ডাকপাড়ি পর্ব -১+২

#ডাকপাড়ি
#সূচনা_পর্ব
#আফনান_লারা

________

“” তুমি আকাশের বুকে
বিশালতার উপমা
তুমি আমার চোখেতে
সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি,ভেঙ্গেচুরে শতবার
রয়েছো তুমি বহুদূরে
আমাকে রেখে চলোনা….
এই হৃদয় ভেঙ্গে গেলে জানো কি তা
লাগেনা লাগেনা জোড়া
লাগেনা লাগেনা জোড়া””””

-‘আপনি খুব ভাল গান করেন’

পার্কের কোণার বেঞ্চিটাতে বসা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকের কানে কথাটা আসতেই সে মাথা তুলে সামনে তাকালো।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।গায়ের রঙ চাপা, শ্যাম-বর্ণের।পরনে একটা সুতির কালো শাড়ী,কানে ছোটর চেয়েও ছোট এক জোড়া দুল ঝুলছে।কপালের মধ্যিখানে একটি কালো টিপ।হাতে এক ডজন চুড়ি ভাগ করে পরা।এক হাতে ৬টা,অন্য হাতে ৬টা।বোধ হয়!মনে হয় পাঁচটা।একটা হয়ত ভেঙ্গে গেছে।

তার কথার উত্তর হিসেবে ছেলেটি বললো,’ধন্যবাদ’

ব্যস কথা টা বলে সে আবার হাতে থাকা স্কেচ বুকটা খুলে আঁকিবুকি শুরু করে দিলো।মেয়েটি যেন আরও কিছু বলতে চাইলো।কিন্তু সামনের মানুষটার এত গম্ভীর ভাবের কারণে তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা।অচেনা মানুষকে তার বড্ড ভয় লাগে।শুরুতে!
এরপর সে আপন করে নিতে জানে।কিন্তু শুরুটা যে কঠিন!
জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে মেয়েটি আবার বললো,’শুনেছি এখানে আশেপাশে নাকি ডাকবাক্স আছে?বলতে পারেন কোন দিকে?আমি এখানে নতুন বলে চিনছি না কিছুই’

ছেলেটি মাথা তুললোনা।আঁকতে আঁকতে বাম হাতটা লম্বা করে ধরে বললো,’সোজা গিয়ে ডান পাশে ঝালমুড়ি ওয়ালা আছে, তার ঠিক পেছনে।’

মেয়েটি আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিকে চলে গেলো।ছেলেটা মনযোগ দিয়ে ছবি এঁকে যাচ্ছে।একটি মেয়ের ছবি।সবে চুল আঁকছে।এখনও মুখের গড়ন আঁকা হয়নি।

‘শুনছেন?’

ছেলেটি বিরক্ত হয়ে তাকালো মেয়েটির দিকে।ছবি আঁকার সময় সামান্য চড়ুই পাখির ডাক ও তার কাছে বিরক্ত লাগে আর এখানে এই অচেনা মেয়েটা জ্বালিয়েই চলেছে।
ছেলেটার কুঁচকানো ব্রু দেখে মেয়েটি আবারও ভয় পেলো।তাও সাহস করে বললো,’আমি সোজা গিয়ে ডান পাশে কোথাও ডাকবাক্স দেখিনি। তবে ঝালমুড়িওয়ালা দেখেছি’

ছেলেটা হাতের খাতাটা,পেন্সিল আর রঙতুলি গুছিয়ে ব্যাগে পুরে, চশমা গুছিয়ে পকেটে পুরে সোজা হাঁটা ধরলো।মেয়েটি ভাবলো তাকে খুঁজে দিতে সে চলেছে,তাই সেও পিছু পিছু চললো।হঠাৎ ছেলেটা থেমে বললো,’আমার বোনের বাসায় যাচ্ছি,আপনিও যাবেন?’

‘নাহ!আসলে আমি ভেবেছি আমাকে ডাকবাক্স খুঁজে দেবেন’

‘আমি কানা লোককে সাহায্য করি,তবে যাদের চোখ থেকেও দেখেনা তাদের সাহায্য করিনা’

‘আপনি এত উদ্ভট প্রকৃতির কেন?একটা অসহায় মেয়ে বিপদে পড়েই তো আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছে।এত প্রতি পদে পদে বিরক্ত হচ্ছেন কেন?’

ছেলেটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,’ পার্কে আমি বাদে ৩৩জনের মতন যুবক আছে।তাদের প্রশ্ন করুন,হাত ধরে নিয়ে দেখিয়ে দেবে ডাকবাক্স ‘

ছেলেটি আর দাঁড়ালোনা।চলে গেলো।মেয়েটা বোকার মতন চেয়ে আছে।সাদা পাঞ্জাবি পরা আর নীল রঙের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ছেলেটা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে।যতদূর অবধি গেলো মেয়েটা তাকিয়ে ছিল। তখনই ডানে তাকিয়ে দেখলো ঝালমুড়ি ওয়ালা তার তোয়ালে সরিয়ে নাড়ছে,নিজেকে বাতাস করছে।তোয়ালের নিচে ডাকবাক্স টি দাঁড়িয়ে আছে রোবটের মতন।মেয়েটি মুচকি হেসে ছুটে গেলো সেখানে।সেই ছেলেটা থেমে একবার পেছনে চেয়ে দেখে নিলো মেয়েটা ডাকবাক্সের কাছে পৌঁছে গেছে।
———-
‘বুয়া এই গাছটাতে পানি পরিমাণ মত দিবেন,এটাতে পানি এদিক সেদিক হলেই মরে যায়।আমার এর আগে ২টা টবের গাছ মরে গেছিলো তাও আমারই অসাবধানতার ফলে’

‘আপা চিন্তা করিয়েননা।আমি ঠিকমত দিই’

‘চিনছেন তো কোনটার কথা বলছি?’

‘জ্বী আপা।চানিজ গাছ’

মেয়েটি হাসলো।হাসি থামিয়ে বললো,’চানিজ নয়
চাইনিজ ল্যাটার্ণ গাছ।এই গাছের ফুলের পাপড়ি ঝরে গেলে খুব সুন্দর দেখায়।আমার সবচাইতে পছন্দের ফুল’

‘হ জানি তো।ভাইয়ে আইনা দিছে বলেই তো এত পছন্দের’

‘নাহ উনি আনেননি।এটা আমায় আমার বড় চাচা গিফট করেছিল।তিনি এনেছেন বিদেশ থেকে।জানো বুয়া? তার অনেক বড় নার্সারী আছে।আমরা আগে প্রায় ঘুরতে যেতাম’

‘আচ্ছা আপা আপনার কি নিজের বাপের বাড়ি যাইতে মন চায়না?’

মেয়েটির হাস্য উজ্জ্বল মুখটা কেমন মলীন হয়ে গেলো।ছাদের বাতাসে তার শুস্ক চুলগুলো খুব জোরে উড়তে লাগলো।বুয়া তার মন খারাপ দেখে চুলে হাতে দিয়ে বললো,’আপা বাদ দেন।তেল দিয়ে দেই?’

‘নাহ,তেল দিলে আমার মাথা ঘুরায়।তুমি বরং গাছে পানি দাও,আমি শুনি।গাছে পানি দেয়ার শব্দ!’

বুয়া পানি দেয়া শেষ করে চলে গেছে।মেয়েটি একা ছাদে বসে চোখ বুজে বাতাসের আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছিল।মন চাইলো একবার উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরতে।বাতাস চলাকালীন সময়ে ঘুরতে সে কি ভাল লাগা কাজ করে!

দোলনা থেকে নেমে মেয়েটা হাত উঁচু করে ঘুরছে আর হাসছে।এই ছাদের রেলিং নেই।
ছিল!স্টিলের।জংয়ে ধরেছে বলে খুলে ফেলা হয়েছে।কদিনের মধ্যেই নতুন নিয়ে আসা হবে।

মেয়েটি সেটা জানেনা।ঘুরতে ঘুরতে সে ছাদের খুব কিণারায় চলে এসেছিল।মনের আনন্দে সে খুব দ্রুত ঘুরছিল বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে।আর একটুর জন্য সে পড়ে যেতো হঠাৎ একটা হাত তার হাতটাকে খুব শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে আসলো ছাদের মাঝখানে।

‘কে!’

‘আমি আনাফ,আপনি তো আর একটুর জন্য পড়ে যেতেন।জেনেবুঝে বাচ্চামো করবেননা!’

‘ওহ!কেন পড়তাম?রেলিং আছে তো’

আনাফ রেলিং শূন্য ছাদটা একবার দেখে বললো,’রেলিং নেই।নতুন আনতে দেয়া হয়েছে।আপনি একবার চেয়ে দেখুন।নিজেই বুঝতে পারবেন’

মেয়েটি মুচকি হেসে বললো,’আমি যেদিকে তাকাই সেদিকেই কালো রঙ দেখি,আমার পৃথিবীটা কালো রঙের।রেলিং দেখবো কি করে?’

‘মানে?আপনি কি কিছু দেখেননা?’

‘দেখি,সব দেখি।মন দিয়ে দেখি।চোখে দেখিনা সেটা বলতে পারেন’

ছেলেটা দম ফেলে আবারও মাথা তুলে তাকালো মেয়েটির দিকে, তারপর বললো,’দোলনায় বসবেন?’

‘নাহ,এতক্ষণ বসেছিলাম।আমি আজ আসি।আর কখনও আমায় এমন ঘুরতে দেখলে বাঁচাতে আসবেন না,আপনার কাছে আমার অনুরোধ।মাঝে মাঝে যা ঘটে তা ঘটতে দেয়া উচিত’

মেয়েটি চিলেকোঠার দেয়াল ধরে ধীরে ধীরে চলে গেলো।আনাফ এক দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখলো।সিড়ি গুনে গুনে নামছে আর মুখ দিয়ে ফাইভ, সিক্স, সেভেন বলছে মেয়েটা।
কি সুন্দর তার চুল! কি সুন্দর তার চোখ।এত সুন্দর চোখে কিনা সে পৃথিবীর রঙ কালো দেখে!আল্লাহর দুনিয়া কত রহস্যময়,কত বিষাদময়। এত সুন্দর একটা মেয়ের এই বন্ধকতা কেন হতে গেলো!এর পরিবারের কেউ কি নেই?একা কেন যাচ্ছে!
——–
‘বুয়া কয়টা বাজে দেখো তো।তোমাকে না বললাম ফারাজ আসলে ওকে দিয়ে আমাদের পুরোনো ঘড়িটা ঠিক করিয়ে আনাতে?ওটাতে শব্দ হলে বুঝতে পারতাম কটা বাজে।এখন বুঝিনা কখন কয়টা বাজলো।কলিংবেল বাজছে শুনলে?মনে হয় ফারাজ এসেছে।জলদি গিয়ে দরজা খুলো”‘

বুয়া হাতের কাজ ফেলে ছুটে গিয়ে দরজা খুললো।ফারাজ মুখে আঙ্গুল দিয়ে বুয়াকে চুপ থাকতে বললো।
তারপর পা টিপে টিপে ভেতরে গেলো।মেয়েটি বসে বসে জিজ্ঞেস করছে কে এসেছে।

ফারাজ কাছে এসে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,’আমি’

‘তুই!এরকম ভয় দেখায় কেউ?আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম’

‘কেন?ভাবলি দুলাভাই এসেছে?’

মেয়েটির মুখ আবারও মলীন হয়ে গেলো।ক্ষীণ গলায় বললো,’কি খাবি বল?’

‘আপাতত আমি আঁকবো।আজকাল পার্কে বসেও শান্তি পাইনা।বাইরের জগৎতের কিছু এলিয়েন টাইপের মানুষ আমাদের জগৎয়ে এসে ভাল মানুষকে জ্বালাতন করে।ওসবে অতীষ্ট হয়ে তোর কাছে আসতে বাধ্য হলাম।তবে দুপুরে আমি সাদা ভাত আর আলুর ভর্তা, ডাল খাবো,সাথে একটা কচি কাঁচা মরিচ দিতে পারিস তোদের ছাদ বাগানের।’

বুয়া কাছে এসে বললো,’এগুলা ক্যান খাইবেন?আমি আজকে কত স্বাদ কইরা কোর্মা, পোলাও রাঁধতেছি।ওগুলা খাইবেন’

‘ওগুলা খেতে গেলে নিজেকে বড়লোক মনে হয়।আমি বড়লোক হতে চাইনা।আমি যেমন আছি তেমনই ঢের ভাল আছি।বড়লোক হলে আমার সারাদিন চিন্তা করতে হবে,ভাবতে হবে,তাই নারে সারথি?’

সারথি হাসলো।হাত বাড়িয়ে ফারাজের হাত ধরে বললো,’আঁকতে বুঝি ভাবতে হয়না?’

‘যে ছবিগুলো মনে গেঁথে আছে সেগুলোর জন্য আবার ভাবতে হয়?শুধু একবার চোখ বুজে মনে গাঁথা ছবিটা দেখে চোখ মেলে বাইরে আঁকি’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_২
#আফনান_লারা
________

সারথি রুমের রকিং চেয়ারটাতে বসে আছে, কিছু একটা ভাবছে, অনেকটা গভীর ধ্যানের মত। হ্যাঁ, সে ভাবছে নিজের স্বামীর কথা।
নাম সজীব। মালয়েশিয়াতে থাকে। গত রোজার ঈদেই দেশে এসেছিল। কাটালো দিন কয়েক, আবার মালেশিয়ায় পাড়ি। পরের ঈদে আবার কি হবে দেখা? আবারও কি দুজনে একসাথে কাটাবে কয়েকদিন তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এভাবেই চলছে সারথির জীবন। অথচ সারথির এই হৃদয় সজীবকে প্রতিটি ক্ষণ আঁটকে রাখতে চায়। ভালোবেসে নিজের করে রাখতে চায়। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না।

খুশির এই ঈদ সবার জন্য সুখের হয় না, পূর্ণতা বয়ে আনে না, কারো কারো কাছে ঈদ মানে দীর্ঘশ্বাস। সারথির দীর্ঘশ্বাস এটাই জানান দেয়।

সজীব সময় পায় না দেশে আসার, বিষয়টা এমন নয়। সময়টা আসলে বের করতে চায় না। সারথি সজীবের কাছে একটা অপছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। অপছন্দের জিনিসটাকে দেখার জন্য এত কিসের আয়োজন হবে তার? হবে না, কখনও হবে না। ”
——
”আপা! আপনার ভাইয়ে তো আলুর ভর্তা ছাড়া ভাত খাবেই না কইতাছে। এহন কি করমু? আমি যে কত কষ্ট কইরা সকাল থেইকা এত পদের তারকারি বানাইলাম কিছুই তো মুখে দিতেছেনা”

”ওসব তো ওর জন্য করা হয়নি পলি। আমার শাশুড়ি আসবেন বলেই তো করলে। ফারাজ যে আসবে আমি জানতাম না। তুমি বরং আমাকে সব এগিয়ে দাও। আমি বসে করছি। তোমার না দেরি হচ্ছে? তোমার ছেলে তো স্কুল থেকে ফিরবে, তাত্তারি যাও। আমি আমার ভাইয়ের জন্য ভর্তা বানাতে পারবো। চোখে দেখিনা বলে কি আমি পঙ্গু? আমার হাতে অনেক জোর। সব এগিয়ে দাও দেখি”

পলি মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে সব এক জায়গায় এনে দিয়ে চলে গেছে। সারথি দেয়াল ধরে ধরে রান্নাঘরের দিকে আসছে। রান্নাঘর চিনতে তার একটুও সমস্যা হয় না। মাছের আঁশটে গন্ধে চিনে যায় ওটা রান্নাঘর।

পিড়িতে বসে হাত বাড়িয়ে আলু সব পাতিলে তুলল, ভেসিনে আলুগুলোকে ধুয়ে চুলা খুঁজে পাতিল বসালো সারথি।

পেছনে ফিরতেই কিছু কাটার আওয়াজ পেয়ে সারথি বললো, ”আমি ভর্তা করবো, তোকে বলিনি। সর এখান থেকে”

ফারাজ পেঁয়াজ কাটতে কাটতে মাথা তুলে বললো, ”মাঝে মাঝে এমন ভাব করিস যেন আমি মস্ত বড়লোকের ছেলে। যদি তাই হতাম তবে সজীব ভাইয়া মাসে একবার হলেও কল দিয়ে শালার খোঁজ নিতো”

”ওর কাছে বড়লোক, ছোটলোকের মানে মতলব নেই। সবটাই সময়ের গতিতে করে। হি ইজ আ রেসপন্সিবল ম্যান। ”

ফারাজ হেসে গোটা পেঁয়াজ ভেসিনে ধুতে ধুতে বললো, ”রেসপন্সিবল? মানে দায়িত্ববান? এতটাই দায়িত্ববান হলে দিনে পাঁচবার ফোন করতো তোকে। পাঁচ বারের কথা বাদই দিলাম। আমি কেনোদিন তোদের কথাই বলতেই দেখিনি। এমন টা কেন?”

”আমার সাথে কথা বলে কোটি টাকার ক্লায়েন্ট কেন হাতছাড়া করতে যাবে? ”

ফারাজ তাচ্ছিল্য করে হেসে পেঁয়াজ কুচি করাতে মন দিলো। সারথি হাত ভাঁজ করে হেলান দিয়ে বললো, ”তা পার্কে কিরকমের এলিয়েন টাইপের মানুষের দেখা পেলি? মেয়ে নাকি ছেলে? ”

”মেয়ে”

”বাহ!দেখতে কেমন? ”

”আমি ওতো কিছু খেয়াল করিনি”

”একটা মানুষ ছেলে নাকি মেয়ে ওটা বুঝতে হলে একবার হলেও দেখতে হয়। আর আমি জানি তুই দেখেছিস। আমাকে বলবিনা কারণ আমি তোকে নিয়ে পরে ঠাট্টা করবো”

”একদম ঠিক ধরেছো”
——–
বাড়ির নাম “হাবিজাবি”

ডাকপিয়ন চিঠি হাতে বাড়িটির সামনে এসে নাম দেখে ভূত দেখার মতন দাড়িয়ে আছে, এক নজরে তাকিয়ে আছে বাড়িটির নামলিপির দিকে। উন্নত মনমানসিকতার অভাব থাকলে একটি বাড়ির নাম এমন উদ্ভট নামে রাখতে পারে মানুষ। সুস্থ মানুষ এত বড় বাড়ির নাম “হাবিজাবি” রাখবে না। একটা পাগলের চিঠি হাতে নিয়ে এতদূর এসেছে ভাবতেই তার কেমন যেন লাগছে। যাইহোক একজন ডাকপিয়নের চাকরি এটাই। প্রাপক পাগল, ছাগল, ভাল, খারাপ, চোর, ঢাকাত যেই হোক না প্রাপকের ঠিকানাই পৌঁছাতেই হবে। ডাকপিয়ন বেশ অসস্তিতে আছে এই বাড়িটির সামনে এসেই। যতদ্রুত পারে চিঠি হাতে ধরিয়ে দিয়েই প্রস্থান করাই লক্ষ্য। আর দেরি করা ঠিক হবে না মনে করে ডাকপিয়ন কলিংবেলে রাগের বশত কয়েকবার চাপ দিয়ে আঙ্গুলটা সরানোর আগেই দরজা খুলে গেলো। কলিংবেল বাজানোর ২সেকেন্ড ও অতিক্রম হলো না আর দরজা খুলে গেলো!
দরজার একটু ভেতরে, একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে হাফ প্যান্ট, উদম দেহ, কাঁধে গামছা ঝোলানো। লোকটা ডাকপিয়নকে ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর বললেন, ”আপনে কেডা? ”

”আমি ডাকপিয়ন সবুজ রহিম। এই চিঠিটা জনাব বেলায়েতের নামে এসেছে। উনি কি আছেন? একটু ওনাকে ডেকে দিন”

”আপনে সত্যি ডাকপিয়ন ? ”

সবুজ রহিম নিজের শার্ট আর টুপি ঠিক করে বললেন, ”জ্বী আমাকে দেখে যদিও অফিসার মনে হয় কিন্তু সত্যি কথা হলো আমি একজন ডাকপিয়ন । দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে এই চাকরিটা করছি। ”

”তয় এতক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বড় বড় চোখ দিয়ে কি দেখছিলেন? ”

সবুজ রহিম হালকা কেশে ইতস্তত হয়ে বললেন, ”আসলে আপনাদের বাড়ির নামটা কেমন যেন সেটাই ভাবছিলাম। মনে মনে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেছিলাম”

”দেহি চিঠিটা দেন”

”নাহ। যার চিঠি তার হাতেই দেবো”

”উনি এখন ধ্যানে বসছেন, দেখেন না দুপুর দুইটা বাজে? এসময়ে উনি ধ্যান করেন”

”তাহলে আমি বসি। ওনার ধ্যান শেষ হলে দিয়ে যাবো”

”আজ আর শেষ হবে না। আজ বৃহস্পতিবার না? এই দিনের ধ্যান স্যার পরেরদিন ভাঙ্গেন”

”নামাজ পড়েন না? ”

”পড়েই তো। খাঁটি মুসলিম নামাজ পড়বেনা কেন!এইসব কি আবোলতাবোল বকতাছেন!আপনি সত্যি ডাকপিয়ন তো?

”আরে! ধ্যানে থাকলে নামাজ পড়ে কি ভাবে? ”

”বসে বসে! হাঁটুর ব্যাথা না!নিচু হতে পারেনা তো। । ধ্যান বাদ দিয়ে অজু করে এসে নামাজ পড়ে আবার ধ্যান করে”

”ওহহ। উদ্ভুত!আচ্ছা এক গ্লাস পানি দেয়া যাবে? ”

”দাঁড়ান আনছি”

লোকটা হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেলো। ফিরলো দুই মিনিট পর।
ওর থেকে গ্লাস নিয়ে এক ঢোক পানি খেয়েই সব ফেলো দিলো ডাকপিয়ন ।
থুথু করতে করতে বললেন, ”এত নোনতা কেন!পানি এত নোনতা হয়? লবণ মিশিয়েছেন নাকি!”

”আমরা তো টাংকির পানি খাই। তয় মাঝেমধ্যে আমাগো বাড়ির ছোট পোলাপানগুলা টাংকিতে প্রস্রাব করে আসে।খুব বেয়াদব! এখনও করেছে মনে হয়। যাই টাংকি পরিষ্কার করে আসি, আপনে আর কিছু বলবেন? ”

ডাকপিয়ন গ্লাস রেখে আবারও ভূত দেখার মতন ভয় পেয়ে এমন ছুট লাগালো আর মনে মনে ভেবে নিলো বেঁচে থাকতে আর এই বাড়িতে পা রাখবেনা”
———-
আআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআ

”দাদাভাই আ এর পরে আর কিছুই কি নেই? ”

জনাব বেলায়েত হাসান চোখ খুলে তাকালেন। শোবার ঘরের জানালার ধারে বসে ধ্যান করছিলেন তিনি। নাতি সিয়ামের ডাকে চোখ খুলেছেন। ওর কথার উত্তর দেয়া প্রয়োজন মনে করলেননা। পুনরায় আবারও ধ্যান করা শুরু করেছেন তাই।

সিয়ামের পাশে এসে দাঁড়ালো পিয়ালি। দাদাভাইয়ের আআআআ শুনে সে বললো, ”দাদা ভাইয়া বলতে চাইছে “আমার খিধা পেয়েছে,চলো মাকে বলে আসি”

সিয়ামের হাত ধরে পিয়ালি চলে গেলো। বেলায়েত হাসান চোখ খুলে ওদের চলে যেতে দেখে উঠে এসে দরজা ভাল করে লাগিয়ে চলে এসে আবারও ধ্যানে বসেছেন।
——-
”মা শুনছো, দাদাভাইয়ের খুধা লেগেছে”

”এটা কি মুখে বলেছে? ”

পিয়ালি মাথা নাড়ালো। সিয়াম ভ্রু কুঁচকে বললো, ”না মা। শুধু আআআআআ করেছে”

”তাহলে খিধে লাগেনি। যা তো বাবা ছাদে এই শুটকি গুলো দিয়ে আয়। আর পিয়ালিকে নিয়ে ওখানে বসে থাক,
নাহলে বিড়াল এসে খেয়ে নেবে”

”উফ মা!তুমি সবসময় আমাদের দেখলেই ছাদে পাঠিয়ে দাও। আর ভাল্লাগেনা!”

মতিন এসে বললো, ”আপা আমারে দেন, আমি দিয়া আসি”

মিসেস সায়না শুটকির ডালাটা মতিনের হাতে দিয়ে তরকারিতে ঝোল দিচ্ছেন এবার।
মতিন শুটকির ডালা নিয়ে ছাদে এসে দেখলো অনন্ত টাংকিতে ১নাম্বার করে নামতেছে।

”এই হারামজাদা!তোরে কইবার কইছি এখানে এই কাজ করবিনা। একদিন ঠাস করে একটা চড় মেরে তোর দাঁত সব টাংকিতে ফালাইয়া দিবো”

অনন্ত ছলছল চোখে চেয়ে থেকে বললো,’আমি সবাইকে বলে দিব তুমি বানুকে বাগানের সব ফুল ছিঁড়ে এনে দাও প্রতিদিন’

‘আহারে আমার বাবুটা,রাগ করো কেন বাবু?যাও যত খুশি করো যাও,পানি তো তোমার গুষ্টিই খায়। আর বকবোনা সোনা।’

অনন্ত মুখ বাঁকিয়ে চলে গেছে।শুটকি রোদে ফেলে মতিন আবার গেলো টাংকি পরিষ্কার করতে।
———
“””তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা
আমি তোমাকে গড়ি ভেঙ্গেচুরে শতবার
রয়েছো তুমি বহুদূরে!!!!!””””

‘আপনার কি এই গানটা অনেক প্রিয়?’

ফারাজ চোখ খুলে দেখলো কালকের মেয়েটা আজ আবারও এসেছে।আগের মতন হাতে চিঠি,পরনে শাড়ী।তবে এটা হলুদ রঙের।আজ খোঁপার জায়গায় চুল খোলা।

আবারও বিরক্তি চাহনিতে ফারাজ বললো,’আমার সাথে আপনার কি কোনো দরকার আছে?প্রতিদিন আমার সামনে এসে দাঁড়ান কেন?’

‘প্রতিদিন কবে হলো?আজ সহ দুইদিন’

‘ওমন দাঁত কেলিয়ে হাসছেন কেন?চলে যান এখান থেকে।আমার কাজে কেউ ডিস্টার্ব করুক সেটা আমার পছন্দ না’

‘কি কাজ?একটু দেখি?’

মেয়েটা ধপ করে ফারাজের পাশে বসে গেলো।ফারাজ লাফ দিয়ে উঠে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সোজা হাঁটা ধরেছে

‘আরে শুনুননা,কাজের জন্যই এসেছি।আমার একটা হেল্প করতে পারবেন?’

ফারাজ থেমে পেছনে ফিরে বললো,’আজ পার্কে চুয়াল্লিশ জন যুবক আছে।তাদের বলুন,তারা আপনার আঁচল ধরে সব হেল্প করে দিবে’

‘প্লিজ প্লিজ একটা হেল্প’

ফারাজ বিরক্ত হয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
মেয়েটা এবার ওর সামনে এসে পথ আটকে বললো,’আমি না ভুলে ডাকবাক্সে ভুল চিঠি ফেলে দিয়েছি।আমার ধারণা ঐ চিঠিগুলো এখনও পোস্ট হয়নি।আমাকে আমার সেই চিঠিটা বের করে দিতে পারবেন?আপনার হাত তো মাশাল্লাহ অনেক লম্বা!নিয়ে দিলে তবে এটা রেখে ওটা ফেলে দিবো’

‘ক্ষমা করুন,আমার দ্বারা এসব চোরাই কাজ হবেনা’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here