদর করতে না করো আবার না করলে ছটফট কর। ব্যাপারটা কি? ‘
‘ কিহ! ওফ অসহ্য। ঘুমাতে দেন তো। ‘
ষশ্মিথ এবার কুহেলীকে নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বলে,
‘ মহারানী এবার খুশি তো? ‘
‘ খুব। ‘
‘ উদ্ধার হলাম আমি। ঘুমান এবার। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ‘
‘ কেনো? ‘
‘ ঘুম ভালো হবে। চুপ,এবার ঘুমাও তো। ‘
‘ হুম। ‘
তিতির ও সেকেন্ডের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেলো। হঠাৎ মনে হলো একজোড়া ঠোঁট খুব গভীরভাবে তিতিরের ঠোঁটে বিচরণ করে গেলো। ভয়ে ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ খুললো তিতির। দেখে ষশ্মিথ ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। নজর দিয়ে খুবলে খাচ্ছে তিতিরের সবটা। অন্তর আত্তা কেঁপে ওঠলো তিতিরের। নরেচরে ওঠাতে ষশ্মিথ আরো কাছে টেনে নিলো তিতিরকে। তিতিরের এতক্ষনে হুঁশ ফিরেছে ষশ্মিথ ওকে আর ও ষশ্মিথকে আষঁটে পিষঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তিতির তাড়াতাড়ি ওঠে পড়তে চাইলে ষশ্মিথ জোর করে আবার তিতিরকে ওর বুকে শুইয়ে দেয়।
‘ একবার যখন নিজে থেকে এসছো আমি কিন্তু আর ছাড়ছি না। ‘
‘ না না না কক্ষনো না। আমি নিজে থেকে মরে গেলেও আসিনি। আপনি টেনে নিয়ে এসছেন। আর কি করতে চাচ্ছিলেন এখন? ‘
‘ চাচ্ছিলাম না, করে ফেলছি। একটু আদর। আর আসছো তুমি নিজেই। জড়িয়ে ধরেছো আমাকে। ‘
‘ ছিঃছিঃ। কি বেহায়া লোক! ছাড়ুন তো আমাকে। ‘
‘ রাত আরো অনেক বাকি। আমার বুকেই ঘুমাবে এখন। ‘
তিতির আরো কয়েকবার চেষ্টা করে নিজেকে ছুটাতে না পেরে ষশ্মিথের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে তিতিরকে নিয়ে ষশ্মিথ কুমিল্লা চলে এলো। খুব সুন্দর করে আগে থেকেই সাজিয়ে নিয়েছে ফ্ল্যাটটা ষশ্মিথ। তিতির সম্পূর্ণ অবাক। এতো কিছু কখন করালো? ফ্ল্যাটে মোট তিনটে রুম,ডায়েনিং। প্রত্যেক রুমেই এডজাস্ট ওয়াশরুম। তিন রুম থেকে একটা তিতিরের আর বাকি দুটো অন্য দু’জনের। অনেক রাস্তা জার্নি করে আসার কারণে ষশ্মিথ তিতিরকে রেস্ট নিতে বলল। কিন্তু কে শুনে কার কথা। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আধ ঘন্টার মধ্যে নিজের রুমটা আর কিচেন নিজের মন মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিলো। তারপর এক ঘুমে রাত আটটায় ওঠলো। ষশ্মিথ আজ রাত থাকবে। কাল সকালে খুব ভোরে চলে যাবে। এই কথাটা যেনো তিতির মেনেই নিতে পারছে না।
ইরিনা, ষান্দ্র, মিসেস শৈলি, মি. ষাহবাব সবার জন্য খুব খারাপ লাগছে। ফোন কয়েক দফা কান্নাও করে ফেলেছে। রাতে ষশ্মিথ নিজে রান্না করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তিতিরকে। ষশ্মিথের ও প্রচন্ড খারাপ লাগছে।
সিগেরেট হাতে বারান্দায় চলে এলো ষশ্মিথ। রেলিং এর উপর পুরোটা ফাঁকা। পা তুলে বসে পড়লো সেখানে। ভাবছে এই মেয়েটা পুরোটাই মায়ায় ভরা। কয়েকদিন ওর কাছে থেকেই কেমন অভ্যাস করছি ওর। ওকে ছাড়া থাকার কথা ভাবলেই কেমন যেনো করে ভেতরে। কান্না করতে ইচ্ছা করে খুউব। কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মেছে যে, কাঁদে কিভাবে? ছেলেদের যে কাঁদতে নিষেধ। শুধু পাষাণের মত দেখে যাও সব। আর সহ্য করো।
তিতির খাটে শুয়ে শুয়ে দেখছে ষশ্মিথকে। এতক্ষন কতই না বৃথা চেষ্টা করছে ঘুমানোর। কিন্তু অসম্ভব। ওঠে বারান্দায় এসে দাড়ালো। ষশ্মিথ তিতিরকে এক পলক দেখে চোখ বুজে রইলো আবার। তিতির আস্তে করে ষশ্মিথের বুকে জায়গা করে নিলো। এমন ভাবে খামছে ধরেছে নিজেকে যেনো এখনি ডুকে যাবে বুকের ভেতর। ষশ্মিথ টের পেলো ওর বুকটা ভিজে ওঠেছে। তিতির কান্নার শব্দও শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট। ষশ্মিথ তিতিরের হাতে হাত রাখতেই তিতির দৌড়ে রুমে চলে এলো। কেনো এত জ্বলছে বুকের ভেতরটা নিজেই বুঝতে পারছে না তিতির।
ষশ্মিথ ও এলো তিতিরের পেছন পেছন। তিতির কাঁদছে। ষশ্মিথ চুপচাপ তিতিরের কাছে গিয়ে কোলে তুলে নিলো ওকে। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ঝরণা ছেড়ে দিলো। দুজনই ভিজে টুইটুম্বুর হয়ে গেলো। ষশ্মিথ তিতিরকে পেছন থেকে এভাবে গলায় জড়িয়ে ধরেছে যেনো এখনি শ্বাস আটকে মেরে ফেলবে। ষশ্মিথ গভীর ভাবে ডুবে আছে তিতিরের গলায়। কয়েকটা চুমু খেয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো তিতিরকে। মেয়েটা লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। ঠোঁটটা ভীষণভাবে কাঁপছে তিতিরের। ষশ্মিথ নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না। ডুবিয়ে দিলো নিজেকে তিতিরের ঠোঁটের ভাজে। হাত দুটো আস্তে আস্তে কোমর ছাড়িয়ে ওঠে এলো তিতিরের জামার চেইনে। একটানে অর্ধেকটা খুলে আবার কি মনে পুরোটা আটকে দিলো। এক ঝাটকায় তিতিরকে ছেড়ে বের হয়ে গেলো।
চলবে.