ছায়াবর্ণ পর্ব -০৯+১০

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৯

আজ আমি একদম পরিপাটি হয়েই বসে আছি। বলা যায় না হুট করেই তিনি কখন চলে আসেন। কিন্তু মূল কথা হলো আমি পড়া করতে ভুলে গিয়েছি। আমার একদম মনেই ছিল না। প্রথম দিন তো, উনি হয়তো মাফ করে দেবেন। এখন বাজে আটটা। একই বাড়ি হওয়ার সুবাদে তিনি যখন তখন পড়াতে আসতেই পারেন। ওনার সময়েরও একটা ব্যাপার আছে। বাবা আসেন দশটায়। বাবা আসার আগেই তিনি বেরিয়ে যান। মা ডাকলেন, আমি আস্তে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। তিনি এসেছেন। মা অসন্তোষ কন্ঠে বললেন–

— তোর কি কান্ড জ্ঞান কখনও হবে না রে ছায়া? বর্ণ না তোর স্যার? এসেই হা করে দাঁড়িয়ে আছিস, সালাম দেবে কে শুনি?

আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। সত্যিই তো, কাজটা ঠিক হয়নি। আমি বিনম্র হয়ে সালাম দিলাম–

— আসসালামু আলাইকুম।

তিনি জবাব দিয়ে আমার অপেক্ষা না করেই রুমে চলে গেলেন। এমন ভাবে হেঁটে গেলেন যে, দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে এ লোক মহা ব্যস্ত মানুষ। মা ধমকের সুরে বললেন–

— দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছেলেটার অনেক কাজ থাকে, তোর মতো শুয়ে বসে দিন পার করে না। সময় বের করে যে তোকে পড়াতে আসে সেটাই তোর চোদ্দ গোষ্ঠীর ভাগ্য ভালো। যা, আমি ছেলেটার জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি।

আমি হতাশ শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম। মায়ের সাথে পেরে ওঠা কখনও সম্ভব নয়। বর্ণ ভাই নিজে নিজেই বই বের করে ওল্টাচ্ছেন। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম। বসার সাথে সাথেই তিনি বললেন–

— অ্যাডাম স্মিথ এর অর্থনীতির সংজ্ঞা বলো।

এই রে! এবার কি হবে? আমি তো বই খুলেই দেখিনি। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ ভেবে কাঁচুমাচু হয়ে বললাম–

— পারি না।

উনি অদ্ভুত চোখে তাকালেন। যেন বিশ্বের সেরা গর্দভ দেখছেন উনি। থমথমে কন্ঠে বললেন–

— কত মাস হচ্ছে কলেজে যাচ্ছ?

— তিন মাস।

— আর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার কত মাস বাকি আছে?

— তিন মাস।

— তিন মাসে কি করেছ? অ্যাডাম স্মিথ এর সংজ্ঞা টা পর্যন্ত বলতে পারছ না। আমি পড়া দিয়ে গিয়েছিলাম তাও পড়োনি। পরীক্ষায় কি লিখবে তুমি? আমার মাথা নাকি তোমার মু’ন্ডু?

মাথা নিচু করে বসে আছি। সত্যিই আমার চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো অবস্থা। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–

— আজ কিছু বললাম না। আমি যা পড়াবো এবং পড়া দিয়ে যাবো সবটা রোজ রেডি চাই আমার। পড়ালেখার ফাঁকি আমি একদম পছন্দ করবো না।‌ পরবর্তীতে শাস্তি পেতে হবে মনে রেখো।

উনি সুন্দর করে রুটিন অনুযায়ী পড়িয়ে দিলেন। এমন ভাবে পড়ালেন যে আমার মাথায় তা গেঁথে গেল। সত্যিই উনি একজন চমৎকার শিক্ষক।

আজ শুক্রবার। আমার শান্তির দিন। বর্ণ ভাইয়ের পড়ালেখার অত্যা’চারে প্রাণ ওষ্ঠাগত। পড়া একটু আটকে গেলে তিনি তা দশবার পড়িয়ে পাঁচ বার লেখান। আমি তো পারি না দেওয়ালে মাথা ঠু’কে কাঁদতে। আজ তো আর পড়াতে আসবেন না, সেই ভেবেই আমি শান্তিতে বসে টিভি দেখছি। এখন বাজে সাতটা। বাবা বাইরে গিয়েছেন। মা ঘর গোছাচ্ছেন। তিনি শান্ত হয়ে বসতে পারেন না। কোনো না কোনো কাজ তাকে করতেই হবে। আমি বুঝি না, এতো কাজ তিনি কীভাবে করেন? হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি সেদিকে এক পলক তাকিয়ে আবার টিভিতে মনোযোগ দিলাম। টান টান অ্যাকশান সিন চলছে। মা বিরক্তিতে দরজা খুলতে খুলতে বললেন–

— মুখের সামনে দরজা, উনি একটু উঠে খুলতে পারলেন না। আমাকেই আসতে হলো।

দরজা খুলতেই শোনা গেল–

— আরে ভাবি আপনি! আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।

বাড়ি ওয়ালা আন্টি কে দেখে আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রতার সাথে সালাম দিলাম। তিনি জবাব দিয়ে হাসি মুখে বললেন–

— ভাবি, আমি একটু শপিং এ যাবো। ছায়াকে যদি আমার সাথে একটু যেতে দিতেন।

— অবশ্যই যাবে। কিন্তু আপনি এ সময়ে যাচ্ছেন যে!

— আসলে কি বলুন তো ভাবি? আপনার ভাইয়ের একদম সময় নেই। আর বর্ণ টাও বাড়িতে ছিল না। মাত্র এলো, আর আমার যাওয়াও খুব দরকার। তাই আর কি।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

মা আমাকে ডেকে বললেন–

— ছায়া! আন্টির সাথে একটু যা তো। যা রেডি হয়ে আয়।

আমি রেডি হতে গেলাম। শপিং মানেই আমার কাছে একটা আনন্দের বিষয়, সেটা আমার হোক বা অন্যের। মানা করার প্রশ্নই আসে না। আমি বোরখা পরে হিজাব বেঁধে নিলাম। আন্টিও রেডি হয়েই এসেছেন। মাকে বিদায় জানিয়ে আমরা নেমে আসলাম।
নিচে বর্ণ ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। আন্টিকে বললেন–

— দাঁড়াও আমি সিএনজি ডেকে নিয়ে আসি।

তিনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সিএনজি নিয়ে এলেন। সিএনজির পেছনে তিন ছিটের বসার জায়গা এবং সামনে চালকের দু পাশে দুজন। বর্ণ ভাই চালকের পাশে বসলেন। চালকের অপর পাশে ইতোমধ্যে একজন যাত্রি বসে আছেন। আমি আর আন্টি ভেতরে উঠে বসলাম। এখান থেকে শপিং মল বেশ কিছুটা দূরে। যেহেতু আমার পাশে একজন বসার জায়গা আছে, সেহেতু লোক দেখে চালক সিএনজি থামালেন। আমি চেপে বসলাম। অজ্ঞাত পুরুষের পাশে বসা আসলেই অস্বস্তিকর। লোকটি উঠে বসার আগেই বর্ণ ভাই বলে উঠলেন–

— দাঁড়ান!

লোকটা থেমে গেল। বর্ণ ভাই নেমে বললেন–

— যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি সামনে বসবেন? এই দুজন আমার লোক, তাই তিনজন একসাথে বসলে সুবিধা হতো আর কি।

লোকটা দ্বিমত করলেন না। সামনে উঠে বসলেন। বর্ণ ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কেন জানি না এই মানুষটার সাথে থাকলে নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে হয়। রাস্তার দুই এক জায়গায় খারাপ আছে। প্রচন্ড এক ঝাঁকুনিতে আমি উল্টে পড়ে যেতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ বর্ণ ভাই আগলে নিলেন। পিঠের পেছন দিয়ে হাত গলিয়ে বাহু চেপে ধরে এক হাতের মধ্যে বেঁধে নিলেন। আন্টি পাশে থাকায় দ্বিগুন অস্বস্তিতে পড়ে মোচড়া মুচড়ি শুরু করলাম। উনি কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা কন্ঠে বললেন–

— চুপ চাপ বসে থাকো। রাস্তা সামনে আরও খারাপ আছে। ধাক্কা ধুক্কি খেয়ে ব্যথা ট্যথা পেলে তো আন্টি আমাকে বলবেন যে তার ভালো মেয়ে নিয়ে আসলাম আর আহত বানিয়ে নিয়ে গেলাম। তা না হলে আমার তো খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই যে তোমাকে ধরে বসে থাকবো।

অপমানে মুখ থমথমে হলো। আমি কি বলেছি যে আমাকে ধরে রাখুন? একশো বার ধাক্কা খাবো আর কপালে ফুলিয়ে আলু বানাবো। হুহ! সিএনজি এসে শপিং মলের সামনে থামলো। তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে নেমে গেলেন। আমি আর আন্টিও নেমে পড়লাম। বর্ণ ভাই ভাড়া মিটিয়ে এগোতে লাগলেন। আমি আর আন্টি হাঁটলাম তার পিছু পিছু। আন্টি আমায় বললেন–

— আমার সাথে সাথে থাকবে ছায়া। এখানে কিন্তু অনেক ভিড়।

আন্টি একটা শাড়ির দোকানে ঢুকলেন। বর্ণ ভাই এক পাশে বসে ফোন দেখতে লাগলেন। আন্টি একের পর এক শাড়ি দেখে চলেছেন। জামদানি শাড়ি। আমি জিজ্ঞেস করলাম–

— শাড়ি কি নিজের জন্য নিবেন আন্টি?

আন্টি শাড়ি দেখতে দেখতে বললেন–

— না গো। আমাদের বাড়ি থেকে দুইটা বাড়ি রেখে একটা ভাবিদের বাড়ি। আমাদের প্রতিবেশীই বলা চলে। তবে ওনাদের সাথে অনেক ভালো সম্পর্ক আমাদের। তাদের মেয়ের বিয়ে আগামীকাল। তোমার আংকেল আর বর্ণ ব্যস্ত থাকায় কিছুই কেনা হয়নি। তাই আজ ভাবলাম একটা ভালো শাড়ি নিয়ে নিই। ভালো হবে না বলো?

— খুব ভালো হবে।

— কিন্তু আমি তো পছন্দ করতেই পারছি না। তুমি একটু দেখো তো।

আমি শাড়ি দেখতে লাগলাম। গাঢ় একটা খয়েরী রঙের শাড়ি ভালো লাগলো। আন্টিকে বললাম–

— দেখুন তো আন্টি এটা কেমন?

আন্টি গদগদ হয়ে বললেন–

— এটা তো খুব ভালো হবে ছায়া। মেয়েটা ফর্সা আছে তোমার মতো। ও’কে এটা বেশ মানাবে।

আন্টি এটা প্যাক করে দিতে বললেন। মেলে রাখা শাড়ি দেখতে দেখতে আমার একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল। কালো রঙের একটা জামদানি। অসম্ভব সুন্দর! আমি হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। ইশ্! যদি বাবার সাথে আসতাম তাহলে এটা নিয়েই যেতাম।‌ কিন্তু তা হলো না, এটা পরে আর পাওয়াও যাবে না। মন খারাপ হয়ে গেল। শাড়ি আমার হাতে গোনা কয়েকটা আছে। শাড়ির পাশে খুব কম যাই আমি। শাড়ি সামলানো বিরাট ব্যাপার। তবুও পছন্দ হলেই কিনে রাখি। তবে এটা হলো না। আন্টি বললেন–

— ছায়া চলো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আন্টি হাঁটতে হাঁটতে বললেন–

— ভাগ্যিস তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম। নাহলে তো আমি শাড়ি পছন্দ করতেই পারতাম না।

আমি কিছু বললাম না। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার ফলে এক যুবকের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার পূর্বেই এক বলিষ্ঠ হাত টেনে সরিয়ে দিল আমায়। বর্ণ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— কপালে চোখ নেই? আর একটু হলেই ধাক্কা খেতে ওই ছেলের সাথে। দেখে হাঁটো।

আমি মুখ কালো করে হাঁটতে লাগলাম। আন্টি বললেন–

— তোর হাতে ওটা কিসের ব্যাগ? কি কিনেছিস?

— আমার প্রয়োজনীয় একটা জিনিস।

আন্টি আর কিছু বললেন না। এবার সিএনজিতে আন্টির হাত ধরে বসে ছিলাম। যেন উনি ধরতেও না পারেন আর কথা শোনাতেও না পারেন।
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১০

সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। আজ আন্টির প্রতিবেশীর সেই মেয়ের বিয়ে। আন্টি জেদ ধরে বসেছেন যে আমাকে তার সাথে যেতেই হবে। তিনি মা কেও রাজি করিয়ে ফেলেছেন। আর মা বাবাকে রাজি করিয়েছেন। আন্টি নিচে গিয়েছেন রেডি হতে। আমি বিছানায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মা বললেন–

— বসে আছিস কেন ছায়া? যা রেডি হয়ে নে। ভাবি তো এখনই চলে আসবেন।

আমি হতাশ কন্ঠে বললাম–

— আমি কি পরে যাবো মা?

মা এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি একটা এলিয়েন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন–

— কি সুন্দর একটা সাদা জামা কিনে দিয়েছিলাম। সেটা তো কোথা থেকে রঙে গোসল করে নষ্ট করলি। নষ্ট না হলে আজ দিব্যি ওটা পরে যেতে পারতি। এখন ওই রঙ চঙ মাখা জামা পরে যা।

আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম–

— এই জন্যই আমি যেতে চাইনি। যাব না আমি। আন্টিকে বলে দিও।

মা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে আমার ওয়ারড্রবের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার একটা মিষ্টি রঙা শাড়ি বের করে বললেন–

— এসব কিনেছিস কি জন্য? সাজিয়ে রাখবি বলে? আয় তোকে এটা পরিয়ে দিই।

আমি নাকোচ করে বললাম–

— আমি শাড়ি সামলাতে পারব না মা। আমি পরব না।

— আমি সুন্দর করে পরিয়ে দেবো। কোনো সমস্যা হবে না। তাড়াতাড়ি আয়।

অগত্যা আমাকে শাড়ি পরতে হলো। মা সুন্দর করে পিন লাগিয়ে সেট করে দিলেন। শাড়ির সাথে পরলাম কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত হাতা ওয়ালা ব্লাউজ। চুল খোপা করে আর্টিফিসিয়াল গাজরা লাগালাম। হাতে পরলাম কাঁচের চুড়ি। চোখে একটু আইলাইনার আর ঠোঁটে হাকলা গোলাপী লিপস্টিক ছাড়া আর তেমন সাজলাম না। মা আমার আপাদমস্তক দেখে বললেন–

— দেখ তো, শাড়ি পরলে তোকে কি সুন্দর লাগে! আর তুই শাড়ি পরতেই চাস না। যা এখন তোর আন্টি অপেক্ষা করছে বোধহয়।

আমি মৃদু হেসে হাতে ফোন নিয়ে বের হয়ে গেলাম। বিনা নিমন্ত্রণে যেতে কেমন একটা লাগছে, আন্টিও না! বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসলেন। আমি আন্টি দের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খোলাই আছে। আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, এমন সময় দেখলাম বর্ণ ভাই ফোন চাপতে চাপতে এগিয়ে আসছেন। পরনে একটা হলুদ রঙের টি শার্ট এবং কালো ট্রাউজার। উনি কি বিয়েতে যাবেন না? হুট করে ফোন থেকে মুখ তুলে উনি কেমন থমকে গেলেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টিতে কেমন যেন নুইয়ে পড়লাম। আন্টি এসে বর্ণ ভাইকে বললেন–

— এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সর।

বর্ণ ভাই সম্বিত ফিরে পেয়ে সরে গেলেন। আন্টি একটা ফিরোজা রঙের শাড়ি পরেছেন। তিনি আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন–

— ও’মা! ছায়া! তুমি শাড়ি পরেছ! কি সুন্দর লাগছে তোমায়! আমারই তো নজর লেগে যাচ্ছে।

আমি হাসলাম। হঠাৎ বর্ণ ভাই বললেন–

— মা! দুই মিনিট ওয়েট করো।

বলেই তিনি হনহনিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি পরিপাটি হয়ে ড্যা’সিং লুক নিয়ে বের হলেন। কালো রঙের জিন্স আর ইয়াশ রঙের শার্ট পরনে তার। উন্মুক্ত চুল গুলো কপালে পড়ে আছে। আজ না জানি কত মেয়ে কাত হবে! আমার নিজেরই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ, এসব কথা উনি জানতে পারলে কি মনে করবেন! আন্টি অবাক হয়ে বললেন–

— তুই যাবি! তুই যে বলেছিলি যাবি না, তোর কি কাজ আছে। তাহলে?

উনি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললেন–

— এখন আর কাজ নেই মা। তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে যাই।

— আচ্ছা ঠিক আছে চল। দেরি হয়ে গেল তো। চলো ছায়া।

বাড়ি যেহেতু কাছেই সেহেতু আমরা হেঁটেই গেলাম। জাঁকজমক ভাবে সাজানো বিয়ে বাড়ি। লোক জন গিজগিজ করছে। আমি আন্টির পাশে পাশে হাঁটছি। সবাই অপরিচিত, কাউকেই চিনি না। বর্ণ ভাই আমাদের পিছু পিছু হাঁটছেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আন্টি বললেন–

— ছায়া তুমি এখানে বসো, আমি গিফট দিয়ে আসি।

আন্টি চলে গেলেন। আমি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। বর্ণ ভাই আমার পাশে বসে বললেন–

— পড়ালেখায় সব সময় ফাঁকি তাই না? পড়ার ভয়ে নাচতে নাচতে বিয়ে বাড়ি চলে এলে? আমি তো তোমাকে পড়াবো বলেই আসতে মানা করেছিলাম।

বিয়ে বাড়িতে আছি মুডটা একটু ভালো ছিল। সেটাও ওনাকে খারাপ করতেই হবে! আমি মুখ গোমড়া করে বললাম–

— আমি নাচতে নাচতে চলে আসিনি। আন্টি জোর করে এনেছেন।

তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে বললেন–

— বুঝেছি, যত সব বাহানা।

আমি কিছু বললাম না। ওনাকে কিছু বলাই বৃথা। আমি আশে পাশের লোকজন দেখতে লাগলাম। একেক জন কি সুন্দর করে সেজে এসেছে! আমার দেখতে খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ একটা মহিলা আমার পাশে বসে বললেন–

— তুমি কে গো মা? কার সাথে এসেছ?

— আমি বিথী আন্টির সাথে এসেছি।

উনি পাশের বর্ণ ভাইকে দেখে বললেন–

— বর্ণ! এটা তোমার কোনো বোন বুঝি? ভারি মিষ্টি মেয়ে।

আমি লজ্জা পেলাম এভাবে বলায়। বর্ণ ভাই ফোন থেকে মুখ তুলে বললেন–

— সে আমার কেউ হয় না আন্টি। আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকে মাত্র।

বর্ণ ভাইয়ের এমন কথায় মন খারাপের আভাস পেলাম। মহিলাটি আমার কাছে বিভিন্ন কথা শুনতে লাগলেন। যেমন: তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়? তোমার বাবা কি করেন? ইত্যাদি। এক সময় বর্ণ ভাই বললেন–

— আপনার ছেলের সাথে এই মেয়ে হবে না আন্টি। সে কেবল দশম শ্রেণীতে উঠেছে।

মহিলাটির মুখ থমথমে হয়ে গেল। তিনি আফসোসের সাথে বললেন–

— এতো ছোট?

— হ্যাঁ।

মহিলাটি চলে গেলেন। আমি চোখ বড় বড় করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম–

— আপনি মিথ্যে বললেন কেন?

তিনি দাঁত কটমট করে বললেন–

— তো কি বিয়ে করতে চাও? এসব শাড়ি টাড়ি পরে কি ছেলেদের মায়েদের দেখাতে এসেছ? যেন তারা দেখে আর তোমাকে তুলে নিয়ে যায়? বিয়ে করার এতোই শখ?

ওনার ঝাঁঝালো কথায় আমার চোখের কোণে জল জমলো। আমি ঢোক গিলে বললাম–

— আমি বুঝিনি যে উনি এই জন্য আমার থেকে এসব জিজ্ঞেস করছিলেন।

— তা বুঝবে কেন? তুমি তো নার্সারিতে পড়ো।

আমি মুখ ঘুরিয়ে উঠে যেতে নিলেই উনি শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন। শাসিয়ে বললেন–

— খবরদার এখান থেকে এক পাও নড়বে না।

অগত্যা আমাকে বসে থাকতে হলো। লোকে বিয়ে বাড়িতে এসে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আর আমাকে মুর্তি হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

নয়টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল। বিয়েও পড়ানো শেষ। বর বউকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। দু’জনকে মানিয়েছেও বেশ। আন্টি বর্ণ ভাইকে বললেন–

— আমার যেতে দেরি হবে। মেয়ে বিদায় দিয়ে তারপর যাবো। তুই ছায়াকে নিয়ে বাড়িতে যা। ও শাড়ি পরে আর থাকতে পারছে না।

বর্ণ ভাই রাজি হলেন। আমাকে ইশারা করে এগোতে বলে নিজে হাঁটতে লাগলেন। আমি গুটি গুটি পায়ে ওনার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। উনি এতো জোরে জোরে হাঁটছেন যে আমি ওনার সাথে পেরে উঠছি না। আমি হাঁপিয়ে গিয়ে বললাম–

— একটু আস্তে হাঁটুন প্লিজ। আমি আপনার সাথে পারছি না।

উনি দাঁড়িয়ে বললেন–

— হাঁটতেই যখন পারো না তখন শাড়ি পরলে কেন?

— আচ্ছা ঝামেলায় পড়লাম তো। মা আমাকে জোর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। আমি নাচতে নাচতে শাড়ি পরিনি। আপনি সেই তখন থেকে আমাকে এই নিয়ে কথা শোনাচ্ছেন। এতোটা বাজে দেখতে লাগছে আমাকে? ধুর! আর কোনো দিন শাড়ি পরবোই না। আজ আমার আসাই উচিত হয়নি।

আমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বর্ণ ভাই এক হাতে আমার দু হাত মুড়িয়ে পেছনে আটকে ফেললেন। এক হাত আলতো করে আমার গাল স্পর্শ করলেন। তিরতির করে কেঁপে উঠলাম। ফাঁকা রাস্তায় কেউ নেই, শুধু আমরা দুজন। ওনার চোখের দিকে তাকালাম, এই চোখের ভাষা আমি পড়তে জানি না। তিনি ফিসফিস করে বললেন–

— তোমার এই নতুন রুপ দেখে যে একজনের মনের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা জানলে তুমি কখনও শাড়ি পরতে না। তোমার এই সাজ দেখে যে একজনের ঠিক কত বার হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছে, তা জানলে তুমি এমন সাজতে না। তোমার এই গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট দেখে যে একজন তা ছোঁয়ার জন্য ছটফট করছে, তা জানলে তুমি ঠোঁট রাঙাতে না। তোমার হাতের এই রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে যে একজন মাতাল হয়ে যাচ্ছে, তা জানলে তুমি চুড়ি পরতে না। কখনও না।

আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব শুনে গেলাম। কিছুই বুঝলাম না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ধীর কন্ঠে বললাম–

— কে সেই একজন?

তার হাত ঢিলে হলো। ছেড়ে দিলেন আমায়। হাঁটতে হাঁটতে বললেন–

— দ্রুত এসো। কাজ আছে আমার। লোকদের দেওয়া নেওয়া করার মতো সময় নেই আমার।

আমি মুখ গোমড়া করে হাঁটতে লাগলাম। এতক্ষণ কি সব বকলেন উনি? কার কথা বললেন? কিছুই তো মাথায় ঢুকলো না। আসলেই মূ’র্খ আমি! গণ্ড মূ’র্খ! বাড়িতে পৌঁছে উনি বললেন–

— আগামীকাল পড়াতে যাবো। সব পড়া যেন রেডি থাকে। আর একটু আগে কি না কি বলেছি ভুলে যাও। ফোনে দেখেছিলাম তাই মুখ থেকে বের হয়ে গিয়েছে।

আমি ওপরে চলে এলাম। উনি না বললেও আমি জানি উনি কখনও আমাকে এসব বলতে পারেন না। না জানি ওনার গার্লফ্রেন্ড কে এসব বলেন কিনা?

চলবে..
{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here