#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব
পর্ব-২৯
ইমিগ্রেশন শেষ করে ফুপা ফুপিকে বসিয়ে দিয়ে বাথরুমে চলে এলাম আমি।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এতো কস্ট হওয়ার কারন আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। প্রায় আধাঘন্টা পর বের হলাম। চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি কাঁদতে কাঁদতে।
ভাগ্যিস ফুপা আর ফুপির সিট আমার সাথে পরেনি। তাহলে চোখের পানি ধরা পরে যেতো।
আমার যত কস্ট, যত কান্না আর দুঃখের দিন গুলো সব এই দেশেই রেখে যাচ্ছি। এর পর থেকে আমি আর কাঁদবো না। কখনোই কাঁদবো না।
ভ্রমণের দিনগুলো অনেক আনন্দের ছিলো। ফুপা ফুপির বাচ্চাদের মতো খুশি দেখে মন অনেকটায় শান্ত হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু কুয়ালালামপুর ওদের ফিরতি ফ্লাইটের সময় আবার পুরানো ক্ষত গুলো নতুন করে জেগে উঠলো।
পুরো সময়টাতে সাব্বির শুধুমাত্র একবার ফোন দিয়েছিলো। ভেবেছিলাম হয়তো আমাকে কিছু বলবে। কিন্তু আমি বরাবরই ওর ব্যাপারে কিছু বুঝতে পারি না।
রিশাদ ভাইয়ার সাথে কথা হতো নিয়মিত।
ফুপি অনেকবার জিগ্যেস করেছিলো সাব্বিরের সাথে কি হয়েছে আমার। কিন্তু সত্যি কথার বলার দায়িত্বটা তো ছোট ভাইয়া কে দিয়ে এসেছি। তাই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। ওদেরকে এই কস্টটা দিতে চাইনি কখনো আমি। কিন্তু আমার নিজেকেও তো বাচতে হবে।
আমার পরে যাওয়ার ব্যাপারে ফুপা ফুপিকে কনভিন্স করতে একটু কস্ট হলো।
বিদায় বেলায় এসে বুঝতে পারলাম এই মানুষ দুটো সত্যিকার অর্থেই আমাকে মেয়ের জায়গাটা দিয়েছেন।
তাই হয়তো একটু বেশিই কস্ট হচ্ছে।
উনাদের ফ্লাইট মালয়শিয়ান টাইম রাত আটটায়। আর আমার ফ্লাইট রাত সাড়ে বারোটায় ।
ফুপা ফুপি চলে যাওয়ার পর সেদিন কুয়ালালামপুর চেক ইন এ শতশত মানুষ আমার কান্নার সাক্ষী হয়ে রইলো।
সিডনির দিন গুলো হয়তো ভালোকিছুর সাক্ষী হয়ে থাকবে।
প্লেনে উঠা অব্দি ফুপিদের সাথে কথা বললাম। তারপর ছোট ভাইয়াকে একটা কল করলাম।
-ফ্লাইট কয়টায় তোর?
– বাংলাদেশি সময় রাত দশটায় । ওখানে গিয়ে পৌছুতে পৌছুতে ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজবে। রিশাদ অথবা সাব্বির কে বলিস এসে নিয়ে যেতে। আর উনারা গিয়েছে কি না আমাকে একটু জানিয়ো। আমি আর ফোন দিবো না ওদেরকে।
– কে নিতে আসবে তোকে ওখানে?
-জানি না এখনো। মেইল করেছি প্রফেসরকে।
-ও, সাবধানে থাকিস। পৌছেই সিম কিনে ফোন করবি। টাকা পয়সা কত পাঠাতে হবে?
-এখন লাগবে না, লাগলে বলবো। বাসার কাউকে বলিস না আমি কোথায় আছি। বলিস আমি ভালো আছি।
-পাকনামি করতে হবে না। আসল জিনিসটায় তো আমাকে করতে দিয়ে গিয়েছিস।
-সাব্বিরের সাথে মারামারি করিস না প্লিজ!!
-ঢং এর তো পিএইচডিও শেষ করে ফেলছিস!! মাস্টার্স করে আর কি করবি। দেশে আসবি কবে?
– যেতেই তো পারিনি এখনোও। আগে যাই তারপর দেখি।
-তোর আসার ইচ্ছে নাই তাই না রে।
প্রতিউত্তরে আমার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে হয়তো উত্তর পেয়ে গিয়েছে।
ভালো থাকিস বলে ফোনটা কেটে দিলাম।
ফোনের গ্যালারি ঘেটে সাব্বিরের হাস্যজ্বল ছবি দেখতেই বুকের ভিতর অদ্ভুত এক ভালোবাসার টের পেলাম। এই ভালোবাসার কখনো শেষ নেই। এই ভালোবাসা শত কস্টের পরেও দিন শেষে আপন মানুষের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রশান্তির পরশ রেখে দিয়ে যায়। হয়তো ইগোর কারণে সাব্বিরের মুখোমুখি কোনো দিন হবো না। কিন্তু ওর প্রতি এই তীব্র ভালোবাসা অস্বীকার করার ক্ষমতা উপরওয়ালা আমাকে দেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই পালিয়ে আসতে হলো।
এখনকার সময় রাত ১২.১৫ তে ছোট ভাইয়ার কল আসলো মেসেঞ্জারে। আমি তখন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছি সব চেকিং শেষ করে।
-কি বলবি তারাতাড়ি বল। আর পাচমিনিট পরে প্লেনে উঠবো।
– ফুপিরা আসছে সেইফলি।
-ও, কে নিয়ে আসতে গিয়েছিল?
-সাব্বির। আমাকে ফোন দিয়েছে ফুপি। বলেছে কালকে সকালে দেখা করতে।
প্রচন্ড রকম ভয় পেলাম কেনো জানি। এই দিনটি এতো তারাতাড়ি আশা করিনি, তাই হয়তো।
-কালকেই কিছু বলিস না। আর বলিস যে তোর সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি আমার।
আর ভুল করেও বলিস না আমি কোথায় আছি।
আচ্ছা বলবো না বলেই ও ফোনটা কেটে দিলো।
সিমটা খুলে ফোনটা অফ করে দিলাম।
রাত ঠিক ১২.৩০ মিনিটে মালয়শিয়ান এয়ারলাইনসের একটি প্লেন আমাকে নিয়ে সিডনির দিকে উড়াল দিলো।
সিডনির সময় সকাল ৮.৪৫ মিনিট আর বাংলাদেশি সময় ভোর ৪.৪৫ মিনিটে সেইফলি সিডনি পৌছালাম।
নেমেই সিম কিনে প্রফেসর কে ফোন করলাম।
প্রফেসর নিজে এসেছেন আমাকে রিসিভ করতে!!!!!
পরে জেনেছিলাম, আমার সুপারভাইজার ম্যাম আমাকে নিয়ে এমন ভাবে বলেছিলেন যে আমি আসছেন জেনে উনিই সরাসরি নিতে চলে এসেছেন!!!!
মোটা ফ্রেমের বৃদ্ধ প্রফেসর আমাকে সরাসরি উনার বাসায় নিয়ে গেলেন!!!!
এমনটা কখনো অন্য কারোর বেলায় হয়েছে আমি শুনিনি কখনোও। সাধারণত আগে থেকেই একোমোডেশন রেডি করে রাখতে হয় অথবা পরিচিত কেউ থাকলে ভিন্ন কথা।
প্রফেসরের বাসায় কেউ কখনো গিয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
প্রফেসরের স্ত্রীও একজন স্কুলের শিক্ষিকা।
ছেলে মেয়েরা কেউই দেশে নেই।
তাই আমি উনাদের বাসাতেই সাবলেট উঠে গেলাম।
শুরুর দিকে একটু অসুবিধে হলেও কয়েকদিনের মধ্যে ভালোই মানিয়ে নিলাম।
ছোট ভাইয়ার সাথে কথা হয় রেগুলার। ও গিয়েছিল সেদিন ফুপিদের বাসায়। কিন্তু ডিভোর্সের কথা বলতে পারেনি। শুধু এইটুকু বলেছে আমি আর ফিরবো না এইখানে। তাতেই ফুপির কান্নাকাটি দেখে আর কিছু বলার চেষ্টা করেনি।
বড় ভাইয়া আর মেজো ভাইয়া গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করেছিলো শুনতেই আমারও কেমন জানি ভীষণ কান্না পেয়েছিলো।
অনেকবার আমার কথা জানতে চেয়েছিলো ওরা। উত্তরে ও একটা কথায় বলেছিলো যে আমি ভালো আছি।
কিন্তু আমিতো ভালো নেই। সবাইকে অনেক বেশি মিস করি। আর সাব্বিরের কথা মনে হলেই পাগল পাগল লাগে নিজেকে। এমন একটা দিনও নেই যে আমি ওর কথা ভেবে করে কান্না করিনি!!!
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো সাব্বির একবারও আমার কথা জানতে চায়নি!!!
সবকিছুর মধ্যে দিয়ে আমার রিসার্চ পড়াশোনা চলতে লাগলো। প্রফেসর মাঝে মাঝে একটা কথায় বলে,
মেহের ইউ শুড বি স্টে হেয়ার। প্লিজ, ডোন্ট গো টু ইউুর কানট্রি!!! আই উইল ট্রাই টু ম্যানেজ ইউুর সিটিজেনশিপ!!
উত্তরে আমি শুধু হাসি। আর উনি হতাশ হয়ে মাথা ঝাকান।
স্কলারশিপের টাকায় ভালোই বিলাসিতা করে চলে যায় আমার। তার সাথে একটা পার্ট টাইম অফিসিয়াল জবও এখানে এসে পরিচিত একজন বাঙালি ম্যানেজ করে দিয়েছেন। দেশের বাইরের আর ভিতরের বাঙালির মধ্যে অনেক পার্থক্য এখানে এসে আবিষ্কার করলাম।
আমার রিলেশনশিপের কথা জিগ্যেস করতেই সব ওদেরকে খুলে বললাম।
বৃদ্ধ প্রফেসর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, মেহের আই থিংক, ইউ উইল মিট উইথ হিম ভেরি সুন।
আর ঠিক তখুনি ছোট ভাইয়া হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিলো, সাব্বিরের ব্যাপারে আমার সাথে ইমারজেন্সি কথা আছে। ফোনটা যেনো পিক করি!!!!