ডাকপাড়ি পর্ব -১৫+১৬

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১৫
#আফনান_লারা
________
সারথির কথাগুলো লেভেন শুনলে আনন্দে লাফাতো কিন্তু সজীবের যেন বুকটা খালি হয়ে গেলো।
লেভেন সজীবকে পিঠ জড়িয়ে ধরে ফেলেছে ততক্ষণে।
সারথির কথা সব কাঁটার মতন সজীবের বুকে বিধছে।তার দম বন্ধ লাগছে। যে মেয়েটাকে কখনও ছুঁয়ে দেখেনি,সেই মেয়েটার জন্য তার কেন এত পুড়ছে?তার পাশে তার ভালবাসার মানুষ তবে কেন এই মেয়েটার জন্যই তার মন খারাপ হয়ে গেলো এত আনন্দের মাঝে।
লেভেনকে ঝটকা দিয়ে গায়ের থেকে সরিয়ে সজীব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
তার চোখে পানি।দম ফেলে সে শুধু বললো,’আমি আসছি সারথি,আমি আসছি’
লাইন কেটে দিলো সে।লেভেন দূর থেকে সজীবকে দেখছে।সজীব চোখ মুছে ফ্লোরে বসে গেলো।লেভেন কাছে আসতে নিতেই সে হাত উঠিয়ে ওকে থামিয়ে বললো,’প্লিজ চলে যাও।আমি একা থাকতে চাই ‘

লেভেন আর কিছু বললোনা।নিজের ব্যাগটা বিছানা থেকে তুলে চলে গেলো।
ওপারে সারথি কাঁদছে।তার মনে হয় আজ সে সব বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে।তার আর কেউ নেই।নিজের বলেই কেউ নেই।
সজীবকে সে নিজের সবটা দিয়ে ভালবেসেছিল তবে কেন তার কপালে এমনটা হলো?তার কপাল এত খারাপ কেন?
কেন সে অন্ধ হলো আর কেনোই বা সে নিজের স্বামী প্রদত্ত ভালবাসাটুকু পেলোনা।
সারথিকে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখেছে সজীবের মা।ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি কাছে এসে বসলেন।ওর হাতটা ধরে বললেন,’মা রে আমি জানি তুমি সজীবকে অনেক ভালবাসো।আমার সজীব তোমায় ভালবাসে কিনা জানিনা।তবে ওর উপর আমার আস্থা আছে।দায়িত্ব সে ভুলবেনা।তুমি সজীবের দায়িত্ব। বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তার সব কিছুর উপর তোমার অধিকার আছে।সজীবের বাবার সাথে আমি কথা বলেছি।তোমায় মালয়েশিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফেলতেছেন তিবি।খুব শীঘ্রই তুমি যেতে পারবে।ওখানে সজীবের কাছাকাছি থাকলে তোমাদের মনমালিন্য সব দূর হয়ে যাবে সারথি।আর ভেবোনা’

সারথি চোখ মুছে হাসি ফুটালো মুখে, তারপর বললো,’দেশের মানুষ দেশেই থাকি।আর উনি উর্মি আপুর বিয়েতে আসবেন বলেছেন।আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিবে।অনেক সুন্দর একটা সারপ্রাইজ ‘

সজীব আসবে শুনে তিনি অনেক খুশি হলেন। এরপর চলে গেলেন বাকিদের সে কথা বলার জন্য।সারথি চুপচাপ আগের জায়গায় বসে থাকলো।
সজীব এ প্রথমবার চোখের পানি ফেললো কোনো নারীর জন্য।লেভেনের জন্য ও সে কখনও কাঁদেনি,তবে সারথির জন্য কেন তার কষ্ট হয়?
‘আমি তো ওরে ভালবাসিনা।আমি লেভেনকে ভালবাসি।তাহলে কেন ওর প্রতি আমার টান!’
———
ফারাজ মুরগী দুইটা কিনে মতিনের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।পূর্নতা ওর পিছু পিছু সব জায়গায় যাচ্ছে।বিরক্ত হতে হতে শেষে ফারাজ বললো,’পাবলিক টয়লেটে যাচ্ছি,যাবেন?আসেন কোলে তুলে নিয়ে যাই আপনারে’

পূর্ণতা দাঁত কেলিয়ে বললো,’আরেহ না না।আমার তো টয়লেট পায়নি।আপনি যান।আমি অপেক্ষা করছি’

‘আমার আধ ঘন্টা লাগবে’

‘রাত করে পেট খারাপ হতেই পারে।আমি হাঁটছি।আপনার সাথেই ফিরবো।সমস্যা নাই’

ফারাজের বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা এমন চুইংগামের মতন কেনো?!আজব তো!
ভ্রু কুচকে চলে গেছে সে।পূর্ণতা হাত ভাঁজ করে গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা বখাটে ছেলে অনেকক্ষণ ধরে পূর্ণতাকে লক্ষ করছিল।খয়েরী রঙের সুতোর শাড়ী আর খোঁপায় ওকে দারুণ লাগছিল,ছেলেটা পথ দিয়ে যাওয়া ধরতেই ওকে দেখে আটকে যায়।
এখন ওকে একা পেয়ে কাছে ঘেঁষছে।পূর্ণতার কাছে এসে সে বলে,’কি গো মামণি?এই রাতে এখানে কি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রোদ খুঁজছো?’

‘না আব্বা,রোদ তো নাই।’

‘আমি তোমার বাপ হইলাম কবে?’

‘যেদিন থেকে আমি আপনার মামণি’

‘আরে ধুর! ওটা মজা করে বলেছি’

‘আমি কিন্তু মজা করিনি। আপনাকে একদম আমার বাবার মতন দেখতে ‘

ছেলেটা বিরক্ত হয়ে খপ করে পূর্ণতার হাত ধরে ফেলেছে হঠাৎ।

‘বেশি বকরবকর আমার পছন্দ না,চলো তোমায় একটু রাতের দুনিয়া দেখিয়ে আনি’

‘আমি দেখেছি অনেক।রাতে হাঁটার মজাই আলাদা।আহা হাতে চাপ দিচ্ছেন কেন?হাতে চাপ খেলে আমার মেজাজ গরম হয়’

‘তোর মেজাজে আমি ডরাই?এত ন্যাকা কথা কস কেন তুই?চল!’

ছেলেটা হাঁটার জন্য পা বাড়াতেই ঠাস করে গালে চড় খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।পূর্ণতা মেরেছে চড়টা।গালে চড় খেয়ে ছেলের মেজাজ গেলো বিগড়ে,কিছু বলতে যাবে তার আগে আরেকটা চড় খেলো।পূর্ণতা কোমড়ে হাত রেখে বললো,’আমি তোমার মামণি না বাবুসোনা।আমি তোমার বয়সে বড় হই।পেশায় একজন টিচার।আমাকে আপা ডাকবা।আপার হাত ধরে টানাটানি করলে চড় থাপ্পড় খাইতে হয়।আর টানবা?’

‘এবার তোরে উঠাই নিয়ে যামু আমি’

ছেলেটা এই বলে পূর্ণতাকে ধরতে যেতেই আরেকটা চড় খেলো এবার এটা মেরেছে ফারাজ।চড় খেয়ে মাথা তুলে ফারাজকে দেখে ছেলেটা ভয় পেয়ে গেলো।ফারাজে সে চিনে।ভেবেছিল ফারাজ আসার আগেই মেয়েটাকে নিয়ে পালাবে।কিন্ত তা আর হলো কই।ফারাজকে দেখে সে আর থাকলোনা।দৌড়ে পালালো।ফারাজ পূর্ণতার পা থেকে মাথা অবধি দেখে বললো ‘বোরকা পরতে পারেননা?শাড়ী পরে বের হয়েছেন কেন?’

‘এরকম বখাটেদের আরও অনেক হেনস্তা করছি আমি।অভ্যাস আছে।আপনি না আসলে শেষ মারটা আমি দিতাম’

‘কি আর দিতেন জানা আছে।চলুন এখন।আর কোনোদিন আমায় ফলো করতে করতে অন্তত রাতে বেরুবেননা।রাত মেয়েদের জন্য অভিশাপ’

ফারাজ হাঁটা ধরেছে।পূর্ণতা ওর পিছু পিছু চলছে।কি মনে করে আবার বললো,’আচ্ছা বলুন না আপনার প্রেমিকার নাম কি?’

‘কিছু গান থাকে আমাদের খুব পছন্দের।সেই গানগুলো আমাদের পছন্দ কারণ গানের লাইনে প্রিয় মানুষটার নাম থাকে।’

‘হুমমম!!আপনি যে গান প্রতিবার গান তাতে তো অনেক নাম আছে।উপমা,প্রতিমা।তার নাম কি আসলে?’

‘প্রতিমা’

পূর্ণতা থেমে গেলো।ফারাজ ও থেমেছে।
পূর্ণতা তখন মুখে হাত দিয়ে বললো,’মেয়েটা হিন্দু?’

‘হ্যাঁ,চমকানোর কি আছে?মুসলিম ছেলেরা মুসলিম মেয়েদের মাঝে যে মোহ দেখে প্রেমে পড়ে আমি সেই মোহ প্রতিমা নামের হিন্দু মেয়েটার মাঝে পেয়েছি’

‘সে কি জানে আপনি মুসলমান?’

‘জানবেনা কেন?’

‘কতদিন ধরে?’

‘দেড় বছর’

‘এখন কই সে?চিঠি কেন পাঠান?সে বাংলাদেশের না?’

‘সে কলকাতাতে থাকে।আসবে একদিন।আমার জন্য সে ফিরবে,আমার বিশ্বাস আছে’

পূর্ণতা মুখে হাত দিয়ে হাঁটছে।আশ্চর্য হয়ে সে আবার বললো,’দাদাজান জানলে তো মেনে নিবেননা’

‘দাদা তোমার নাকি আমার?আমি মানিয়ে নেবো’

‘যদি না মানে?’

‘মানবেই।আমি মানাতে পারি।’

পূর্ণতা কপালে হাত দিয়ে হাঁটছে।ফারাজ হঠাৎ থেমে গেলো সারথিকে দেখে পূর্ণতা আসতে আসতে ফারাজের পিঠের সাথে এক ধাক্কা খেলো।সারথি বাগানের ঘাসে বসে কাঁদছে।ওকে কাঁদতে দেখে ফারাজের পা থেমে গেছিলো মাঝপথেই।ছুটে গেলো সে সারথির কাছে।
———-
আনাফের দিন কাটেনা।সারথি গেছে একদিন ও হয়নি।তার কেমন যেন লাগছে।মন চাইছে কথা বলতে একবার।গাল ফুলিয়ে বারান্দায় বসে বসে এসবই ভাবছিল সে।মা আরেকটা মেয়ের সন্ধান এনেছেন।মেয়ে পেশায় ডাক্তার।মা এসেই বললেন,’শুনেছি ডাক্তাররা ডাক্তার পছন্দ করে।নে তোর জন্য মা একটা ডাক্তার নিয়ে এসেছি।দেখ কেমম লাগে’

‘মা আমি সেইরকম ডাক্তার না যে ডাক্তার পাত্রি খুঁজবো।আমার একজন সাধাসিধে মানুষ লাগবে যে দিনশেষে আমার ক্লান্তি দূর করে দিবে।এবার সে যেই হোক’

‘তো এই ডাক্তার মেয়েটাকে দেখ কেমন লাগে।তোরে মাথা ব্যাথার ঔষুধ খাইয়ে তোর সব ক্লান্তি দূর করে দিবে’

আনাফ কপালে হাত দিয়ে বললো,’মা আমি যেমন দিনশেষে ক্লান্ত থাকি,মেয়েটাও ক্লান্ত থাকবে।কে কার সেবা করবে বলো তো?’

‘বুয়া রাখবি’

‘বুয়া আমার বেডে উঠে আমার হাত পা টিপবে?এগুলো স্ত্রীরা করে’

‘তোর বউ তুই খুঁজ যা’

‘আমি তোমায় বলিনি খুঁজতে।যার সাথে বিয়ে হবার সে নিজে হেঁটে আসবে আমার কাছে।আমার যেতে হবেনা’
———-
ফারাজ ঘাসের উপর বসে সারথিকে ধরে ঠিক করে বসালো তারপর ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,’কে কি বলেছে?কাঁদিস কেন?’

‘কেউ কিছু বলেনি।এমনি চোখের পানি পড়তে পারেনা?’

‘না পারেনা। আমায় বল কি হয়েছে’

‘কিছু হয়নি।যা এখান থেকে।আমি একটু একা থাকতে চাই’

‘সজীব ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবি সারথি?’

‘জানিনা,আমি কিছু জানিনা।আমি শুধু শান্তিতে মরতে চাই’

ফারাজ সারথিে জড়িয়ে ধরলো সাথে সাথে। সারথি আর দমিয়ে রাখতে পারেনি আর্তনাদ। চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছে।পূর্ণতা দূর থেকে সব দেখছে।তার খারাপ লাগছে ভীষণ।সারথির জীবনে কি এমন হয়েছে যে সে এমন করে কাঁদছে।ফারাজকের কাছে জানতে চাইলে তো বলবেনা’
————
সজীবের মা ভেসিনে পানি নিয়ে কুলকুচি করছেন।সিয়াম সেটা দেখে বারবার মানা করছে ওনাকে।উনি কুলি করে বললেন,’আরে টাংকির পানি নোনতা নোনতা।লবণ পানি দিয়ে কুলকুচি করলে আমার গলা ব্যাথা কমে।’

এই কথা শুনে সিয়াম বমি করা ধরছিল।
কোনোমতে দৌড়ে পালালো।মতিন গামছা দিতে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।সজীবের মা বের হতেই গামছা দিয়ে দিলো সে।সজীবের মা হেসে বললেন,’টাংকির পানিতে লবণ দিয়ে খুব ভাল করছো।আমার কি যে উপকার হলো’

মতিন থুথু করতে করতে চলে গেলো ওখান থেকে।সজীবের মা বুঝতেছেন না সবাই এমন কেন করছে।

মুখ মুছে তিনি বের হয়ে চললেন সোনালীর কাছে।বেয়ইনের সাথে একটু আলাপ করা যাবে।
———
সজীব সাজিয়ে রাখা ওয়াইনের বোতল নিয়ে আবারও সমুদ্রের দিকে গেছে।বালিতে বসে ওয়াইনের ছিপিটা খুলে দূরে ফেললো।তারপর তাতে ঠোঁট লাগিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা খেয়ে বোতলটা সরিয়ে রেখে সমুদ্রের ঢেউ দেখছে এবার।বিয়ের পর প্রায় ৬মাস সজীব দেশে ছিল।সারথিকে সে কখনও ছুঁতে চায়নি,সারথিও নিজ থেকে কাছে আসার চেষ্টা করেনি।ঘরের কাজ ওকে করতে হতোনা,বুয়া সব করতো। সারথি তাও সজীব যখন তৈরি হতো তখন নিজে ওকে তৈরি করে দিতে হেল্প করতে চাইতো। যেটা সজীব দিতো, ওর আসলে ভালই লাগতো।সবসময় সে স্বপ্ন দেখতো তার জীবনসঙ্গী তাকে তৈরি হবার সময় হেল্প করবে।কি মধুর সেই মূহুর্ত।সারথি যে এমন করবে সে কল্পনাও করেনি।সারথির মনে ওর প্রতি ভালবাসার অভাব ছিল না।এটা সজীব নিজেও জানে।কিন্তু সে যে লেভেনকে মন দিয়েছিল।সারথিকে নিয়ে এতদিন ভাবেনি।কিন্তু তাও আজকাল তার কোনো কিছু ভাল লাগেনা।সারথিকে সে অনেক ঠকিয়েছে।আর পারছেনা ঠকাতে।
মা যদি জানে লেভেনের কথা নির্ঘাত ত্যায্য করে দেবে।
‘আর কি করেই বা ডিভোর্স দেবো!সারথির কি হবে!ওর জীবনটা টভাবে নষ্ট করবো?
নাকি সব ছেড়ে সারথির সাথে সম্পর্ক ঠিক করে নেয়া উচিত?লেভেনের কি হবে!
না না আমি পারছিনা ভাবতে।দু নৌকায় পা দিয়ে চলা যায়না।আমি সেটা করে যাচ্ছি,আমাকে ডুবতেই হবে।
——–
পূর্ণতা সারথিকে বাগানে দেখতে দেখতে বাসার ভেতর ঢুকছিল,ফারাজ টুলের উপরে দাঁড়িয়ে বাসার মেইন দরজার উপরে লাগানো বাতিটা ঠিক করছে।হঠাৎ জ্বলছে, আবার হঠাৎ নিভছে।তাই ঠিক করতে ওর টুলে উঠা।
পূর্ণতা সারথির দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল।বাসায় ভেতরে পা রাখতেই আচমকা টুলের সাথে লেগে ধপাস করে ফারাজকে নিয়ে পড়লো মেঝেতে।
এত জোরে আওয়াজ পেয়ে সবাই ছুটে আসলো।অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছেনা।
অর্ক টর্চ জ্বালিয়ে বললো,’পূর্ণতা ম্যাম ফারাজ চাচ্চুকে নিয়ে পড়ে গেছে’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১৬
#আফনান_লারা
________
পূর্ণতা অর্কর কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে উঠার চেষ্টা করছে,ফারাজ ও একই চেষ্টায় আছে কিন্তু কিসের কারণে যেন দুজনেই জোর পাচ্ছেনা উঠে দাঁড়ানোর।এদিকে সবাই টর্চ লাইটের আলো ওদের মুখের উপর ধরে রেখেছে।আলোর জন্য কিছু দেখছেইনা দুজনে।পরে সবাই মিলে ওদের উঠালো।ফারাজ এক ধমক দিয়ে বললো,’এই মেয়েটার সাথে যবে থেকে পরিচয় হয়েছে তবে দেখে ঝামেলা সৃষ্টি করেই চলেছে।দাদাজানের কি দরকার ছিল আপদ ঘরে তোলার?ভাল ভদ্র মেয়ে হলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না,কিন্তু এমন স্বভাবের একটা মেয়েকে কেন রাখছেন তিনি?
এমন কোনো বাজে স্বভাব নাই যেটা ওর মাঝে নাই।সব দিয়ে ভরপুর।একটা মেয়ে কি এমন হয়?মেয়েরা হয় শান্তশিষ্ট, ভদ্র,নম্র,সুশীল।আর এই মেয়েটার মাঝে আমি সেসবের কিছুই দেখিনা।সবসময় আমাকে জ্বালাতন করবে!’

ফারাজের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে শুনেছে এক কোণায় দাঁড়িয়ে।সবাই ফারাজের কথা শুনছিল চুপচাপ।দাদাজান ও শুনেছেন।ফারাজ চুপ হতেই তিনি ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন।গম্ভীর গলায় বললেন,’পূর্ণতার কাছে মাফ চাও”

‘কি জন্য?আমি তো ভুল কিছু বলিনি’

‘যা বলেছো তার সবটাই ভুল।পূর্ণতাকে দেখার নজর ভুল তোমার।পূর্ণতা আসলে যেমন, তেমন হিসেবে দেখো।আমি ওর মাঝে সব ভাল গুণ দেখি।এখন তুমি ওর কাছে মাফ চাইবে নাহলে আমার শেষ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হও’

ফারাজ খুব ভাল করে জানে দাদাজান এমন একটা কথা বলবেন যেটাতে ওর ঘর ছাড়তে হতে পারে।এ সময়ে মেসে থাকার চেয়ে বাড়িতে থাকা ভাল।তাছাড়া সারথি ও এখানে।ওর শ্বশুর বাসায় গিয়েও থাকা যাবেনা।সুতরাং দাদা যা বলছেন তাই করা উচিত।
এই ভেবে সে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে সরি বলে চলে গেলো ওখান থেকে।পূর্ণতা দাঁত কেলিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেছে।
ফারাজের রাগ সীমানা অতিক্রম করে ফেলেছে আজ। মন চাইছিল পূর্ণতাকে ধরে নাকানিচুবানি খাইয়ে তারপর ছাড়তে।পূর্ণতা সেসময় নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল, ফারাজ তখনই ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালো।

ওকে দেখে পূর্ণতার বোঝা বাকি নাই যে এখন ওর উপর রাগ ঝাড়বে ফারাজ।তাই পূর্ণতা আগেভাগে কানে হাত দিয়ে বললো,’আমি মাফ চাইতেছি।আমার কারণে আপনার বকুনি খেতে হলো’

‘মাফ চেয়ে কি সব ঠিক করা যায় মিস পূর্ণতা?’

‘না যায়না।তাও চাইছি,আপনি মাফ করে দিন আমায়।প্লিজ’

ফারাজ পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে গাল ফুলিয়ে। পূর্ণতা আশেপাশে কাউকেই দেখছেনা যে বাঁচার জন্য ইশারা করবে।ফারাজ এখন কি করবে কে জানে।অশ্লীল কিছু করবেনা সে ব্যাপারে পূর্ণতার বিশ্বাস আছে।কারণ ফারাজ তো একজনকে ভালবাসে।কাউকে ভালবাসলে যত ছোঁয়ার ইচ্ছা থাকে সব তাকে ঘিরেই।আরেকজনকে ছোঁয়া যায়না,ইচ্ছাও আসেনা।এটা নিয়ে পূর্ণতা নিশ্চিত হলো।
ফারাজ অনেকক্ষণ পূর্ণতাকে দেখে- টেখে চলে গেলো ওখান থেকে।পূর্ণতা বুকে থুথু দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা ভাল করে লাগিয়ে ফেলেছে।
———–
সজীব অফিস এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কারোর কথা আর মাথাতে আনেনি।না লেভেন আর না সারথি।কাজে মন দেয়ার পেছনে অবশ্য কারণ আছে।লেভেনের বাবার দেয়া শর্ত পূরণ করতে আর কটা মাস বাকি।যাকে নিয়ে এতদূর পাড়ি জমানো হলো তাকেই নাহয় বেছে নেয়া হোক।
সারথিকে আপন করে নিলে যে লেভেনকেও ধোকা দেয়া হবে।
‘ও তো আমায় ভালবাসে।ওর কি দোষ?’

এতসব ভেবে সজীব সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে লেভেনের বাবার শর্ত পূরণের পেছনে লাগাতার থাকবে।

‘লেভেন সকাল থেকে একটিবারও কল করেনি।কি হয়েছে মেয়েটার কে জানে।হয়ত রাগ করেছে।রাগ করবারই কথা।ওকে তো আমি কাল রাতে!!!’

কপাল টিপে স্টাফকে একটা কফির কথা বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সজীব।অফিসের শেষ প্রান্তে গার্ডেনের মতন করে সাজিয়ে রাখা।এটা অবশ্য লেভেনের আইডিয়া।মন খারাপ থাকলেই সজীব এখানে এসে বসে।এখনও ওখানে এসে বসেছে।লেভেনকে কল দিতেই সে রিসিভ করেছে।যেন সজীবের কলের অপেক্ষাতেই ছিল সে।

‘কি করছো লেভেন?’

‘বাবার অফিসে বসে আছি।তুমি কেমন আছো?’

‘আমি আছি,ভালই।মিট করবে?’

‘হঠাৎ?’

‘কেন তোমার ইচ্ছে নেই?’

লেভেন ঝট করে রাজি হয়ে গেলো,বলে দিলো সে আসতেছে।সজীব ফোন রেখে কফির মগ হাতে নিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।
সারথি যেমন তার দায়িত্ব অন্যদিকে লেভেন ওর ভালবাসা।লেভেন নিজের সবটা দিয়ে ওকে ভালবাসে।এখন সারথি সজীবের ওয়াইফ বলে তাকে প্রায়োরিটি দিয়ে লেভেনকে দূরে ঠেলে দেয়া তো আরেকরকম ঠকানো।তার চেয়ে বরং ডিভোর্স দিয়ে লেভেনকে সে বিয়ে করে নেবে
এটাই শেষ সিদ্ধান্ত।এর কোনো নড়চড় হবেনা।উর্মির বিয়েতে দেশে ফিরে সব খোলসা করে নেয়া হবে।
———
লেভেন আসতে বেশি সময় নেয়নি।খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে।ওর আর সজীবের অফিসের দুরুত্ব তেমন একটা নয়।
সজীবের অফিস Gua Bama তে আর লেভেনের অফিস Shaq western এর কাছাকাছি।আসতে বেশি সময় লাগেনি।
সজীব কফিটা সবে শেষ করেছে ওমনি লেভেন এসে হাজির।

সজীব সেসময় একটা ফাইল মনযোগ দিয়ে পড়ছিল।লেভেন একটা ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছে সাথে।তোড়াটাকে সজীবের সামনে টেবিলে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’জনাব আপনার জন্য ফুল আনলাম।গ্রহণ করুন’

সজীব মাথা তুলে ফুল না দেখে আগে লেভেনকে দেখলো।এরপর মুচকি হেসে বললো,’আমার সামনে যে ল্যাভেন্ডার ফুল দাঁড়িয়ে আছে।প্রতিনিয়ত সেই লেভেনকে আমি দেখি তবে আর কোনো ফুল কেন দেখবো?’

লেভেন চেয়ারে বসে গালে হাত রেখে বলে,’আজ তোমার কি হয়েছে বলো তো?হঠাৎ কথাবার্তা বদলে ফেলেছো।সারথিকে লাগবেনা?’

‘কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়।আমি সারথিকে হারিয়ে তোমায় পেতে চলেছি।ধরে নাও সেটাই।’
———–
আনাফের আজ একটা ক্যাম্পে যেতে হবে।টিকার ক্যাম্প।যেহেতু সে একটা প্রাইভেট হসপিটালের ডাক্তার তাই ঐ হসপিটালের কর্তৃক ক্যাম্প করা হয়েছে বলে তাকে উপস্থিত থাকতে হবে।সকাল থেকে সেখানেই বসে ছিল ও।
ফ্রি চেকআপ চলে।দুপুর গড়িয়ে এসেছে এবার।সে তখন উঠে গেলো লাঞ্চ করার জন্য।
যেতে যেতে মনে হলো সারথিকে দেখেছে।পরে ভাবলো ভুল।কিন্তু নাহ,আসলেই সে সারথিকেই দেখেছে।ক্যাম্পের পাশেই বড় রাস্তা ছিল,বড় বড় যানবাহন চলাফেরা করে সেখানে।সারথি ঐ রাস্তায় মূর্তির মতন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।যখন শুনলো পথচারী পারাপারের সনয় শেষ তখন সে হেঁটে রাস্তা পার হওয়া শুরু করে।মানে তার ইচ্ছা সে নিজ থেকেই আজ এক্সিডেন্ট ঘটাবে।আনাফ শুরুতে এত সব বোঝেনি।সে ভাবলো সারথি যেহেতু চোখে দেখেনা হয়ত ভুলে এই কাজ করেছে।সব ফেলে তাই সে ওদিকপ ছুটলো সারথিকে বাঁচাতে।কিন্তু তার আসতে ব্যাঘাত ঘটালো একটা বাচ্চা ছেলে।হুট করে সামনে এসে পড়লো।ছেলেটা আনাফের গায়ের সাথে লেগে নিচে পড়ে যায়।আনাফ ওকে নিচ থেকে তুলে আবার ছুটলো।কিন্তু ততক্ষণে সারথিকে বাঁচাতে একটা প্রাইভেট কার জোরে ব্রেক কষলেও সারথির সাথে ধাক্কা লেগে যায়।
সারথি ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
তার জ্ঞান ফেরে হাসপাতালের বিছানায়।চোখ খুলে সে শুধু বললো ‘আমি কোথায়’।নার্স তাকে বলে সে হাসপাতালে আছে। সারথি মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে বললো,’কেন?কে এনেছে?’

‘আপনার তো এক্সিডেন্ট হয়েছিল।পরে আমাদের স্যার বাঁচিয়ে এনেছেন আপনাকে।’

‘কোন স্যার?’

‘আমি’

সারথির নাকের কাছে সেই আতরের গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে আনাফের গলা শুনে।এরপর আর কিছু বলেনি।মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে থাকলো।আনাফ ওর পাশে বসে ওর হাত টেনে সেটাতে মলম লাগাতে লাগাতে বললো,’এত সুইসাইড করার ইচ্ছা কেন?সংসারে অশান্তি হলে ডিভোর্স দিয়ে দিন।তাহলেই তো হয়’

‘সেটাই করবো’

‘তবে আবার সুইসাইড কেন?জামাই ছাড়া জীবন চলেনা বুঝি?’

‘না চলেনা।কিছু স্ত্রী স্বামী যত খারাপই হোক না কেন, তাকে অন্ধের মতন ভালবাসে।আর আমি তো মানুষটাই অন্ধ।এটাই যত দোষ’

‘তবে দূর থেকেই ভালবাসবেন স্বামীকে, মরতে চাওয়ার কি আছে?’

‘আমার এই দুুনিয়া অসহ্য হয়ে গেছে।আমার ভাল লাগেনা এভাবে বেঁচে থাকতে।আমি মরে গেলেই বাঁচি।আপনাকে বলেছিলাম আমায় আর কোনোদিন বাঁচাবেন না।তাহলে আবার কেন?’

‘দেরি করে ফেললাম।চেয়েছিলাম বিনা চোটে বাঁচাবো,কিন্তু আজ আমার একটা ভুলের কারণে আপনার হালকা পাতলা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো,একা বেরিয়েছিলেন নাকি?’

‘সাথে মতিন ছিল।সে কোথায় জানিনা’

‘বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিন।সকলে চিন্তিত হবার কথা’

‘ফোন রেখে এসেছি বাসায়’

‘সব পরিকল্পনা করেই এসেছেন তাহলে।আচ্ছা নাম্বার মুখস্থ পারেন?’

‘আমার শুধু মিঃ সজীবের নাম্বার মুখস্থ ‘

‘হায়রে!!এরকম অন্ধ ভক্ত বউ ঘরে ঘরে জন্মাক।আচ্ছা বাসার ঠিকানা দিন,আমি পৌঁছে দিবো’

সারথি হুট করে বলে ফেললো,’আপনি আমায় পছন্দ করেন?’

আনাফের কাশি এসে গেলো কথাটা শুনে।কাশতে কাশতে নার্সের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে আগে পানি খেলো,তারপর গলা ঠিক করে বললো,’না তা নয়”
——-
পূর্ণতা বাবার চিঠিটা নিয়ে এসেছে ডাকবাক্সে ফেলবে বলে।ওমা!!এখানে এসে দেখলো ফারাজও চিঠি দিতে এসেছে।ওকে দেখে পূর্ণতা কিছু বলতে যাবার আগেই ও চিঠি রেখে দ্রুত হেঁটে চলে গেলো।
পূর্ণতা নিজের চিঠিটা পোস্ট করে ওর পিছএ আর যায়নি।যেহেতু ওর কথা কাজে ফারাজ বিরক্ত হয় সেহেতু ও ঠিক করেছে আর ওকে বিরক্ত করবেনা।সে চললো তার সেই স্কুলে যেখানে ও বাচ্চাদের পড়ায়।এমনিতেও তিনটে দিন সে নষ্ট করেছে।হেড স্যারের কাছে বকা খেতে হবে।
———
ফারাজ পার্কে বসে আবারও ছবি আঁকা ধরেছে।তার প্রতিমার ছবি।
আজকে সকাল থেকে বাতাস বইছে চারিদিকে।এখন বিকাল হয়ে গেলো তাও বাতাসের কমতি নাই।মনে হয় বড়সড় একটা ঝড় আসতে চলেছে।ভালই হবে, গরমে যে হাল চারিদিকে।বৃষ্টি দরকার আছে।
সে ভেবেছিল পূর্ণতা আবারও ওর পিছু পিছু আসবে,কিন্তু আসেনি বলে তার ভালই লাগলো ব্যাপারটা।যাক বোঝা গেলো বুদ্ধিশুদ্ধি আছে মেয়েটার।ওতটাও ছেঁসড়া না।মুখে হাসি ফুটিয়ে সে চোখ আঁকা শেষ করে দেখলো সে প্রতিমার চোখ না একে পূর্নতার চোখ একে বসে আছে।নিজের দ্বারা এত বড় ভুল হয়েছে দেখে ওর রাগ হলো।
এর আগে এমনটা কখনও হয়নি।তবে এখন কেন হলো!এটা মোটেও ঠিক হয়নি।
কাগজটা মুঠোয় নিয়ে দূরে ফেলে নতুন করে আঁকতে বসেছে ফারাজ।
ওখান দিয়ে যেতে থাকা একজন ভদ্র লোকের পায়ের কাছে গিয়ে পড়েছে কাগজটা।তিনি কাগজ তুলে মেলে ধরে দেখলেন অপূর্ব সুন্দর এক জোড়া চোখ।মুখে হাসি তুলে বললেন,’ভায়া,তুমি যদি এই জোড়া চোখের ছবি গোটা আঁকতে তবে একটা পুরুস্কার পেতে।চোখ এত সুন্দর না জানি গোটা মুখ কেমন সুন্দর।ফেললে কেন?’

‘সব সুন্দর আমার হবে কেন?’

‘এটা কেমন কথা? যে সুন্দরের ব্যাখা তুমি কাগজে এত ভাল করে ফুটিয়েছো সে সুন্দর তোমার হবেনা কেন?’

‘আমি সুন্দর পছন্দ করিনা।আমি মোহে গলি,রুপে না’

‘চোখ তো রুপ না।চোখই আসল মোহ।মোহে পড়া কাকে বলে জানো ভায়া??মায়ায় পড়া।চোখের মায়ায় মানুষ সবার আগে পড়ে।তুমি ভেবে নাও তুমি আসলে কোন মানুষটার মোহে পড়েছো’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here