#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৭
অন্ধকারে এগোনো চারটি খানি কাজ নয়। আমি তো আর বিড়াল নই যে চোখ জ্বালিয়ে অন্ধকারে হাঁটব। এগোতে নিলেই টেবিলে লেগে পড়ে যেতে নিলাম। তখনই বলিষ্ঠ কোনো হাত চেপে ধরলো আমার বাহু। হেঁচকা টানে একদম তার কাছে নিয়ে গেল। নাকে ঠেকলো মাতাল করা সুগন্ধ। এমন পারফিউম আমি আগেও পেয়েছি। তবে কোথা থেকে পেয়েছি মনে পড়ছে না। কে ধরে আছে আমাকে? হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে নিলেই এক হাত দিয়ে আমার দুহাত বন্দী করে ফেললো। খুব দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এখন ইচ্ছে করছে বিড়াল হতে। যদি বিড়াল হতে পারতাম তাহলে হয়তো দেখতে পেতাম। একটা হাত আমার ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করলো। শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এ কেমন শীতল হাত! কিছুক্ষণ পর আমার আশে পাশে আর কারোর অস্তিত্ব অনুভব করলাম না। বিদ্যুৎ চলে আসলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমি ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। দূর দূরান্তে কেউ নেই। আন্টি চা আর বিস্কুট এনে টেবিলের ওপর রেখে বললেন–
— দাঁড়িয়ে আছো কেন? অন্ধকারে আবার ভয় টয় পাওনি তো?
আমি ধপ করে বসে বললাম–
— না আন্টি। এমনি দেখছিলাম হাতের কাছে কোনো টর্চ বা অন্যকিছু পাই কিনা।
— আচ্ছা ঠিক আছে। খাও এখন।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিলাম। তখন ঠিক কি হয়েছিল আমার সাথে? সবটাই কি আমার কল্পনা ছিল? এখানে তো আন্টি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। আর দরজাও লক করা। তাহলে? এমন বাস্তবের মতো কল্পনা কীভাবে সম্ভব? স্পর্শ গুলো একদম জীবন্ত ছিল। আর আমার ঠোঁট! ঠোঁটে হাত দিলাম। এখানেও তো ছুঁয়ে ছিল। কি অদ্ভুত! এমন জীবন্ত কল্পনাও হয়?
—
কলেজ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি রানি আর আমি। রানি তো কিছুতেই যাবে না। তার এক কথা, “ওই ক্যাবলা কান্তর সাথে আমি যাবো না। আমাকে কি অপমান টাই না করলো। আমি কিছুতেই যাবো না।” আমি ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে–
— আরে রানি, আমার কথা শোন। আফীফ ভাই তো তোকে অপমান করেছে তাই না? তুইও আজ ইচ্ছে মতো ওনার টাকা উড়িয়ে শোধ নিবি। আমার বুদ্ধিটা কেমন বল?
রানির আমার কথা মনে ধরলো। অতঃপর সে এক পায়ে রাজি হয়ে গেল। আজ সে আফীফ ভাইকে নাকানিচুবানি খাইয়েই ছাড়বে। আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কিছুক্ষণ পর আফীফ ভাই আসলেন। স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বললেন–
— তোমরা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছ নাকি?
আমি বললাম–
— না ভাইয়া। আমরা কিছুক্ষণ হলো দাঁড়িয়েছি।
— ঠিক আছে। চলো তাহলে যাওয়া যাক?
আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলাম। আফীফ ভাই এগিয়ে গেলেন পিছু পিছু চললাম আমরা। কিছুদূর যেয়ে আফীফ ভাই একটা রিকশার পেছন থেকে দেখিয়ে বললেন–
— তুমি ওটাতে যাও। এই হাওয়া হাওয়ায়ী কে নিয়ে আমি আসছি।
রানি বেঁকে বসে বলল–
— না! আমি আপনার সাথে এক রিকশায় কিছুতেই যাবো না। আমি ছায়ার সাথে যাবো।
রানি এগোতে নিলেই আফীফ ভাই তার হাত চেপে ধরে বললেন–
— ছায়া তুমি যাও। আসলে কি বলো তো? তোমার বান্ধবীর সাথে আমার কিছু কথা আছে। তুমি যাও।
আমি অসহায় হয়ে এগিয়ে গেলাম। পেছন থেকে রানি চেঁচাচ্ছে–
— ছায়া! আমাকে রেখে যাস না। এই! ছাড়ুন আমাকে। আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ক্যাবলা কান্ত কোথাকার। ছাড়ুন বলছি।
আফীফ ভাই রানির কোনো কথা কানে না তুলে তাকে টানতে টানতে নিয়ে রিকশায় উঠলেন। রিকশায় উঠতে গিয়েই চকমে উঠলাম। বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে গেল। রিকশায় বসে থাকা ব্যক্তি ভাবলেশহীন ভাবে বললেন–
— মুখ বন্ধ করো। মাছি ঢুকবে।
আমি হকচকিয়ে গিয়ে মুখ বন্ধ করে নিলাম। ছলছল চোখে সামনে তাকিয়ে দেখলাম আফীফ ভাইদের রিকশা ইতোমধ্যে অনেকটা চলে গিয়েছে। আফীফ ভাই কাজটা ঠিক করলেন না। আপনার কপালে হাওয়া হাওয়ায়ী জুটবে দেখে নিয়েন। ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠ আমায় ভাবনার জগৎ থেকে টেনে বের করলো।
— তুমি কি যাবে? যদি যেতে চাও তাহলে ওঠো, নাহলে আমি চলে যাচ্ছি।
আমি মুখ কালো করে উঠে বসলাম। ওনার সাথে এক রিকশায় বসতে গেলে ওনার গা ঘেঁষে বসতে হয়। রিকশার অর্ধেকের বেশি বর্ণ ভাইয়ের সুঠাম দেহ দখল করে আছে। আমি যত পারছি চেপে বসছি। হঠাৎ কোমরে শীতল স্পর্শে শিউরে উঠলাম। উনি কোমরে এক হাত চেপে টেনে নিলেন। সামনে তাকিয়ে থেকে বললেন–
— আবোল তাবোল কিছু ভেবো না আবার। যেভাবে বসেছিলে একটু ধাক্কা লাগতেই রাস্তায় আছাড় খেতে। আর লোকে ভাবতো আমি তোমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি। সো নিজের সেফটির জন্য আমাকে এমনটা করতে হলো।
ওনার কথা তো বুঝলাম। কিন্তু এদিকে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথম কোনো পুরুষ এভাবে স্পর্শ করলে ঠিক কেমন লাগতে পারে? হোক সেটা পরিস্থিতির কারণে।
একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে রিকশা থামলো। উনি নিজের হাত সরিয়ে নিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে নেমে পড়লাম। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ভাড়া দেবো নাকি দেবো না? বলা তো যায় না, উনি যদি আবার লজ্জা দেন? ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে নিলেই উনি বললেন–
— তোমার কি আমাকে এতোটা গরিব মনে হয় যে আমি একটা রিকশা ভাড়া প্রর্যন্ত দিতে পারবো না?
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম–
— এ কথা আমি কখন বললাম?
— এই যে তুমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিলে, এটাতে সেই কথাই প্রমানিত হয়।
কি মুশকিল! টাকা দিলে দোষ না দিলেও দোষ। আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি ভাড়া মিটিয়ে এগোতে লাগলেন। আমাকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–
— আপনাকে কি ভেতরে যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিতে হবে জনাবা?
ওনার উপহাসের কথা শুনে তীব্র আক্রোশ জন্মালো। গটগটিয়ে হেঁটে রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেরতে গিয়ে দেখলাম কোণের একটা টেবিলে রানি এবং আফীফ ভাই বসে আছেন। আমি সেখানে গিয়ে রানির পাশে ধপ করে বসে বললাম–
— আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারলেন আফীফ ভাই?
হঠাৎ প্রশ্নে আফীফ ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন–
— কি করেছি আমি?
— আপনি ওই অসভ্য লোকটার সাথে এক রিকশায় আমাকে পাঠিয়ে দিলেন? কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি।
— বর্ণ তোমাকে কিছু করেছে নাকি?
আমি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললাম–
— ওই লোক পারে শুধু আমাকে হেনস্থা করতে। ইচ্ছে তো করে..
— কি ইচ্ছে করে জনাবার?
অতি আবেগে ভেসে গিয়ে যেসব বলছিলাম এই একটা কন্ঠে তা আমার বন্ধ হয়ে গেল। বর্ণ ভাই আফীফ ভাইয়ের পাশে আমার মুখোমুখি বসলেন। আবারও বললেন–
— কি হলো বলো? তোমার দেখি অনেক ইচ্ছে। আমরাও একটু শুনি।
আমি মাথা নিচু করে নিলাম। উনি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, যে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলাবার ক্ষমতা আমার নেই। আফীফ ভাই বললেন–
— আরে বর্ণ ছাড় তো। ছায়া কি খাবে বলো? তোমাদের তো আবার বাড়িতেও ফিরতে হবে তাই না?
আমি রানিকে খোঁচা দিলাম। সে বলল–
— আচ্ছা শুনুন।
আফীফ ভাই বাঁধা দিয়ে বললেন–
— তোমার কাছে শুনতে চেয়েছি? ছায়া তুমি বলো।
রানি আঙুল উঁচিয়ে বলল–
— দেখুন! একে তো রিকশায় করে জোর করে এনেছেন আবার বক বক করে আমার মাথা খেয়েছেন। আবার আমার..
রানি থেমে গেল। আফীফ ভাই ভ্রু নাচিয়ে বললেন–
— হ্যাঁ আবার তোমার? তারপর?
রানি ইতস্তত করতে লাগলো। আফীফ ভাই আবারও বললেন–
— কি হলো বলো?
— আপনি আমাকে আঙুলে কামড়ে দিয়েছেন। বিলাই কোথাকার!
আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। এদিকে বর্ণ ভাই নিজের ফোনে ব্যস্ত, এখানে যে কিছু হচ্ছে সে খেয়াল তার নেই। আফীফ ভাই রানির উঁচু করা আঙুল ধরে কুটুস করে কামড়ে দিলেন। রানি আর্তনাদ করে উঠলো–
— আহ্! আপনি আবার কামড়ে দিলেন? আসলে আপনি শুধু বিলাই না, আপনি হলেন একটা জংলি বিলাই।
— তুমি যত বার এভাবে আঙুল উঁচু করবে তত বার আমি কামড়ে দেবো।
রানি চুপ হয়ে গেল। আফীফ ভাই নিজের পছন্দ মতো অর্ডার দিলেন। আফীফ ভাই আর আমি গল্প জুড়ে দিলাম। রানি মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। আর বর্ণ ভাই? তিনি ফোন নিয়েই ব্যস্ত। কোন গার্লফ্রেন্ড এর সাথে চ্যাট করছেন কে জানে? খাবার চলে এলো। চিকেন ফ্রাই, নুডুলস্, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পেস্ট্রি কেক আর কোল্ড ড্রিংকস্। আফীফ ভাই আর আমার কথা থামলো না। আমাদের সাথে থাকা আরও দুজন চরম বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাতে আমাদের যাচ্ছে আসছে না। আফীফ ভাইয়ের দুই একটা কথাই আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। হঠাৎ কোল্ড ড্রিংক পান করতে গিয়ে বড় সড় রকমের বিষম খেলাম। নাকে মুখে উঠে যা তা অবস্থা। বর্ণ ভাই লাফিয়ে উঠে চেয়ার টেনে আমার পাশে বসলেন। মাথায় লাগাতার হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। বিস্ময়ে আমার বিষম এমনি এমনিই ভালো হয়ে গেল। #ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৮
আমার চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। যে ব্যক্তি এতক্ষণ নির্লিপ্ত ছিল কোনো দিকে যার খেয়ালই ছিল না, সেই ব্যক্তি আমার সামান্য বিষয় নিয়ে কেমন উতলা হয়ে উঠলো! তিনি আমার মুখের সাথে পানি ধরে ধমকের সুরে বললেন–
— হা করে তাকিয়ে না থেকে খাও।
আমি হকচকিয়ে পানি পান করে নিলাম। আমাদের দেখে আফীফ ভাই আর রানি মুখ টিপে হাসছে, যেন তারা খুব মজা পাচ্ছে। বর্ণ ভাই টেবিলে গ্লাস রেখে বললেন–
— সব সময় তো তিড়িং বিড়িং। খাওয়ার সময় অন্তত একটু শান্ত হয়ে খাও।
আফীফ ভাইয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন–
— আফীফ! এখন আর একটা কথাও হবে না। চুপ চাপ খা।
আফীফ ভাই আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে খাওয়া শুরু করলেন। বর্ণ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন–
— কি হলো খাও?
আমি কেঁপে উঠে মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললাম–
— খেয়েছি তো। আর খাবো না।
বর্ণ ভাই চোখ ছোট ছোট করে বললেন–
— কি খেয়েছ তুমি?
— চিকেন ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিংক।
— ব্যস? পেট ভরে গেল?
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। বর্ণ ভাই গমগমে কন্ঠে বললেন–
— আফীফ কোনো দিন কাউকে ট্রিট দেয় না, এমনকি আমাকেও না। শা/লা কিপটে। আজ তোমার জন্য ও ট্রিট দিচ্ছে, আর তুমি এতো গুলো খাবার নষ্ট করবে? সেটা আমি কিছুতেই হতে দিয়ে পারি না।
আফীফ ভাই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন–
— আমি মোটেও কিপটে নই।
— তুই চুপ থাক।
বলেই তিনি নুডুলসের প্লেট হাতে নিয়ে নুডুলস্ আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন–
— খাও।
আজ যেন আমার অবাক হওয়ার দিন। বর্ণ ভাই! যে আমাকে এক প্রকার সহ্য করতে পারেন না। তার কেয়ারিং রুপ দেখে রীতিমতো আমি অবাকের শীর্ষে। মনে মনে ভাবলাম “খিটখিটে মেজাজের হলেও লোকটা বেশ কেয়ারিং। ইশ্! যে বর্ণ ভাইকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।” তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করে নুডুলস্ মুখে নিতে বললেন। আমি চুপ চাপ খেয়ে নিলাম। সত্যি বলতে আমার বাবা , মামা, চাচার পর তিনিই একমাত্র পুরুষ যার হাতে আমি খেলাম। শুধু খেলামই না, তৃপ্তিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
—
টিভিতে মুভি দেখছিলাম আর চিপস খাচ্ছিলাম। এমন সময় মা আমার সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম–
— উফ্ মা! সরো তো। দেখতে পাচ্ছি না তো।
মা রাগান্বিত কন্ঠে বললেন–
— তোর এসব ছাড়া আর কোনো কাজ নেই ছায়া? পড়ালেখা নেই তোর? কদিন পর যে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা সে কথা মাথায় আছে? বই ছুঁয়ে দেখিস একটুও?
আমি বিরস মুখে তাকিয়ে রইলাম। রোজ রোজ এক কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেল। মা আবারও বললেন–
— রেজাল্ট ভালো না করতে পারলে তোকে রিকশা ওয়ালাও বিয়ে করবে না। তখন থাকিস বাপের ঘাড়ের ওপর বসে।
— মা! থামবে তুমি?
— কেন রে? থামবো কেন? আমার শেষ কথা শুনে রাখ, তোর জন্য একটা স্যার ঠিক করেছি। রোজ রাতে এসে তোকে পড়াবে। ভদ্র মেয়ের মতো পড়বি। যদি একটুও বাঁদরামি করেছিস তো আমার ঝাড়ু আর তোর পিঠ। মনে থাকে যেন।
মা আমাকে শাসিয়ে চলে গেলেন। আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। আশ্চর্য! কি এমন স্যার যে রাতে পড়াবে! এখন তো এক্সট্রা খাটুনি হবে। কোচিংয়েও যাও আবার রাতে প্রাইভেট টিউটরের কাছেও পড়ো। জীবনটা আসলেই বেদনার।
রাতে রুমে শুয়ে শুয়ে মেসেঞ্জারে চ্যাট করছিলাম। কয়টা বা বাজে? সাড়ে সাত কিংবা আট? এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। তারপর ড্রয়িং রুম থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো। কারো সাথে খুব গদগদ হয়ে কথা বলছেন। আমি বাদে বাকি সবার সাথে উনি খুব ভালো ব্যবহার করেন। বাবাকেও আমার দলে ধরা চলে। বাইরে থেকে মায়ের আওয়াজ এলো–
— ছায়া! এই ছায়া!
আমি অলস ভঙ্গিতে ফোনটা পড়ার টেবিলের ওপর রেখে বাইরে গেলাম। সোফায় বসে থাকা ব্যক্তিকে দেখে ভয়ংকর ভাবে ভড়কে গেলাম। নিজের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ রসগোল্লার আকার ধারণ করলো। একটা গেঞ্জি আর প্লাজু পরে আছি। গলার দুপাশে ওড়না ঝোলানো। এতক্ষণ শুয়ে ছিলাম, চুল গুলো নিশ্চয়ই পাখির বাসার মতো দেখাচ্ছে? মা আমাকে দেখিয়ে বললেন–
— বাবা বর্ণ এই হলো আমার মেয়ে ছায়া।
উনি আমার দিকে তাকানোর সাথে সাথে আমি দৌড়ে রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম। হায় আল্লাহ্! ওনার সামনে আমি এভাবে! ছিঃ ছিঃ উনি কি ভাবলেন! এই প্রথম উনি আমাদের বাসায় এলেন আর আমি! লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাইরে থেকে মায়ের কন্ঠ ভেসে আসছে–
— এই মেয়েটাও না! তুমি কিছু মনে কোরো না বাবা। আসলে খুব চঞ্চল ও।
বর্ণ ভাইয়ের কন্ঠ পেলাম না। আমি দ্রুত চেঞ্জ করে বাইরে গেলাম। এবার পরিপাটি হয়েই বেরিয়েছি। মা বললেন–
— তুই এভাবে চলে গেলি কেন ছায়া? কি মনে করলো ছেলেটা? যা ওকে তোর ঘরে নিয়ে যা।
মাথাতেই ঢুকছে না, ওনাকে আমার রুমে কেন নিয়ে যাবো? মা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–
— কি হলো? যা। বর্ণ আজ থেকে তোকে পড়াবে। ওর সব কথা শুনে চলবি।
এবার যেন চারশো কুড়ি ভোল্টের ঝটকা খেলাম। বর্ণ ভাই আমাকে পড়াবেন! বর্ণ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। আমার অপেক্ষা না করেই আমার রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। ভাগ্যিস নতুন স্যার আসবে বলে মা বিকেলে ঘরটা গুছিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে কি লজ্জাটাই না পেতে হতো। বর্ণ ভাই টেবিলে চেয়ার টেনে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–
— বসো।
তার ঝংকার তোলা পুরুষালী কন্ঠে বুক কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে বসে পড়লাম। এই লোকটার সামনে যেতেই আমার কাঁপা কাঁপি শুরু হয়। আর রোজ এই লোকটা আমাকে পড়াতে আসবে! ভাবা যায় এসব? তিনি বললেন–
— পরিচয় দিয়ে শুরু করবো। আমি আমার পরিচয় বলবো তারপর তুমি তোমারটা বলবে। ঠিক আছে?
আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। তিনি বিরক্ত হলেন। বললেন–
— মাথা দোলানো, বাঁকানো এসব আমার সামনে করবে না। মুখে জবাব দেবে। বুঝেছ?
আমি আবারও ঘাড় কাত করতে যেয়েও থেমে গিয়ে বললাম–
— জি।
বর্ণ ভাই মুখ খুলবেন এমন সময় আমার ফোন টুং করে উঠলো। পর পর বেশ কয়েকবার শব্দ হলো। ফোনটা টেবিলের ওপরই ছিল। ভুল বশত আমি নেট অন করে রেখেছিলাম। বর্ণ ভাই ফোন হাতে তুলে নিলেন। ভ্রু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–
— জানু কে?
আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম–
— রানি।
— “ছায়ার বাচ্চা তোর আফীফ ভাই আমাকে জ্বালিয়ে মেরে ফেললো। আমি কিন্তু ওই ব্যাটার গলা টিপে পটল ডাঙায় পাঠাবো বলে দিলাম।”
“বর্ণ ভাইয়ের সাথে কি তোর কিছু চলছে নাকি রে ছায়া? সেদিন কি সুন্দর তোকে গালে তুলে খাওয়ালো। আহা! আমার ক্রাশটা কত্ত ভালো দেখেছিস?”
রানির পাঠানো মেসেজ বর্ণ ভাই পড়ে আমাকে শোনালেন। আরও একবার লজ্জায় পড়ে গেলাম। বর্ণ ভাই ফোন অফ করে রেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–
— এসব হয় দুই বান্ধবীর মাঝে?
আমি নিজের সাফাই গাইতে বললাম–
— বিশ্বাস করুন। আমি এসবের কিছুতেই নেই। রানি নিজে নিজে এসব করে। এক নম্বরের লুচু মহিলা।
শেষের কথাটা ধীর কন্ঠে বললাম। বর্ণ ভাই সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন–
— পড়ার সময় ফোন অফ রাখবে। মনে থাকবে?
আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিলাম। তিনি রেগে গিয়ে বললেন–
— আবার সেই ঘাড় বাঁকানো! কি বলেছি তোমায়?
আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–
— স স্যরি। আর হবে না।
— ঠিক আছে। এখন পরিচয় শুরু করা যাক। আমি আওসাফ বর্ণ। আমার বাবার নাম সৈয়দ আব্দুল্লাহ। মায়ের নাম মিসেস বিথী বেগম। আমার কোনো ভাই বোন নেই। আমি তিন বছর আগে আমার পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছি। আপাতত চাকরি করছি না, ইচ্ছে হলে করবো পরে।
এবার তুমি বলো।
পড়াতে এসে কেউ এতো কিছু বলে তা আগে জানা ছিল না। আমি বলা শুরু করলাম–
— আমি তাহসীনা ছায়া। বাবার নাম মোস্তফা রহমান। মায়ের নাম মিসেস তামান্না বেগম। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমি একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী।
— ঠিক আছে। এবার আমি তোমাকে একটা রুটিন তৈরি করে দেবো। সেই অনুযায়ী রোজ পড়তে হবে।
উনি রুটিন তৈরি করে দিলেন। উনি যা পড়ালেন ভদ্র মেয়ের মতো পড়লাম। এমন একটা ভান করলাম যেন আমার থেকে ভদ্র মেয়ে আর দুটি নেই। সত্যি বলতে ওনার সামনে আমি একদমই ভেজা বেড়াল। মা আমাকে কাত করেই ছাড়লো। পড়ানো শেষে আমি মিনমিন করে বললাম–
— আপনি কি রোজ পড়াতে আসবেন?
— কেন? রোজ এলে কি তোমার সমস্যা হয়ে যাবে?
— না না। তা হবে কেন? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।
— আমার সময় হলে আমি রোজই আসবো। আর যে পড়াগুলো দিয়ে যাচ্ছি, সেগুলো যেন আগামীকাল রেডি থাকে।
হুমকির সুরে বলে উনি চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লাম। আমার আনন্দের দিন শেষ। সবই কপাল!
চলবে..