জলপদ্ম পর্ব -০২

#জলপদ্ম
#কুরআতুল_আয়েন

|২|
পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়।সেই সাথে ফুটে উঠে আমার মুখে বিস্তর হাসি।পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম।পর্দা টা সরিয়ে দিতেই এক ফালি রোদ্দুর আমার মুখের উপর এসে জায়গা করে নিলো।তাদের উপস্থিতিতে আমি চোখ দুটো কুঁচকে ফেলি।পিটপিট করে চোখ খুলে জানালার বাহিরে চোখ নিক্ষেপ করে সুন্দর এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখতে পেলাম সেই সাথে মিষ্টি এক আবহাওয়াও আমার সারা শরীর বেয়ে অদ্ভুত এক শিহরণ জাগিয়ে গেলো।আমি আর দেরি না করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।খালি পা’য়ে বের হয়েছি।মাটিতে হাঁটতে খুব ইচ্ছা করছে।বাড়ি পেরিয়ে সামনের সরু রাস্তাটায় এগিয়ে যেতেই চোখ পড়লো তনায়া আপুর উপর।ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছে।আমিও নিঃশব্দে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।তনায়া আপু নিজের হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছে।আমাকে এখনো দেখতে পায় নি।অবশ্য,দেখার কথাও না আমি তো তনায়া আপুর পিছনে দাঁড়িয়ে আছি।

তনায়া আপু যখন ফোনের অপাশে থাকা ব্যক্তি টিকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো”আই লাভ ইউ বাবু ভাই!লাভ ইউ সো মাচ!”কথাটি আমার কানে বাজতেই আমি এক চিৎকার দিয়ে উঠলাম।বেশখানিকটা জোর গলায় বললাম,

‘তনায়া আপু তুমি প্রেম করো।তাও আবার বাবু ভাইয়ের সাথে।আবির ভাই এইজন্যই তোমাকে চোখে চোখে রাখে।’

আমার হঠাৎ আওয়াজে তনায়া আপু যেনো ভয় পেয়ে গেলো। একলাফে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়েছে।কিন্তু,দূর্ভাগ্যক্রমে!তনায়া আপুর ফোনটা থপাস করে গোবরের মাঝখানে পড়ে যায়।মুহুর্তেই ফোনটা গোবরে মাখামাখি হয়ে গিয়েছে।

তনায়া আপু কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকিয়ে রইলো গোবর মিশ্রিত ফোনটার দিকে।আর,আমি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছি তনায়া আপুর দিকে।ইশশ!তনায়া আপুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।সেই সাথে আমার নিজের উপর নিজেরেই খুব রাগ হচ্ছে।

তনায়া আপু আমার দিকে তাকিয়ে ক্রন্দনরত গলায় বললো,

‘রিমঝিম রে!কি করলি তুই আমার।বাবু ভাই এখন হ্যালো হ্যালো করেও আমাকে পাবেন না গোবরকে পাবেন।এতো জোরে কেউ চিৎকার দেয়।’

তনায়া আপুর কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।তবুও অনেক কষ্টে হাসি টাকে চাপা দিয়ে তনায়া আপুর উদ্দেশ্যে বললাম,

‘আমি একটুও বুঝতে পারি নি তনায়া আপু।আসলে,একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তুমি বাবু ভাইয়ের সাথে প্রেম করছো এইটা শুনে।’

আমার কথা কর্ণপাত করেই তনায়া আপুর মুখে লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি ফুটে উঠলো।তনায়া আপুর মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে বাবু ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক আছে।আমাদের কথার মাঝেই রক্তিম ভাই মুখে ব্রাশ নিয়ে এসে হাজির হলেন।আমি সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।কারণ,উনাকে দেখলেই আমার গতকালকের বিয়ের কথাটা মনে পড়ে যায়।কিছুক্ষণ পর রক্তিম ভাই মুখের পেস্ট যুক্ত থুঁতুটা আমার পা’য়ের কাছে ফেলে দিয়ে তনায়া আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘কিরে তনায়া তোর মুখের এই হাল কেনো।কিছু হয়েছে নাকি।’

তনায়া আপু যেনো রক্তিম ভাইকে দেখে প্রাণ পেলো।মুখটা ভোঁতা করে চোখ দিয়ে গোবর মিশ্রিত ফোনটার দিকে ইশারা করে বললো,

‘রক্তিম ভাই আমার ফোন ইন্তেকাল করেছে।তোমার বন্ধু বাবু ভাই এখন গোবরের সাথে প্রেমআলাপ করছেন।’

রক্তিম ভাই ফোনের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

‘তোর ফোনের এই অবস্থা করলো কে?তাকে ছেড়ে দিস না তনায়া।বরং,তার মাথায় গোবর দিয়ে মাখামাখি করে দে।’

আমি ভয়ে তাকালাম রক্তিম ভাইয়ের দিকে।রক্তিম ভাইয়ের চোখ,মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না।তবে,উনি মুখ দিয়ে যা বলেন তাই করেন।যখন,ইমাজিন করলাম আমার মাথা গোবর দিয়ে মাখামাখি তখনি নাক,মুখ কুঁচকে তাকালাম তনায়া আপুর দিকে।তনায়া আপুর মুখ,চোখ দেখে বেশ বুঝতে পারছি আপুও অনেকটা অবাক হয়েছে।হয়তো রক্তিম ভাইয়ের কথাটা তনায়া আপুও হজম করতে পারে নি।

রক্তিম ভাই তনায়া আপুকে তাড়া দিয়ে বললেন,

‘এইভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা পলিথিন হাতে বেঁধে নে।যে তোর ফোনের এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ধরে রাখবো আর তুই ইচ্ছামতো তার মাথায় গোবর মাখিয়ে দিবি।নে মিশন শুরু কর তনায়া।’

রক্তিম ভাইয়ের কথার হাবভাবে বুঝলাম আজকে আমার নিস্তার নেই।কিছু একটা হবেই আমার সাথে।যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এইখান থেকে আমার পালাতে হবে।তাই,একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছি।সুযোগ বুঝেই দিবো এক দৌড়।

তনায়া আপুকে হাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রক্তিম ভাইয়ের ভ্রুজোড়া কুঁচকে গিয়েছে।এমতাবস্থায় বললেন,

‘তোর দ্বারা কিছুই হবে না তনায়া।যা করার আমিই করছি।তুই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখ।’

কথাটা বলেই রক্তিম ভাই খুব দ্রুত গতিতে গোবরের দিকে হাত বাড়ালেন।আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি রক্তিম ভাইয়ের কান্ডকারখানা।সেই সাথে তনায়া আপুও।এক মুঠো গোবর হাতে নিয়ে যখন দেখলাম আমার দিকে তেড়ে আসছেন তখনি আমার দিকবিদিক যেনো শুন্য হয়ে গেলো।চোখ বন্ধ করে দিলাম এক দৌড়।পিছনে তাকানোর কোনো প্রয়োজনই বোধ করছি না।তবে,লাভের লাভ কিছুই হয় নি,রক্তিম ভাই ঠিকই আমার দিকে গোবর ছুঁড়ে মারলেন!একদম আমার পিঠের মাঝখানে এসে ধপাস করে লেগে গেলো।মুহুর্তেই আমার শরীর যেনো গোবরের গন্ধে ভরে গিয়েছে।আমি নাক,মুখ ফুলিয়ে রক্তিম ভাইকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই তারিন আপু এসে আমাকে দেখে বললেন,

‘ছি ছি!রিমঝিম তোমার শরীর থেকে কি বাজে গন্ধ আসছে।কয়দিন হলো গোসল করো না তুমি।’

মুহুর্তেই আমার রাগ যেনো মাথায় চড়ে গিয়েছে।তারিন আপুর কথার পিঠে জোর গলায় বললাম,

‘আপনি কানা নাকি তারিন আপু।কালকেই তো দেখলেন আমাকে গোসল করতে।আর,আজকেই বলছেন,আমি কয়দিন হলো গোসল করি না।’

আমার কথা শুনে তারিন আপু কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।পরক্ষণেই নাক চেপে আমাকে পাশ কাটিয়ে রক্তিম ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।রক্তিম ভাই ঘাসের উপর উনার গোবর যুক্ত হাত টা মুছতে মুছতে তারিন আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘জানিস তারিন!রিমঝিমের গোসল করা যেই কথা না করা সেই কথা।একটু পরেই ওর শরীর থেকে কেমন একটা উদ্ভট গন্ধ পাবি।বমি না করে তুই থামবিই না।বুঝলাম না,আমারদের বংশে যে এইরকম গন্ধ কীভাবে জন্মালো!!

রক্তিম ভাইয়ের কথায় তারিন আপু যেনো খুব মজা পেয়েছেন।হাসতে হাসতে মনে হয় মাটিতে গড়াগড়ি খাবেন এই অবস্থা।আর,আমি ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছি রক্তিম ভাইয়ের দিকে।আজকের,দিনটা আমি কখনো ভুলবো না।রক্তিম ভাই আর তারিন আপুর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে আসার জন্য সামনের দিকে পা বাড়ালাম।আমার যাওয়া দেখে তনায়া আপুও আমার পিছন পিছন দৌড়ে আসছে।আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।কিন্তু,এখন আমি কাউকে পাত্তা দিবো না!যতক্ষণ না পর্যন্ত নিজেকে ঠান্ডা করতে পারছি।
—-
শরীরে সাবান,শ্যাম্পু দিয়েও গোবরের গন্ধ সরাতে পারলাম না।একটু আগেই মা এসে আমাকে একদফা বকে গেলো।এতো বড় মেয়ে হয়ে আমি কীভাবে গোবরের মধ্যে গড়াগড়ি খেলাম।কিন্তু,মা তো আর আসল কাহিনী জানে না।আর বললেও,বিশ্বাস করবে না।কারণ,রক্তিম ভাই সকলের মধ্যমণি।তাই,আমিও আর ঘ্যানঘ্যান না করে ঘরে এসে বসে আছি।এরিমধ্যে,আমার সামনে রিমি দুইটা লেহেঙ্গা ধরে বললো,

‘তুই কোনটা পড়বি রিমঝিম!লাল টা নাকি গোলাপি টা।তনু আপুর বৌভাতে যেতে হবে তো।’

লেহেঙ্গা দেখেই আমার ফুফার ফতোয়ার কথা মনে পড়ে গেলো।আমি এক নিঃশ্বাস নিয়ে রিমির তাকিয়ে বললাম,

‘যাই কিছু হয়ে যাক না কেনো!আমি আর লেহেঙ্গা পড়ছি না রিমি।তোরা পড়ে যা।’

‘কেনো রে!আমরা তো সবাই প্ল্যান করেছিলাম তনু আপুর বিয়ে আর বৌভাতে সবাই লেহেঙ্গা পড়বো।আর এখন তুই উল্টে গেলি।’

‘ভুলে গেছিস নাকি কাল কি করেছিলেন রক্তিম ভাই আমার সাথে।কাল তো আমাকে ফুফার ফতোয়া পড়িয়েছিলেন আর আজকে আমাকে বস্তা পড়িয়ে নিয়ে যাবেন।আমি আর কারোর হাসির পাত্রী হতে চাই না।’

রিমি মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে খয়েরী রঙের সিল্কের একটা জামা বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।রিমি হয়তোবা আমার যাওয়ার পানে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!!

বরাবরের মতো আজকেও আমার দেরি হয়ে গিয়েছে।দেরি হওয়ার আসল কারণ,তনায়া আপু।তনায়া আপুর চুল বেঁধে দিতে গিয়ে আমার নিজেরেই দেরি হয়ে গিয়েছে।রাস্তার সামনে গিয়ে দেখি সবাই গাড়িতে উঠে বসে আছে।একমাত্র আমি বাদে।সামনের গাড়ি থেকে বাবা মাথা বের করে বললো,

‘রিমঝিম মা তুই!রক্তিমদের গাড়িতে গিয়ে উঠে বস।আমাদের গাড়িতে সবাই বড়োরা বসেছি।তাছাড়াও গাড়িতে জায়গাও নেই।’

বাবা কথাটা বলেই তাঁদের গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো।কিছুক্ষণ পরেই,বাবাদের গাড়ি চলে গেলো তনু আপুর শ্বশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে।পড়ে রইলো রক্তিম ভাইদের গাড়ি।সেখানে এগিয়ে দেখি একটা সিটও খালি নেই।সামনের সিটে আবির ভাই বসে আছে,পাশেই ড্রাইভার।পিছনের সিটে একপাশে রিমি,তনায়া আপু।আরেকপাশে রক্তিম ভাই আর তারিন আপু।তারিন আপু রক্তিম ভাইয়ের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে আছেন।যা দেখে আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তনায়া আপুকে বললাম,

‘আমি কোথায় বসবো।এই গাড়িতেও জায়গা নেই।’

তনায়া আপু আমার দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে আছে।অসহায় মুখ করে বললো,

‘রিমঝিম বিশ্বাস কর!আমি তোর আসার একটু আগেই এসেছি।এইখানে জায়গা খালি পেয়ে বসে গিয়েছি।’

রাগে,দুঃখে আমার কান্না চলে আসবে এই অবস্থা।তার উপর মাথায় কড়া সূর্য।তাকাতেও পর্যন্ত পারছি না।তনায়া আপু আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রক্তিম ভাই কে বললো,

‘রক্তিম ভাই!রিমঝিম কীভাবে যাবে?গাড়িতে জায়গাও তো নেই।’

রক্তিম ভাই স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,

‘সেটা আমি কীভাবে বলবো।ওর যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে যাবে।আমি শান্তিতে যেতে পারলেই হলো।’

তনায়া আপু আর কিছু বলার আগেই আমি বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,

‘দরকার নেই!তোমরা চলে যাও।আমি একাই যেতে পারবো।’

একরাশ অভিমান নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলাম।বিয়ের আগে তনু আপুর শ্বশুড় বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম।বেশিদূরে না।সর্বোচ্চ ত্রিশ মিনিট লাগে।আমি কিছুদূর আগানোর পরেই পিছন থেকে রক্তিম ভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাই আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন।আমি তা দেখে দ্রুত গতিতে পা চালাতে শুরু করলাম।কিন্তু বেশিদূর আগাতে পারি নি।রক্তিম ভাই আমার হাত ধরে আটকে দিলেন।নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে কাকে যেনো ফোন করলেন।পরক্ষণেই জোর গলায় বলতে লাগলেন,

‘মজনু মামা তুমি কি বাড়িতে আছো?বাড়িতে থাকলে তোমার ভ্যানগাড়ি টা নিয়ে আসো তো।একজন যাত্রী নিয়ে যেতে হবে।’

আমি হাত মোচড়ামুচড়ি করছি রক্তিম ভাইয়ের হাতের বাঁধন থেকে ছাড়ানোর জন্য।আমার মোচড়ামুচড়ি দেখে রক্তিম ভাই আমার হাত টা আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন।দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

‘এইরকম মোচড়ামুচড়ি করলে তোর খবর আছে রিমঝিম।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’

‘আমাকে যেতে দিন রক্তিম ভাই।আমার যাওয়া নিয়ে আপনাকে এতো ভাবতে হবে।আমি একাই যথেষ্ট।’

‘তোর উপর বিশ্বাস নেই রিমঝিম।এমনও তো হতে পারে রাস্তায় কোনো ছেলেকে একা পেয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসলি।পরে,মান-সম্মান তো আমার বংশের যাবে।’

‘শুনোন রক্তিম ভাই!আপনার বংশ কিন্তু আমারও বংশ।তাই,আমি এমন কোনো কাজ করবো না যার জন্য আমার বংশের কোনো বদনাম হোক।আপনার মতো নাকি!’

রক্তিম ভাইয়ের চোখ,মুখ রোদে যেনো লাল হয়ে গিয়েছে।সেই সাথে আমার কথা শুনে যেনো রাগে আরো লাল হয়ে যাচ্ছেন।আমাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে চোয়াল শক্ত করে বললেন,

‘আমার মতো মানে কি রিমঝিম!আমার মতো সোনার টুকরো ছেলে কি তুই একটাও পাবি নাকি।আমি হলাম কোটিতে একটা।’

‘কোটিতে নাকি পয়সাতে সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি।এবার ছাড়ুন তো আমাকে।’

রক্তিম ভাই আর কিছু বলতে পারলেন না তার আগেই মজনু মামা উনার ভ্যানগাড়ি নিয়ে হাজির হলেন।মজনু মামাকে দেখে রক্তিম ভাই ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললেন,

‘কি উপকার করলে যে তুমি মজনু মামা।ওকে একটু তোমার ভ্যানগাড়িতে করে নিয়ে এসো তো।বেশি দূর যেতে হবে না!তনুর শ্বশুড় বাড়ি চিনো না সেখান পর্যন্ত নিয়ে গেলেই হবে।’

মজনু মামা পান খাওয়া দাঁত গুলি বের করে হাসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘রিমঝিম আম্মাজান!আমার ভ্যানগাড়ি তে উইঠ্যা পড়ো।আর,রক্তিম আব্বাজান তুমি কোনো চিন্তা কইরো না।আমি রিমঝিম আম্মাজান রে নিয়া আইতাছি।’

আমি সরু চোখে ভ্যানগাড়ি টার দিকে তাকালাম।ভ্যানগাড়ি টার মাঝবরাবর ছাগলের পায়খানা পড়ে আছে।যা দেখে আমি রক্তিম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,

‘রক্তিম ভাই আমি এই ভ্যানগাড়ি তে করে যাবো না।আপনি দেখেন!মাঝখানে ছাগলের পায়খানা পড়ে আছে।’

‘তোর জন্য এটাই পার্ফেক্ট।তুই নিজে কি।গু’র থেকে তো কম না।তাই,এতো বাহানা না করে উঠে পড়।তোর জন্য আমাদের অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।’

আমি রক্তিম ভাইয়ের হাত ধরে বললাম,

‘প্লিজ রক্তিম ভাই আমি এইটাতে করে যাবো না।আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিলেই হবে।’

‘ওরে আমার পিতলা ঘুঘু রে।কি ভাব উনার।বললাম না তোর জন্য এটাই ব্যাটার।যা তাড়াতাড়ি উঠে পড়।’

আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।জোর করে রক্তিম ভাইয়ের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে ভ্যানগাড়ি তে উঠে বসলাম।উনার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছি না।নিচের মাটির রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছি।একটুপরেই ভ্যানগাড়ি চলতে শুরু করলো।তারপরও আমি সামনে তাকাচ্ছি না।আগের ন্যায় মাথাটা নিচু করে রেখেছি।বুঝতে পারছি রক্তিম ভাই এখনো দাঁড়িয়ে আছেন।চোখ দিয়ে আমার টপটপ করে পানি পড়ছে।একটা মানুষ কতোটা দয়ামায়াহীন হতে পারে তা রক্তিম ভাইকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
—-
তনু আপুর শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।সামনে তাকিয়ে দেখি রক্তিম ভাইদের গাড়িটা দাঁড় করানো।দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম।আমাকে দেখেই তনায়া আপু আর রিমি এগিয়ে আসলো।তাদের দু’জনেরই মুখ গোমড়া হয়ে আছে।রিমি আমার হাত ধরে বললো,

‘ভাইয়া যে এইরকম একটা কাজ করবে তা আমি একটুও বুঝতে পারি নি।তোর জন্য আমি গাড়িতে জায়গা রেখেছিলাম।কিন্তু,কোথা থেকে যে তারিন আপু এসে বসে পড়লো আমি নাও করতে পারি নি।’

আমি রিমির কথায় কিছুই বললাম না।রোদের তাপে আমার মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছে।মনে হচ্ছে,একটা বিছানা পেলে ভালো হতো।আমি সামনে তাকিয়ে মা’কে খুঁজার চেষ্টা চালাচ্ছি।কিন্তু,মা’র কোনো খোঁজ পেলাম না।রিমিকে রেখে চলে আসতে নিলেই তনায়া আপু আমার হাত ধরে আটকে দিলো।নিজের কাছে নিয়ে বললো,

‘রোদে একদম তোর মুখটা বেহাল অবস্থা হয়ে গিয়েছে রিমঝিম।আমার সাথে চল,একগ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে তনু আপুর সাথে দেখা করে আসবো।’

আমি কিছু বলার আগেই রিমি আর তনায়া আপু আমাকে নিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে।আমি তাদেরকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না।তারা যে আমার জন্যই কষ্ট পাচ্ছিলো তা ঠিকই বুঝতে পেরেছি।কথাটা ভেবেই আমার মুখে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো।
—-
আমি,রিমি আর তনায়া আপু মিলে খাবার খাওয়ার জায়গায় চলে আসলাম।এতোক্ষণ তনু আপুর কাছেই ছিলাম।আমি আসার পর থেকে একবারও রক্তিম ভাইয়ের মুখোমুখি হয় নি।ইচ্ছে করেই উনার থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছি।কিন্তু,খাবারের জায়গায় এসে রক্তিম ভাইয়ের কাছ থেকে আর বাঁচতে পারলাম না।সেই,মুখোমুখি হয়েই গেলাম।আবির ভাই সহ আরো কয়েকটা ভাইয়া বসে আছেন।তাদের সাথে তারিন আপুও আছেন।বরাবরের মতোই তারিন আপু রক্তিম ভাইয়ের সাথে চিপকে আছেন।আমি তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।আমার ডান পাশেই রিমি আর তনায়া আপু বসেছে।

হঠাৎ করেই আমার বাম পাশের চেয়ারে একজন সুপুরুষ এসে বসে পড়লেন।আমি পাশে তাকিয়ে দেখি সুপুরুষ টি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই উনি মধুর কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘হাই রিমঝিম!আমি নিহান।তুমিই তো সেই ব্যক্তি যে কিনা লেহেঙ্গার উপরে ফতোয়া পড়ে বিয়েতে এসেছিলে।’

কথাটা শুনেই আমার কাশি উঠে গেলো।সামনে রাখা গ্লাসের পানিটুকু একচুমুকেই শেষ করে দিলাম।নিহান নামের সুপুরুষ টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন,

‘আস্তে খাও রিমঝিম।আমি তো জাস্ট তোমার সাথে মজা করছিলাম।তবে,তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছিলো।আমার কাছে তো খুবই স্পেশাল লাগছিলো।’

আমি কিছু না বলে জোরপূর্বক শুধু একটা হাসি দিলাম।দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি রক্তিম ভাই আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে পানি ছাড়াই গিলে খাবেন।শুধু তাই নয়,নিহান নামক ব্যক্তিটিকেও মনে হয় চোখ দিয়ে ভস্ম করে দিবেন।আমি সেদিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি মেরে নিহান নামক ব্যক্তিটির সাথে আড্ডায় মেতে উঠলাম।মুহূর্তেই আমাদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো।আশেপাশের কারোর দিকে না তাকিয়ে আমি আর নিহান নামক সুপুরুষ টি কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।তবে,আড়চোখে আমি রক্তিম ভাইয়ের হাবভাব খেয়াল করছি।এখনো আগের ন্যায় তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি খুব জ্বলছেন আমাকে আর নিহান নামক ব্যক্তিটিকে একসাথে দেখে।কিন্তু,পরক্ষণেই আমার মনে পড়ে গেলো রক্তিম ভাই জ্বলবেন কেনো!!উনি তো তারিন আপুকে ভালোবাসেন!!

চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here