চুপি চুপি ইচ্ছেরা পর্ব -০৭

চুপি চুপি ইচ্ছেরা
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

তিতিরের মনে দিনে দিনে অবাধ্যতা বাড়ছে ষশ্মিথের বিচরণের। নিঝুমের বিয়ের খবর শুনে কষ্ট হয়েছিল খুব। কিন্তু ষশ্মিথের ভালোবাসা এর চেয়ে বেশি খুশি দিয়েছে। আজ প্রায় চারমাস পর তিতির বাড়ি এসছে।লম্বা ছুটি পেয়েছে। ষশ্মিথ তখন খাগড়াছড়ি। সে এলো আরো সাতদিন বাদে। এই প্রত্যেকটা দিন তিতিরের মনে হচ্ছিল একেকটা যুগ। ষশ্মিথ আসলে তিতির নিজ হাতে রান্না করে ওর পছন্দের খাবার। রাতে ঘুমানো সময় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই তিতিরকে কাছে টেনে নিলো ষশ্মিথ। তিতিরও চুপচাপ মাথা ঠেকিয়ে দিলো ষশ্মিথের বুকে। ষশ্মিথ এক হাতে তিতিরের চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

প্রকৃতি বড়ই নিরব। বিশাল আকাশ জুড়ে উঁকি দিচ্ছে এক ফালি সূক্ষ চন্দ্র। বারান্দা থেকে হালকা শীতল বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে পর্দাগুলোকে। নিরবতা কাটিয়ে ষশ্মিথ বলে ওঠলো,

‘ আর তো মাত্র সাত দিন আছো আমার কাছে। ‘

‘ হুম। ‘
অভিমাণী সুর তিতিরের। তিতির খুব করে বলতে চাইছিল এর আগে আসোনি কেনো? আমার কষ্ট হয়েছে না বুঝি?
ষশ্মিথ মুচকি হেসে বললো,

‘ ম্যাডাম মনে হয় খুব বেশিই মিস করেছে আমাকে? ‘

থমকে গেলো তিতির। ষশ্মিথ কিভাবে জানলো এ কথা। ছিঃ ছিঃ! কি লজ্জাটাই না পেতে হলো! তিতির ব্যাস্ততার সাথে উত্তর দিলো,

‘ কই না তো! ‘

‘ একটুও না? ‘

‘ উও…হুম। একদমি না। ‘

‘ তাহলে চলে যাব কাল? ‘

‘ মানে? ‘

‘ এসছিলামই তো তোমার জন্য। যখন তুমিই মিস করোনি তাহলে থাকব কেনো? ‘

তিতির কন্ঠ এবার ফ্যাশফ্যাশে হয়ে গেলো,
‘ আপনি খুব খারাপ। চলে যান না, কে করলো? ‘

তিতির ওঠে যেতে চাইলেও ষশ্মিথ আবার শুয়ে দিল ওর বুকে। মুচকি হাসলো সে।
‘ হুম খুব খারাপ আমি। ‘

তিতির আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ষশ্মিথকে।ষশ্মিথ আবার বলতে লাগলো,
‘ আচ্ছা তুমি কখনো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল গুলোতে ঘুরেছো? এই মানে ধরো ঠাকুরগাও, পঞ্চগর, কুড়িগ্রাম। ‘

‘ না। কেনো বলুন তো? ‘

‘ যাবে? ‘

‘ কিন্তু আপনার তো বেশিদিন ছুটি নেই! ‘

‘ সাত দিন যথেষ্ট তিতিরপাখি। ‘

তিতির উত্তেজনাতে এবার ওঠে বসে পড়লো। বললো,
‘ তাহলে অবশ্যই যাব। কবে নিয়ে যাবেন? ‘

‘ কাল? ‘

‘ কালকে! সবাইকে বলতে হবে না? ‘

‘ না, শুধু তুমি আমি। ‘

‘ কিন্তু সবাই গেলে বেশি মজা হতো। প্লিজ চলুন না সবাই মিলে যাই? ‘

আহ্লাদী কন্ঠে কথাটা বলে তিতির। ষশ্মিথ মুচকি হেসে তিতিরকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে,
‘ আমি যে তোমার সঙ্গে একাকী সময় কাটাতে চাই! ‘

চমকে গিয়ে লজ্জা মিশ্রিত চোখে তাকায় তিতির। ষশ্মিথ কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইশঃ লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো কতো তাজা হয়ে উঠেছে! তিতির প্রসঙ্গ প্লাটাতে বলে উঠে,

‘ ব্যাগ ও গোছাতে হবে তো। ‘
ষশ্মিথ এবার একটু শব্দ করে হেসে ওঠলো।

‘ প্যাকিং আমি করে দিব। তাহলে কাল রাতে রওনা দিব আমরা। ওখানে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেই এসছি আমি। ‘

তিতির পুরোই টাশকি খেলো। একটু রাগ নিয়েই বললো,
‘ করেই আসলে আমাকে প্রশ্ন করলেন কেনো? ‘

‘ রাগ করলে? ‘

‘ মোটেই না। খুশি হয়েছি। তবে আপনার যা খুশি করতে পারেন। এখন থেকে আমার কাছ থেকে পারমিশন নিবেন না প্লিজ। ‘

‘ আচ্ছা পাগল মেয়ে! এবার আসো, ঘুমাবে। ‘

‘ হুম। ‘

ষশ্মিথ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। যে মেয়েকে পাওয়া তার জন্য অসম্ভব ছিল সে আজ তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে পরম শান্তিতে ঘুমচ্ছে। তার অর্ধাঙ্গিনী, তার প্রেয়সী। এর চেয়ে শান্তির আর কি হতে পারে! আল্লাহর কাছে খুবই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিতিরকে তার করে দেয়ার জন্য।

চারিদিকে ঘন কৃষ্ণের ছাঁয়া। বাসের আধ-খোলা জানালা দিয়ে এক ঝাপটা ঠান্ডা বাতাস অবিন্যস্ত করে দিলো তিতিরের মন। চুলের খোপা খুলে দিল বাতাসের তালে। সাথে সাথে ষশ্মিথের নাকে এসে বারি খেলো মিষ্টি একটা ঘ্রাণ। বরাবর তিতিরের চুলের প্রাকৃতিক ঘ্রাণ উম্মাদ করে ষশ্মিথকে। স্থান, কাল, পরিবেশ না ভেবে ষশ্মিথ মুখ ডুবিয়ে দিলো তিতিরের চুলে। তিতির এতে স্তম্ভিত হলেও সরিয়ে দিতে পারছিল না ষশ্মিথকে। আসলে ইচ্ছে করছিলো না সরাতে। কতগুলো দিন পর পেলো এই ছোঁয়া। পরম প্রাপ্তিতে চোখ বুজলো তিতির। পরক্ষণেই সোজা হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়লো ষশ্মিথ। তিতিরের বেশ রাগ হলেও চুপ করেই রইলো। প্রথমে নিঝুমকে ভুলতে ষশ্মিথের কাছে যেতে চাইলেও এখন খুব উপভোগ করে তার সঙ্গ। মায়ায় পরে গেছে নাকি? কে জানে! তবে ভালোবাসতে চায় না। তার সব প্রিয় মানুষেরা যে অকালেই হারিয়ে যায়!

বাস ক্রমশঃ আধার ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলো। তিতির ষশ্মিথ উভয়ই নিশ্চুপ। এর মাঝে তিতিরের হঠাৎ করে মনে হলো আজ ও নিজ হাতে বিরিয়ানি আর কাবার বানিয়েছিল ষশ্মিথের জন্য। কিন্তু বলা হয়নি। এখনো হ্যান্ড ব্যাগেই আছে। চটকরে ঘড়িটা দেখে নিলো। পনে দশটা বাজে। ষশ্মিথের ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে ক্ষুদা লেগে গেছে। ব্যাগ থেকে ঝটপট বিরিয়ানির বাটিটা নিয়ে ষশ্মিথের সামনে ধরলো তিতির। ষশ্মিথ একটু অবাক হয়েই বাটিটা নিয়ে দেখলো বাটি ভর্তি করতে বিরিয়ানি আর কাবাব। এবার একটু জোরেই হেসে ওঠে বললো,

‘ ও আচ্ছা সে জন্যই বুঝি তখন ভারী খাবার কিনতে নিষেধ করছিলে? ‘

তিতির একটু লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে বললো,
‘ চামচ, খাওয়া শুরু করুন। ‘

‘ হাত দিয়েই খাই, তুমি খাবে তো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। ‘

‘ না না না। আমাকে মা যেমন খাইছে আজ মনে হয় আগামী দশদিন না খেলেও চলবে। আপনি খান। ‘

ষশ্মিথ একটু আওয়াজ করে হেসেই আবার বললো,
‘ মাও না! কি দরকার ছিল এত কষ্ট করার। ‘

তিতির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ মানে? ‘
‘ মানে আবার কি অসুস্থ শরীর নিয়ে বিরিয়ানি রান্না করার দরকার ছিল! কিনে নেয়া যেতো। ‘

‘ কেনো? কষ্টটা তো অন্য কেউও করতে পারে। ‘

ষশ্মিথ মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলো। মাঝে মাঝে তিতিরকেও খাইয়ে দিচ্ছিল। তিতিরের কাছেও তেমন একটা খারাপ লাগেনি। ষশ্মিথ খুব একটা প্রশংসা না করলেও তৃপ্তি ওর চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল।নবেশ আনন্দ নিয়েই খেয়েছে ষশ্মিথ।নতিতিরের খুব ভালোই লাগছিল।

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে প্রায় দশঘন্টার মত লেগে গেলো। হানিফ, নাবিল, শ্যামলী পরিবহনগুলো ঢাকা থেকে ডাইরেক্ট বাংলাবান্ধা পর্যন্ত যায়। শ্যামলী নন-এসি বাসে রাত সাড়ে আটটায় ওঠেছে ওরা। বাস ভর্তি হয়ে ছাড়তে ছাড়তে প্রায় নয়টা। সকাল সাতটা বিশে পঞ্চগড় সদরে পৌঁছালো বাস। সারাটা রাস্তা তিতির ষশ্মিথের পায়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। ষশ্মিথ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সোজা চলে এলো ‘কাজী অ্যান্ড কাজী’ রিসোর্ট। রিসোর্টটি উত্তর বাংলার পঞ্চগড় জেলার তেতুলিয়া উপজেলার রওশনপুরে অবস্থিত। কম্পানির একান্ত নিজস্ব লোক ছাড়া বাকিরা এলাউড নয় এই রিসোর্টে। রিসোর্টটি ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন হওয়ার এখানে থাকতে গেলে পারমিশন লাগে। তবে উইথআউট প্রেমেন্ট। ষশ্মিথের পরিচিত লোক থাকায় কোনো প্রবলেমে পড়তে হলো না। পঞ্চগড় সদর থেকে রিসোর্টে পৌঁছতে প্রায় দেড়ঘন্টা লেগে গেলো। তিতির ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত। ষশ্মিথের কাধে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে গাড়িতে। তবে গাড়ি রিসোর্টের ভেতর প্রবেশ করতেই একরকম লাফিয়ে ওঠে বসলো তিতির। এক সবুজ আর ফ্রেশ জায়গা যা ধারণাতীত। অনেকটা স্বপ্ন রাজ্যের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রিসোর্টের সামনে এসে গাড়ি থামতেই দেখলো দুজন লোক ওদের ওয়েলকাম করার জন্য পূর্বেই তৈরী।

তিতির আশেপাশের প্রকৃতি চোখ দিয়ে মেপে নিতে লাগলো। একটি রিসোর্ট থেকে অপরটিতে যাওয়ার জন্য রয়েছে পানির উপর ব্রীজ। চাল ছন আর টিনে ছাওয়া বেশ কয়েকটি কর্টেজ। সম্পূর্ণ রিসোর্ট এড়িয়া ঘাসে মুড়নো। তিতিরের চোখে পড়লো ওর থেকে হাত বিশেক দূরে দু’তিনটে ঘোড়া মুক্তভাবে বিচরণ করছে মাঠে। মাঝে মাঝে দোয়েল ডেকে ওঠছে খুব শব্দ করে। বেশ মনোরম পরিবেশ।

তিতির আর ষশ্মিথকে একটা ছেলে এসে তাদের রুম দেখিয়ে দিলো। রুমটা দক্ষিণ দিকে। জানালা কাঠের দোপাট দেয়া। দোপাট খুলতেই এক পশলা মধুময়ী বাতাস ছুয়ে গেলো তিতিরের মুখ, চোখ, গাল,ঠোঁট! হাত মুঠো খুলো আপনা-আপনি ওঠে গেলো বাহুতে। ছেলেটা চলে গিয়েছে। ষশ্মিথ এসে পেছন থেকে হালকা ছোঁয়ায় তিতিরকে নিজের বুকে ঠেঁকালো। ঠোঁট ছোয়ালো তিতিরের গলার শিরায়। শিউরে ওঠে চোখ বন্ধ করে নিলো তিতির। তিতির গলায় কিছুক্ষণ মুখ গুঁজে রেখে হঠাৎই পাগলের মত চুম দিতে লাগলো। শুষে নিতে লাগলো তিতিরের শরীরের বিভ্রম জাগানো গন্ধ। তিতির আজ চুপিসারে সায় দিয়ে যাচ্ছে তার স্বামী নামক প্রেমিক পুরুষকে।

শাড়ির আঁচল উঁকি দিচ্ছে সদ্য ভেজা লতার ফাঁকে।ভোর পাঁচটা বাজে ঘড়িতে। পঞ্চগড় এখনো কুঁয়াশা বাষ্পে মোড়ানো। সাদা ধোঁয়া শরীরে মেখে ছোট্ট ছোট্ট পানি কণাতে পরিণত হচ্ছে। হৃদস্পন্দে এরা ছন্দ খুঁড়ে বাসা বেঁধে নিচ্ছে অবিরাম। তিতির ফজর নামাজ আদায় করে আর ঘুমোয়নি। কুঁয়াশায় নিজেকে ভেজাবে বলে। আকাশময়ী মৃদু আলো ফুটতেই ছুটে এসছে সবুজ-সাদা মিশ্রিত ঘাসে পা ফেলতে। শাড়িও পড়েছে খুব সখ করে। সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে নিজেকে। শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁইছুঁই। অনেকবার ডেকেছে ষশ্মিথকে। কাল রাতে-দিনে ঠিকমতো ঘুমতে পারেনি সে, তাই খুব ক্লান্ত।

তিতিরের অবশ্য একাএকাও খারাপ লাগছেনা খুব একটা। এখানে কয়েকদিন কাটালে কোনো মানুষ কবি হয়ে ওঠতে পারবে মুহূর্তে। তিতিরের ও খুব ইচ্ছে করছে এই পরিবেশের প্রেমে পড়ে একটা গোঁটা কবিতা লিখে ফেলতে। ঘাসে পা ফেলে হাটতে হাটতে হঠাৎ কোথাও লেগা হোঁচট খেয়ে পরে যাওয়ার উপক্রম হতেই একজোড়া শক্ত হাত ঝাপটে আকড়ে ধরলো তিতিরের কোমল পেট। খোলা চুলগুলো মাথা দুপাশ বেয়ে ঝাঁকি খেয়ে আবার ফিরে এলো নিজ স্থানে। সেই হাতের মালিক তিতিকে টেনে মিশিয়ে নিলো বুকের সাথে। তিতিরের পিঠ এবার মিশে গেছে মানুষটাতে, মাথা ল্যাপ্টে আছে বুকে। ম্লান হেসে তিতির বললো,

‘ আপনি! ‘

ষশ্মিথ নিশ্চুপ রইলো। ওর চোখের স্পর্শ তিতিরকে বুঝিয়ে দিলো মনের আকুতি। ষশ্মিথের চোখের মাঝে মনের সকল অস্টষ্ট ভাষা উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিচ্ছে তিতিরের কাছে। তিতির তা পড়ছে, দেখছে, শিখছে। ষশ্মিথের চোখজোড়া যেন চিৎকার করে বলতে চাইছে তিতির,

‘ ভালোবাসি ভালোবাসি।খুব খুব খুব করে ভালোবাসি আমার তিতিরপাখিকে। ‘

আকাশে দৃষ্টি স্থির করে একমনে ছাদে দাড়িয়ে আছে বিভাবরী। চোখ তার জ্বলছে। প্রচন্ড জ্বলছে। বুক ভার হয়ে আছে। বুকের ভেতর দলা পাকানো কষ্ট গুলো সকল বাধন ছেড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে চোখ দিয়ে। বুঝে ওঠার আগেই শ্রাবণ ধারার মতো টুপ টুপ করে পানি ঝড়তে লাগলো অশ্রু হয়ে। কষ্ট ধীরে ধীরে প্রত্যেকটা রক্তকণার মধ্য দিয়ে বেয়ে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছে। ছাদে বসেই দুই হাতে মুখ চেঁপে কাঁদতে লাগলো। মানুষটা তাকে ভালোবাসতে পারবেনা জেনেও ভালোবেসে ফেলেছে বিভা। কষ্ট এখন খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে তাকে। ও তো একটা মেয়ে। এক মানবী স্বত্তা। জীবনে ভালোবাসা ওকে ছুঁয়ে যায়নি কখনো কিন্তু ওর খুব করে ইচ্ছে করে ভালোবাসা পেতে। ইচ্ছে করে স্বামীর বুকে মাথা রেখে রাত পাড় করতে। দুষ্ট মিষ্টি আদরে নিজেকে ভেজাতে। খুব ইচ্ছে করে তো! খুব করে। কান্নারা সব ঝটলা পাকিয়ে গিয়েছে মুখের ভেতর। জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো বিভা। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

‘ হ্যা হ্যা হ্যা, আমি খুব ভালোবাসি আপনাকে। নিজের করে চাই। কবে বুঝবেন আপনি নিঝুম। খুব করে চাই। আমার প্রত্যেকটা অস্তিত্বে ধারণ করতে চাই আপনাকে। কালো বলে কি আমার ভালোবাসার, ভালোবাসা পাবার অধিকারটুকুও নেই? ‘

নিঝুম বাড়ি ফিরেছে তখন রাত বারটা। কলিং বেল চেপেই যাচ্ছে কেউ খোলার নাম নেই। শপিং করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেলো। বিভার জন্য পছন্দ করে হলুদ রঙ্গের একটা সিল্কের শাড়ি কিনেছে। বিভার পছন্দের সব খাবার ও নিয়ে এসছে বাহির থেকে। নিঝুম যতই বুঝাক না কেনো বিভা মেয়েটা ও না ফেরা পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকবে। একদম তিতিরের মতো! অনেকক্ষণ বেল বাজানোর পর মিসেস শায়লা ঘুমঘুম চোখে ওঠে এসে দরজা খুললেন। নিঝুম ত্রস্তভাবে চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখে নিলো। বিভার উপস্থিতি পেলো না। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে? না,তা কি করে সম্ভব। কখনো তো ঘুমায় না। আর ঘুমোলে তো একদমই চলবে না। নিঝুম দ্রুত জিজ্ঞেস করলো,

‘ বিভা কই মা? ‘

শায়লা ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘ চোখ লেগে গেছে বোধ হয় মেয়েটার। জেগে থাকলে কি আর উপায় ছিল। হাওয়ার বেগে ছুটে আসতো দরজা খুলতে। ‘

‘ আচ্ছা আমি ঘরে যাই। ‘

‘ এই শোন। মেয়েটা খায়নি। ওকে তুলে খাইয়ে দিবি। ‘

‘ হুম আচ্ছা। ‘

নিঝুম ঘরে ডুকে ভীষণভাবে চমকে গেলো। বিভা ঘরে নেই। এত রাতে কি মেয়েটা তাহলে ছাদে বসে আছে? দ্রুত পা চালিয়ে ছাদে চলে এলো নিঝুম। ছাদে পা দিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতেই চোখে পড়লো দেয়াল ঘেঁষে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে বিভা। নিঝুম বিভার কাছে গিয়ে কয়েকমুহূর্ত মায়া ভরা মুখটা দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখে শরীর ঠান্ডা হয়ে এসছে বিভার। দ্রুত কোলে তুলে নিলো। ঘরে এনে খাটে শোয়াতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো বিভার। তড়িঘড়ি করে ওঠে বসলো সে।

‘ আপনি কখন এলেন? ‘

‘ যখন তুমি ছাদে ঘুমোচ্ছিলে! ‘

লজ্জায় চিবুক বুকে নামালো বিভা।বললো,
‘ হাত মুখ ধুয়ে আসুন। খাবার গরম করছি। ‘

‘ খাবার নিয়ে এসছি। ওইখানে প্যাকেট নিয়ে যাও। ‘

প্যাকেটগুলোতে হাত দিতেই বিভার হাতে পড়লো শাড়িটা। হলুদ রঙ্গের বেশ সুন্দর। নিঝুম সবসময় বলতো হলুদ শাড়িতে তিতিরকে বেশ লাগে। তাহলে শাড়িটা তিতিরের জন্যই কিনেছে! বিভার জন্য কিনলে তো তাকে দিতোই। নিঝুম বিভাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

‘ আচ্ছা শোনো তিতির…। ‘

নিঝুমকে শেষ করতে না দিয়েই বিভা বলে ওঠলো,
‘ তিতিরের জন্য কিনেছেন শাড়িটা তাই তো! ‘

নিঝুম অবার হয়ে শার্টের বোতামে হাত দিয়েই দেখতে লাগলো বিভাকে। কিছুটা থেমে অভিমাণি সুরে আবার বললো,
‘ কেনো? সব কিছুতে তিতির কেনো? শুধু কালো বলে কি আমি ভালোবাসার অযোগ্য। ভালোবাসা যায়না আমায়? ‘
নিঝুমের চোখমুখ শক্ত হলো।দুর্বল কন্ঠে বললো,
‘ শাড়িটা তিতির নয় তোমার জন্যেই এনেছিলাম আমি। শুধু বলতে চেয়েছিলাম তিতিরের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাব তোমায়। আর ভালোবাসা আমার কাছে আশা করে লাভ নেই তা তোমাকে আগেই ক্লিয়ার করে দিয়েছি আমি। ‘

বলেই ঘরে থেকে বের হয়ে গেলো নিঝুম। বিভা তবুও খুশি থাকলো। অন্তত তার জন্য শাড়ি কিনেছে নিঝুম ভালো নাহয় নাই বাসলো। এতটুকু যত্নেই নাহয় সুখ খুঁজে নেবে সে!

একসাথে কিছু সময় কাটিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলো ষশ্মিথ আর তিতির। আটটা নাগাদ রওনা হল মির্জাপুর শাহী মসজিদের উদ্দেশ্যে। রিসোর্ট থেকে মসজিদে পৌঁছতে ৪৫ মিনিটের মত লেগে গেলো। আটোয়ারী উপজেলায়। তিতির মুগ্ধ এই মসজিদের দর্শনে। মসজিদটি ১৬৫৬ সালে নির্মাণ করা ৪০ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৫ফুট প্রস্থের এখনো বাংলাদেশের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শণের মধ্যে পড়ে। ছোট্ট নেইম ফলকে এর সম্পর্কে অনেক তথ্য দেয়া আছে। তিতির তা পড়তে চাইলে ষশ্মিথ বললো,

‘ এখানে তেমন কিছু লিখা নেই মসজিদ সম্পর্কে। তবে অনেকে বলেন স্থানীয় বাসিন্দা মালিক উদ্দিন এর নিমার্ণ করেন। আর নিমার্ণ কাজ করেন তারই বন্ধু মোহাম্মদ। মোগল আমলে তৈরী করেন এ মসজিদ। ‘

তিতির অবাক ভঙ্গিতে জানতে চাইলো,
‘ আপনি এর আগেও এসছেন এখানে? ‘

‘ আমি বাংলাদেশের প্রায় অনেক জেলাই ঘুরেছি। এখানের এই নিয়ে তিনবার”

তিতির এবার অবাক না হয়ে পারলো না। ওর ধারণা ছিল বাংলার উত্তরাঞ্চলের দিকটাতে ঘুরার তেমন কিছু নেই! তবে মনোরম পরিবেশ, প্রকৃতি যেনো নিজে এসে ধরা দিলো। মসজিদের ভেতর ঢুকে দেখতে পেলো পুরো মসজিদেই তিনটি গম্বুজ এবং সাথে মিনার। দুই জনই দু’রাকাত সুন্নাত নামাজ আদায় করে নিলো মসজিদে। তারপর চলে এলো আটোয়ারী ইমামবাড়ায়। ইমামবাড়াটি মির্জাপুর মসজিদের খুব কাছেই। তিতির ইমামবাড়া ঘুরে দেখলো। এটি মাত্র এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিশাল কক্ষ বিশেষ। ইমামবাড়ার পাশেই কিছু প্রাচীন কবর রয়েছে। যা এখনো অনেক রহস্যময় স্থানীয় লোকদের কাছে।

সেখান থেকে বের হয়ে বারো আউলিয়ার মাজারে আসে। যদিও তিতির প্রথমে আসতে চায়নি কিন্তু ষশ্মিথ এক প্রকার জোর করেই নিয়ে এসছে। তিতির রাগ করে বললো,
‘ আমি যাব না। মাজারে যাওয়া খারাপ আপনি জানেন না? ‘

‘ আহা তিতিরপাখি, মাজারে যাওয়াটা খারাপ না। মানুষ যে মাজারে এসে মৃত ব্যাক্তির কাছে তাদের মনের আশা পূরণের জন্য দোয়া করে তা খারাপ। কারণ মৃত ব্যাক্তি কখনই কিছু দিতে পারেনা। দেয়ার মালিক শুধুই আল্লাহ। কিন্তু আমরা তো মাজারের এই বড় বড় পীড়দের জান্নাত লাভের জন্য দোয়া করতে পারিনা তাইনা? যেমন তুমি তোমার মৃত বাবার কবর জেয়ারত করে করো ঠিক তেমনটা। ‘

‘ আচ্ছা! ‘

‘ জানো ধর্ম প্রচারের জন্য এই বারো জন আউলিয়া এসে বসবাস করেছিলেন এখানে। ‘

তিতির আমতা আমতা করে বললো,
‘ এর পর কোথায় যাচ্ছি? ‘

‘ উমমম…এরপর। এখান থেকে মহারাজার দীঘি দেখে ভিতরগড় দূর্গে যাব। পারবেনা যেতে? নাকি রেস্ট লাগবে? ‘

‘ পারব না মানে? খুউব পারব। আ’ম এ স্ট্রং লেডি আফটারঅল! ‘

তিতিরের বাচ্চামো দেখে ষশ্মিথ হো হো করে হেসে বললো,
‘ হুম মাই লেডি, মাই সোল! ‘

তিতির এবার লজ্জা পেলো। নতঃমাথা করে মুচকি হাসলো। ষশ্মিথ অবাক চোখে দেখছে তার প্রেয়সীকে। লজ্জা পেলে তার ছাঁয়ার মেয়েটার চোখ, মুখ, ঠোঁট সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। খুব বেশিই আবেদনময়ী লাগে। এই যেমন এখনি ষশ্মিথের ইচ্ছা করছে টুপ করে একটা কামোর লাগিয়ে দিতে ওর মৃদু গোলাপী ঠোঁটে। আশেপাশে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে হন্তদন্ত করে কমোড় চেঁপে নিজের কাছে নিয়ে এলো ষশ্মিথ। আকস্মাৎ টেনে আনায় চোখবুজা মুখে অস্ফূট লজ্জা মিশ্রিত ভয়ে দেখতে পেলো ষশ্মিথ। ষশ্মিথের বুকের বাম দিকের শার্টে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ তিতির। কাচুমাচু হয়ে গেলো।
মুহূর্তের মধ্যে তিতিরের ঠোঁটে ঠোঁট চালালো ষশ্মিথ। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো ঠোঁটের বিচলন। শান্ত করে লাগলো বেহায়া মন। তিতির কিছুই বললো না, শুধু বেখায়ালে হাত দুটো শক্ত করে আকড়ে ধরতে চাইলো ষশ্মিথের শার্ট। ষশ্মিথের হাত স্লাইড করে উপরে ওঠতে ওঠতে তিতিরের ঘাড়ে এসে ঠেকলো। ইষৎ টানে আরো কাছে নিয়ে এলো তিতিরকে। ষশ্মিথের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আছড়ে পড়তে লাগলো তিতিরের মুখে। পাগল করে দিচ্ছে ওকে এই মোহময় অনুভূতি। চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো খুব সহজে।

সাড়ে বারোটার মধ্যেই ঘুড়া শেষ করল মহারাজার দিঘি, ভিতরগড় দূর্গ। মহারাজার দিঘি বিশালাকার জলাশয়। ৮০০বাই ৪০০গজ আয়নের এই দিঘির গভীরতা প্রায় ৪০ফুট।দশটি ঘাটলা। ভিতরগড় দূর্গ পঞ্চগড় জেলাসদর থেকে ১৬কি.মি. উত্তরে অবস্থিত।প্রায় ২৫বর্গকি.মি. স্থান জুড়ে তৈরী মধ্যযুগের দূর্গনগরী।এটি কয়েকটি স্তরে চার বেষ্টনীতে বিভক্ত। এর উত্তর এবং পূর্বপশ্চিমের দেয়াল ভারতের জলপাইগুড়ি অংশে পড়েছ।

রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে প্রায় দেড়টা পার হয়ে গেলো। এসেই গোসল সেড়ে খেয়ে নিলো দু’জন। ষশ্মিথ নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তিতিরকে। খাওয়ার ফাঁকে তিতির বলতে লাগলো,
‘ আচ্ছা আর কি কি ঘুড়ার জায়গা আছে এখানে? ‘

‘ এখনো তো কোথাও যাওইনি। বদেশ্বরী মন্দির, গোলকধাম মন্দিরl আর ডাকবাংলো গেলে তো পাগল হয়ে যাবে। ‘

‘ ওমা!এত্তো কিছু? ‘

‘ ডাকবাংলো থেকে সরাসরি কাঞ্চনজংঙ্ঘা দেখা যায় শীত আর হেমন্তে। ‘

‘ কিহ! সিরিয়াসলি। ‘

‘ হুম ম্যডাম। এটা অনেকেরই অজানা। ‘

‘ আমি দেখব। আজই যাব প্লিজ! ‘

‘ আরে দেখাব বলেই তো নিয়ে এলাম। তবে ওখানে কাল সন্ধ্যে যাব। একদিন থাকব। ‘

তিতির খুশিতে কি করবে বুঝতে না পেরে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো ষশ্মিথকে।ষশ্মিথ হেসে বলো,
‘ এখন রেস্ট নাও। একটু পর বের হবো আবার। ‘

তিতির চুপচাপ শুয়ে রইলো। ষশ্মিথ বারান্দায় দাড়ানো।বরাবর, দেখা যাচ্ছে ভালোভাবেই। সিগেরেট খাচ্ছে পিলারে ঠেঁস দিয়ে দাড়িয়ে। অবশ্য তার আগে তিতিরের কাছ থেকে অনুমতিও নিয়ে গেছে। কেনো যেন ষশ্মিথকে সিগেরট খেতে দেখে রাগ হলেও কিছু বলতে পারেনা ও। অসম্ভব মায়াবী লাগে ছেলেটাকে তখন। সিগেরেটের ধূসর ধোঁয়া যখন শূণ্যে ছেড়ে দেয় মনে হয় ষশ্মিথের চেয়ে সুদর্শণ পুরুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু সেটা খাওয়া তো খারাপ। আর ও থাকতে তা কিভাবে হতে দিতে পারে নাকি!

তড়িঘড়ি করে বারান্দায় ছুটে এলো তিতির। এসেই খপ করে সিগেরেটটা খপ মেরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো পাশের জলাশয়। ঘটনার আকস্মিকতাৎএকটুও চমকায়নি ষশ্মিথ। বরং আরো মুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখছে তার সহধর্মিনীর রাগ। কপট রাগ দেখিয়ে তিতির বললো,

‘ সিগেরেট খেয়ে যদি ঠোঁট পোড়ান না, আমি এই ঠোঁটে চুমু দিব না! ‘

ষশ্মিথ উচ্চস্বরে হেসে কাছে টেনে নিলো তিতিরকে। দু’হাতে কমোরে চাপ দিয়ে উচু করে বসিয়ে দিলো রেলিংএ। কপালের বিন্দু বিন্দু মুক্তর মতো পানির উপর পড়ে থাকা চুলগুলোকে দুই আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে খুব যত্ন গেঁথে দিলো কানের পেছনে। মুখ তিতিরের কানের কাছে নিয়ে নরম চুমু দিয়ে মোলায়েম ঝংকার করে বললো,

‘ তোমার জন্য শুধু সিগেরেট কেনো সব ছাড়তে পারে এই ষশ্মিথ! ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here