জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ২

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

২.
চাঁদ ফিকে, জোৎস্না ফিকে,
ফিকে রাত্রির সৌন্দর্য।
সুন্দর শুধু তুমি কন্যা-
তোমাতেই খেলে মাধুর্য।
ভবঘুরে হতে ঘরমুখো আমি-
তোমার বিভূষণ কুড়াই।
উত্তাল নিশ্বাস, হৃদয়ের হাহাকার,
কী উপায়ে সরাই?

মোহনাকে পেছন থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে কথাগুলো বলছিলো সৌমিক। ঘোর লাগা নিশ্বাস তার, ঘোর লাগা কণ্ঠও। মোহনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত বা বলা উচিত সেটা সে বুঝতে পারছেনা। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। সৌমিকের উত্তপ্ত নিশ্বাস তার ঘাড়ের ওপর শিহরণের প্রলেপ এঁকে দিচ্ছে। হৃদয় কেঁপে উঠছে বারং বারংবার। তার তো এখন উচিত ছিলো সৌমিককে খুব জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়া। তারপর কয়েকটা কঠিন কথা বলে সেখান থেকে গটগট করে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু আশ্চর্য! মোহনা এসবের কিছুই করতে পারছেনা। অথবা করতে চাইছেনা। সৌমিকের স্পর্শ যেন তার বিষন্ন হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টির মতো ঠাণ্ডা হাওয়া লাগিয়ে দিয়েছে। বলতে নেই, ভালো লাগছে মোহনার। কিন্তু তার তো রাগ হওয়ার কথা। হচ্ছেনা কেন? এটাই কী স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনের শক্তি? পবিত্র অনুভূতির শক্তি?

‘কিছু বলছোনা যে? কেমন লাগলো?’

সৌমিকের কথায় মোহনার ঘোর কাঁটে। চোখ মেলে আরো একবার ঘরটাকে পরখ করলো সে। ঘরের চারকোণে চারটা বড় আকারের টেবিল ফ্যান চলছে মিডিয়াম স্পিডে। যেন ঝিরিঝিরি বাতাস দিচ্ছে প্রকৃতি। জানালা খোলা, চাঁদের আলো টিমটিম করে ভেতরে প্রবেশ করছে। চারিদিকে রঙ বেরঙের মোমবাতি রাখা হয়েছে গ্লাসের মতো কিছু একটার ভেতর। ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোলাপের পাঁপড়ি। মাতাল করা গোলাপের সুবাস ভেতরের অনুভূতি জাগ্রত করে। ফ্লোরে একটা বিছানা পাতা আছে। সাদা রঙের চাদর বিছানো। সেটার ওপর অনেকগুলো গোলাপের আর গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে রাখা। ফুলের সুবাসে মো মো করছে পুরো ঘর। হ্যাঁ, এটাই তো ছিলো মোহনার ইচ্ছা। ঠিক এভাবেই তার বাসর ঘর হবে। ঠিক এভাবেই সে বলেছিলো তার ভালোবাসার মানুষকে। কিন্তু… এটা সৌমিকের জানার কথা না। কীভাবে জানলো? উত্তরটা সৌমিকই দিলো।

মোহনাকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে সৌমিক বললো, ‘আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো এভাবে ফুলে ফুলে সাজিয়ে নেব বাসর রাত।’

মোহনা কিছু বললোনা। হুবহু একইরকম ইচ্ছে কি দুজন বিপরীত মানুষের হতে পারে? হ্যাঁ, হতেও তো পারে। হয়তো মোহনা বেশি বেশি ভাবছে। সে যেরকমটা ভাবছে ওরকম কিছুই হয়তো না। হঠাৎ মোহনা অনুভব করলো, সৌমিক তার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়েছে। সহসাই মোহনার আত্মা কেঁপে উঠলো। সৌমিকের হাত আস্তে আস্তে বেসামাল হচ্ছে। মোহনা ছটফট করতে লাগলো। ঢোঁক গিলে হঠাৎই বলে উঠলো, ‘আমি সময় চেয়েছিলাম।’

থেমে গেল সৌমিক। মাথা তুললো। মোহনাকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর কণ্ঠে বিষাদ মেখে বললো, ‘উফ! একটু রোম্যান্স করা যাবেনা? আমিতো আর ঐটা করছিনা।’

মোহনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের মনকে বুঝাতে পারছেনা সে। কিছুতেই পারছেনা। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। অবশেষে কাঁন্না আটকাতে না পেরে কেঁদেই দিলো সে। সৌমিক থতমত খেয়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলো, ‘এই এই, কেঁদোনা প্লিজ। আচ্ছা আচ্ছা, আর ধরবোনা তোমাকে আমি। কেঁদোনা।’

মোহনা কান্না থামালো কিন্তু একটু পর পর ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাক টানতে লাগলো। সৌমিক মনেমনে নিজে নিজের পিণ্ডি চটকাচ্ছে। কেন যে ওসব করতে গেল! সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, ‘ও বউ, ঘুমাবে চলো। রাত অনেক হয়েছে। এখানেই ঘুমাই। ভয় পেওনা, তোমাকে ছোঁবোনা।’ কথাটা বলে হাসলো সৌমিক। তারপর মোহনার হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে যেতে লাগলো। মোহনা স্তব্ধ, বিস্মিত। সৌমিকের মুখের ‘বউ’ ডাকটা যেন তার অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিলো। হ্যাঁ, বউ-ই তো সে সৌমিকের। কী অবলিলায় আজ অন্য একটা পুরুষের নামের সাথে তার নাম জুড়ে গেল! কেন সে সৌমিকের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করছে? বিছানায় এসে বসতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মোহনা। দু’হাতে মুখ ঢেকে বুক ভেঙে কাঁদতে লাগলো সে। সহ্য হচ্ছেনা এই কষ্ট। কেন সে ভালো থাকতে পারছেনা? কেন সুখের সন্ধানে এসেও সুখ ধরা দিচ্ছেনা? কেন?

সৌমিক তাকিয়ে আছে কান্নারত মোহনার দিকে। কাঁদছে মোহনা, সবকিছু ভেঙেচুরে কাঁদছে। সৌমিক কিছু বলছেনা, একটা মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে মোহনার মাথাটা নিজের বুকে ঠেকালো। ওমনি মোহনা দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সৌমিককে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সৌমিক হাসছে। এক হাতে মোহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।

সৌমিক হাসনাইন। মা বাবার একমাত্র সন্তান। কোনো ভাইবোন নেই তার। বছর তিনেক আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে নিজের বাবা আর মা-কে হারায় সে। তারপর থেকে তার একমাত্র ফুফু আর ফুফুতো ভাইকে নিয়ে থাকছে সে। ফুফু আগে থেকেই থাকতেন ওদের সাথে সৌমিকের জন্মের আগে থেকে। স্বামী মারা যাওয়ায় উনাকে আর ওখানে কেউ রাখতে চায় নি। তাই সৌমিকের বাবা তার পাঁচ মাসের অন্ত:সত্ত্বা বোনকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। সেই থেকে উনি এই পরিবারের সদস্য। এইতো এক বছর আগে ফুফুতো ভাই বিয়ে করেছে। তারপর সৌমিকের সাথে বিজনেস সামাল দিচ্ছে। এইতো, দুঃখ থাকতেও একটা সুখী পরিবার।

সকাল সাতটা বাজে। টেবিলে চা খেতে বসেছেন সব মহিলারা। সাথে চলছে নানারকম গল্প, আড্ডা। এই চার পাঁচজন মহিলা বাদে সবাই এখনও ঘুমে জবুথবু। এদের মধ্যে সৌমিকের ফুফু ও ফুফুতো ভাইয়ের বউ আছে।

‘বর বউয়ের কী এখনও ওঠার সময় হয়নি? গিয়ে জাগিয়ে দেবো?’ আড্ডার আসরে সৌমিকের ফুফুতো ভাইয়ের বউ রুমি হঠাৎ কথাটা বলে উঠলো।

সৌমিকের ফুফু নমিরুন বললেন, ‘আরে ডাকতে হবেনা গো। আমার সৌমিককে চেনোনা? দেখো গে ঠিকই উঠে এখন ব্যায়াম করছে।’

‘হ্যাঁ তাই তো। ভাইয়া যা ফিট! এক্সারসাইজ না করলে উনার হয়ই না। দেখো হয়তো বউকেও ব্যায়াম করতে লাগিয়েছে।’ বললো রুমি। ওর কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠলো।

ঘামে জবজবে খালি শরীর নিয়ে মোহনার কাছে এসে মোহনাকে ডাকছে সৌমিক। চোখ খুলে সৌমিকের এহেন অবস্থা দেখে মোহনার চক্ষু চড়কগাছ! সে দু’হাতে চোখ ঢেকে চেঁচিয়ে বললো, ‘বড্ড বেলাজ তো আপনি! এভাবে খালি গাঁয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সরুন নয়তো কাপড় পরুন।’

চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সৌমিক। অবাক লাগলো তার। সে বললো, ‘আশ্চর্য! আমি খালি গাঁয়ে থাকলে তো কোনো সমস্যা নেই। তুমি আমার বউ, তোমার সামনে লজ্জা কিসের? আর তাছাড়া প্যান্ট পরেই তো আছি। আমাকে দেখে এমন করছো কেন? খালি গাঁয়ে আমার মাঝে দেখার কী আছে? আমার তো আর তোমার মতো ব্রে…’

সৌমিককে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলো মোহনা। তারপর বললো, ‘উফ আল্লাহ, এই লোকটার মুখে লাগাম বলতে কিছু নেই। কীসব কথা বলে!’

‘কী বললাম? আর তুমি হাত সরাচ্ছো না কেন?’

‘আপনার গাঁ খালি। ঘামে ভেজা। লেপ্টে থাকা লোম দেখা যাচ্ছে।’ তড়াক করে কথাটা বলেই জিহবা কাটলো মোহনা। এই যা! কী বলে দিলো এটা? ছি ছি! কী ভাববে সৌমিক। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে মোহনার।

সৌমিক একটা দুষ্টু হাসি দিলো। তারপর বললো, ‘কেন? ফিলিংস চলে আসছে?’

‘কিসের ফিলিংস?’ বলতে বলতে সৌমিকের দিকে না তাকিয়েই উঠে যেতে নিচ্ছিলো মোহনা। সৌমিকের থেকে একটু দূরে গিয়ে বললো, ‘কোন ফিলিংস?’

‘এস ই এক্স!’ কথাটা বলে ধুপ করে ফ্লোরে পাতা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো সৌমিক। বিস্ময়ে মোহনার মুখ হা হয়ে গেল। কান দিয়ে যেন গরম বাতাস বের হতে লাগলো। সে কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘ছি! আপনি, আপনি সত্যি একটা অসভ্য।’ বলেই ওয়াশরুমে গিয়ে অনেক জোরে শব্দ করে দরজা লাগালো সে। এদিকে সৌমিক হেসে কুটিকুটি।

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতে যাবে মোহনা আর ঠিক তখনই শুনতে পেলো কারো কথোপকথন। একটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো সৌমিক কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আর সৌমিক ফোনের ওপাশের মানুষটাকে যে কথাটা বলেছে সেটা শুনে মোহনার কান ঝাৎ করে উঠলো। মাথার ভেতর এলোমেলো হয়ে গেল। অপমানের পোকাগুলো শরীর জুড়ে কিলবিল করতে লাগলো। এতো বড় কথা! সৌমিক এতো বড় কথা বললো তার বিষয়ে? এই কথাটা… এই কথাটা কাকে বললো সে? রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেল মোহনা। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা সৌমিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here