#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৫
বাড়িওয়ালা আন্টি ডেকেছেন। অদ্ভুত হলেও তিনি এখন আমার শাশুড়ি। মাকে বার বার করে বলেছেন আমাকে যেন পাঠিয়ে দেন। এই খবর তিনি বর্ণ ভাইকে দিয়ে পাঠিয়েছেন। এখন সাড়ে আটটা বাজে, বর্ণ ভাইয়ের পড়ানো শেষ। তার সাথেই এসেছি। প্রবেশ করার সময় বর্ণ ভাই কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন–
— শশুর বাড়িতে তোমাকে স্বাগতম।
আমি হা করে তাকাতেই উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে গেলেন। আমাকে দেখে আন্টি বললেন–
— এসো ছায়া। আজ তোমার আংকেল বাড়িতে নেই বুঝলে? তাই ডাকলাম তোমাকে ডিনারে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আর তুমি তো আসোই না, আমি কিন্তু রাগ করেছি।
আমি হেসে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললাম–
— স্যরি সুইট আন্টি। এবার থেকে সময় পেলেই আসবো আর দুজনে খুব গল্প করবো।
আন্টি হেসে ফেললেন। দুজনে সোফায় বসে গল্পে মেতে উঠলাম। আন্টির যত গল্প জমানো আছে সব একে একে বলছেন। এরই মধ্যে বর্ণ ভাই রুম থেকে বের হয়ে এলেন। ফোন হাতে নিয়ে আমার সোজাসুজি সিঙ্গেল সোফাতে বসলেন। আন্টি বললেন–
— কিরে! তুইও আমাদের সাথে গল্প করবি নাকি?
বর্ণ ভাই ফোন চালাতে চালাতে বললেন–
— না, তোমাদের মতো গল্প পাগল নই আমি। রুমে বোর হচ্ছিলাম তাই এসেছি।
আন্টি আমার দিকে ফিরে বললেন–
— একবার কি হয়েছিল শোনো। ছোট বেলায় বর্ণের সামনের দুটো দাঁত একসাথে পড়ে গিয়েছিল। যখন দাঁত বের করে হাসতো তখন কি যে দেখাতো ছায়া! আমরা ছেলের হাসি দেখেই হেসে ফেলতাম। আর ও সবার সামনে যেয়ে দাঁত দেখিয়ে হাসতো। পুরোনো দাঁত পড়ে নতুন দাঁত উঠবে সেই আনন্দে হেসে বেড়াতো। আর যখন কথা বলতো তখন দাঁতের মাঝ দিয়ে কথা ফসকে যেতো। আর এখন দেখো সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে পড়ে থাকে।
আন্টির কথায় আমি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। ওনার ছোট বেলার গল্প শুনে খুব মজা লেগেছে। বর্ণ ভাই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বললেন–
— ক্ষুধা লেগেছে মা।
বলেই উঠে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন। আন্টি উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে বললেন–
— সেকি! এতো তাড়াতাড়ি?
— হ্যাঁ খেয়ে ঘুমাবো।
আন্টি আমাকেও ডেকে বসতে বললেন। আমি একটা চেয়ার টেনে বসতে গেলেই বর্ণ ভাই হালকা কেশে আমাকে ইশারা করে নিজের সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। আন্টি ব্যস্ত থাকায় সেটা দেখতে পেলেন না। আমি বোকার মতো ওনার সামনে বসলাম। আন্টি খাবার সার্ভ করতে করতে বললেন–
— জানো ছায়া? এ কদিন ইন্টারভিউ এর জন্য দিন রাত এক করে পড়েছে। খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করতো না। দরজা বন্ধ করে পড়তো। পর পর সাত জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছে। এখন একটা চাকরি জুটলেই হয়।
আমি ওনার দিকে তাকালাম। এই জন্যই কি লোকটা ঘুমাতে পারেনি? আন্টি আমাকে সার্ভ করে দিয়ে নিজে বসলেন। খাবার মুখে দিতেই হোঁচট খেলাম। আমার পা কেউ পা দিয়ে চেপে ধরেছে। আমি চোখ রসগোল্লার আকার করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি স্বাভাবিক ভাবে খেয়ে চলেছেন। দেখে বোঝার উপায় নেই। আমার গলায় খাবার আটকে আসছে। ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছি না। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি পাত্তা দিলেন না। আমি পানি দিয়ে বহু কষ্টে খাবার গিললাম। বললাম–
— আন্টি আমার খাওয়া শেষ। বেসিন টা কোন দিকে?
আন্টি অবাক হয়ে বললেন–
— ওমা! তুমি তো কিছুই খেলে না ছায়া।
— আমার পেট ভরে গিয়েছে আন্টি আর পারবো না।
আন্টি আমাকে বেসিন দেখিয়ে দিলেন। বর্ণ ভাই পা ছেড়ে দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে হাত ধুতে গেলাম। আমার হাত ধোয়ার পর পরই বর্ণ ভাই হাত ধুতে এলেন। আমি থমথমে কন্ঠে বললাম–
— আপনি ওভাবে আমার পা ধরেছিলেন কেন?
তিনি হাত ধোয়া শেষে তোয়ালে থাকা সত্ত্বেও আমার ওড়নায় হাত মুছলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন–
— আমি? কখন? তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?
চুপসে গেলাম। আমার কাছে তো কোনোও প্রমাণ নেই। তিনি এক হাত কোমরের পাশ গলিয়ে হেঁচকা টান মারলেন। আমি হুমড়ি খেয়ে ওনার বুকের ওপর পড়লাম। দুহাত ওনার বুকে ঠেকিয়ে বড় বড় চোখে তাকাতেই উনি টুপ করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনি বললেন–
— আমি তোমাকে চুমু খেয়েছি? কোনো প্রমাণ আছে?
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। থরথরিয়ে কাঁপতে লাগলাম। তিনি কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন–
— আমি সম্পূর্ণ বৈধ ভাবে তোমাকে ছুঁয়েছি। আমি কিন্তু তোমাকে অপবিত্র করিনি। আমার এই শুভ্র গোলাপকে আমি কখনও অপবিত্র করতে পারি না। কখনও না।
মনের মধ্যে ভালো লাগা খেলে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। উনি আবারও বললেন–
— একটা মিথ্যে কথা বলবো?
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তিনি ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন–
— আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
আমি চমকে তাকালাম। কম্পিত কন্ঠে বললাম–
— ক কি বললেন?
— আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
উনি মিথ্যে বলছেন। তার মানে উনি আমাকে! আমি লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম। ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উল্টো ঘুরে ছুটলাম। পিছু থেকে ভেসে এলো ওনার মৃদু হাসির শব্দ। গোমড়া মুখো লোকটার হাসি দেখতে পেলাম না, আমি তো মুখ লুকাতে ব্যস্ত।
—
মামাতো বোন সামিয়া আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার বড় মামার মেয়ে তিনি। এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন। বিয়ের কথা শুনতেই আমি বাকবাকুম হয়ে উঠলাম। বিয়ে মানেই মজা! আর সামিয়া আপুর বিয়ে তো আরও মজা হবে। আপু আমার বোন কম বন্ধু বেশি। বাবা মা এখন আলোচনা করছেন কবে যাবেন কি যাবেন না। আমি বাবার এক হাত জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসে আছি। মা বললেন–
— আমার বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আমি কিন্তু আগে ভাগে যাবো বলে দিলাম। আমাদের বংশের প্রথম বিয়ে!
বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন–
— তোমাদের বংশের প্রথম বিয়ে! তাহলে আমরা পর’কি’য়া করছি নাকি?
আমি ঠোঁট চেপে হেসে ফেললাম। জোরে হাসলেই এখন বিপদ। মা মেকি রাগ দেখিয়ে বললেন–
— আমি বলতে চাইছি আমাদের তিন ভাই বোনের ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিয়ে। সব কিছু কি বুঝিয়ে বলতে হবে?
— হ্যাঁ তা তো বলতেই হবে। আমি আবার একটু বুঝি কম।
আমি ভাবলাম আপুর আগে আমি বিয়ে করে ফেলেছি। বিয়ে করে ফেলেছি বলাটা ভুল, আমাকে জোর করে বিয়ে করা হয়েছে। এটা জানতে পারলে মায়ের রিয়্যাকশান কি হবে সেটা দেখারই অপেক্ষা। মা বললেন–
— আমি পাঁচ দিন আগেই যাবো কিন্তু ছায়ার বাবা।
— আচ্ছা বেশ যেও। আমার ছুটি হবে না। আমি নাহয় দুই দিন আগে যাবো।
মা সম্মতি দিলেন। কিছু ভেবে বললেন–
— বাড়িওয়ালা ভাবিদের দাওয়াত দিলে কেমন হয়? ভাবির সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে।
— তোমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে তুমি জানো।
মা ক্ষেপে গিয়ে বললেন–
— কি বলতে চাইছেন আপনি? আমার ভাইয়ের মেয়ে আপনার কিছু হয় না?
— আরে বাবা! আমি সেটা বলিনি। ঠিক আছে, তুমি ওনাদের দাওয়াত দাও। খুব ভালো হবে।
মা গদগদ হয়ে আমাকে নিয়ে চললেন তাদের দাওয়াত দিতে।
মায়ের দাওয়াতের কথা শুনে আন্টি বললেন–
— অবশ্যই যাবো ভাবি। অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় না জানেন তো? এবার বিয়ের ছুতোয় বাইরে থেকে একটু ঘুরেও আসা যাবে।
মা খুশি হয়ে বললেন–
— খুবই ভালো হবে ভাবি। আমাদের গ্রাম আপনার খুব ভালো লাগবে। বাবা বর্ণ! তুমি যাবে তো?
বর্ণ ভাই পাশেই বসে ফোন চাপছিলেন। মুখ খুলে কিছু বলার আগেই আন্টি ব্যাগড়া দিয়ে বললেন–
— আরে ও যাবে না মানে! এখন তো শুয়ে বসেই আছে। কদিন ঘুরে এলে ও’রও ভালো লাগবে। আর এতোটা পথ, আমাদের সাথে ও গেলে ভালো হবে। আপনার ভাই নাহয় ছায়ার বাবার সাথেই যাবে। আমরা আগে চলে যাবো। বিয়ে কবে?
— এই তো দশদিন পর। আমরা পাঁচ দিন আগেই যাবো।
— বেশ হবে। আপনাদের গ্রামটাও ঘুরে দেখতে পারবো।
দুজনে মিলে গল্প জুড়ে দিলেন। এক ফাঁকে বর্ণ ভাই ইশারা করে ওনার পিছু পিছু যেতে বললেন। আমি মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে গেলাম। ওনার পিছু পিছু ছাদে চলে এলাম। থালার মতো চাঁদ উঠেছে। উনি আমাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বললেন–
— তোমার মা দেখি জামাই সহ বেয়াই বেয়াইনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম–
— কচু! উনি তো আর জানেন না যে ওনার মেয়েকে আপনি জোর পূর্বক বিয়ে করে নিয়েছেন।
বর্ণ ভাই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। চাঁদের আলোয় তা দেখে এক প্রকার থমকে গেলাম। এতো সুন্দর তার হাসি! উনি বললেন–
— কিন্তু আমি যে যেতে পারবো না।
মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে বললাম–
— যাওয়া লাগবে না। আমি কে যে আপনি যাবেন? ছাড়ুন আমাকে।
উনি হাতের বাঁধন আরও মজবুত করলেন। নাকে নাক ঘষে বললেন–
— আচ্ছা আমি যাবো। কিন্তু তোমাকে খুব জ্বালাবো। যদি রাজি থাকো তাহলে বলো।
অস্ফুট স্বরে বললাম–
— এক মুহুর্ত আপনাকে না দেখে থাকার চেয়ে আপনি আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিন, সব মেনে নেবো।
উনি আবারও হাসলেন, সেই মনোমুগ্ধকর হাসি। আমার বলতে ইচ্ছে হলো, “আপনি সব সময় হাসবেন। তবে শুধু আমার সামনে। আপনার হাসিতে আমি মুগ্ধ হবো। আর কেউ না। কেউ না।”
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৬
আজ আমাদের যাওয়ার দিন। একটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। এই গাড়িতে করেই আমরা যাবো। নদী পথেও যাওয়া যায়। কিন্তু মা ঠিক করেছেন যাওয়ার সময় স্থল পথে যাবেন আর ফেরার সময় নদী পথে আসবেন। ব্যাগ পত্র নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি আন্টি এবং আমার ওনার জন্য। আমার উনি! ভাবতেই লজ্জা পেলাম। উনি আমাকে কোনো সম্বোধন করতে মানা করেছেন। তবে সম্বোধন না করলেও চলে না। কিছুক্ষণ পরই ওনারা নেমে এলেন। মা গাড়ির মাঝের সিটে বসে বললেন–
— উঠে আয় ছায়া।
আমি উঠতে গেলেই বাঁধা দিলেন বর্ণ ভাই। বললেন–
— আন্টি, মা ভেবেছিল আপনার সাথে গল্প করতে করতে যাবে। তাই যদি মা আর আপনি একসাথে বসতেন তাহলে ভালো হতো।
মা হাসি মুখে বললেন–
— অবশ্যই, ভাবি আপনি আমার পাশে বসুন। ছায়া তুই পেছনে বোস।
আন্টি মায়ের পাশে বসলেন। আমি তাদের পেছনের সিটে বসে পড়লাম। বমি হবার ভয়ে কিছু খাইনি। আমি জার্নিটা এনজয় করতে চাই। অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার সমস্যা। বর্ণ ভাই আমার পাশে এসে বসলেন। নেভি ব্লু শার্ট এবং কালো প্যান্ট পরেছেন। উনি যাই পরুন না কেন আমার কাছে সব সময় সুন্দর লাগে। আমার বে’হায়া চোখ ঘুরে ফিরে শুধু তার দিকেই যাচ্ছে। গাড়ি চলতে শুরু করলো। মা আর আন্টি পুরো দমে গল্প শুরু করেছেন। আমি ভেবে পাই না, এতো গল্প ওনারা কোথা থেকে নিয়ে আসেন? বর্ণ ভাই আমার পিঠের নিচ দিয়ে হাত গলিয়ে আগলে বসে রইলেন। আমি চমকে উঠে ফিসফিস করে বললাম–
— কি করছেন? মা, আন্টি দেখে ফেললে কি ভাববে?
উনি কন্ঠ নিচু করে বললেন–
— কিছু দেখবে না। দেখতে পাচ্ছ না কেমন গল্প করছে? এখন তোমাকে দশ বারোটা চুমু খেয়ে নিলেও কিচ্ছু দেখবে না।
আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললাম–
— ধুর! আপনি একটা যা তা।
উনি কিছু বললেন না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন শুধু। আমাদের যেতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম–
— একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
উনি ইশারায় সম্মতি দিলেন। আমি বললাম–
— মাত্র ক’টা মাসে আপনি আমাকে কীভাবে এতোটা ভালোবাসলেন যে বিয়ে করে ফেললেন?
উনি গভীর চোখে তাকালেন। আমি আগ্রহী হয়ে চেয়ে আছি ওনার জবাবের আশায়। উনি মোহময় কন্ঠে বললেন–
— আমি এখন যা বলবো সব মিথ্যে। আমি তোমাকে একটা দুটো দিন না দুটো বছর ধরে ভালোবাসিনি। সেদিন রাস্তায় আমাকে তুমি প্রথম দেখলেও আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি। তুমি যে স্কুলে পড়তে সেই স্কুলে আমি তোমায় প্রথম দেখিনি।
আমি অতিষ্ট হয়ে বললাম–
— আপনি ভালো করে বলুন। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।
উনি নাক টেনে দিয়ে বললেন–
— মাথা মোটা তুমি। বুঝবে কি করে?
আমি মুখ ভেংচি কাটলাম। তিনি বলা শুরু করলেন–
— তোমাদের স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি কোনো কারণে উপস্থিত ছিলাম। সেদিনই তো আমার সর্বনাশ হয়েছিল। লাল টুকটুকে শাড়ি পরা মেয়েটা আমাকে ভয়ংকর ভাবে মায়ায় জড়িয়ে ফেললো। এ যে সে মায়া নয় কঠিন মায়া। এই মায়ায় এক বার জড়ালে মানুষ বের হতে পারে না। পঁচিশ বছরের আমি একটা নাইনে পড়ুয়া মেয়ের প্রেমে পড়েছি ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর। তবুও আমি পড়েছি। তার পিছু পিছু ঘুরে তার অনেক বন্ধুর থেকে তার সম্পর্কে সব জেনেছি। তখন তো সবে পড়ালেখা শেষ করেছি, সব সময় তার পেছনে থাকতাম। তার আশেপাশে থাকতাম। খুব ভয় হতো জানো তো? যদি আমার শুভ্র গোলাপকে কেউ ছোঁয়ার চেষ্টা করে? যদি আমি ভালোবাসি বলার আগেই কেউ তাকে কেড়ে নেয়? খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তার বাবা বাসা পাল্টাবেন। আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম তাকে নিজের আশেপাশে রেখে চোখে চোখে রাখার।
তিনি একটু থামলেন। লম্বা শ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন–
— আমাদের ফ্লাটটা খালি ছিল। আমি ছলে বলে কৌশলে তার বাবার কানে কথাটা পৌঁছে দিলাম। আর আমার পরিকল্পনা মাফিক তারা আমাদের বাড়িতে উঠলো। তারপর থেকে পুরোপুরি তার ছায়া হয়ে গেলাম। এক মুহূর্তও একা ছাড়তাম না তাকে। মাঝে মধ্যে তো কাজের নাম করেই তার সাথে এক রিকশায় বসে যেতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কত যে তাকে দেখেছি সে বোকারানি বুঝতেই পারেনি।
আমি সতর্কতার সাথে ওনার কাঁধে মাথা রাখলাম। প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বললাম–
— এতো ভালোবাসেন কেন আমায়?
তিনি মশকরা করে বললেন–
— কই আমি তো ভালোবাসি না। একদমই ভালোবাসি না।
আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম–
— এই ক্ষেত্রেই সব সময় আপনাকে মিথ্যে বলতে হবে?
তিনি মৃদু হেসে বললেন–
— এই ব্যাপারে আমি সারাজীবন মিথ্যে বলে যাবো।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তার কাঁধে মাথা রেখেই পুরোটা রাস্তা চললাম।
—
আমাদের গ্রামটা ছোট্ট। তবে এর সৌন্দর্যের শেষ নেই। রাস্তার দু ধারে সারি সারি ধানের ক্ষেত। পাঁচ ঘণ্টা জার্নির পর আমরা পৌঁছেছি। প্রায় পুরোটা রাস্তা আমি বর্ণ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পার করেছি। উনি চুপ চাপ আমাকে ধরে বসে ছিলাম, টু শব্দটি করেননি। মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কিছু খাবো কিনা, আমি খেয়ে এসেছি বলে কাটিয়ে দিলাম।
গ্রামে আমার নানু বাড়ি থেকে তিনটা বাড়ি রেখে আমার দাদু বাড়ি। একদমই পাশাপাশি বলা চলে। আবার আমার নানাভাই ও দাদু ভাইয়ের মধ্যে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তারা সেটাকে আরও গাঢ় করতে আমার বাবা মায়ের বিয়ে দিয়ে ছিলেন। আমার দুই চাচা আর দুই ফুপি আছে। তাদের সব ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমার বাবা সবার ছোট হওয়ায় আমিও সবার ছোট। বাবার গোষ্ঠীতে একমাত্র আমার বিয়েটাই বাকি আছে। কিন্তু কাউকে বলতে পারছি না সেটাও সম্পন্ন হয়েছে। দাদাভাই এর ছোট পুতিন হওয়ায় আর নানাভাই এর একমাত্র নাতনি হওয়ায় আমার আদর বরাবরই একটু বেশি। অন্যদিকে মা মেজ। মামা-মামি, চাচা-চাচি ও কম যত্ন করেন না। আমাকে মাথায় তুলে রাখেন।
গাড়ি থামতেই দুই মামাকে দেখা গেল। তারা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তারা। গাড়ি থেকে নামতেই মাথা ঘুরে উঠলো, এতক্ষণ না খাওয়ার ফল। বর্ণ ভাই ধরে ফেললেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন–
— ঠিক আছ তুমি?
আমি মৃদু হেসে বললাম–
— হু ঠিক আছি।
তার বিশ্বাস হলো বলে মনে হলো না। এতো লোকের মাঝে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। মামারা এগিয়ে এসে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বর্ণ ভাইকে আলিঙ্গনও করলেন। ছোট মামা একটা ব্যাগ এক হাতে নিয়ে আমার এক হাত ধরে বললেন–
— আম্মু চলো যাওয়া যাক?
আমি হেসে মাথা দোলালাম। এখান থেকে কিছু টা দূর হেঁটে যেতে হবে। এতো বড় গাড়ি নানু বাড়ি প্রর্যন্ত যাবে না। আমি আর ছোট মামা আগে আগে হাঁটছি। আর বাকিরা পেছনে। দু মিনিট হেঁটে আমরা পৌঁছালাম। ছোট মামা বাড়িতে ঢুকেই হাঁক ছাড়লেন–
— কোথায় সবাই? আপারা চলে এসেছে।
সবাই একে একে বের হয়ে এলো। মামিরা মায়েদের সাথে একটু কথা বলেই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বড় মামি বললেন–
— তুই আজও কিছু খেয়ে আসিসনি তাই না ছায়া? আয় কিছু খেয়ে নিবি আয়।
মা’ও তাল মেলালেন–
— হ্যাঁ ভাবি। এতো করে বললাম কিছু খেয়ে নিতে কিন্তু খেলোই না। বলে যে আমার বমি হয়ে যাবে। রাস্তায়ও কিছু খেলো না।
আমি শুকনো ঢোক গিলে বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি চোখ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি জোর পূর্বক হাসলাম। ছোট মামা ওনাকে টেনে নিয়ে একটা রুমে নিয়ে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মা আর আন্টিও চলে গেলেন। তবে মামিরা আমায় ছাড়লেন না। হাত মুখ ধুইয়ে খেতে বসালেন। সবার আগে আমার খাওয়া হয়ে গেল। সবে মাত্র বারোটা বাজে। আমি খেয়ে দেয়ে সামিয়া আপুর রুমে চলে গেলাম। আপু ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি পেছন থেকে গিয়ে ‘ভো’ করে চেঁচিয়ে উঠলাম। আপু ভয়ে লাফিয়ে উঠলো। আমি খিলখিল করে হেসে উঠলাম। আপু আমার দিকে তাকিয়ে বুকে থুথু দিয়ে বললেন–
— ছায়া তুই! আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানিস?
আমি বিছানায় ধপ করে শুয়ে বললাম–
— ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলে কেন শুনি? জিজুর সাথে কথা হচ্ছে নাকি?
আপু লাজুক হেসে মাথা উপরনিচ দোলায়। আমি রসিয়ে বললাম–
— বাবাহ! জিজুকে খুব মনে ধরেছে দেখছি। তা এটা কি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ নাকি লাভ ম্যারেজ? হু?
আপু আমার বাহুতে মৃদু থাপ্পড় মেরে বললেন–
— মজা করা হচ্ছে আমার সাথে? এটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ’ই।
আমি হতাশ ভঙ্গি করে বললাম–
— আহা গো! অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তাই এতো পিরিত! লাভ ম্যারেজ হলে না জানি কি হতো?
আমি মেকি ধমকে উঠে বললেন–
— ছায়া! মজা বন্ধ কর।
— কেন? লজ্জা পাচ্ছ বুঝি? আচ্ছা বাদ দাও। জিজুর ছবি তো দেখাও না কি?
আপু ফোন ঘেঁটে ছবি বের করলেন। আমি দেখলাম বেশ ভালো দেখতে। আপুর সাথেও জব্বর মানাবে। তবুও আমি মজা করে বললাম–
— এ কোন বুড়ো গো আপু? এই বুড়োকে তুমি পছন্দ করেছ? তোমার সাথে একদম মানাবে না।
আপু রেগে চিৎকার করে উঠলেন–
— ছায়া! দাঁড়া তুই!
আমি ফিক করে হেসে ফেলে, উঠে ভো দৌড় দিলাম। এখানে থাকলে আমার আর নিস্তার নেই।
চলবে..
{