ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ২০

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -২০

“কেন ডিভোর্স হচ্ছে, আবার চিন্তা কর, আমার মাথা ঠিক আছে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি এই টাইপ কোনো প্রশ্ন আমাকে করবি না। আর মেহেরকেও এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না।” শুভ ভাইয়া কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আবার সাব্বিরের দিকে তাকাচ্ছে।
থাইগ্লাস ভেদ করে বাইরের আলোতে ময়লা পোশাক পরিহিত একজোড়া বয়স্ক দম্পতিকে দেখতে পাচ্ছি। কি হাস্যজ্জ্বোল ভাবে তারা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে মহিলাটি পুরুষ লোকটিকে খাইয়ে দিচ্ছে!!! লোকটি বার বার মাথা ঝাকিয়ে নিষেধ করছে সে হয়তো খাবে না আর মহিলাটিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মহিলাটি জোর করেই বার বার লোকটির মুখে লোকমা তুলে দিচ্ছে।
আর আমরা মাত্র অর্ধেক জীবন পার করা ভীষন অসুখী মানুষদুটো এই দামী রেস্তোরাঁয় জীবনের হিসাব চুকাতে ব্যস্ত।
ওদের দুজনের কথায় আমার খেয়াল নেই। খেয়াল করেই বা কি করবো, যা কিছু হচ্ছে কোনোটাই তো আর আমার ইচ্ছে মতো হচ্ছে না। আমি ওদের হাতের পুতুল মাত্র। ওদের হাত দিয়ে শুরু হওয়া খেলাটা না হয় ওদের হাতেই শেষ হোক। এর পর এদের কারোরই আমার জীবনে স্থান নেই।
সামনে খাবার আসতেই খুব নরমাল ভাবেই সাব্বির খাওয়া শুরু করলো। শুভ ভাইয়া ইতস্তত করছে। হয়তো কি করবে বুঝতে পারছেন না তিনি। কিছুক্ষণ বাদে তিনিও শুরু করলেন। বেচারার আর কি দোষ, কেউ তো আর কারো জন্য থেমে থাকে না।
“এক্সকিউজ মি, আমার খাবারটা একটু পারসেল করে দেওয়া যাবে ?” আমার কথা শুনে সাব্বির ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো।
“শিউর ম্যাম”। বলেই স্মিত হেসে ওয়েটার চলে গেলো।
“ডিভোর্স হলে তো আমার কাবিনের টাকা টা আমি পেয়ে যাবো তাই না?” এবার সাব্বির বিষম খেলো কথা শুনে। আমি আর একটু ওকে বিষম খাওয়ানোর জন্য বললাম, ক্যাশ দিলেই ভালো হয়। ব্যাংক থেকে চেক ভাঙানো ঝামেলার ব্যাপার।
কাশতে কাশতে সাব্বিরের চোখে পানি চলে আসছে। শুভ ভাইয়া ওর পিঠে চাপর দিয়ে সামলানোর চেষ্টায় আছে।
ইচ্ছে করেই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই করলাম না। কি হতো যদি আজকের সন্ধ্যাটা আমার আর তোমার হতো? খুব তো প্রিমার থেকে আমার রিলেশনের দুর্বল দিক গুলো জেনে ভেঙে দিয়েছো। তোমাকে দেখানোর জন্যে হলেও ফয়সালের সাথে আমি কথা বলবো আবার। এই দুমাসে তোমাকে আমি কি পরিমাণ যন্ত্রণা দিয়ে যাবো, সেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।

-ভাইয়া, যদি পারেন এই মাসের মধ্যে ডিভোর্স টা যেনো হয়ে যায় সেটার চেষ্টা একটু করে দিয়েন। আমার একটু আরলি দরকার আরকি।
সাব্বির কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুঝতে চেষ্টা করলাম না সেটা। কি হবে আর এতো বুঝে।
-ভাই তোমাদের এসব কান্ড কারখানার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। বিয়ের ৩ মাসের মাথায় যদি ডিভোর্সই লাগে তাহলে বিয়েটা করেছ কেন তোমরা?
এতোই যদি তাড়া থাকে তালাক দিয়ে দে তুই। একমাস কেনো, এই মুহুর্তে সেপারেশন হয়ে যাবে।
“ওয়াও!!!” এইটা তো আমার মাথাই আসে নি!!! একেবারে বাইন তালাক দিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ!!!!
ওকে, ভাইয়া ডান। ডিভোর্স টিভোর্স এইগুলোর ঝামেলা তাহলে বাদ। তালাক হওয়াটাই ব্যাটার। আমি তো আর দিতে পারবো না, আপনার ফ্রেন্ড কে বলেন তারাতাড়ি কাবিনের টাকা সহ তালাক দিয়ে দিতে।”
আমার এতো খুশি হয়ে তালাক চাইতে দেখে শুভ ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আর সাব্বির অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে আছে!!!

“আমার ডিভোর্সই লাগবে। তুই এই মাসের মধ্যেই ব্যবস্থা কর” রাগে দাত কিড়মিড় করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বললো ও।
আল্লাহই জানে আজকে বাসায় কি আছে কপালে!! জোড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম
-ঠিক আছে ভাইয়া, ও যেহেতু চাইছে তাহলে ডিভোর্সই হোক। বাট যেটাই হোক কাবিনের টাকাটা আমার এই মাসেই লাগবে, আপনার ফ্রেন্ডকে বলে দেন এটা।
এর পর আর দুজনের কেউই আর খেতে পারলো না। আহারে!

বাইরে এখনো সেই বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছে। খাবার প্লেট হাতে নিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে মহিলাট কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছে আর লোকটি খুব রাগ দেখাচ্ছে মহিলার প্রতি।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে ওরা দুজন সামনে হাটছে আর আমি একটু পিছনে।
“মা এটা আপনাদের জন্যে। আর একটু দোয়া কইরেন আমার জন্যে ” বৃদ্ধ মহিলার হাতে পারসেল টা দিতেই খুশিতে সবকয়টা দাত বের করে আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
-আইজকা আফনাদের বিবাহ বার্ষিকি বুঝি আম্মা? দোয়া করি আফনেরা ভালা থাকেন।
-না আম্মা আজকে আমাদের আলাদা হওয়ার দিন।
বলেই হনহন করে সামনের দিকে হেটে চলে এলাম। সাব্বির আর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি তখনো বৃদ্ধ মহিলাটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কান্না পাচ্ছে শুধু শুধু। চোখের পানি লুকানোর জন্য গাড়িতে গিয়ে পিছনের সিটে বসে পরলাম।
ওর ফ্রেন্ডকে বিদায় দিয়ে এসে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো।
“হয় সামনের সিটে এসে বসো না হয় নেমে যাও।”

একটা মানুষ এমন হতে পারে?
চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে সামনে হাটা ধরলাম।
মরে যেতাম এক্সিডেন্ট করে, খুব ভালো হতো। কালকেই চিটাগং চলে যাবো যেভাবেই হোক। অসহ্য লাগতেছে এইখানে। সাব্বিরের চেহারাটা দেখলেই বুকের ভেতর কেমন যে লাগে বলতে পারবো না কাউকে। বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বালের ভালোবাসা আমার, কুত্তার বাচ্চা একটা, দুনিয়ার যতো গালি আছে সব বিরবির করে দিতে দিতে বিকাশের দোকানে গেলাম।
ভাগ্যিস প্রিমার কাছ থেকে বিকাশে এখহাজার টাকা নিয়েছিলাম।
টাকা উঠিয়ে সিএনজি ঠিক করে বাসার সামনে এসে নামতেই দেখি সাব্বির গাড়িতে বসে আছে।
বাহ্!!!!!!
ওকে দেখে ঘেন্না হচ্ছে কেমন জানি।
বাসায় ঢুকতেই ফুপি জড়িয়ে ধরে বললো, এতো দেরি করলি কেনো? রাত ১১.৩০ বাজে খেয়াল আছে সেটা?
-তোমার ছেলেকে জিগ্যেস করো কেন দেরি হইছে। ফ্রেশ হয়ে আসি বলেই উপরে চলে এলাম।
সেই তিনশো স্কয়ার ফিট এর এইখান থেকে ধানমণ্ডি পাঁচ!!! একা একা সিএনজি তে উঠি নাই কখনো। এই সাব্বিরের জন্যে আরও যে কি কি করতে হবে আল্লাহ মালুম।
ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগানোর আগেই সাব্বির ঢুকে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে শাওয়ার ছেড়ে দিলো!!!
-মা* একটা!! তোর লাজ লজ্জা কিছুই নাই তাই না? সব ফয়সাল কে দিয়ে আসছিস!!!! খুব শখ আজকে তালাক নিয়ে কালকে থেকে ওর সাথে শুবি?? তুই এমন কেনরে!!! আমাকে কোনোদিনই বুঝলি না!!
বলেই ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো!!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই এতো গুলো জিনিস ঘটে গেলো, মনে হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে গেছে!!!

রাতে সাব্বির আর রুমে আসেনি। ফয়সালের কথা মনে পরছে খুব। গুগল ড্রাইভে রাখা স্মৃতি গুলো ওর আর আমার পাঁচ বছরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত ৫ মাসে কতো কিছু বদলে গিয়েছে আমার জীবনে!! প্রথমে আম্মু মারা গেলো, এর দুমাস পর আব্বু, এর তিনদিন পর ফয়সাল ব্রেকাপ করলো আর এর পর এই অসহ্যকর জীবন শুরু।
ফ্লোরে বসে লাগেজ থেকে বের করে ফয়সালের দেয়া কিছু গিফট বের করলাম। ঘড়ি, ব্রেসলেট, পায়েল, চুড়ি, কানের দুল, মালয়শিয়া থেকে নিয়ে আসা কতো মেকাপ, ১৩টা কিটক্যাট,৫টা ডেইরি মিল্ক,। এই সব জিনিস গুলো আব্বু মারা যাওয়ার আগে ঢাকায় আসার সময় দিয়েছিলো। আরও অনেক জিনিস হলের লকারে রাখা আছে। আমার বেশিরভাগ জিনিসই ফয়সালের কিনে দেয়া। শুক্রবার খুব সকালে আমি আর ও মিলে বাজারে যেতাম। দুপুরে নামাজ পড়ে আমার কাছ থেকে খাবার থেকে হলের নিচে আসতো। প্রতি বার আসার সময় একটা করে কিটক্যাট নিয়ে আসতো আর যাওয়ার সময় হাতে অল্প করে চাপ দিয়ে যেতো। বলতো এটা নাকি ভালোবাসা।
কেমন করে পারলে তুমি ফয়সাল??!!!!!!!
জিনিস গুলো বুকে জড়িয়ে ধরতেই দুচোখের নোনা পানির স্রোতের যেনো বাধ ভেঙে গেলো!!!
এতো মায়া ছেড়ে চলে যেতে কিভাবে পারলে ফয়সাল!!!!
কতোক্ষন কেদেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই চোখ মেলে দেখি রিশাদ ভাইয়া চোখে পানি নিয়ে সামনে বসে আছে।
“ভাইয়া জানো, এই সব জিনিস গুলো না ফয়সাল দিয়েছিলো, আমার প্রায় সব জামা কাপড় ওর সাথে গিয়ে কেনা। এইযে আমি পরে আছি সেটাও। হলের লকার পুরোটা ভরা ওর দেয়া জিনিস দিয়ে। এইযে হাতের রিং এটাও না ফয়সালের দেয়া,মালয়শিয়া থেকে কিনে নিতে এসেছিলো। এখনও হাতে আমি এটা পরি।
ও কেন আমার সাথে এমন করলো ভাইয়া!!!???
কেউই আমাকে ভালোবাসে না। ভালো না বাসুক কস্টও না দিতো আমায়!!!”
কাঁদতে কাঁদতে কথা বলে ফ্লোরে শুয়ে পরলাম। আমার কান্না দেখে ভাইয়াও কাঁদছে!!
-তোকে দেখে কোনোদিন তো বুঝতেও পারিনি তুই এতোটা কস্টে আছিস!! তুই তাহলে সাব্বিরকে বিয়ে কেনো করলি!!! ফয়সালের জন্যে অপেক্ষা করতি!!
-ফয়সাল যদি বিয়ের পরে এসেও আমার কাছে এসে সরি চাইতো, আমি হয়তো ওর হাত ধরেই চলে যেতাম। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর আমাকে বলে আমি নাকি পছন্দের মানুষের সাথেই নাকি বিয়ে করেছি!!!
আমি মরিচিকার পিছনে ছিলাম ভাইয়া।
আর একজন কেন আমাকে বিয়ে করেছে তাই সে জানে না!!!!
জানো ভাইয়া, আজকে আমাদের পাঁচ বছরের এনিভার্সারি ছিলো!!!
আরও কতো কিছু বলে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পরলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সামনে জিনিস গুলো নেই!! হয়তো লাগেজ অথবা ড্রয়ারে আছে।
কিন্তু কোথাও নেই। সবথেকে অবাক করা ব্যাপার হলো আমার পরনের রাতের ড্রেসটার বদলে এখন অন্য একটা ড্রেস যেটা আমি আগে কখনও দেখি নি!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here