জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ৩

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৩

একনাগাড়ে বলে খেয়া কয়েক পা এগিয়ে যেতেই নির্ঝর পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরে।কোনো প্রতিক্রিয়া করার আগেই এক টানে মাথার টাওয়াল খুলে ভেজা চুলে মুখ ডোবায়।সে শিউরে উঠে!

নির্ঝর এই প্রথম তাকে জড়িয়ে ধরেছে।এর আগে কখনো এমন আচরণ করেনি।হঠাৎ করেই দমকা হাওয়ার মতো কোথা থেকে যেন অজানা ভয় এসে তাকে গ্রাস করে।সে এক ধাক্কায় নির্ঝরকে সরিয়ে দিয়ে কান্না করে দেয়।

খেয়ার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দেই যেন নির্ঝরের হুশ ফিরে।সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে খেয়াকে ধরতে নিতেই ছিটকে পেছনে সরে যায়।

নির্ঝর অপরাধীর মতো করুণ সুরে বলে,

__’স-স্যরি!আমায় ক্ষমা করো।বুঝতে পারছি না এসব কি হচ্ছে আমার সাথে।কা-কান্না করবে না তুমি।একদম কান্না করবে না।কেমন?আ-আমি যাচ্ছি।তুমি ঘুমাও।ঘুমাও!’

বলেই একমুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়।

খেয়া দরজা ভেতর থেকে লক করে বালিশে মুখ গুঁজে কান্না শুরু করে।এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে?এর চেয়ে বাচ্চাদের সাথে ইয়াতিম খানায় কাটানো দিনগুলোও তো ভালো ছিল।তার কান্নার বেগ সময়ের সাথে বেড়ে যায়!

৪.

সকালবেলা পেটের ক্ষুধা মাথা চাড়া দিতেই খেয়া ভয়ে ভয়ে নিচে নামে।ডাইনিং এর দিকে এগোতেই দেখে নির্ঝর,পিচ্চি মেয়েটা খাবার সামনে বসে আছে।একটা মধ্য বয়স্ক মহিলা খাবার সার্ভ করছে।

সে দাঁড়িয়ে পড়ে।ডাইনিং এ যাবে নাকি উপরে চলে যাবে বুঝতে পারছে না।রাতের ঘটনার পর নির্ঝরের সামনে যেতে তার লজ্জা লজ্জা লাগছে।নির্ঝরের কোনো কিছুই তার সুবিধের মনে হচ্ছে না।বার বার মনে হচ্ছে ছেলেটার মাঝে এক সমুদ্র রহস্য আছে।

তবে সে এটা নিশ্চিত যে নির্ঝর অবিবাহিত।কিন্তু সে অানম্যারিড হলে পিচ্চি মেয়েটা তাকে বাবা কেন ডাকছে?দত্তক নিয়েছে নাকি?নাকি নির্ঝরের প্রথম স্ত্রীর সন্তান?তাছাড়া নির্ঝর বিয়ে করে না কেন?বয়স তো মে বি সাতাশ-আটাশ হয়ে গেল।

খেয়ার ভাবনার মাঝে নির্ঝর ডাক দেয়।সে অনিচ্ছার সহিত নির্ঝরের মুখ বরাবর সামনের সিটে বসে।পিচ্চি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে।

__’খেয়া,আমার এই লক্ষীটির নাম নুহা।নুহা জুবায়ের।আমার মেয়ে।আমি অফিস যাবো।তুমি সময় কাটানোর জন্য নুহার সাথে গল্প করতে পারো।নুহা কিন্তু প্রচুর গল্প জানে।’

নির্ঝর নুহার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বলে।খেয়া মাথা নেড়ে সায় জানায়।নুহা কিভাবে তার সন্তান হয়,সে প্রশ্ন সে বাদ রাখে।আপাতত নির্ঝর যে অনেক স্বাভাবিক আছে এটাই ঢের বেশি!সে প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করে।

নির্ঝরই আবার বলে,

__’নুহা কিন্তু অনেক স্ট্রং।তোমার মতো ছিঁচকাঁদুনে না।তুমি তোমার বাইশ বছরের জীবনে যেই পরিমাণ কান্না করেছ এতদিনে তো কোনো সমুদ্র তৈরি হওয়ার কথা।সমুদ্র না হলেও দিঘি অন্তত হওয়ার কথা।দীঘির কোনো নাম রেখেছ?’

খেয়া তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকায়।নুহা না বুঝেই বাবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে থাকে।নির্ঝর ভয়ার্ত গলায় বলে,

__’এই কথার জন্য যেন আবার কান্না করো না প্লিজ।তাহলে আমার আজকের দিনটাও মাটি হবে।’

__’আপনি চুপ করুন প্লিজ।’

__’চুপ করলাম।এখন ঠিকঠাক মতো খাও।আর বেশি বেশি খাবে।’

__’হুঁ!’

খাবারের মাঝে নুহা হঠাৎ বায়না ধরে সে আন্টির হাতে করে খাবে।খেয়া অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

নির্ঝর নুহার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’মা,আমি খাইয়ে দিই!কেমন?’

সে দৃঢ়কণ্ঠে বলে,

__’না!আমি আন্টির হাতে খাবো মানে আন্টির হাতে খাবো।’

নির্ঝর কিছু বলতে নিতেই খেয়া তাকে থামিয়ে দেয়।সে নিজের প্লেট নিয়ে এগিয়ে এসে নুহার পাশে বসে।তারপর পরম মমতায় হাসিমুখে নুহার মুখে খাবার তুলে দেয়।

এই প্রথমবার সে মা না হওয়ার কষ্টটুকু অনুভব করল।সে কি সত্যিই কোনোদিন মা হতে পারবে না?কেউ তার সদ্য বুলি ফোটা মুখে আধো আধো করে মা ডাকবে না?সে সত্যি কোনোদিন কারো মুখে মা ডাক শুনবে না?তার চোখ জলে কানায় কানায় ভরে উঠে।জল লুকানোর জন্য অন্যদিকে তাকায়।

সে নুহার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক প্রশ্ন করে।

__’নুহা,তুমি স্কুলে যাও? ‘

__’জ্বি আন্টি।কিন্তু বাবাই অনেক ভয় পায়।তুমিই বল,ভয় কিসের?আমি তো ড্রাইভার দাদুর সাথে যাই।’

__’এবার থেকে আমি তোমায় নিয়ে যাবো।তুমি খুশি হয়েছ?’

নুহা খুশিতে হাতে তালি দেয়।দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে বলে,

__’আমি এত খুশি হয়েছি।’

খেয়া হেসে ফেলে।হাসিমুখেই নির্ঝরের দিকে তাকায়।নির্ঝর খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

খাওয়া শেষে নুহা স্কুলের জন্য রেডি হতে উপরে গেল।একটুপর খেয়া নিজেও রেডি হওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা রাখতেই উপর থেকে নির্ঝর নামে।একদম স্যুট ট্যুট পড়ে ফর্মাল ড্রেসে।ছেলেটা এত বেশি সুন্দর কেন?মাঝে মাঝে তার বড্ড হিংসে হয়।চোখে চোখ পড়তেই খেয়া চোখ সরিয়ে নিল।

নির্ঝর কাছাকাছি এসে বলল,

__’ইয়ে মানে আমি এখন অফিস যাচ্ছি।’

খেয়া নরম গলায় বলল,

__’অহ।বেশ তো, যান।’

__’আজ ফিরতে একটু লেট হতে পারে।তবে চেষ্টা করবো লেট না করার।যাচ্ছি।’

খেয়া অবাক হয়ে তার মুখপানে তাকায়।কই,জাহিদ তো অফিস যাওয়ার আগে তাকে এভাবে কোনোদিন বলেনি?নির্ঝর তাকে বলছে কেন?সে নির্ঝরের কে হয়?কিছুই না!

নির্ঝর এখনো দাঁড়িয়ে আছে।যাচ্ছি বলে এখনো যাচ্ছে না।হয়তো তার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাচ্ছে।সাবধানে ড্রাইভ করবেন,দুপুরে টাইমলি লাঞ্চ করবেন টাইপ কিছু।সে দারুণ অস্বস্তিতে পরে যায়।এই ছেলে প্রতিটা মুহূর্ত তাকে অস্বস্তিতে কেন ফেলে?

অস্বস্তি নিয়েই খেয়া জিজ্ঞেস করল,

__’আপনার অফিস কি সেই আগেরটাই?’

__’হুঁ।তবে অফিসের পাশাপাশি নতুন একটা কাজ করি।অফিসে আমার কাজ নেই বললেই চলে।সবকিছুর হিসেব রাখা শুধু।কর্মচারীরা সব করে।সেজন্য ম্যাক্সিমাম সময় ফিজিক্স ল্যাবে কাটাই।তুমি তো জানো আমার ফিজিক্সের গবেষণার প্রতি দারুণ ঝোঁক।এখন প্রথমেই ফিজিক্স ল্যাবে যাবো।’

__’অহ,ভালো।’

__’আপাতত ল্যাবে কি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে শুনতে চাও?আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি নিয়ে।আমরা আপেক্ষিকতার নতুন ফরমুলা বের করার চেষ্টা করছি।কাল দীর্ঘায়ন আর দৈর্ঘ্য সংকোচনের মধ্যে যোগসূত্র যাকে বলে।’

খেয়ার কিছুই মাথায় ঢুকছে না।নির্ঝরের সাথে প্রথম দেখার পরেই বুঝবে পেরেছে ফিজিক্সের প্রতি তার আগ্রহতা।কথায় কথায় ফিজিক্স টেনে দীর্ঘ বক্তৃতা দিবে!

সে প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল,

__’বাসায় তো আমরা তিনজন আর সার্ভেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে দেখছি না।আপনার বাবা গ্রাম থেকে কি এখনো ঢাকা আসতে চায় না?’

নির্ঝরের মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।সে ভারী গলায় বললো,

__’বাবা,গতবছর অন্য পৃথিবীতে চলে গেছেন।আমি যাচ্ছি।’

বলেই হাঁটা শুরু করে।খেয়ার মন খারাপ হয়।সে অযাচিত প্রশ্ন করে শুধু শুধু নির্ঝরের মনটা খারাপ করে দিল।নির্ঝরও বর্তমানে তার মতো অসহায়।আপন বলতে কেউ নেই বললেই চলে।

বহির্গমন গেটের কাছে পৌঁছাতেই খেয়া গলা উঁচিয়ে বলে,

__’সাবধানে যাবেন, মি. নির্ঝর সাহেব!’

নির্ঝর থমকে দাঁড়ায়।খেয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বের হয়ে যায়।

৫.

খেয়া ছাদের পশ্চিমের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে চারিদিকে।আবছা অন্ধকারে বেশ ভালোই লাগছে তার!

আজ সতেরো দিন হলো সে নির্ঝরের বাড়িতে এসেছে।প্রথম দিকে নির্ঝরের সামনে একটু অস্বস্তি হলেও এখন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।নির্ঝরের সাথে সেই প্রথম পরিচয়ের সময় যেমন বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল তেমন হয়েছে।

নুহাও তাকে ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।প্রতি রাতে তার সাথে ঘুমায়।গল্প বলে বলে তাকে ঘুম পাড়াতে হয়।পিচ্চি টা অতি অল্প সময়ে তার হৃদয়ের অনেকখানি জুড়ে নিয়েছে।

তবে নুহার ব্যাপারটা সে আজ পর্যন্ত জানে না।নির্ঝর কিছু বলেনি।সেও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেনি কিছু।তার মনে হয় নুহার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করা মানেই ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো।তাকে আশ্রয় দিয়েছে তাতেই সে কৃতজ্ঞ।

তার ধারণা নির্ঝর তাকে নিজে থেকে বলবে।

হঠাৎ করে তার জাহিদের কথা মনে পড়ে।ডিভোর্সের সাত দিনের মাথায় নির্ঝরের কিনে দেয়া নতুন ফোন দিয়ে সে জাহিদকে কল করেছিল।জাহিদ তার সাথে তুই তুকারি করে কথা বলেছে।অলরেডি একজনকে বিয়ে করে ঘরেও এনেছে।

সেদিন রাতে সে আবারও নতুন করে কান্না করে।তার কান্নার বেগ বেড়ে যায় নির্ঝরের বকা শুনে।কেন সে জাহিদকে ফোন করেছে? ইত্যাদি।

খেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো।আজ আকাশ একদম পরিষ্কার।প্রচুর তারা জ্বল জ্বল করছে।কি ভয়ংকর সুন্দর!সে গুনগুন করে বলে উঠে,

“দুঃখ দাও,অবহেলা করো!
কেন শুকনো শিউলিতে গাঁথা মালায় অশ্রু হয়ে ঝরো?”

পেছন থেকে কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে দিতেই সে চমকে ঘুরে তাকায়!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here