জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ৩

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

৩.
সৌমিক কলটা কেটে দিয়ে মোহনার দিকে তাকালো। দেখলো মোহনার চোখেমুখে কঠিন একটা ভাব ফুটে আছে। সে একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার, মহারাণী? এভাবে তাকিয়ে আছেন যে?’

‘কী বললেন আপনি?’ কটমটে চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো মোহনা।

‘কোথায়? কী বললাম?’ সৌমিক অবাক হলো।

‘এইমাত্র কী বললেন?’

‘কিছুই তো বলি নি!’

‘উফ!’

মোহনা এক হাত দিয়ে নিজের আরেক হাত খামচে ধরেছে। সৌমিক অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মোহনার দিকে। হুট করে মোহনা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো। তার কোমল পেলব ওষ্ঠ বসিয়ে দিলো সৌমিকের কাষ্ঠ, সিগারেটের ধোঁয়া সয়ে যাওয়া ওষ্ঠে। আকস্মিক এহেন কাণ্ডে সৌমিক বাকরূদ্ধ হয়ে গেল। মোহনা এমন কিছু করবে সেটা সে চিন্তাও করেনি। কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই সৌমিকও আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো মোহনাকে। হাত বেসামাল হলো তার। যখন পুরোপুরি নেশা ভর করেছে সৌমিকের মাথায় তখনই মোহনা ধাক্কাতে লাগলো তাকে। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সৌমিকের থেকে। সৌমিক আবার এগিয়ে যেতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মোহনা। ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সৌমিক। আশ্চর্য! কাঁদছে কেন? সে তো জোর করে কিছু করেনি। মোহনা নিজেই ইন্টারেস্ট দেখালো। সৌমিক বললো, ‘কাঁদছো কেন? আমি কি কোনো ভুল করলাম? আমিতো…’

সৌমিকের কথার মাঝখানে মোহনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগলো, ‘বিশ্বাস করুন, আমি লেসবিয়ান না। আমি সত্যি নরমাল, ঠিক আছি। আমার ছেলেতে ইন্টারেস্ট। আমি শুধু আপনার কাছে সময় চেয়েছি। আপনি জানেন, আগেও বলেছি যে আমি একজনকে…’

‘হোল্ড অন! হোয়াট দ্য হেল আর ইউ সেয়িং?’ অবাকের অষ্টম পর্যায়ে পৌঁছেছে সৌমিক। কিছু বুঝতে পারছেনা সে।

মোহনা দু’হাতে চোখ মুছলো। তারপর নিজেকে একটু শান্ত করে বললো, ‘ঢং করবেন না। আপনি বলেছেন আমি লেসবিয়ান।’

‘মানে! কখন? কাকে বললাম?’ সৌমিক খানিকটা চেঁচিয়েই বললো কথাটা। রাগ উঠে যাচ্ছে তার।

‘এইমাত্র বলেছেন কাউকে, ফোনে।’

তাৎক্ষণিক সৌমিক কাহিনী ধরে ফেললো। এতোক্ষণ মাহফুজের সাথে কথা বলছিলো সে। মাহফুজ একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে আছে। মেয়েটার হাব ভাব খুব একটা ভালো না। মাহফুজের কাছে আসলে কেমন গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে থাকে। এইরকম কিছু কথার ছলে সৌমিক বলেছিলো যে ‘মেয়েটা লেসবিয়ান নয় তো?’। আর এই কথাটাকেই মোহনা নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। সৌমিক মুখ দিয়ে ‘ফু’ করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আসলেই। কেউ একজন ঠিকই বলেছে। মেয়েদের মনে আসলেই জিলাপির প্যাঁচ।’

কপাল কুঁচকে ফেললো মোহনা। বললো, ‘মানে?’

‘আড়ি পেতে আমার কথা শুনছিলে?’

‘আড়ি পাতবো কেন? যা জোরে কথা বলেছেন, দেখুন গিয়ে পুরো বাড়ির মানুষই শুনেছে।’

‘ওগুলো আমি তোমাকে বলিনি। মাহফুজের গার্লফ্রেন্ডকে বলেছি। মেয়েটা ভালো না। খুব একটা সুবিধার না। খারাপ স্বভাবের। আর… তুমি আমার স্ত্রী। আমি অন্য একজনের কাছে তোমার নামে এমন বলবো, ভাবলে কীভাবে?’ শেষের কথাগুলো সৌমিক খুবই শান্ত কিন্তু ধারালো গলায় বললো।

মোহনার মনে হলো তার দুনিয়া ঘুরছে। কানের ভেতর চিনচিনে একটা শব্দ হচ্ছে। একটু আগের করা কাণ্ডটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই যেন পা টলতে লাগলো তার। এটা কী করলো সে? ছিঃ! হে আল্লাহ! এবার কী করবে সে? এক দৌড়ে যদি নিজের বাসায় চলে যেতে পারতো! অথবা যদি মাটির ভেতর ঢুকে যাওয়া যেতো! চোখ বন্ধ করে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মোহনা। থরথর করে কাঁপতে লাগলো সে। সৌমিক এক কদম এগিয়ে মোহনার কাছে এসে দাঁড়ালো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘লজ্জা পাচ্ছো?’

ঝট করে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলতে লাগলো মোহনা, ‘আপনি বেরিয়ে যান প্লিজ। এক্ষুণি বেরিয়ে যান। আপনার পায়ে পড়ি, প্লিজ। নাহলে মরেই যাবো।’

হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সৌমিক। মোহনা দাঁড়িয়ে থাকলো ওইভাবেই।

পার্লারের মেয়েরা যত্নসহকারে সাজিয়ে দিলো মোহনাকে। ভারী সাজগোজ গয়নাগাটি এসব মোহনার ভালো লাগে না। তবুও আজ ওয়ালিমা। মোহনার বাবার বাড়ি থেকে সবাই আসবে। সাথে সৌমিকেরও অনেক আত্মীয় আসবে। তাই সাজতে হলো। মেয়েগুলো চলে যাওয়ার পর রুমি সহ আরো কয়েকজন মহিলা এসে বসলো মোহনার পাশে। রুমি মোহনাকে দেখে উল্লাস করে বললো, ‘হায় আল্লাহ! তোমাকে এতো সুন্দর লাগছে! ভাইয়া তো এমনিতেই ফিদা, আজ তো ভাইয়া একেবারেই ফিদা হবে।’

রুমির কথা শুনে রুমের সবাই হেসে উঠলো। হাসি ঠাট্টা চলতে লাগলো। কিন্তু মোহনার বিরক্ত লাগছে। ভালো লাগছেনা কিছু তার। হঠাৎ সৌমিক আসতেই সবাই বেরিয়ে গেল। মোহনার সাথে চোখাচোখি হতেই সৌমিক মুচকি হাসলো। তারপর যতোবারই চোখাচোখি হলো বারবারই সৌমিক ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলো। মোহনার ভীষণ রাগ হলো। সে ঝাঝের গলায় বললো, ‘একদম হাসবেন না বললাম।’

সৌমিক এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে একবার এইসাইড হচ্ছে তো আবার ঐ সাইড। মোহনা ড্রেসিংটেবিল এর সামনে থেকে উঠে গিয়ে বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে দু’হাত রেখে বললো, ‘শুনুন, আপনি ভাববেন না যে সকালের ঘটনার জন্য আমি এখনও লজ্জা পাচ্ছি। ওটা একটা ভুল ছিলো।’ বলে একটা দম নিলো মোহনা। তারপর জোর গলায় বললো, ‘ভুলে যান। আমি এতো লজ্জাবতী নই।’

এই ‘ভুলে যান’ কথাটা ধমকের স্বরে বললো মোহনা। সৌমিক তখনও হাসছিলো মুচকি মুচকি। সে বললো, ‘সকালের ঘটনা? কী ঘটেছিলো? তবে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। যেখানে একজন সুন্দরী ললনা আমাকে চুমু খেয়েছিলো। সেটার কথা বলছো?’

মোহনা হা হয়ে গেল। কিছু একটা বলতে গিয়েছিলো কিন্তু তখনই সৌমিক আবার বললো, ‘তবে, টেস্টটা ছিলো দারুণ। ইয়াম্মি।’ বলেই হাতের ঘড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মোহনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে সৌমিকের গুষ্টি শুদ্ধো বিনাশ করলো। তারপর ঘাড় ঘুরাতেই নিজের মোবাইলটা চোখে পড়লো মোহনার। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল একজনের কথা। কী করছে সে? কেমন আছে? নিশ্চয়ই অনেক সুখে আছে। কান্নারা দলা পাকালো গলায়। নিজেকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টায় মগ্ন মোহনা।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here