চুপি চুপি ইচ্ছেরা পর্ব -০৬

চুপি চুপি ইচ্ছেরা
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

‘ ভালোবাসা দিলে বেদনায়
গেঁথে নেবো নম্র বকুল
তীব্রতার অহংকার
হবে,মণীষার কাংখায় কামনায়
রাত্রি রেখে যাবে শোক
চোখের চর্তুরপাশে,সংসারে
ভালোবাসা পেলে প্রিয়ময়
হবে এইটুকু পতন,
প্রিয় মুখের শহরে,প্রিয়
অধরে আঁখিতে আশ্রয় লিখে
গ্লানি নিন্দার মুকুট পরাবো জীবনে
তবু ব্যর্থতায় ফিরে যাব।’

শীতের শুরু হয় ঝুপরি দেয়া বৃষ্টির কথায় মুড়ে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় বাড়ে শীতে বেহায়া তীব্রতা। বৃষ্টির বড়বড় কণা ঝুপ করে শিউলি গাছটাতে পরে অনেক ফুল ঝরিয়ে দেয়। শিউলি ফোটা মানেই শিশির জমা। হিমশীতল গন্ধ! ষশ্মিথের কন্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা জানালার পাশে বসে নিভৃত মনে আওড়াচ্ছিল তিতির। এ যেনো তার বোধে প্রাণের সঞ্চার দেয়।

রাতের খাবারটা ঝটপট বানিয়ে নিলো আরবা। আরবা ষশ্মিথের বেস্টফ্রেন্ড বিলাসের ছোটবোন। শুধু মাত্র নিজের জন্য খাবার রেঁধে খেয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে নিলো আরবা। তিতিরকে মানতে বেশ বিরক্ত লাগছে ওর।মছোট থেকেই ষশ্মিথের বৈশিষ্ট্য, পার্সোনালিটি, এটিটিউড, কমোলত্বের উপর বিশেষ লোভ ছিল আরবার। ষশ্মিথের একখানা পুরনো ছবি হয়ত এখনে লুকনো অবস্থায় রয়ে গেছে বইয়ের ফাঁকে। ফ্যামিলি রিলেটেড বলে কখনো বলে ওঠতে পারেনি ষশ্মিথকে ওর অনুভূতিগুলো। তাই বলে ষশ্মিথ কেনো বুঝে নিবে না? এ তো অন্যায়!

ঘোর অভিমাণ জমা ছিল এতদিন আরবার এই ছোট্ট মনটাতে। আজ যেনো সেগুলো মাথাচারা দিয়ে জেগে বসেছে। বিছানার চাদর ক্রমশঃ ভিজে ওঠেছে অশ্রুধারায়। ঘুমোতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও এই মেয়েটার সাথে কেনো থাকতে হবে ওকে! কেনো চোখবুজে, হাত গুটিয়ে দেখতে হবে অন্য নারীর সঙ্গে ষশ্মিথের অন্তরংগতা!

কাল যে বাড়ি থেকে বের হলো আজ সকালে ফিরেছিল ষশ্মিথ। তিতিরের জন্য চিপস, চকলেটস, কেক আর কিছু সামান্য শুকনো খাবার নিয়ে এসছে। তিতিরের পছন্দ বলে মিসেস শৈলি কয়েক বোয়ম আচার সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ষশ্মিথ চলে গেছে সকালেই। এখন থেকে অফিসে জয়েন করতে হবে। যাওয়ার আগে তিতিরের মুখ চেয়ে করুণভাবে বলে গেছে,

‘ এখন তো আর আমার ভালোবাসাগুলো বিরক্তি নিয়ে সহ্য করতে হবে না তোমায়। ‘

তিতিরের খুব অদ্ভুত লাগছে কথাটা এখন। আচ্ছা ভালোবাসা কি সহ্য করার বিষয়! নাকি অনুভবের? আসলে ও নিজেই বিষয়টাকে অসহ্যকর করে তুলেছে।
মানুষটা আজ পাশে নেই। রাত হয়েছে। ঘড়ির কাটা পনে নয়টা ছুঁইছূই। অথচ জিজ্ঞেস করবার কেউ নেই ‘খেয়েছ?’

মনটা পুড়ে যাচ্ছে। ওই বাড়ির মানুষগুলো জন্য। নাকি লোকটা কাছে নেই বলে? যাই হোক কষ্ট হচ্ছে খুব। জীবনে এতক্ষন না খেয়ে থাকেনি কখনো। কান্নাও পাচ্ছে। ফোনের রিংটোন কানে আসতেই জানালা পাশে ছেড়ে ওঠলো তিতির। সারাদিনে যতবার কল এসেছে লাফিয়ে লাফিয়ে ফোনের কাছে গেছে তিতির। মনে কোনে কোথায় যেনো একটা বলছিল “আরে যা, তাড়াতাড়ি যা। ষশ্মিথের কল।” কিন্তু প্রত্যেকবারই হেরে গেছে তিতির। ভাবতে ভাবতেই মোবাইলের স্কিনে তাকিয়ে হচকিত হয়ে গেলো তিতির। অস্ফুটস্বরে ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসলো,

‘ ষশ্মিথ! ‘
আর সাথে ঠোঁটের নিচের গালে এক সূক্ষ ভাজ।

‘ কি করছো? ‘ স্পষ্ট ভাষায় বললো ষশ্মিথ।

‘ কিছু না। ‘

‘ খাওনি না সকাল থেকে। ‘

তিতির চুপ করে রইলো। লোকটা অদ্ভুত! কি করে বুঝলো ও খায়নি? ষশ্মিথ আবার বললো,
‘ কি? ‘

নিচু স্বরে বললো,
‘ আপনি জানলেন কিভাবে? ‘

‘ তোমার কন্ঠ বলে দিলো। ‘

‘ এটা আশা করিনি। কন্ঠ আবার কিভাবে বলে! ‘

‘ ভালোবাসলে সবকিছুই বলে। আচ্ছা একটু পর খাবার এসে যাবে। আমি ওর্ডার করে দিয়েছি। ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন আর পাস্তা যেটা ভালোলাগা খেয়ে নিবে। ‘

‘ হুম। ‘

‘ খাওনি কেনো এখনো? ‘

তিতির একটু লজ্জা পেয়েই বললো,
‘ আমি কি রাঁধতে পারি নাকি? ‘

‘ ইশঃ আমি থাকলে রেঁধে খাওয়াতাম। ‘

তিতির অবাক হয়ে বললো,
‘ আপনি কি কি রাঁধতে জানেন? ‘

‘ সব। ‘

বেল বাজতেই তিতির বললো,
‘ রাখি। বেল বাজচ্ছে। ‘

‘ হুম খেয়ে কল দিবে আমাকে। আর দরজা ভালোভাবে আটকে নিবে। কেও আসলে খোলার দরকার নেই। ‘

‘ হুম আচ্ছা। ‘

‘ এ্যাহ,ওই কালা মাইয়্যারে নাকি শহরের অনেক বড়লোক পোলার লগে বিয়া দিব। কন দেহা যায় এমন আদিখ্যেতা! আমার তো ভাই মনে হয় নিশ্চয়ই ছেলের কোনো সমস্যা-টমস্যা আছে। নাইলে অমন কালা মেয়েছেলেরে ক্যান বিয়া করতে চাইবো? ‘

উঠানের উত্তর পার্শ্বে বকুল গাছের তলায় দাড়িয়ে মনোরা মামির কথাগুলো নির্লিপ্তে শুনছে বিভাবরী। কান্দম্বর গ্রামের মেয়ে বিভাবরী। সেই গ্রামে মানুষেরা এখনো অনেক কুসংস্কারে ডুবে আছে। কালো রংএর মেয়েদের কেউ বিয়েই করতে চায় না। তার উপর বিভাবরীর গায়ের রং নিগ্রোদের মতোন। গায়ের চামড়া কালো হওয়ার দোষে হাজার লোকের হাজার খোটা মুখ বুজে সহ্য করে চলেছে ছোট থেকে। মনোরার তো এই নিয়ে কথার শেষ নেই।

বেলা একটু গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমে হেলতেই মিসেস শায়লা নিঝুম আর কিছু আত্নীয় নিয়ে চলে এলেন নমরুল মিয়ার বাড়ি। টিনের চালার ঘর সব। উঠান ঘিরে তিনটা চালা ঘর। শায়লা চোখের সামনে নিঝুমকে এভাবে আর সহ্য করতে পারছিল না। তিতিরের জন্য আর কতদিন কষ্ট পাবে এভাবে ছেলেটা।পুরো ভেঙ্গে গিয়েছে।
নিঝুমের জন্য নম্য,ভদ্র একটা বউ চাই এখন শায়লার।জোর করে তাই নিয়ে এসছে এখানে।মেয়ে হিসেবে তার বিভাবরীকে বড্ড লেগেছে।
গ্রামের মেয়েরা সাজিয়ে দিতে চাইছিল বিভাবরীকে। কিন্তু সে সাজবে না। মনোরা মনে মনে অবশ্য খুশিই হলেন। যেই চেহারার ছিড়ি তাতে কোনো পুরুষের নজর ভূলেও পরবেনা ওর উপর।

বিভাবরীকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে আসতেই নিঝুম চটকরে বলে ফেললো,
‘ আমি ওর সাথে পার্সোনালি কথা বলতে চাই। ‘

সবাই বড়ই বিচলিত হয়ে গেলো। এ গ্রামে রীতি অনুযায়ী বিয়ের আগে তো পাত্রী দেখার চল নেই, যদি ছেলে পূর্বে চিনে থাকে তাহলে তার বড় সৌভাগ্য। মনোরা প্রায় চিৎকার করেই বলতে লাগলেন,
‘ একিকথা একিকথা। এইভাবে কেউ মাইয়্যার লগে আলদা কইরা কথা কয় নাকি? ‘

নমরুল অনেক বিরক্ত হয়ে মনোরাকে চুপ করিয়ে বলেন,
‘ বেশি কথা কও তুমি। ওনারা শুহুরে মানুষ। ওনাদের ব্যাপারই আলাদা। বিভু মা তোর ঘরে লইয়্যা যা তো বাবারে। ‘

বিভাবরী মাথা দুই পাশে হেলে সম্মতি দিয়ে চুপচাপ হেটে এলো নিজ ঘরে। পেছন পেছন নিঝুম।
বিভাবরীর ঘরটা দেখেই বেশ অবহেলার ছাপ পেলো নিঝুম। খাট বরাবর একটা জানালা আর একপাশে একটা পুরনো চেয়ার। ব্যাছ আর কিছুই নেই। নিঝুম একবার চোখবুলিয়ে বলতে লাগলো,

‘ আমি অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসি। তার বিয়ে হয়েছে। তাই মা চায় না আমি একা থাকি। সম্ভবত আমি বিয়েটা করছি না আর যদি করিও স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু ভালোবাসতে পারব না। ‘

বিভাবরী কিছু না বলে স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো একপাশে। নিঝুম আবার বলতে লাগলো,
‘ কিছু বলবে না? ‘

‘ জি না। ‘

নিঝুম এতক্ষনে তাকালো বিভাবরীর দিকে। সাথে সাথে বুকের বাম পাশটায় বড় একটা ধাক্কা খেলো। মেয়েটার মুখের ধাচ, শরীরের গরন-গারন, বয়স সব কিছু তিতেরের মতোনই। এমনকি কন্ঠও কিছুটা।

‘ নাম কি? ‘

‘ বিভাবরী। জন্মের পর কালা আছিলাম দেইখা মায় সোহাগ কইরা নাম রাখছিল বিভাবরী। বাপে তো তহনই অস্বীকার করছে কালা দেইখা। মা একমাসের মধ্যে মারা গেলে বাপ এনে ফালায় গ্রামান্তরে গেছেগা। ‘

‘ পড়ালেখা করেছো কোন ক্লাস অবদি? ‘

বিভাবরীর স্বর আরো নিচু হলো,
‘ মামিয়ে পড়তে দেয় নাই, নাইনে ওঠছিলাম। ‘

মুচকি হাসলো নিঝুম। মেয়েটার কথা অভিমানের ছোঁয়া স্পষ্ট। কিছুক্ষন নিরবতার পর নিঝুম জানতে চাইলো,
‘ আমি কিন্তু তোমার অনেক বড়। এগারো বারো বছর তো হবেই হয়ত। ‘

বিভাবরী চুপ করেই রইলো। নিঝুম তাই আবার বললো,
‘ বিয়েটা না হলে কেউ কিছু বলবে না তোমায়? ‘

‘ হোওওও! মামি তো মাইরাই ফেলব। ‘
নিঝুম আর কিছু না বলে বসার ঘরে চলে এলো।শায়লাকে বললো ও বিয়েতে রাজি। তবে আজই বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে তবেই ফিরবে।

মিসেস শৈলী সকাল থেকে বাড়িতে হৈচৈ বাধিয়ে রেখেছেন। তিতিরকে কুমিল্লায় একা তিনি কিছুতেই রাখবেন না। মেয়েটা সকালে ফোন দিয়ে কান্না করছিল, তাদের কথা খুব মনে পরছে। ষাহবাব কোনো বুঝ দিয়েই পারছেন না স্ত্রীর সাথে শৈলীর এক কথা, দরকার হলে এখান থেকেই প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়াব। তাও আমার মেয়েটা আমাদের সাথে থাকার জন্য কাঁদবে! তা মেনে নেয়া চলে না। ষশ্মিথকে বলছে ‘বাবা গিয়ে নিয়ে আয় ওকে, নাহলে আমাকে কিছুদিন রেখে আয় তিতিরের কাছে। ‘

উপায়ন্ত না দেখে ষশ্মিথ মিসেস শৈলীকে কুমিল্লা নিয়ে এলো দুদিন পরেই। তিতিরের খুশি দেখেকে! আরবা আর তিতিরের সাথে যে মেয়েটা থাকবে সে এখনো আসেনি। তাই ষশ্মিথ ও ভাবলো দু’দিন নাহয় ও থেকেই যাক তিতিরের কাছে।

রাতে শৈলী রান্না শেষে তিতিরকে ডেকে নিয়ে গেলো নিজ হাতে খাইয়ে দিবে বলে। খাবার মুখে তুলে তিতিরের মনে হচ্ছিলো যেনো অমৃত মুখে দিয়েছে। সেই গন্ধ,মসেই স্বাদ, সেই হাতের ছোঁয়া। এগারোটা দিন কিভাবে কাটিয়ে ও এই খাবার না খেয়ে? শৈলি তিতিরের পাশের চেয়ারটাতে বসে খাইয়ে দিচ্ছে তিতিরকে। ষশ্মিথ আর আরবা অপর পাশে বসা। শৈলী ষশ্মিথকে বললেন,

‘ আচ্ছা আমি পাশের ওই ঘরটাতে ঘুমাবো। ওই রুমটাতো তালা দেয়া। চাবিটা দিস তো! ‘

ষশ্মিথ এবার ইচ্ছে করেই বললো,
‘ মা তিতির তোমাকে এতদিন কত মিস করেছে বলতো। আমাকে তো আগেই বলে দিয়েছে তোমার সাথে ঘুমাবে। ‘

তিতির পুরোই বোকা বনে গেলো। এতবড় মিথ্যা কথাটা কিভাবে বলে দিলো ওর নামে? ও কখন বললো এই কথা! শৈলী খুব খুশি হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। হাসতে হাসতে বললেন,

‘ আচ্ছা আমিই ঘুমাবো তিতিরের সাথে। কিন্তু তোরা নিশ্চয়ই আবার ঝগড়া করেছিস। নাহলে তুই তো এইকথা কোনোদিনও বলতি না! ‘

ষশ্মিথ বললো,
‘ আরে কি যে বলো না মা! আমি তো তোমার মেয়ের কথা ভেবে বললাম। ‘

তিতির একবার আড়চোখে দেখে নিলো ষশ্মিথকে। যাই হোক, ভালো হলো। এই বদমাশটা তো আর জ্বালাবে না! তিতির খুশি হয়ে বললো,
‘ মামনি তাহলে আজ তোমাকে জড়িয়ে ধরে খুব শান্তিতে ঘুমাতে পারব আমি। ‘

রাতের উত্তাপ বেড়ে চলেছে ধীরে ধীরে। এক পশলা শুভ্র স্বচ্ছ কুয়াশা উঁকি দিচ্ছে কৃষ্ণনভেঃ। কুয়াশা আর মেঘেতে খেলায় মেতেছে হারানোর খেলায়। মৃদুমন্দা মোহময় সুরে ষশ্মিথ গান ধরলো,

“বকুলের মালা শুকাবে ,রেখে দিও তার সুরভী | দিন গিয়ে রাতে লুকাবে ,মুছো না কো আমারি ছবি | আমি মিনতি করে গেলাম , এই মন তোমাকে দিলাম ,এই প্রেম তোমাকে দিলাম…
তুমি চোখের আড়াল হও ,কাছে কি বা দূরে রও ,জেনে নিও আমিও ছিলাম ,এই মন তোমাকে দিলাম…”

বারান্দার লোহার গ্রিলের মাঝে মাথা ঠেকে দিব্যি ষশ্মিথ গান চুরি করে নিচ্ছে তিতিরের কান। মনের চঞ্চলতা বাড়ছে। সাথে রাতের মার্ধূয্যতা। হিমশীতল কুয়াশার স্পর্শে গানটা মন্দ লাগছেনা। শুধু একটা জিনিস কম। মানুষটার উপস্থিতি। অনুভব করতে পারছে তিতির, তার প্রত্যেকটা স্পষ্ট স্পর্শ। কিন্তু তার মাঝেও লক্ষ্য বিভ্রম। ঘুম জরানো চোখ দুটিও চাইছে সারারাত চেয়ে থাকতে। তারা দেখতে। মন চাইছে খুনশুটি করতে। বিবেক আজ বাধা দিতে চাইছে না। শুধু ষশ্মিথকে চাইছে।

এনাটমি বইটার কয়েকটা পাতা ওল্টে টেবিলে ফেলে রাখলো আরবা। চোখ থেকে মোটা ফ্রেমে চশমা খুলে রেখে দিলো বইয়ের ওপর। হাত ভাঙ্গিয়ে টেবিলে রেখে তার উপর মাথা গুঁজে ষশ্মিথের কন্ঠ অনুভব করতে লাগলো। চোখের সামনে থাকা ওয়াটারপট-টা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে গেলো। মন কোনো এক কোণ থেকে উঁকি দিচ্ছে প্রিয়তমের প্রতি কিছু সুপ্ত ভালোবাসা। নিজেকে অসহ্য লাগছে। এর আগে যদি মুখ ফুটে একবার নিজের কথাগুলো ষশ্মিথকে বলতো আজ এই গান ওর হতো। শুধুই আরবার!

ঝিম ধরা আবেদনময় একরাতের পর ভোরে আজ হঠাৎই সূর্যের দেখা। কুয়াশার জাল কাটিয়ে সে মুক্তি চাইছে। মাথা নাড়াতেই নরম তুলতে কিছু ঠেকলো ষশ্মিথের মুখে। চোখ বুঝেই নাক, মুখ আওড়াতে শুরু করলো। সেই ঘ্রাণ, সেই জ্বলনময় দহন, সেই তৃষ্ণার্থ স্পর্শ! ক্রমশঃ অবশ করে দিতে লাগলো ষশ্মিথের মস্তিষ্ক। ভার হয়ে এলো মাথা। নাক সমানে ঘষে যাচ্ছে সামনের মানুষটার গায়ে। তার মুখ তিতিরে গলায় ঠেকেছে বেশ বুঝতে পারছে। তিতিরের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়েছিল সারারাত! ত্রস্ত হাতে তিতির কমোর টেনে আরো কাছে এনে জড়িয়ে ধরলো ষশ্মিথ। তিতির যে তার অভ্যাসে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে বুঝতে বাকি রইলো না। ঘুমের মাঝেই ওঠে এসেছে। ষশ্মিথের মাথা বুকে নিয়ে কি নিষ্পাপভাবে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।

চারদিকে চোখবুলিয়ে বিচক্ষণতার সাথে ঘরটাকে দেখে নিলো বিভাবরী। এতবড় বাড়ি এর আগে সে দেখেছে। বাংলা সিনেমাতে। ওর মনে আছে লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমিয়ে মাসে একদিন গায়ের বান্ধবিদের নিয়ে সিনেমা দেখতে যেত। মনোরা টের পেলে সেকি মাইররে বাবা। একবার গ্রামে রাত্রে বড় পর্দায় কোয়েল মল্লিকের ‘অরুন্ধতি’ সিনেমাকে দেখেছিল এমন বড় বাড়ি। আর এখন থেকে সে এখানে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। নিঝুমকে রুমে ঢুকতে দেখেই মাথার ঘোমটা কপাল ছাড়ালো বিভাবরীর হাতের ছোঁয়া। নিঝুম ভিতরে ঢুকে খাটের মাঝে বসে থাকা বিভাবরীর কান্ড দেখে অবাক হলো। মুচকি হেসে বললো,

‘ এত ফরমালিটি দেখাতে হবেনা। এখন থেকে এটা তোমারও ঘর। যাও কাপড় পাল্টে নাও। ‘

‘ আইচ্ছা। ‘
কথা মুখে বললেও খাট থেকে ওঠলো না বিভাবরী। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হলো যাচ্ছো না কেনো। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছ। এখন রেস্ট নেবে তো। ‘

বিভাবরী কিছু না বলে চুপচাপ ওঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। টিয়া কার্লারের একটা থ্রি-পিছ পড়েছে। কালো হওয়ার জন্য তেমন একটা না মানালেও বেশ ভালোলাগছে নিঝুমের কাছে। হাতে কিছু একটা নিয়ে খাটে বসলো নিঝুম। বিভাবরী হাত পাঁচেক দূরে দাড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। নিঝুম খেয়াল করলো মেয়েটার চোখে মুখে অসম্ভব মায়া রয়েছে। এতটা ভালোলাগা কেন কাজ করছে মেয়েটার প্রতি? এটাই হয়ত আল্লাহ্_র সৃষ্টির এক অন্যতম সৌন্দর্য। বিয়ের পর একরাতের মাঝেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কেমন এক অদৃশ্য সূতার বন্ধন তৈরী করে দেন। সুতা ছিড়ে গেলেও যার রেশ থেকে যায় আজীবন। নিঝুম বিভাবরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ বিভাবরী! অর্থ জানো এর? ‘

বিভাবরী মাথা দুই দিকে জোরে জোরে হেলিয়ে দেখালো না।নিঝুম ওর বাচ্চামি দেখে হাসলো।
‘ রাত্রী, রাত। ‘

‘ আমার নামের এত্ত ভালা অর্থ। আমি তো জানতামাই না। ‘

‘ এখন থেকে তোমায় বিভা বলে ডাকব আমি। ‘

‘ হুম। ‘

‘ বকুল ফুল পছন্দ তো? নাও। তোমার জন্য। ‘

বিভা এগিয়ে গিয়ে নিঝুমের হাত থেকে দুই মুঠো ভর্তি করে বকুল ফুল নিলো। খুশি মেয়েটার চোখ মুখ ঠোঁট সব জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছে। নিঝুম একটু ব্যাস্ততা নিয়ে বললো,

‘ কাল থেকে স্কুলে যাবে। পড়ালেখা শুরু করবে। আমার সব কথা হয়ে গেছে প্রিন্সিপালের সাথে। ‘

‘ আপনে না খুউব ভালা। ‘

‘ এই দেখো তোমার কথা বলা আমার একদম পছন্দ হচ্ছেনা। এখন থেকে আমাদের মত করে কথা বলবে। ‘

‘ আইচ্ছা। ‘

‘ ওফ! আচ্ছা। ‘

‘ হুম আচ্ছা। ‘

‘ যাও গিয়ে শুয়ে পরো। ‘

‘ হুম। ‘

কয়েকদিনের মাঝেই বিভার পড়ালেখার প্রতি যত্ন আর টেলেন্ড নিঝুমের চোখে পড়লো। মেয়েটাকে এক পড়া আর দ্বিতীয়বার বুঝাতে হয়না। মনেও রাখতে পারে ভালো। ভালো না বাসলেও বিভার যত্ন নিজ হাতেই করছে নিঝুম। স্কুলেও বেশ কয়েকদিনের মাঝেই ভালো ছাত্রী পরিচয় নিয়ে নিয়েছে। নিঝুমের কষ্টটা অন্য জায়গায়। যতটা খেয়াল ও বিভার রাখছে তার এক সিকিও যদি তিতিরকে দিও মেয়েটা হয়ত খুশি আত্নহারা হয়ে যেত। এখন প্রত্যেকটা পদক্ষেপে হাড়ে হাড়ে টের পায় ঠিক কতটা অবহেলা আর অযত্ন করেছে নিজের ভালোবাসার মানুষটার।

বিভাও এর মাঝে বেশ ভালোবেসে ফেলেছে নিঝুমকে সারাক্ষন ধারে কাছে ঘেঁষাঘেষি না করলে ভালোই লাগে না। তবুও যেন মানুষ নিজেকে অনেক আড়ালে রাখে। মাঝে বিভা মনে মনে হিংসা, রাগ করে তিতিরের প্রতি। নিঝুমের সারা অস্তিত্বে জড়িয়ে আছে তিতির। আবার কৃতজ্ঞতাও জাগে। তিতির এভাবে চলে না গেলে হয়ত নিঝুমের মত, না না নিঝুমকেই সে পেতো না।

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here