ছায়াবর্ণ পর্ব -১৭+১৮+১৯

#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৭

আমার নানু বাড়ি টা এক তলা বিশিষ্ট বেশ পুরনো একটা বাড়ি। এক তলা হলেও এর আয়তন বেশ বড়। বেশ কায়দা করে নানাভাই তৈরি করিয়েছেন এটি। মোট আটটা রুম, ড্রয়িং রুম ডাইনিং রুম আলাদা। পাঁচটি রুমে অ্যাটেস্ট ওয়াশ রুম আছে, বাকি তিনটির জন্য রয়েছে কমোন ওয়াশ রুম। বর্ণ ভাইকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম, উনি মানিয়ে নিতে পারবেন কি পারবেন না? কিন্তু ওনাকে অ্যাটেস্ট ওয়াশ রুম ওয়ালা রুম দেওয়া হয়েছে দেখেই আমি একটু স্বস্তি পেলাম। এখন দুপুরে খাওয়ার সময়। রান্না ঘরের সামনেই খাওয়া দাওয়া করার জন্য বড় জায়গা। নানাভাই ইচ্ছে করেই ডাইনিং টেবিল কেনেননি। তার ভাষ্য মতে নিচে বসে খাওয়ার আলাদা মজা। পাটি বিছিয়ে নানাভাই মাঝে বসেছেন। আর তার দুপাশ দিয়ে বসেছে বাকি সদস্যরা। বড় মামা, ছোট মামা, বড় মামার ছেলে সামি- তার বয়স দশ, ছোট মামার একমাত্র মেয়ে রিনি- তার বয়স ছয়, সামিয়া আপু আর বর্ণ ভাই। আপাতত পুরুষরা আর বাচ্চারা বসেছে। মহিলারা পরে খাবে। আমার যেহেতু খাওয়া শেষ সেহেতু আমি বসে বসে দেখছি।‌ বিশেষ করে বর্ণ ভাইয়ের দিকে নজর রাখছি। উনি দুই মামার মাঝে বসেছেন। মামাদের সাথে বেশ ভাব হয়েছে ওনার। বার বার মোচড়া মুচড়ি করছেন, ওনার বসতে অসুবিধা হচ্ছে। ইশ্! আগে কোনো দিন হয়তো নিচে বসে খাননি। বড় মামা তার কাঁধ চাপড়ে বললেন–

— লুঙ্গি পরতে হবে বুঝেছ? নাহলে এভাবে প্যান্ট পরে বসে খেতে যে খুব অসুবিধা হবে তোমার।

তিনি নড়েচড়ে বসে বললেন–

— ঠিক আছে সমস্যা নেই।

খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। মামিরা রান্না ঘর থেকে খাবার বের করছেন আর সার্ভ করছেন। এই সুবিধার্থে রান্না ঘরের সামনেই খেতে বসা হয়। বর্ণ ভাই চুপ চাপ খেয়ে যাচ্ছেন, তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি হচ্ছে না? এরই মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার হলো নানাভাই বেশ কয়েকবার বর্ণ ভাইয়ের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। এর কারণ আমি বুঝলাম না। সবার আগে ভাগে খেয়ে উঠলেন বর্ণ ভাই। মামিরা ধরে বেঁধেও তাকে আর খাওয়াতে পারলেন না। আমি সবার চোখের আড়ালে বর্ণ ভাইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে গেলাম। বর্ণ ভাই চোখের ওপর হাত আড়াআড়ি ভাজ রেখে শুয়ে আছেন। আমি নিঃশব্দে তার পাশে গিয়ে বসলাম। আলতো করে তার চুলে হাত রাখলাম। তিনি চোখ মেলে তাকালেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম–

— এভাবে নিচে বসে খেতে আপনার কষ্ট হয়েছে , না?

— তেমন কিছু না। জার্নি করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। একটু ঘুম প্রয়োজন আমার। নিজে তো আরামে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলে। কি ব্যথা হয়েছে জানো? নাড়াতেও পারছি না।

আমার মায়া হলো। মিনমিন করে বললাম–

— আপনি আমাকে ডেকে দিলেই পারতেন।

ওনার স্পষ্ট উত্তর–

— ইচ্ছে করছিল না।

— ঘাড়ে কি খুব ব্যথা করছে? ওষুধ নিয়ে আসি?

উঠে যেতে নিলেই উনি বাঁধা দিয়ে বললেন–

— লাগবে না। চুল গুলো একটু টেনে দাও তো। ঘুমাবো।

আমি হালকা হাতে চুল টেনে দিতে লাগলাম। সত্যি কথা বলতে ওনার চুলে হাত বোলানো আমার প্রিয় কাজের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। খুব ভালো লাগে ওনার মশৃন চুলে হাত বুলাতে। উনি ঘুমিয়ে গেলে আমি ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।
বারান্দায় বসে নানাভাই পান চিবু্চ্ছেন। আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। নানাভাই আমার মাথায় হাত রেখে বললেন–

— লঞ্চে আসোনি কেন? গাড়িতে তো তোমার কষ্ট হয়। এবার কতবার বমি করেছ?

— একবারও না নানাভাই। আমি তো সারাটা রাস্তা ঘুমাতে ঘুমাতে এসেছি। কখন সময় পার হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।

— তোমাদের সাথে এসেছে ওই ছেলেটা কে তাহসীনা?

— উনি তো আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। যে আন্টি এসেছে না? ওনার ছেলে। কেন নানাভাই?

নানাভাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন–

— পান খাবা?

— আমি তো পান খাই না নানাভাই।

নানাভাই হেসে বললেন–

— ছোট বেলায় তুমি বসে থাকতে যে কখন আমি হামান দিস্তায় পান বাটবো? তারপর এসে হা করে বলতে, ‘আমি পান খাবো নানাভাই।’ পান খাওয়ার সাথে সাথেই তোমার ঠোঁট টুকটুকে লাল হয়ে যেত। একদম পাকা গিন্নি দেখাতো।

আমিও হেসে ফেললাম। সত্যিই আমি ছোট বেলায় এমন ছিলাম। এখন আর পানের ধারে কাছে যাই না।

বিকেলে ছোট মামার মেয়ে রিনিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দাদু বাড়ি চলে এলাম। নানু বাড়ি থেকে দাদু বাড়ি আয়তনে একটু ছোট। প্রথমেই বড় চাচির সাথে দেখা হলো। তিনি আমাকে দেখে গদগদ হয়ে বললেন–

— ওমা! ছায়া! কখন এসেছিস তুই?

— এই তো বারোটার দিকে এসেছি চাচিমা। এসে খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই চলে এলাম।

— খুব ভালো করেছিস। আয় বোস।

আমি বসলাম না। রিনির হাত ধরে দাদু বাড়ি প্রতিটা কোণা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রায় ছয় সাত মাস পর এসেছি। কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি, নানু বাড়িও তাই। চাচারা এখন কেউ বাড়িতে নেই, আর দাদাভাই ও নেই। নানি গত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। তারও বছর দুয়েক আগে দাদি গত হয়েছেন। এক কথায় বাড়িতে কোনো কর্তী নেই। নানাভাই আর দাদাভাই এর কথাই শেষ কথা। বড় চাচার দুই ছেলে। দুজনই বিবাহিত।‌ আর ছোট চাচার দুই মেয়ে, তারাও বিবাহিত। ঘুরতে ঘুরতে বড় ভাইয়ের রুমে গেলাম। ভাবি ঘর গোছাচ্ছেন। আমি পেছন থেকে ডাকলাম–

— ভাবি!

ভাবি পেছন ফিরে হাসি মুখে বললেন–

— আরে ননদিনী! এসো।

আমি রিনিকে বসিয়ে নিজে বসলাম। ভাবির সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলাম। এরই মধ্যে ভাবি বললেন–

— তারপর বলো ভালোবাসার কাউকে পেলে?

আমি লজ্জা পেলাম। বললাম–

— ধুর ভাবি! তুমিও না!

হুট করেই বর্ণ ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। না জানি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছেন কিনা! আমি উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম–

— ভাবি, আজ আমি যাই। কাল আবার আসবো।

— কেন? থেকে যাও।

— না ভাবি আমাকে যেতে হবে। খুব দরকার।

আমি রিনির হাত টেনে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলাম। নানু বাড়ি গিয়ে বর্ণ ভাইকে আশে পাশে কোথাও পেলাম না। সামিয়া আপুকে জিজ্ঞেস করলাম–

— বর্ণ ভাইকে দেখেছ আপু?

আপু কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন–

— কে? ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটা?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম–

— তোমার না বিয়ে ঠিক? তো আশে পাশে এতো নজর দাও কেন?

আপু আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললেন–

— চুপ! নাম জানতাম না তাই ওভাবে বলেছি। তাছাড়া সত্যি বলতে আমার বিয়ে ঠিক না থাকলে এই বর্ণ ভাইকে ঠিক পটিয়ে নিতাম।

মনে মনে গালি দিলাম, “লুচু মহিলা! বোনের বরের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না?” মুখে বললাম–

— তাকে দেখেছ কিনা সেটা বলো।

— হ্যাঁ দেখলাম তো। বাবা আর চাচ্চু মিলে তাকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল মাঠের দিকে।

আমি এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ছুটলাম। সামিয়া আপু পেছন থেকে ডাকাডাকি করলেও শুনিনি। মাঠে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল একে অপরের থেকে। মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। বড় মামা আগে, ছোট মামা পিছে আর মাঝখানে বর্ণ ভাই। এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার কারণ হচ্ছে বর্ণ ভাই লুঙ্গি পরেছেন। অসহায় মুখে এক হাতে লুঙ্গি আঁকড়ে ধরে আছেন। আর মামাদের সাথে তাল মেলাচ্ছেন। মামারা তাকে নিজেদের ধানের ক্ষেত দেখাচ্ছেন। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ছোট মামা আমাকে দেখে বললেন–

— আম্মু দেখো তো তোমাদের এই শহরের বাবুকে লুঙ্গি পরে কেমন লাগছে? জোর করে ধরে বেঁধে পরিয়েছি।

আমি বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক হাতে লুঙ্গি ধরে। আমার ভীষণ হাসি পেল। আমি হাসি চেপে রাখতে পারলাম না, হেসে ফেললাম। বর্ণ ভাই চোখ রাঙালেন। বড় মামা বললেন–

— আহা! হাসছিস কেন? ছেলেটাকে কি ভালো টাই না লাগছে।

আমি হাসি থামিয়ে বললাম–

— হ্যাঁ হ্যাঁ খুউউব ভালো লাগছে। যেন শহরের বাবু নয় একদম গ্রামের বাবু।

বর্ণ ভাই চোখ গরম করে তাকিয়ে বোঝালেন, “আমাকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে তাই না? একবার হাতে কাছে পেয়ে নিই তারপর দেখাচ্ছি মজা।” আমি শুকনো ঢোক গিললাম। বললাম–

— মামা সন্ধ্যা হয়ে এলো বলে। বাড়িতে চলুন এখন। ওনাকে পরে আবার নিয়ে আসবেন।

মামারা সম্মতি দিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলো। তারা আগে আগে হেঁটে চলেছেন আর আমরা পেছনে। বর্ণ ভাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— খুব মজা লাগছে, না? রাতে ছাদে আসবে। যদি না আসো তাহলে সবার সামনে টেনে নিয়ে যাবো। মনে থাকে যেন।

আমি পুনরায় ঢোক গিললাম। ব্যাটা দেখি ক্ষেপেছে। উনি আমাকে পেছনে ফেলেই মামাদের সাথে এগিয়ে চললেন। আমি আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম। না জানি আজ আমার কপালে কি আছে?
বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই সামিয়া আপু টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। বাইরে উঁকি মেরে বর্ণ ভাইকে দেখে বললেন–

— লুঙ্গি পরে বর্ণ ভাইয়াকে সেই লাগছে বল?

আমি বিরক্ত হলাম। আমি আছি আমার জ্বালায় আর উনি এলেন আমার বর নিয়ে টানাটানি করতে। ছাদে যেতে বুক কাঁপছে আবার বর্ণ ভাইকে বিশ্বাস নেই। যে ব্যক্তি জোর করে বিয়ে করতে পারে সে ব্যক্তি সবার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেতেও পারে। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললাম। আজ কপালে সত্যিই দুঃখ আছে। ধুর কেন যে হাসতে গেলাম?
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৮

— লাস্ট ওয়ার্নিং! তুমি আসবে নাকি আমি আসবো? আমি এলে সোজা কোলে উঠিয়ে নিয়ে আসবো। নাউ ডিসিশন ইজ ইউরস্।

ভয়ংকর হুমকির মেসেজ পেয়ে আমি ঢোক গিললাম। পাশে ঘুমিয়ে থাকা সামিয়া আপুর দিকে এক পলক তাকালাম। সে মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে। আমি আস্তে ধীরে বিছানা থেকে নামলাম। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে খুব সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে গেলাম। আশে পাশে ভালো করে দেখে নিলাম। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ! নাহ্ কেউ নেই। এখন বাজে সাড়ে দশটা। গ্রামের মানুষ সবাই দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে এবং দ্রুত ঘুম থেকে ওঠে। আমার নানু বাড়িও সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। নিঃশ্বাস ফেললাম কি ফেললাম না হাতে হেঁচকা টান অনুভব করলাম। বর্ণ ভাই আমাকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনও লুঙ্গি পরেই আছেন। ওনাকে দেখতে অদ্ভুত লাগলেও আমার কাছে সুন্দর লাগছে। আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম–

— আপনি এখনও লুঙ্গি পরে আছেন? ভালো লাগছে। কেউ বলতেই পারবে না যে আপনি শহরের লোক।

বর্ণ ভাই কড়া কন্ঠে আওড়ালেন–

— হাসবে না একদম। আমি পড়েছি মহা জ্বালায়। আর তুমি হাসছ? তোমার নানাভাই হুকুম জারি করেছেন যে আমাকে রোজ লুঙ্গি পরতে হবে। আমি কি সমস্যায় পড়েছি বুঝতে পারছ?

আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। সত্যিই ওনাকে একদম ভেজা বেড়াল লাগছে। বর্ণ ভাই রেগে গেলেন। আরও এগিয়ে এলেন। ওনার উষ্ণ নিঃশ্বাস মুখশ্রীতে আছড়ে পড়তেই আমার হাসি দপ করে নিভে গেল। উনি নিজের এক হাতে আমার দুহাত মুড়িয়ে পেছনে আটকে ফেললেন। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তার দৃষ্টি দেখে তিরতির করে কেঁপে উঠলাম। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম–

— ক কি করছেন?

তিনি জবাব দিলেন না। মুখের ওপর ফু দিলেন। আমি চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। উনি রাগ থেকে অন্য মুডে চলে গেলেন! এতো তাড়াতাড়ি তো গিরগিটিও নিজের রং পাল্টায় না। মনে হচ্ছে জমে যাচ্ছি আমি। হুট করেই গালে উনি নিজের শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া ছোঁয়ালেন। দম বন্ধ অনুভূতি হলো। ওনার হাব ভাব মোটেও ভালো লাগছে না। উনি আমার অধরের নিকট নিজের ওষ্ঠ এগিয়ে নিতেই আমি বলে উঠলাম–

— আপনার লুঙ্গি! আপনার লুঙ্গি খুলে যাচ্ছে।

উনি তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে লুঙ্গি চেপে ধরলেন। সেই সুযোগে আমি জান হাতে নিয়ে দৌড় লাগালাম। উনি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। আমি ওনাকে বোকা বানিয়েছি বুঝতে পেরে উনি মৃদু স্বরে চেঁচিয়ে বললেন–

— আমাকে বোকা বানানো! এর শোধ সুদে আসলে উসুল করবো। তৈরি থেকো।

আমি রুমে এসে দরজা দিলাম। ভয়ানক লোক! আর একটু হলেই আমার জান নিয়ে নিচ্ছিলো। এবার থেকে ওনার আশে পাশেই যাবো না। শোধ নেবার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কি ভয়ংকর ব্যাপার! সামিয়া আপুর পাশে শুয়ে পড়ে গালে হাত রাখলাম। এখানে পরশ দিয়েছেন উনি। মুচকি হাসলাম, ওনার লুঙ্গি চেপে ধরার ব্যাপারটা ভেবেই শব্দ করে হাসতে যেয়েও মুখ চেপে ধরলাম। সামিয়া আপুর ঘুম ভেঙে যাবার ভয়ে আর হাসা হলো না, ঘুমিয়ে পড়লাম।

নানু বাড়িতে এলেই সবার মতো সকাল সকাল উঠতে হয়। পড়ে পড়ে ঘুমানোর সুযোগ নেই। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলাম। রান্না ঘরের সামনে যেতেই মা আমাকে হাতে চায়ের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললেন–

— তোর নানাভাই দের চা দিয়ে আয়। ওরা বাইরে আছে দেখ।

আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বাইরে গেলাম। উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছেন নানাভাই, বড় মামা, ছোট মামা এবং বর্ণ ভাই। বর্ণ ভাইকে দেখেই তার লুঙ্গি চেপে ধরার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি ঠোঁট টিপে হেসে এগিয়ে গেলাম। নানাভাই এর সামনে ট্রে ধরে বললাম–

— নানাভাই চা নিন।

নানাভাই এক গাল হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলেন। একে একে বড় মামা ও ছোট মামাকে দিলাম। বর্ণ ভাইয়ের সামনে ট্রে ধরতেই তিনি গম্ভীর মুখে তাকালেন। কাপ তুলে নিলেন। আমি মেকি হেসে বাড়ির মধ্যে চলে গেলাম।
সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ মা আমাকে চেপে ধরে বললেন–

— হ্যাঁ রে! তোর কোনো কান্ড জ্ঞান আছে?

— আমি আবার কি করলাম মা?

— ছেলেটা আমাদের গ্রামে এসেছে একটু ঘুরবে বলে। আর তুই কি করছিস? নিজের মতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে বেড়াচ্ছিস। বর্ণ কে আশ পাশ থেকে একটু ঘুরিয়ে আন। যা।

— উনি তো বড় মামা ছোট মামার সাথে ঘুরছেনই মা।‌ আবার আমি কেন?

মা চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন–

— তোকেই যেতে হবে। তোর মামারা তো শুধু মাঠ দেখিয়েছে। তুই নদীর আশ পাশের জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবি।

বলেই মা চলে গেলেন। এখন আমাকে গাইড হতে হবে! বর্ণ ভাইকে ডাকতে গেলে দেখি উনি রুম থেকে বের হচ্ছেন। লুঙ্গি ছেড়ে শার্ট প্যান্ট পরে পরিপাটি হয়েছেন। আমি দুঃখি দুঃখি কন্ঠে বললাম–

— একি! আপনি লুঙ্গি পাল্টিয়ে ফেললেন?

তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন–

— তুমি কি চাচ্ছ যে আমি লুঙ্গি পরে পুরো গ্রামে ঘুরে বেড়ায়? নাকি এটা চাও যে আমি লুঙ্গি পরে নাচি?

প্রচন্ড ক্ষেপে আছেন উনি। আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম–

— না না আমি সেটা কখন বললাম? চলুন আপনাকে গ্রাম দেখিয়ে আনি।

আমাদের সাথে যোগ দিলো সামিয়া আপু, সামি এবং রিনি। সামি আর রিনি বর্ণ ভাইয়ের দুই হাত ধরে হাঁটছে। বর্ণ ভাইকে বেশ ভালো লেগেছে তাদের। সামিয়া আপু জিজুর সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে হাঁটছেন। আমি বর্ণ ভাইকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আশে পাশের জায়গা সম্পর্কে বলছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। হাঁটতে হাঁটতে একটা দোকানের সামনে এসে পড়লাম। রিনি বর্ণ ভাইয়ের হাত ঝাঁকিয়ে বলল–

— বর্ণ ভাইয়া আমাকে আইসক্রিম কিনে দেবে?

বর্ণ ভাই মুচকি হেসে বললেন–

— অবশ্যই কিউটি। একটা কথা! তুমি আমাকে ভাইয়া বললে কেন? আমি কি হই তোমার?

রিনি খিলখিলিয়ে হেসে বলল–

— তুমি তো আমার বয়ফ্রেন্ড হও।

বর্ণ ভাই আমার দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললেন–

— হ্যাঁ আমাকে বয়ফ্রেন্ড বলবে। অন্য কারোর মতো যে বর কে ভাই ডাকে এমনটা করবে না ঠিক আছে?

রিনি হেসে মাথা দোলায়। বর্ণ ভাই সামি আর রিনিকে নিয়ে দোকানে গেলেন। যাবার আগে কি সুন্দর আমাকে খোঁচা মেরে গেলেন। সামিয়া আপু আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। বাবা রে বাবা! এদের কথা দেখি শেষই হচ্ছে না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ তাই এই অবস্থা। লাভ ম্যারেজ হলে না জানি কি হতো! হঠাৎ সিটি বাজানোর শব্দে আমি পিছু ফিরলাম। গ্রামের বখাটে ছেলে রনি ও তার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামে যখনই আসি তখনই আমার পেছনে লেগে থাকে। মেজাজ বিগড়ে গেল তাকে দেখে। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। রনি আরও একবার শীষ বাজিয়ে এগিয়ে এলো। বলল–

— আরে ছায়া রানি যে! কবে এলে? কত দিন পর এলে। আমি কত মিস করেছি জানো?

আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললাম–

— চলে যান। কেন আমার পেছনে লাগেন?

— আহা! তুমি বোঝো না? আমি তোমাকে ওটা করি। মানে লাভ করি, বুঝলে? লাভ।

বলেই বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে উঠলো। এগিয়ে এসে ফট করে আমার হাত ধরে বলল–

— চলো ছায়া রানি আমরা একটু নদীর পাশ থেকে ঘুরে আসি। চলো।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম–

— ছাড়ুন আমার হাত। ছাড়ুন বলছি।

— আরে ছাড়বো কেন? চলো তো তুমি।

সামিয়া আপু এগিয়ে এসে বললেন–

— রনি ভাই দয়া করে ও’কে ছেড়ে দিন। আমার বোনটা বছরে একবার আসে। আপনার জন্য কি ও গ্রামে আসা বন্ধ করে দেবে?

রনি বিরক্তের সাথে বলল–

— এই তোর না বিয়ে? তুই সেটা নিয়ে পড়ে থাক। আমাদের মধ্যে একদম আসবি না। কে বলেছে ছায়া রানি গ্রামে আসবে না? আমি তো ও’কে বিয়ে করে গ্রামে রেখে দেবো। তুমি চলো।

হাত ধরে টান দিতেই কোনো বলিষ্ঠ হাত আমার অপর হাত চেপে ধরলো। রনি টেনেও আমাকে নাড়াতে পারলো না। বর্ণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল–

— আবে! কে রে তুই? আমার কাজে বাঁধা দিচ্ছিস!

বর্ণ ভাই হেঁচকা টানে রনির হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন। তার রক্তিম চক্ষু জোড়া দেখেই আঁতকে উঠলাম। ভয়ংকর রাগের লক্ষণ এটা। বর্ণ ভাই রনির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। চোয়াল শক্ত করে বললেন–

— রাস্তা ঘাটে এভাবে মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করা ইজ ভেরি ব্যাড ম্যানার।

রনি হেসে উঠে বলল–

— এই কে রে তুই? আমাকে ম্যানার শেখাতে আসিস! আমি কে জানিস? সর তো। আমাকে আমার কাজ করতে দে।

বলেই রনি আমার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে বর্ণ ভাই তার কাঁধ চেপে ধরলেন। ঠান্ডা কন্ঠে বললেন–

— ভুলেও ও’র দিকে হাত বাড়াস না।

রনি রেগে বলল–

— এই ছায়া! এটা কি তোর শহরের না/গ/র নাকি? তোর জন্য এতো কিসের দরদ এর? কি দিয়ে বশ করলি এই শহরের বাবুকে? রূপ দিয়ে না অন্য কিছু?

তার বিশ্রী ইঙ্গিতে গা গুলিয়ে উঠলো। কথা শেষ হবার সাথে সাথেই বর্ণ ভাইয়ের শক্ত হাতের ঘুষি পড়লো তার চোয়ালে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেল। বর্ণ ভাই রনিকে বে’ধড়’ক মা’রছেন। তাকে রনির বন্ধু রা বাঁধা দিতে গেলে তাদের ও মা’রছেন। নিজেও বেশ আঘাত পেয়েছেন। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–

— থামুন! প্লিজ থামুন।

তবুও তিনি থামছেন না। আশে পাশের লোকজন ছুটে গিয়ে তাকে ঠেকালো। লোকজন এতক্ষণ কিছুই বলছিল না কারণ তারা চাচ্ছিল রনির একটা হেস্তনেস্ত হোক। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে তারা বর্ণ ভাইকে সরিয়ে নিলেন।
#ছায়াবর্ণ
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৯

বর্ণ ভাই ঘন ঘন শ্বাস ফেলছেন।‌ বার বার তেড়ে যাচ্ছেন রনির দিকে। লোকেরা তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। আমি কাতর কন্ঠে বললাম–

— শান্ত হোন। আর মারবেন না ও’কে।‌ অনেক শিক্ষা হয়েছে ও’র।

আমার চোখ থেকে বেয়ে পড়া নোনা জল দেখে তিনি থেমে গেলেন। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। রনি ব্যথায় কাতরাচ্ছে। বর্ণ ভাই নিজের শার্ট টেনে ঠিক করলেন। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন–

— আর কোনো দিন কোনো মেয়ের সাথে জবরদস্তি করতে দেখলে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বুঝেছিস? কেউ না। মাইন্ড ইট।

অতঃপর তার বন্ধুদের বললেন–

— ও’কে হাসপাতালে নিয়ে যাও।

রনির বন্ধুরা হম্বিতম্বি করে রনিকে তুলে নিয়ে চলে গেল। দোকানদার চাচা বললেন–

— রনি অনেক দিন ধরেই মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। চেয়ারম্যান এর ছেলে বলে আমরা কিছু বলতে পারি না। তুমি আজ যে শিক্ষা দিলে তাতে ও আর কোনো দিন এমন কাজ করবে না। তুমি কে গো বাবা?

বর্ণ ভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন–

— ও’র সাথে এসেছি। গ্রামের মেহমান বলা চলে। শহর থেকে এসেছি।

— তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। দোয়া করি তোমার মঙ্গল হোক।

চাচা ফিরে গেলেন। ধীরে ধীরে সকলে নিজেদের কাজে চলে গেল। সামিয়া আপু এক পাশে সামি ও রিনিকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। রিনি দৌড়ে এসে বর্ণ ভাইয়ের হাত ধরে বলল–

— তুমি একদম রিয়্যাল হিরো বয়ফ্রেন্ড। মুভিতে হিরো রা যেমন ঢিসুম ঢিসুম করে মারে তুমিও তেমন মেরেছ।

বর্ণ ভাই হাসলেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠোঁটের কোণে র’ক্ত জমে আছে। তিনি মেরেছেন আবার একটু মারও খেয়েছেন। কে বলেছিল এমন মারামারি করতে? আমি ওড়না দিয়ে মুখ মুছে বললাম–

— বহুত হয়েছে ঘোরা, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। আপু তুমি রিনি আর সামিকে নিয়ে এগোও আমি আসছি।

সামিয়া আপু কিছু না বলে এগোতে লাগলেন। আমি ওনার কাছে গেলাম। ওনার ঠোঁটের কোণে আলতো স্পর্শ করে বললাম–

— কে বলেছিল এভাবে মারধর করতে? নিজেকে কি হিরো ভাবেন? দেখেছেন কতটা ব্যথা পেয়েছেন?

তিনি কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাঁটা আরম্ভ করলেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললাম–

— কথা বলছেন না কেন? কি দরকার ছিল মারার?

তিনি থেমে গিয়ে শক্ত কন্ঠে উত্তর দিলেন–

— তো কি করতাম? তোমার হাত ধরে টানাটানি দেখতাম? তোমাকে নিয়ে আজে বাজে কথাগুলো শুনতাম? বলো?

আমি কথা খুঁজে পেলাম না। তিনি আবারও বললেন–

— তোমার জায়গায় অন্য যে কেউ হলেও আমি সহ্য করতাম না। সেখানে তুমি তো আমার, আমার! ড্যাম ইট!

কন্ঠে তার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম–

— দ দেখুন শান্ত হোন। আপনার এই মারধরের ঘটনা নানাভাই দাদাভাই এর কান পর্যন্ত চলে গিয়েছে। না জানি কি হবে?

বর্ণ ভাই আমাকে ফেলে রেখেই গটগটিয়ে হাঁটতে লাগলেন। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে এগোলাম। বাড়িতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে কে জানে?

ড্রয়িং রুমে পাশাপাশি বসে আছেন নানাভাই এবং দাদাভাই।‌ সবাই এখানে উপস্থিত রয়েছেন। বর্ণ ভাই এক পাশে নির্বাক হয়ে দুহাত বুকে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আছি এক কোণে। আমার ধারণাই ঠিক ছিল। বর্ণ ভাইয়ের রনিকে মা’রার কথা নানাভাই এর কানে চলে এসেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার।‌ নানাভাই খুব রাগী মানুষ অপরপক্ষে দাদাভাই একদম শান্ত। দুই বন্ধুর স্বভাবের আকাশ পাতাল পার্থক্য। নানাভাই জলদগম্ভীর কন্ঠে বললেন–

— তুমি কি মা’রামা’রি করেছ আওসাফ?

নানাভাই সবাইকে ভালো নাম ধরে ডাকেন। ডাক নাম ধরে ডাকা তার পছন্দ নয়। বর্ণ ভাইয়ের স্পষ্ট উত্তর–

— হ্যাঁ।

নানাভাই শক্ত কন্ঠে বললেন–

— তুমি কি জানো আমাদের গ্রামে কখনও এমন মা’রামা’রি হয় না? আমরা খুব শান্তি প্রিয় মানুষ। তুমি কেন এমনটা করেছ?

বর্ণ ভাই নানাভাই এর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বললেন–

— আমি আপনাদের শান্তি ভঙ্গ করেছি তার জন্য দুঃখিত। কিন্তু রনিকে মারার জন্য আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। আমার জায়গায় আপনি হলে মে’রেই ফেলতেন তাকে। আপনি কি জানেন সে আপনার একমাত্র নাতনিকে রাস্তা ঘাটে বিরক্ত করে? তার হাত ধরে টানাটানি করে? বাজে কথা বলে?

নানাভাই চমকালেন। সাথে চমকালো উপস্থিত সকলে। রনি যতোই বিরক্ত করুক আমি কখনও কাউকে বলিনি। তাই সকলে অবাক হয়েছে। নানাভাই হতবাক কন্ঠে বললেন–

— এসব কি সত্যি তাহসীনা?

আমি মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝালাম। নানাভাই আবারও বললেন–

— আমাকে বলো নি কেন? আমাকে বলতে না পারলেও তোমার মামাদের বলতে। কেন বলো নি?

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম–

— আমার জন্য কোনো ঝামেলা হোক সেটা আমি চাইনি নানাভাই।

নানাভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বর্ণ ভাইয়ের শক্ত চোখ মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন–

— আওসাফ কে ভেতরে নিয়ে যাও তাহসীনা। ও’র কে’টে যাওয়া জায়গায় ওষুধ লাগিয়ে দাও। যাও।

বর্ণ ভাই আমার অপেক্ষা করলেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলেন। আমি ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে তার রুমে গেলাম। উনি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি পেছন থেকে ওনাকে বললাম–

— এদিকে আসুন ওষুধ লাগিয়ে দিই।

ওনার গম্ভীর জবাব–

— দরকার নেই।

আমি বক্স বিছানায় রেখে এগিয়ে গিয়ে ওনার হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালাম। উনি হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলেন। রেগে আছেন এখনও। আমি আবারও ওনার হাত ধরলাম। উনি ছাড়াতে চায়লেও ছাড়লাম না। শান্ত কন্ঠে বললাম–

— এতো রেগে আছেন কেন? সব তো ঠিক আছে তাই না? আসুন ওষুধ লাগিয়ে দিই নাহলে ইনফেকশন হয়ে যাবে। প্লিজ।

উনি নিরব। ওনাকে টেনে বিছানায় বসালাম। খুব সাবধানে ওনার কাটা স্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিলাম। উনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি নিচু কন্ঠে বললাম–

— নিজে তো ব্যথা পেয়েছেন, আমার কত কষ্ট হচ্ছে জানেন? কেন যে এমনটা করতে গেলেন? মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখতে শিখুন।

কথা বললেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। যার অর্থ উনি আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নন। আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম–

— আপনি রেস্ট করুন। মারপিট করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই?

আমি বের হয়ে গেলাম। বুঝতে পেরেছি উনি আমার ওপর রেগে আছেন। সেই রাগের কারণেই একটা কথাও বললেন না আমার সাথে।

আজ সামিয়া আপুর গায়ে হলুদ। তোড়জোড় চলছে চারদিকে। আমার সব থেকে চোখে লাগার ব্যাপারটা হলো নানাভাই এবং দাদাভাই এর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন বর্ণ ভাই। যে নানাভাই কদিন আগে বর্ণ ভাইকে দেখতেই পারতেন না, সেই নানাভাই এখন বর্ণ বলতে অজ্ঞান। বর্ণ কোথায়? বর্ণকে মাছের মাথা দাও, বর্ণের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখো, বর্ণ যেন বলতে না পারে আমাদের আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি ছিল ইত্যাদি। বর্ণ ভাই এখন লুঙ্গি পরতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছেন। দিব্যি লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে এর মাঝে তিনি আমার সাথে এক বাক্যও বিনিময় করেননি। আমি কথা বলতে গেলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে গিয়েছেন। মন খারাপ হয়েছে খুব। আমার সাথে কথা বলছেন না তো? ঠিক আছে আমিও আর বলতে যাবো না বলে পণ করলাম।
সামিয়া আপু হলুদ রঙা শাড়ি পরে সেজেগুজে একদম তৈরি। সাথে পরেছে তাজা ফুলের গহনা। একদম ফুল কুমারী লাগছে দেখতে। এরই মধ্যে ফটাফট কয়েকটি ছবি তুলে জিজুর কাছে সেন্ড করাও শেষ। বাব্বা! কি প্রেম! অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে এমন প্রেম আমি বাবার জন্মে দেখিনি। আমি শাড়ি পরতে চাইনি। সামিয়া আপু জোর জবরদস্তি করে আমাকে শাড়ি পরতে বাধ্য করেছে। আমার শাড়িটাও হলুদ রঙা। শাড়ি পরলেও সাজবো না বলে ঠিক করলাম। সামিয়া আপু বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন–

— একটু সাজলে কি হবে ছায়া? কেমন ম’রা ম’রা দেখতে লাগছে।

আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে বললাম–

— আমি সাজবো না মানে কিছুতেই সাজবো না আপু। তোমার বিয়ে তুমি সাজ, এতে আমাকে নিয়ে টানাটানি কোরো না।

মনে মনে বললাম, “কার জন্য সাজবো? সেই লোকটাই তো মুখ ঘুরিয়ে আছে। থাকুক সে তার মতো, দরকার নেই আমার কিছুর।” সামিয়া আপুর নানু বাড়ি থেকে তার কাজিনস্ এসেছে। দুইটা আপু এবং একটা ভাইয়া। ভাইয়াটা সামিয়া আপুর বড় হলেও আপু দুইটা সামিয়া আপুর প্রায় সমবয়সী। তারা তো মেকআপ করে একদম হুরপরী সেজে রেডি। লোকে দেখে বলতেই পারবে না যে কার বিয়ে। আমার চিন্তা তো এক জায়গায়, আমি একদম শিওর এতো সুন্দর সুন্দর হুর পরী বর্ণ ভাইয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। ব্যাটা তো আর কম সুন্দর নয়। কে বলেছিল এতো সুন্দর হতে?

— কি রে সামিয়া! তোর এই ফুফাতো বোন কি এমন নিরামিষ হয়ে থাকবে নাকি? কেমন গাইয়া দেখা যাচ্ছে।

আপুর এক মামাতো বোনের কথায় আমি তার দিকে ফিরলাম। মুখ ভর্তি ফাউন্ডেশন ও কনসিলার আর ঠোঁট ভর্তি টকটকে লাল লিপস্টিক। আমি ঠোঁট টিপে হেসে বললাম–

— আমি এমনই ঠিক আছি আপু। আমার সাজতে ভালো লাগে না। এই শাড়িটা পরেছি এই অনেক। গ্রামে আছি যখন তখন নাহয় একটু গাইয়া হয়েই থাকলাম।

তিনি মুখ বাকালেন। এখানে আসার পর থেকেই তারা দু’জনই আমার ওপর চরম বিরক্ত। কেন তা জানি না। সবাই এতো বিরক্ত কেন আমার ওপর? এদিকে আপুরা আবার অন্যদিকে বর্ণ ভাই!

চলবে..
{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here