ঝরাপাতা পর্ব ৩৫+৩৬

#ঝরা_পাতা🍂🍂
#Nishi_khatun
#পর্ব_৩৩

আমার বাসার সামনে অনেক মানুষের ভীর জমেছিল। ভীরের মাঝ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি অ্যাম্বুলেন্স এর মধ্যে একটা লাশ উঠিয়ে নিয়ে গাড়িটা সোজা চলে যাচ্ছে।
আমি তো একদম আকাশের থেকে পড়ছি এমন অবস্থা! আমার বাসায় লাশ আসলো কোথায় থেকে?আর লাশটা কার?মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের দৌড়াদৌড়ি কিন্তু উওর পাবো কোথায়? হঠাৎ ভীরের মাঝে একজনের কাছে থেকে শুনতে পেলাম অর্ণা না কি সুইসাইড করে মারা গেছে।
অভাগী মেয়েটা বিয়ে হয়েছিল কিন্তু শ্বশুরের বাড়িতে যায় নি।এসব জেনে আমাদের কাজ নেই।মেয়েটা আত্মহত্যা করে ভুল করলো।এবার সারাজীবনের জন্য যে মেয়েটাকে জাহান্নামি হতে হবে।কেনো যে মেয়েটা মরতে গেলো আল্লাহ জানে।হয়তো মেয়েটার চরিএের সমস্যা ছিলো,নয়তো মাথায়। আল্লাহ ভালো জানে।

আশেপাশের মানুষের মুখে এমন সব কথা বার্তা শুনে আমার পায়ের নিচের মাটি একদম সরে যায়।তখন মনে হচ্ছিল আমি অথৈজলে পড়েছি।যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে আহাজারি। আমি চিৎকার করে বলতে যাচ্ছিলাম আমি মরে যায় নি।তোমরা সবাই দেখো অর্ণা জীবিত আছে।কিন্তু ঠিক তখন সামনে তাকিয়ে দেখি আমার জন্মদাতা পিতা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে এতোবছর পড়ে দেখে চিনতে আমার একটু কষ্ট হয়নি।যার জন্য আমি জীবনের সব সুখ হারিয়ে ফেলেছি তাকে কি করে ভুলে যায়।ঐ লোকটাকে তো কোনোদিন ও ভুলতে পারবো না।কিন্তু এতো বছর পর সে এখানে কি করতে আসছে?আমি মারা গেছি সে কথা জানতে পেরে ছুটে এসেছে না? নাহহ যে এতো বছর আমার খবর নিলো না সে হঠাৎ আমার মৃত্যুর কথা শুনে ছুটে আসবে এটা কখনো হতে পারে না।

তাই নিজের পরিচয় আর কাউকে না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব তামাশা দেখতে থাকি।একটুপর দেখি আমার জন্মদাতার পাশে সুমু মেডাম দাঁড়িয়ে আছে।আমার মামাও উপস্থিত।

এনাদের সবাইকে দেখে আমার মাথার মধ্যে ভনভন করে সব কিছু ঘুরতে শুরু করে দেয়।আমি আড়ালে থেকে সবটা দেখতে থাকি।আসলে এখানে কি নাটক চলছে।

কয়েক ঘণ্টা পর মামাকে একটু আড়ালে একা পেতেই তাকে জাপটে ধরে নেকাব খুলে বলি, “মামুজান তুমি আমাকে এভাবে মৃত বলে প্রকাশ করতে পারছো কি করে?তুমি তো জানো ঐ লাশ টা আমার না।তাহলে ঐ লাশ আমার বাসায় আসলো কি করে?”

মামা জান আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুখে বলে,”তোর বাবা কি ভাবে জানতে পেরেছে তোর বিয়ের কথা সেই চাইছে না তুই সেই বাড়িতে গিয়ে সংসার করিশ।সে এখন তোকে ডির্ভোস দিয়ে তার সাথে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছে।যে ব্যক্তি এতোবছর তোর খবর নিলো না তার হাতে তোকে কখনো তুলে দিতে পারবো না।আর সে কখনো তোকে দেখে নাই।
সেই জন্য চিনতেও পারবে না অর্ণা করে।আমি আজ নিজের হাতে অর্ণাকে দাফন করে দিলাম রে মা আমাকে তুই মাফ করে দিস।আমি চাইনা ঐ লোকটার ছায়াও তোর জীবনের উপর পরুক।”

অর্ণা বুঝতে পারে তার মামা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে দিয়েছে।কিন্তু লাশটা কার জানতে চাইলে মামা বলে,”আজ সকালে একটা পাগলি মেয়ে রাস্তার পাশে অসুস্থ হয়ে মারা যায়।ওর কোনো আত্মীয় না থাকাতে লাশটা বেওয়ারিশ হিসেবে গণ্য হচ্ছিল। তাই আমি মেয়েটার লাশটার সঠিক ভাবে দাফনের ব্যবস্থা করি। আর লাশের সাথে তোর পরিচয়টা জুড়ে দিয়েছি। এখন তুই এখানে সবার কাছে মৃত।আমি চাইনা তুই এখানে এই শহরে আর থাকিস।প্লিজ এবার মুক্ত পাখির মতো যেদিকে ইচ্ছা উড়ে চলে যা।স্বাধীন হয়ে নিজের জীবনটা নতুন ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নে।আর ভুলে যা অর্ণা নামটাকে।অর্ণা আজকের পর থেকে মৃত।যার জন্য বোনকে হারিয়ে তোকে আঁকড়ে এতোদিন ছিলাম। আজ তার জন্য এই সমাজের সামনে তোকে মৃত ঘোষণা করে দিলাম।যা তুই মুক্ত কখনো এই শহরে আর ফিরে আসবি না।”

আমি সেখান থেকে সাত পাঁচ না ভেবেই হতাশ হয়ে পাথরের মতো হয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতে শুরু করে দেয়।অবশেষে মামা কি না আমাকে মৃত ঘোষণা করে দিলো?সে কি ঠিক কাজ করলো?আমি নিজেই তো কখনো ঐ লোকটার সাথে যেতাম না।তাকে কিছু কথা শুনিয়ে দিতাম।তবে হয়তো কিছু সময় পর লোকটার কাছে হেরে যেতাম।কারণ রক্তের টান বলে একটা কথা আছে না।আমিও বাবার ভালোবাসার জন্য হলেও সব কষ্টের কথা ভুলে তাকে হয়তো কিছুদিন পর ক্ষমা করে দিতাম।
তবে এসবের থেকে বাঁচার জন্য আমার মৃত্যু নিয়ে এতোবড় নাটকের আয়োজন?তাও আমার মামুজান করছে এটা কীভাবে বিশ্বাস করে নিলাম আমি?
আমার মামা এতো কিছুর প্লানিং কখনো করতেই পারে না।যে এতো আদর-যত্নে বড় করেছে তার দ্বারা এসব অসম্ভব।
আচ্ছা এসবের পিছুনে অন্য কারণ নেই তো?
হঠাৎ করে শুধুমাত্র ঐ লোকটার জন্য মামা আমাকে মৃত ঘোষণা করতে পারে না।এর পিছনের কারণ টা আমাকে জানতেই হবে।কারণ অন্য যে কোনো ভাবেই তো আমাকে লোকটার থেকে আড়ালে রাখতে পারতো মামা।তবে আমাকে আড়ালে রাখার জন্য আমার অস্তিত্ব কেনো নষ্ট করতে হলো মামার। আমার মামা এমন কাজ করতেই পারে না যার জন্য আমি কষ্টি পাবো।

(আরেকটা পর্ব রাতে দিতে চেষ্টা করবো)

‘#ঝরা_পাতা
#Nishi_khatun
#পর্ব_৩৪

আমি জানি কে আমাকে সাহায্য করতে পারবে!
আমি রাইমার সাথে লুকিয়ে যোগাযোগ করে জানতে যা জানতে পারি তাতে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
সুমু ভেবেছিল আয়াশের সাথে আমার বিয়ে হলে সে আমাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে যাবে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি বরং আয়াশ বিয়েটা মেনে নেয়।
এটা সুমু মানতে পারছিল না।সুমু আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছিল।

কারণ সে কখনো স্কুল থেকে ভার্সিটি লাইফে আমার জন্য মনের মতো কাউকে পায়নি।এমন কি কখনো আমার থেকে ভালো রেজাল্ট করতে পারতো না।
ও বড়লোকের মেয়ে হবার পরেও সব স্যার ম্যাডামের চোখের মনি আমি ছিলাম। সুমু আর আমি সব কিছুতে পারদর্শী ছিলাম। সুমু আমার সাথে সব সময় ভালো ব্যবহার করলেও আড়ালে সুমুর মাঝে সময় আমাকে নিয়ে জেলাসির কাজ করতো।সুমু জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে ভেবেছিল এক ঢিলে দুই পাখি মাড়বে।

কিন্তু সেই রকম কোনো কিছুই হয় না।তাই সুমু উন্মাদ হয়ে যায়।আমার খুশি গুলোর গলা টিপে হত্যা করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে।অবশেষে হঠাৎ করে ঘটনাচক্রে সুমুর সাথে আমার বাবার দেখা হয়।
বাবা চাইছিল না আমি আয়াশের সাথে সংসার করি।তাই আমাকে দরকার হলে সে এই পৃথীবি থেকে সরিয়ে দিতে দিবে।

আমার বাবার মনের ইচ্ছার সাথে সুমুর ইচ্ছাও মিলিত হয়।সুমু চাইছিল আমিও দুনিয়ার বুক থেকে হারিয়ে যায়।মেয়ের জন্মদাতা পিতা যদি হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে তাহলে আমি কেনো তাকে সাহায্য করতে পারবো না?

তারা দু জনে মিলে আমাকে মারার প্লানিং করে।আফসোস আমার মামুজান সবটা কি ভাবে বুঝতে পারে।সেদিন যখন ওরা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।তার আগেই মামুজান আমার বাড়ির পেছনের দরজার তালা খুঁলে এমন ব্যবস্থা করে যাতে মনে হয় ভেতরে কেউ একজন আছে।ওরা তো বাহিরে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।মামুজান তখন তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে একটা মহিলার বেওয়ারিশ লাশ এনে আমার স্থানে রেখে দেয়।
এরপর ওদের আগে মামুজান আমার বাড়িতে পৌঁছে যায়।বাহিরের কাউকে সে লাশ দেখতে দেয় না।
আর আমার কাছে সবটা গোপন করে রাখে।
যাতে আমি কখনো যেনো এসব জানতে না পারি।
বাবা আর বান্ধবীর প্রতি যেনো কোনো খারাপ মনোভাব না থাকে।এসব জানলে হয়তো খুব কষ্ট পাবো।

তাই সে সব দোষ নিজের ঘাড়েমাথা পেতে নিয়ে চুপচাপ থাকে।সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এরা আমার সাথে এমন কিছু করতে পারে ভাবতেও পারি নাই।জানের থেকে প্রিয় বান্ধবী কি না আমাকে হত্যা করতে চাইছে?বাবার কথা না হয় বাদ দিলাম।যে ছোট বেলায় মরার একা রেখে চলে যেতে পারে। তার কাছে এমনটা মানাই।

সেদিন এসব কিছু জানার পর রাইমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি উন্মদের মতো চলতে থাকি।
হঠাৎ করে কখন যে মাঝ রাস্তায় চলে আসি বুঝতেই পারি নাই।তখন এভাবে চলতে গিয়ে একটা বাসের সামনের চলে যাচ্ছিলাম।

তখন রোহানের বাবা আমার হাত ধরে টানদিয়ে বাঁচিয়ে দেয়।
সে কোনো এক কাজে এপথে যাচ্ছিল।
হঠাৎ তাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে পানির খোঁজে সে এদিকে ওদিকে হাটছিল।আমাকে এমন ভাবে মরতে দেখে সে বাঁচাতে ছুটে চলে আসে।

সে আমাকে তার সাথে করে নিয়ে আসে।আমি এমন মূর্তি মতো কয়েক দিন ছিলাম।এরপর নিজে থেকে তাদের কাছে আমার সব কথা খুঁলে বলি।তারা সেদিন আমাকে আপন করে নেয়।

রোহানের বাবা আমাকে বলে,”সত্যি ভালো কাজ করেছে তোমার মামা।অর্ণা জীবনে অনেক কষ্ট দেখেছে।
সে আজ ঝরা পাতার মতো ঝরে গিয়ে নতুন সজীবতার সাথে প্রাণ খুলে বাঁচার স্বাদ গ্রহণ করবে তারিফা নামে।তোমার উচিৎ মাস্টার্স কমপ্লিট করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে তোমার মতো মানুষদের সাহায্যদান করা।”

আমি সেদিন নিজের পুরাতন সব কিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে শুরু করি।এসবের মাঝে আমার সাথে আবারো ভাগ্য আয়াশের দেখা করিয়ে দেয়।ওদিকে অর্ণার মরার পর আর কিছু হয়েছিল কি না সে সব আমার অজানা ছিলো।

আয়াশ আমাকে কখনো দেখে নাই তাই সে চিনতে পারে না।আমি তার সম্পর্ক খোঁজ খবর নিতে শুরু করি।এরপর সবটা জানতে পারি।অরিন রোহান কে পছন্দ করে।আর রোহান ও অরিন কে পছন্দ করে।তবে এদের দু জনকে মিলিয়ে দিতে গিয়ে আমি একটু নিজের জন্য স্বার্থপর হয়ে যায়।
নিজের স্বামী কে নিজের করে পাওয়ার জন্য রোহানের বোনের বিয়ের দিন ওদের দু জনের দূর্ঘটনার ভিডিও করি।সেই ভিডিও কে নানারকম বাজে ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আয়াশ কে বাধ্য করি আমাকে বিয়ে করতে।এতপর আয়াশ সেদিন একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করে।

এরপর নিজের নতুন পরিচয় নিয়ে তো আমি খুব ভালোই ছিলাম তবে এসবের মাঝে সুমু আবারো বিষ ঢেলে দেয়।সে আয়াশের নামে অরিনের কাছে খারাপ কথা বলে দু জনের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে।তবে আমি জানতাম না যে অরিনের কাছে আয়াশের নামে মিথ্যা কথা বলেছে।
সময়ের সাথে সাথে সব সত্যি প্রকাশ পেয়েছে। আমার সত্যি সবার সামনে এসেছে।
এবার আপনারা বলেন আমার দোষটা কোথায়?
আমার মা নিজের স্বামীর ধোঁকা সহ্য করতে না পেরে জীবনটা শেষ করে দিয়েছে এটা?
আমার জন্মদাতা পিতা কোনোদিন ও আমার খোঁজ খবর নেই নি এখানে?জোর করে বিয়ে আয়াশ করেছে!আমি শুধু তাকে নতুন করে পেতে চেয়েছি।
বাবা থাকতেও আজ আমি এতিমের লিস্টে এটা আমার দোষ?
আজ আমি আমার জীবনের প্রতিটা কাহিনী বলেছি এবার বলেন এখনো কি আমি ঝরা পাতার মতো ঝরে যাবো?আমার কী অধিকার নেই জীবনটা কে উপভোগ করার?আমি কাউকে ঠকিয়ে এখানে আসি নাই।
আমার সাথে আয়াশের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
আয়াশ আমার জীবন নষ্ট হবার জন্য দায়ী নয়।
আমার জীবনটা তো আমার কাছের আপনজনরা নষ্ট করেছে।নিজেদের ইচ্ছা মতো আমাকে নিয়ে গল্প সাজিয়েছে।আমি সেই ছোট থেকে বার বার ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছি। আজ আমি বড় ক্লান্ত।
আমি আর এভাবে ঝরা পাতার মতো ঝরতে পারছি না।বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

এখানে উপস্থিত সবাই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।তারাও তো মেয়েটার সাথে কম খারাপ ব্যবহার করে নি।তারা সবাই ইচ্ছা করলে তো সাধারণ ভাবে সবটা মেনে নিতে পারতো।

আয়াশ সবার সামনে ছুটে গিয়ে অর্ণা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।সত্যি সেও ইচ্ছা করলে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে অর্ণার সাথে সব কিছু নরমাল করে নিতে পারতো।কিন্তু আয়াশ অর্ণার উপর অভিমান করে একবুক অভিযোগ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল।

(গঠনমূলক মন্তব্য আশা করবো)
.
.
.
চলবে……

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here