জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ১৩

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

১৩.
খালি গায়ে থাকায় চারিদিকের বাতাসে ঠাণ্ডায় শরীর শিরশির করে উঠলো সৌমিকের। চোখ খুলে খানিক ধাতস্থ হতে সময় লাগলো তার। মনে পড়লো, সেই যে বেলকনিতে এসেছিলো তারপর আর রুমে যায়নি। ভেজা শরীর নিয়েই এখানে শুয়ে পড়েছিলো। শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুম চলে এসেছিলো। নড়েচড়ে উঠে বসলো সে। চারিদিক অন্ধকার। তারমানে রাত হয়ে গেছে। কটা বাজে?

‘মোবাইল, মোবাইল…’ বলে চারিদিকে তাকিয়ে মোবাইল খুঁজতে লাগলো সৌমিক। ফ্লোরে দেখতে পেলো মোবাইলটা। হাতে নিয়ে দেখলো রাত দশটা বাজতে চললো। আনমনে একটা বাঁকা হাসি দিলো সে। তার জীবনের তো বারোটা বেজেই গেল। টিকিটের জন্য কল করেও টিকিট বুক করেনি সৌমিক। মনে পড়ে গিয়েছিলো, সেদিন মোহনা বলেছিলো তার অনেক ইচ্ছে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার। মোহনার কথা মনে পড়তেই মাথায় এলো, মোহনা কী করছে? ভাবতে ভাবতে উঠে ভেতরে গেল সৌমিক। দেখলো রুমের লাইট জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমাচ্ছে মোহনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাইট ওফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো সে। তারপর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। মিনিট পাঁচেক পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো সে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে মোহনার দিকে তাকাতেই দেখলো মোহনা খানিক নড়ে উঠেছে। সৌমিক আস্তে আস্তে মোহনার পাশে গিয়ে বসলো। হালকা বেগুনি রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরেছে মোহনা। ভেজা চুল বালিশের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চোখের পাশের শুকনো দাঁগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কান্না করেছে। কান্নাভেজা এই মুখটা কী স্নিগ্ধ! কী মনোরম! সৌমিক মুচকি হাসলো। কেন হাসলো সে নিজেও জানেনা। মোহনার সামনে উবু হয়ে সে মোহনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাকতে লাগলো, ‘মোহনা… মোহনা, ওঠো।’

মোহনার কোনো সাড়াও নেই। সৌমিক আমার ডাকলো একইভাবে। এবার মোহনা একটু নড়ে উঠে কিছু একটা বিড়বিড় করলো। সৌমিক বললো, ‘বুঝিনি। কী বলছো? এই আমরা তো ডিনার করিনি। উঠো, খেতে চলো।’

মোহনা পিটপিট করে তাকালো। কিছু না বলে তাকিয়ে থাকলো। লম্বা করে নিশ্বাস নিলো। সৌমিক বললো, ‘ঘুম ভেঙেছে?’

‘হুম।’

‘চলো। খাবো।’

‘আমাকে খাও।’ ভাঙা গলায় বললো মোহনা। সৌমিক প্রথমে বুঝলোনা মোহনা কী বললো। সে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো। মোহনা বললো, ‘বুঝতে পারোনি?’

‘ন-না। কী বললে?’

‘তার আগে বলো আমি তোমাকে তুমি বললে সমস্যা নেই তো?’

সৌমিকের বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো মোহনার গলা শুনে। ঘুম আর কান্নার মিশ্রণে কী বিষাদময় কণ্ঠে কথা বলছে মোহনা! সৌমিক মোহনার আরেকটু কাছে এগিয়ে এক হাতে ওর গাল ধরে বললো, ‘অবশ্যই বলতে পারো। কিসের সমস্যা থাকবে?’

মোহনা এবার দু’হাত তুলে সৌমিকের গলা জড়িয়ে ধরলো। সৌমিক অবাক হলো। মোহনা ভাঙা ভাঙা গলায় বলতে লাগলো, ‘তুমি তখন আমাকে চুমু না খেয়ে ওভাবে চলে গেলে কেন?’

সৌমিকের অস্বস্তি লাগলো। কী বলবে বুঝতে পারছেনা। এই প্রশ্নের মানে কী? সে নিজেই তো…

‘চুপ করে আছো কেন? বলো।’ আবার জিজ্ঞেস করলো মোহনা।

‘তুমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলেছিলে।’

‘আমি ধাক্কা দিয়ে সরালেই তোমাকে সরে যেতে হবে? আমি যা বলবো তাই হবে? তাহলে এখন ধাক্কাচ্ছি, যাও। সরো… সরো বলছি…’ বলে ধাক্কাতে লাগলো মোহনা সৌমিককে। সৌমিক হেসে দিলো। মোহনার ওপর ভর ছেড়ে দিয়ে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। মোহনা বললো, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি ওকে ভুলে যাওয়ার। কিন্তু বারবার… বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সব… সবকিছু… আমি তোমাকে কবে ভালোবাসতে পারব জানিনা। কিন্তু, আমি চাই তোমাকে মায়ার বাঁধনে জড়াতে। আমি চাই এই বাঁধন সৃষ্টিকর্তা বিহীন কেউ যেন না ছিঁড়তে পারে। মরণ বিহীন আমরা যেন আলাদা না হই। আমি… আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাই। তোমাকে নিয়ে আমার জীবন সাজাতে চাই। তুমি… তুমি পারবেনা আমার হৃদয়ে রঙ ফেরাতে? পারবেনা? আ-আমাকে আদর করো।’ এতোটুকু বলে চোখ বন্ধ করলো মোহনা। জল গড়িয়ে পড়লো তার চোখ থেকে। বিস্ময়, মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে সৌমিক। ধাক্কা সামলে উঠতে সময় লাগছে তার। মোহনার ঘুম কি এখনও ছাড়েনি? সে কী ঘুমের ঘোরে এমন বলছে? সৌমিক আস্তে করে বললো, ‘তুমি কি ঘুমের ঘোরে আছো?’

‘ঘুমের ঘোরে থাকলেই কি শুধু আদর করবে?’ চোখ খুলে তাকালো মোহনা। এই চাহনিতে কিছু একটা আছে। সৌমিক ঠাহর করে উঠতে পারছেনা। মোহনা আবার বললো, ‘আমার ঘুম অনেক আগে ভেঙেছে। তুমি আমার পাশে আসার আগে।’

সৌমিক ঢোক গিলে বললো, ‘খেতে চলো। নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে তোমার?’

‘তার আগে হৃদয়ে যেই পোড়া পোড়া ক্ষিধে আছে সেটা মেটাও।’ কথাটা বলার সময় পৃথিবীর সমস্ত কাতরতা যেন এসে জায়গা করে নিয়েছে মোহনার চোখে। সেই চোখে তাকিয়ে থেকে সৌমিকের মনে হলো, এতোদিন থেকে সৌমিক বুকের ভেতর যে পাহাড়সম না বলা অব্যক্ত অনুভূতি জমিয়ে রেখেছিলো, সেই সবগুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কোনোকিছু না ভেবে এবার সৌমিক নিজের ভেতরের সেই লুকোনো ঘুমন্ত সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুললো। এক হাত মোহনার চুলের ভেতর রেখে ওপর হাতে তাকে নিজের সাথে গভীর আলিঙ্গনে বেঁধে নিলো সৌমিক। আর তারপর, সবকিছু ভুলে মত্ত হলো মোহনার সুনিপুণ কোমল ওষ্ঠদ্বয়ে। মেটাচ্ছিলো নিজের তৃষ্ণা, আর মোহনার হৃদয়ের পোড়া পোড়া ক্ষিধে। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মোহনাকে ছেড়ে দিয়ে তার গলায় নাক ডুবালো সৌমিক। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে লাগলো। হাত মোহনার শরীরের এদিকওদিক নাড়াচাড়া করছিলো। মোহনা সৌমিকের সে হাত ধরে বললো, ‘আদর করতে বলেছি। পুরো হানিমুন করতে বলি নি। আমরা কিন্তু হানিমুনের রাস্তায়, এখনও পৌঁছাতে সময় আছে।’

কথাটা শুনে সৌমিক যেভাবে ছিলো সেভাবেই হেসে দিলো। তারপর উঠে বসলো। মোহনাও উঠে বসলো। সৌমিক দুষ্টু হাসি হেসে মোহনার দিকে তাকাচ্ছে। মোহনা সেই হাসি দেখে বললো, ‘যদি ভেবে থাকো তোমার এই হাসি দেখে আমি লজ্জা পাবো, তাহলে ভুল ভাবছো। লজ্জা পাওয়ার সময় শেষ।’

সৌমিক অবাক হলো না। বরং হাসলো হো হো করে। মোহনা চুল খোঁপা করতে করতে বললো, ‘এখানেই খাবার অর্ডার দাও। বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।’

সৌমিক খাবার অর্ডার করলো। খাওয়াদাওয়া শেষে সৌমিক বললো, ‘ভোরে উঠতে হবে। তুমি শুয়ে পড়ো।’

‘তুমি আসবেনা?’

‘আমি একটু টিভি দেখবো।’

‘কিন্তু আমিযে তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে চাই।’ সহজ সরল স্বীকারোক্তি মোহনার। সৌমিক বাঁকা হাসলো। বিছানায় এসে শুয়ে মোহনাকে বুকে টেনে নিলো। কপালে চুমু খেয়ে বললো, ‘আজ যতো আরাম করে ঘুমানোর, ঘুমিয়ে নাও। কাল থেকে এই সুযোগ তুমি পাবেনা।’

খিলখিল করে হেসে উঠলো মোহনা। হাসতে হাসতে আরো নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করলো সৌমিককে। ঠিক সেই মুহূর্তে মোহনার মনে হলো, সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা কখনও বৃথা যায় না। আল্লাহ যা কিছু করেন, সবকিছু উনার বান্দার ভালোর জন্য, সুখের জন্য। যেভাবে সৌমিক আজ তাকে হাসাচ্ছে, সেভাবে হয়তো তার পছন্দের মানুষটা তাকে রাখতে পারতনা। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো মোহনা। ঘুমিয়েও পড়লো একটা সময়।

টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন এর দূরত্ব ৪২ কি:মি:। তন্মধ্যে ২৫ কি:মি: হচ্ছে নাফ নদী। আর বাকি ১৭ কি:মি: হচ্ছে খোলা সাগর। সৌমিকদের জাহাজটা এই মুহূর্তে সাগরে অবস্থান করছে। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। আর মিনিট বিশেকের মধ্যে পৌঁছে যাবে গন্তব্যে। সৌমিক আর মোহনা অদূরে পাহাড় আর সাগরের শো শো শব্দ চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। জাহাজে অনেক যাত্রী আছেন। সবাই যার যার মতো সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করায় ব্যস্ত। মোহনার শাড়ির আঁচল উড়ছে বেশামাল ভাবে। চুলগুলো বারবার উড়ে উড়ে সৌমিকের মুখের ওপর পড়ছে। একটা সময় চোখ খুলে মোহনা মুগ্ধতা নিয়ে বললো, ‘এতো সুন্দর! পাহাড়ের ঘ্রাণটা ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে।’

সৌমিক মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সত্যিই সুন্দর।’

‘ঢেঁড়সের মতো ওভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমাকে এসে ধরো পেছন থেকে।’ ক্যাটকেটে গলায় বললো মোহনা।

‘আমার স্পর্শ সহ্য করার ক্ষমতা আছে তোমার?’ বলতে বলতে নিবিড়ভাবে পেছনথেকে জড়িয়ে ধরলো মোহনাকে সৌমিক।

‘করেই দেখো স্পর্শ। আমি এতো দুর্বল নাকি?’

‘এখানে? জাহাজে? “365 days” মুভির মতো? কিন্তু অনেক মানুষ যে…’ ভীষণ চিন্তিত মুখ বানিয়ে বললো সৌমিক। মোহনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। কিছু মুহূর্ত ব্যয় হলো তার ব্যাপারটা বুঝতে। যখন বুঝতে পারলো তখন হা হয়ে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘ইশ, এতো অসভ্য কেন?’

সৌমিক হো হো করে হাসতে লাগলো। আর মোহনা সৌমিকের পিঠে মারতে লাগলো।

জাহাজ থেকে নেমে সৌমিকের সাথে কথা বলতে বলতে যখন হাঁটছিলো মোহনা, তখন তার চোখ গেল সৌমিককে ছাড়িয়ে আরো ডানদিকে। সাথেসাথেই পা দুটো থমকে গেল তার। আরেকটু ভালোভাবে তাকালো মোহনা। হ্যাঁ, ও-ই তো। মোহনা হুট করে কেমন উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেল। সৌমিকের দিকে তাকালো ফ্যাঁকাসে মুখে। সৌমিকের হাত আস্তে আস্তে ছেড়ে দিচ্ছিলো। সৌমিক বললো, ‘কী হয়েছে তোমার? কী করছো?’

মোহনা সৌমিকের হাত ছেড়ে দিয়ে শুধু বললো, ‘ঐ দেখো, ঐযে… আরাফাত। ও আরাফাত…’ তারপর সৌমিক চেয়ে চেয়ে দেখলো, দুপুরের খটমটে রোদ মাথায় নিয়ে, চিকচিক করা জল চোখে নিয়ে, শাড়ির আঁচল বাতাশে উড়িয়ে সবকিছু উপেক্ষা করে দৌড়ে যাচ্ছে মোহনা। গৌরবর্ণা রক্তিম শার্ট পরা ঐ ছেলেটার দিকে। এই কি সেই ছেলে? যার জন্য মোহনার হৃদয় পুড়ছে প্রতিনিয়ত? মোহনা যতই ঐ ছেলেটার দিকে এগোচ্ছিলো, সৌমিকের বুকের ভেতররে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো ততই নির্মমভাবে। পুড়ছিলো কলিজা অবিরত।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here