ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১৪

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১৪

আজকে সন্ধ্যায় সাব্বিরও বাসায়। এমনিতে ও বাসায় থাকে না। সেটা আমি আসার জন্যেই নাকি কে জানে। দুইভাইয়ের মধ্যে আগুন আর ঘি এর সম্পর্ক। আগুনে যেমন ঘি ঢাললে ধপ করে জ্বলে উঠে তেমনি একজন আরেকজন কে দেখলে ধপ করে জ্বলে উঠে। আমার মাথায় ঢুকে না কোনো আহামরি কারণ ছাড়া এইরকম হবার কারণটা কি হতে পারে।

একটা রিস্ক নেয়াই যায়। আতপ চালের ছোট ছোট পিঠা আর চিতল পিঠা বানালাম সাথে চ্যাপা শুটকি ভর্তা ,সরিষা ভর্তা আর গরুর মাংসের ঝোল।
নাস্তা বানিয়ে সবাইকে ডাকলাম খেতে আসার জন্যে। কারণ এই বাসায় এখনো অব্দি সবাই একসাথে খেতে বসিনি একবারও। সাব্বির রিশাদ ভাইয়াকে দেখলে আর খেতে আসে না আর রিশাদ ভাইয়া সাব্বিরকে দেখলে।

যথারীতি দুজন দুজনকে দেখে টেবিলে বসে নি। সাব্বির আগে এসে বসছিলো। তারপর রিশাদ ভাইয়াকে টেবিলে বসতে দেখে চলে গিয়েছে। আবার সাব্বির কে উঠতে দেখে রিশাদ ভাইয়া যেয়ে রুমে চলে গিয়েছে । এখন দুজনেই রুমে যেয়ে বসে আছে। কি স্যাক্রিফাইস দুজনের!!!!
অগত্যা যার যার রুমে খাবার দিয়ে আসলাম। ইচ্ছে করছিলো শুধু চা দিয়ে আসি। বদমাইশ গুলো। আমি এতো কস্ট করে এক বিকেল ধরে এইগুলো বানাইছি কি রুমে বসে খাওয়ার জন্যে। খাওয়ার সময় তো কম খায় নাই কেউই। আমার ভাগের গুলোও দিয়ে আসছি। টেবিলে বসে খেলে কি হতো। যত্তসব ফাউল পোলাপাইন।

ঈদের আগের দিন আব্বু কোরবানির জন্যে গরু কিনতে যাওয়ার প্ল্যান করতেছে। কিন্তু আব্বুর শরীরটা তেমন ভালো না। বয়স্ক মানুষ। দুই ভাইকে পাঠানোর বললাম। আম্মু আব্বু দুজনেই মানা করে দিলো। কারণ যারা খাবার টেবিলেই একসাথে বসে না তারা আর যাই হোক একসাথে কিছুই করবে না।

শেষমেশ আব্বুই গেলো আর অনেক ভুজুং ভাজুং দিয়ে রিশাদ ভাইয়াকে সাথে পাঠালাম। প্রিথিবীতে আসলে বেঁচে থাকার জন্যে যে অনেক বেশি কিছুর দরকার হয় না সেটা আব্বুকে দেখে আবার উপলব্ধি করলাম। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যতখন দেখা যায় দেখলাম বয়স্ক মানুষটা বার বার পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছতেছেন আর এক হাত ছেলের কাধে রেখে হাটছিলেন।

ঈদের দিন সকালে রিশাদ ভাইয়াকে পাঞ্জাবি পরা হাস্যোজ্জলভাবে আব্বুর সাথে কথা বলতে দেখে নিজের বাবা মা ভাইবোন ছাড়া প্রথম ঈদ করার কস্ট ভুলে গেলাম।মনে হলো অনেক দিন পর শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি। রিশাদ ভাইয়া গত চারবছর যাবত কোনদিন এক একরাকাত নামাজও পরে নি। সেই ছেলে আজকে কি সুন্দর করে নামাজে যাওয়ার জন্যে রেডি!! আবার আব্বুকে তাড়া দিচ্ছে!!! নিচে বসে আব্বুর পায়জামা ভাজ করে দেয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখে পানি আটকানোটা কস্টই হয়ে গেলো। পাশে তাকাতেই দেখলাম বেচারি আম্মু আচলে মুখ চেপে কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে!! আর সাব্বির রুমের বাইরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহারে কি সুন্দর দৃশ্য!!! এই জীবনে আর কোনো আফসোস নেই আমার। সাব্বির ডিভোর্স দিয়ে দিবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে ভীষণ!! অবশেষে এই সংসারের মায়ায় পরে গেলাম।

দুই ছেলেকে দুপাশে নিয়ে একরকম পাঞ্জাবি পড়ে ঈদের নামাজে যাচ্ছে আব্বু। আর হাউ মাউ করে আম্মু আমাকে ধরে কাঁদছে!! আহারে!! আহারে!!

কিছুক্ষন বাদে আম্মু ধাতস্থ হতেই দুটো হাত ধরে খুব মিনতি ভরা গলায় বললাম
-আমার বোনের উপর আর অভিশাপ রাইখেন না আম্মা। আমার বোনটাও অনেক কস্টে আছে। দুলাভাই অনেক ভালো। কিন্তু শশুরবাড়ির লোকেরা তো বুঝতে চাই না। এতোদিন ধরে বাচ্চা হচ্ছে না সবাই আপুকেই দোষ দিচ্ছে। কিন্তু আপু ভাইয়ার কোন প্রব্লেম নাই ডাক্তার বলছে। তার পরেও হচ্ছে না। সবাই বলে আমার বোনের জন্যে রিশাদ ভাইয়ার এই অবস্থা হইছে। বিশ্বাস করেন আম্মা আমার বোন এইরকম না।
-তোর বোনের উপর আমার কোনো রাগ নাইরে। ভুল তো আমারি ছিলো। ঐ দিন ছেলের কথা চিন্তা করলে আজকে এই দিনের জন্যে এতোদিন অপেক্ষা করতে হতো না।
-জানেন আম্মা আমার আব্বু অনেক কস্ট পেয়েছিল আপনার কথায়। বার বার শুধু একটা কথায় বলতো ঝিনুক এইটা করতে পারলো? তার জন্যে যত বার আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিতেন আমার জন্যে আব্বু মানা করতো আর বলতো এর পরের বার ঝিনুক এমন কথা বললে আমি সহ্য করতে পারবো না। তার পরেও আপনাকে কিছু বলতেন না যদি আপনি কস্ট পান এই ভেবে।
– ভাইজানরে অনেক কস্ট দিছি রে মেহের, অনেক কস্ট দিসি। এইটা যদি আগে বুঝতে পারতাম তাও হইতো। তোর ছোট ফুপির কথায় কতো কথা বলছি ভাইজানরে।
-জানেন আম্মা ছোট ভাইয়ার সাথে যখন আমি ঝগড়াঝাটি করে ওর হাতে মাইর খেতাম তখন আব্বা একটা কাহিনী বার বার বলতো, তোরা জানিস আমি ঝিনুকরে কতো আদর করতাম? একবার ঝিনুকের কলেরা হলো। আর আমার তখন ইন্টার টেস্ট পরিক্ষা চলে। সব পরিক্ষা তে পাশ মার্কস তুলে আমি বাসায় চলে আসতাম। সারাদিন ওরে কোলে নিয়ে বসে থাকতাম। আর তোরা কি করিস?
এটা বলে থামতেই আম্মু আবার হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলো।
তুমি যদি পারো একবার মেহনাজ আপুর সাথে একটু কথা বইলো।আমরা ভাইবোনরা তো চাইলেও সবাই সবার কাছে যাইতে পারি। কতো কথা বলতে পারি। বেচারি লন্ডন থেকে কিছু বলতেও পারে না। ফোনে কি আর এতো কথা বলা যায়, বলো। জানো, আম্মু মারা যাওয়ার পর সব রিলেটিভরা কেমন জানি হয়ে গেছে। ছোট ফুপি ফোন করেই মেজো ভাইয়াকে আমার বিয়ের কথা বলতো। মামা তো নাই। খালারাও কেউ খোজ খবর নেয় না। আমাদের টাকা পয়সার দরকার এমন তো না। একটু মনে সাহস দেয়াটাও অনেক কিছু।

সারাদিন অনেক খাটাখাটুনির পর রাতে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। এতো ক্লান্ত লাগছে। আম্মুর কথা মনে পরছে ভীষণ। ঈদের সময় বাড়িতে থাকতেও সব কাজ আমারি করতে হতো।আমার ২ভাবি কোনো কাজই করতো না।মেজোটা সারাদিন ছেলের পিছন ঘুরঘুর করতো। আর বড়টা নিজের বাড়িতে মেহমান হয়ে যেতো। রাত হতে হতে মাইগ্রেনের ব্যথাটা অনেক বেড়ে যেতো। তখন আম্মু খুব আলতো করে মাথায় বিলি কেটে দিতো। আমি আরাম করে ঘুমিয়ে যেতাম। আজকেও অনেক মাথা ব্যথা। কিন্তু কেউ নেই। ভাবতেই কান্না চলে আসছে।
গভীর ঘুমে যাওয়ার আগেই মনে পরলো আমাকে তো ফ্লোরে ঘুমাতে হবে। উফ্, এতো আলসেমি লাগছে। কি হয় ফ্লোরে না ঘুমালে। আজব পোলা একটা। আমি কি তোকে কিছু করবো নাকি। কোনরকম চোখ একটু খুলে ফ্লোরে এসে ধপাস করে শুয়ে পরলাম। কিন্তু সেই সাথে মাথায় ব্যথাও পেলাম অনেক। ফ্লোর তো আর বিছানার মতো নরম না। যার জন্য মাইগ্রেনের ব্যথা কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো।
উঠে ব্যাগ থেকে মেডিসিন বের করে খাওয়ার আগেই দেখলাম সাব্বির এসে আমাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে বেসিনে মাথায় অনেক্ষন পানি দিলো। তারপরে চুল মুছে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরতে বললো। আজব ব্যাপার!!!আমার জন্যে এতো দরদ!!
-পরশু একটা ফ্রেন্ড আসবে বাসায়। ডিভোর্সের ব্যাপারে আমরা তার সাথেই কথা বলবো। আর আজকে আমি পাশের রুমে ঘুমাচ্ছি। তুই বিছানাতে ঘুমা।
বলেই রুম থেকে চলে গেলো।

বাহ আমাকে সেবা যত্ন করে আবার আমাকেই উপহার দিয়ে গেলো!! কোন ঈদে এতো ভালো গিফট কখনো পাইনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here