ডাক্তার সাহেব পর্ব ২১+২২

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২১

বোরকাটা পরে মিহুর বাসা থেকে বের হতে যাব এমন সময় মিহু চেঁচিয়ে উঠল।

– আরে সিঁথি তুই এভাবে বের হলেও তোকে মানুষ চিনে ফেলবে। এভাবে বের হলে ধরা পড়বি নির্ঘাত।

খানিকটা বিস্মিত হলাম তার কথা শুনে। কারণ নিকাব পরার পরও কেউ কী করে চিনবে আমায় সেটাই মাথায় ঘুরপার খাচ্ছিল। বিচলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম

– কীভাবে চিনবে আমায়? আমি তো বোরকা পরে আছি। এরকম ভাবে তো আমাকে কেউ কখনও দেখেনি। আর চোখ ছাড়াও তো কিছু দেখা যাচ্ছে না তাহলে চিনবে কী করে?

– আসলেই তুই বোকা বোকাই রয়ে গেলি। আর বুদ্ধি সুদ্ধি তোর মাথায় হবে না। তোর তো মার্কা মারা নীল চোখ আছে৷ আমাদের এলাকায় এরকম চোখ কারও নেই। যে কেউ তোর চোখ দেখে চিনে ফেলবে তুই সিঁথি। আর কিছু লাগবে না তোকে চেনার জন্য তোর চোখেই যথেষ্ঠ।

আমি নিজের জিহ্বায় নিজেই কামড় দিয়ে বসলাম। মিহু যা বলেছে একদম ভুল বলেনি। কিন্তু এর উপায় হিসেবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হালকা গলায় বললাম

– চোখ কী করে ঢাকব এখন। চোখ বন্ধ করেও তো হাঁটা যাবে না।

মিহু তার ব্যাগ থেকে কালো সানগ্লাস বের করে বলল

– এটা পরে নে। তাহলে আর কেউ চিনবে না। আসার সময় আমার জন্য কিছু নিয়ে আসিস। এত রিস্ক নিয়ে তোকে বের করতেছি এর জন্য তো কিছু পাওনা আমি।

মিহুর কথায় মুচকি হেসে বললাম

– আগে তো যাই তারপর নাহয় বাকি কথা হবে। এমনিতেই ভয়ে বুক ধুকধুক করছে। কখনও তো এমন করিনি। এমন ভাবে পালিয়ে কারও সাথে দেখা করিনি। হার্টবিট বেড়ে চলেছে ক্রমেই।

– আরে…. তোর মতো মেয়ে ভয় পাচ্ছে! তোকে সবাই চিনে মাফিয়া নামে আর তুই কী না এসব বলছিস। তুই কী সত্যি সত্যি প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? দেখা গেল বাজির প্রেম বাস্তব রূপ ধারণ করল।

বলেই মিহু হাসতে লাগল। সে অবশ্য নীল আর আমার বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানে না। সে ভেবেই নিয়েছে আমি নীলের সাথে প্রেমটা বাজি জিতার জন্যই করতেছি। অবশ্য আমিই কাউকে কিছু বলছি না। একটা ছেলে বিরোধী মাফিয়া স্বভাবের মেয়ে কি না প্রেমে পড়ে ভীতু শান্তিশিষ্ট হয়ে গেছে সেটা বাকিরা জানুক আমি চাই না। মিহুর হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিলাম না। জোরে একটা থাবা কষিয়ে দিয়ে বললাম

– আমার মতো মেয়ে প্রেমে পড়বে। পাগল নাকি তুই? বাদ দে সেসব কথা। ভয় পাচ্ছি ধরা খেলে বাশ খাব বাসায় তাই। এর বাইরে কিছু না। এখন যাই আমি।

মিহু কপালটা ভাঁজ করে মলিন মুখে উত্তর দিল।

– তোর হাবভাব যদিও অন্যকিছু বলে। থাক সেসব কথা। সাবধানে যাস। আর সানগ্লাসটা যত্ন করে দিয়ে যাস। নিজের মনে করে রেখে দিস না।

– হুম ঠিকাছে।

বলেই বাসা থকে তড়িঘড়ি করে বের হলাম। মিহুর বাসা থেকে মূল রাস্তায় যেতে হেঁটে পাঁচ মিনিট সময় লাগে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যতই সামনে এগুচ্ছিলাম ততই ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সবাই আমাকে চিনে ফেলবে। নিস্তব রাস্তা তবুও যেন আশেপাশে মানুষের বিচরণ অনুভব করছিলাম। বেশ হন্তদন্ত হয়েই হেঁটে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। বুকের কম্পন যেন থামছেই না। এত ভয় এত ভীতি এর আগে কখনও লাগেনি। জীবনে অকর্ম করেনি এমন কোনো কাজ নেই। তবুও কেন জানি না আজ ভীষণ ভয় লাগছে। শত ভাবনা শত ভয় নিয়েই মূল রাস্তায় আসলাম। রাস্তায় আসতেই রিকশা ওয়ালা বলে উঠল

– নানী কোথায় যাবেন?

রিকশাওয়ালার কথা শুনে আমার রাগ বেড়ে গেল৷ আমার মতো বাচ্চা মেয়েকে নানী বলছে! পরক্ষণেই মনে হলো আমার যে সাজগোজ এর থেকে বেশি ভাবার কথা না। গলাটা কিছুটা ভেঙে বললাম

– তিন রাস্তার পেছনে যাব।

বলেই রিকশায় উঠে বসলাম। এ প্রেম যে আমাকে কত কিছু করাচ্ছে সেটাই চিন্তা করতেছি। এ প্রেমে মগ্ন হয়ে যে অবাধ্য পথে হাঁটছি সে পথ কী ঠিক নাকি ভুল সেটাই বুঝে পাচ্ছি না। অবাধ্য এ প্রেমের শেষটা আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে। ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু জমে উঠেছে। অশ্রুটা পড়বে পড়বে এমন সময় রিকশাওয়ালা মামা ডেকে উঠলেন

– নানী চইলা আইছি নামেন।

আমি নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরিয়ে আনলাম। অবাধ্য এ চোখের পানিটা আর গড়াতে দিইনি আটকে দিলাম চোখের মধ্যেই। রিকশা ভাড়াটা এগিয়ে দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। নীলকে কল করলাম সাথে সাথেই।

– কোথায় তুমি?

নীল উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল

– তুমি কোথায়?

– আমি তো কোচিং এর পেছনে।

– দাঁড়াও ২ মিনিট এখনই আসতেছি।

মোবাইলটা ব্যাগে রাখলাম। দুই মিনিটও হয়নি নীল আমার সামনে চলে এসেছে। বাইকে বসে আছে সে। পরনে নীল শার্ট, কালো প্যান্ট। মাথায় নীল হ্যালমেট। নীল যেন নীলে একাকার। হ্যালমেটে তার মুখ স্পষ্ট না তবে তাকে চিনতে আমার ভুল হলো না। নীল সামনে এসেই মুগ্ধ কন্ঠে বলল

– বাইকে উঠো।

আমি বাইকে উঠতে যাব এমন সময় সে বাঁধা দিয়ে বলল

– দাঁড়াও হ্যালমেটটা পরে নাও।

মুখটাকে মলিন করে জবাব দিলাম

– আমি হ্যালমেট পরতে পারি না।

নীল হালকা হাসলো, হ্যালমেটটা নিজ হাতে পরিয়ে দিল। আমি বাইকে উঠে বসলাম। নীলের কাঁধে শক্ত করে ধরলাম। বাইকটা স্টার্টের শব্দ কানে আসলো আর শুর শুর করে চলতে লাগলা। বাইরে বাতাস এসে আমার বোরকায় ঝাঁপটা দিতে লাগল। প্রথম কোনো অল্প পরিচিত ছেলের সাথে বাইকে উঠেছি। এর আগে যতবার উঠেছি বাবার সাথে। তবে নীলের সাথে বাইকে উঠার অনুভূতি ভিন্ন। উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলাম

– আরও জোরে চালাও। আস্তে চালালে হবে নাকি৷

– এত উৎকন্ঠা কেন তুমি? আরে বোকা মেয়ে বেশি জোরে চালালে পড়ে যাবে।

– পড়ব না তোমাকে তো জড়িয়ে ধরে রেখেছি। আচ্ছা আমরা যাব কোথায়?

– দেখি দুচোখ যেদিকে যায়। কেন তোমার বাইক চড়তে ভালো লাগছে না?

– ভীষণ ভালো লাগছে। আমি তোমাকে আরও শক্ত করে ধরি?

– ধরো।

– কাতুকুতু দিই?

– একদম না। পরে যাব তাহলে।

কিন্তু আমার নাছোরবান্দা মন কেন জানি না নীলের কথায় বাধ্য হতে পারল না। বেশ উৎকন্ঠা আর উৎফুল্লতা নিয়েই কাতুকুতু দেওয়া শুরু করলাম। নীল বারবার বারণ করছিল আর আমি অবাধ্যের মতো বারবার কাতুকুতু দেওয়া বহাল রাখছিলাম। সে সাথে খিলখিল করে হাসছিলাম। হাসতে হাসতেই মনে হলো সজোরে শব্দ হলো। শব্দটা যেমন হলো তেমনি কোমড়েও জোরে আঘাত পেলাম। বুঝতে আর বাকি রইল না বাইকটা রাস্তার একপাশে পড়ে গেছে। নিজেকে সামাল দিলাম। কোমড়টা ব্যথায় টনটন করছে তবুও উঠলাম। নীল ও উঠে দাঁড়াল। ব্যথা পেলেও বড় ধরণের কোনো সমস্যা হয়নি কারও। আমি উঠে দাঁড়াতেই নীল কর্কশ গলায় বলে উঠল

– না করেছিলাম তোমাকে কাতুকুতু দিতে। সবসময় ফাজলামি তাই না?

কী উত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে উত্তর দেওয়ার জন্য বেগ পোহাতে হলো না তেমন। কারণ উত্তর দেওয়ার পূর্বেই সে জায়গায় পুলিশের আগমণ ঘটল। নীলের কাছে বাইকের চাবি আর ড্রাইভিং লাইসেন্স চাইল। নীল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাইকটা থানায় নিয়ে গেল। দুজনেই বসে আছি থানায়। নীলের রাগ আমার উপর ক্রমশ বেড়ে চলছে। যেটুকু অকম্য হয়েছে সেটার দায় যে আমার সেটা নীল তার চোখের রাগী চাহুনি দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। পিনপনা নীরবতা থানায়। পুলিশ অফিসার আসার অপেক্ষায় বসে আছি দুজন। পুলিশ অফিসার আসলে যে বড়সড় একটা কান্ড ঘটবে সেটা দুজনেই আন্দাজ করতে পারছিলাম। অপেক্ষার প্রহর বেশিক্ষণ গুণতে হলো না, দুজনের সামনে এসে বসলেন এক যুবক। বুঝতে বাকি রইল না ইনিই হলেন সে পুলিশ অফিসার। দুজনেই ভয়ে ঢুক গিলতে লাগলাম। ভয়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল পুলিশ অফিসারের আচমকা প্রশ্নে। #ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব -২২

ভয়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল পুলিশের আচমকা প্রশ্নে। পুলিশ অফিসার প্রশ্নটা নীলের দিকে ছুরে না দিয়ে আমার দিকে প্রশ্নের তীর ছুরে দিলেন।

– এ লোক তোমার কী হয়?

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কী পরিচয় দিব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রেমিক পরিচয় তো ভুলেও দেওয়া যাবে না। পরিচয় দেওয়ার মতো সম্পর্কই যেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেশ নীরব হয়ে বসে থেকে হুট করে জোরেসোরেই বলে উঠলাম

– উনি আমার আপন মামা হয়। আমার মায়ের ছোট ভাই। আমরা নানু বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমি পর্দা করি তো তাই বোরকা নিকাব পরে বের হই। আর বাইকে বোরকা সামলাতে পারিনি তাই পড়ে গিয়েছিলাম। মামাও হয়তো বাইক নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই এক্সিডেন্ট টা হয়। এমনিতে মামা বেশ ভালো বাইক চালায়।

কথা গুলো বলে আমি নীচের দিকে তাকালাম। আড়চোখে নীলের দিকে দৃষ্টি দিলাম। নীল আমার দিকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে আছে। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি আমি এমন উত্তর দিব। তবে সে কী ভাবলো তা দেখার বিষয় এখন না। এ পুলিশের হেফাজত থেকে বের হওয়াটায় এখন মূখ্য বিষয়। বুদ্ধি করে এ সম্পর্ক বলেছি বলেই জটিল বিষয়টা বেশ সরল হয়ে গেল। পুলিশ অফিসার অন্তত সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। উনিও বিশ্বাস করে নিলেন আমরা মামা ভাগ্নী। এক তো নীলের সাথে আমার বয়সের ফারাক বেশি৷ তার উপর নীলের মাথায় চুল কম কপালটা বেশ ফাঁকা তাকে দেখলে মামা, মামা একটা ভাব লাগেই। অপরদিকে আমার বয়স কম। তাই পুলিশ অফিসার উত্তরটা বেশ সিরিয়াস ভাবেই নিয়েছেন। তেমন জটিল কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো না। তবে বাইক পুলিশ হেফাজত থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। নীল আর কথা বাড়াল না। যথারিতী নিজের পকেট থেকে পাচশ টাকার ৬ টা নোট বের করে পুলিশের হাতে গুজে দিলেন।

অতঃপর সকল ফরমালিটি শেষ করে আমরা দুজন থানা থেকে বের হলাম। দ্রূত বাইকে উঠলাম। নীল ও বাইকটা স্টার্ট দিয়ে মিনেট পাঁচেকের মধ্যে থানার রাস্তাটা পার করল। মিনেট দশেক বাইকটা বেশ জোর গতিতে চলল। আর আমি নিশ্চুপ হয়ে পেছনে বসে আছি। কোনো কথায় আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। মিনেট দশেক পর বাইকের গতি মৃদু হয়ে থেমে গেল। বাইকটাকে এক পাশে দাঁড় করিয়ে আমার হাতের বাহু ধরে নামানো হলো। নীলের কর্কশ গলা আমার কানে এসে ধাক্কা দিল।

– আমি তোমার কোন জন্মের মামা হই? আমাকে তোমার মামা লাগে? কী উত্তর দিয়েছো তুমি? ভাই ও তো বানাতে পারতে? এক লাফে মামা বানাতে গেলে কেন? যা সত্যি তাই বলতে, সমস্যা হলে আমি দেখে নিতাম। তাই বলে আমাকে তোমার মামা বানিয়ে দিবে? তখন ওদের সামনে তো কিছু বলতে পারিনি। এখন মন চাচ্ছে তোমার গালে ঠাটিয়ে একটা চড় দিয়ে দাঁত গুলো ফেলে দিই। সম্পর্কের মানে বুঝো?

নীলের কথা শুনে আমার কপালটা আপনাআপনি ভাঁজ হয়ে গেল। রাগটাও হালকা বাড়ল। কিছুটা জোরগতিতেই বলে উঠলাম

– তো কী বলব প্রেমিক? আমি এটা বলি আর তোমাকে আমাকে ধরে থানায় রেখে দিক তাই না? তারপর বাবা, মা কে খবর দিয়ে এনে ধরিয়ে দেয়া হোক। তোমার নামে নাবালক মেয়ে কিডন্যাপের মামলা হোক। এটাই তো চেয়েছিলে তাই না? একজন ডাক্তারের মাথা যে এত গোবর ঠেসা জানা ছিল না। শুনো সব জায়গায় সব কিছু সত্যি বলে হ্যান্ডেল করা যায় না। এ বিষয়টায় আমার উত্তর যথার্থই ছিল। দেখলে না পুলিশ অফিসার ও আমার সব মিথ্যা স্বীকারোক্তি কত সহজে মেনে নিলেন। অন্য উত্তর দিলে কী, তা মানত? একদম আমার সাথে রাগ দেখাবে না। আমি যা করেছি ভালোর জন্য।

নীল চুপ হয়ে গেল। তবে তার রাগটা এখনও কমেনি সেটা তার লাল বর্ণের চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রাগটা স্থায়ী রেখেই বলে উঠল

– মেনে নিলাম তোমার উত্তর ঠিক আছে। কিন্তু বাইকে বসে না করা সত্ত্বেও কাতুকুত কেন দিলে? এ অকাজটা না করলে আজকে এ ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়াটায় আমার ভুল হয়েছে। দিনটাই মাটি করে দিলে। সহজ বিষয়গুলো তোমার জন্য বারবার জটিল হচ্ছে।

বলেই নীল চুপ হয়ে গেল। রাগে সে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। তার রাগের মাত্রাটা যে প্রখর সেটা তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছি না। দুকান ধরে নীলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখগুলো মিটমিট করে বললাম

– আমি তো এমনই তুমি তো জানো তারপরও রেগে কেন যাও। কান ধরে সরি বলতেছি প্লিজ রাগ করো না। এমন ভুল আর হবে না। তাড়াতাড়ি মাফ করে দাও নাহয় বেশিক্ষণ কান ধরে থাকলে আশেপাশের মানুষের নজরে পড়ব।

নীল আমার দিকে তাকাল। আমার চোখে তার চোখে যেতেই যেন সব রাগ তার থেমে গেল। হালকা হেসে বলল

– এটাও একটা অভিজ্ঞতা হলো। রাগ করিনি কান ছাড়ো। নাহয় মানুষ চিড়িয়াখানার বানর ভেবে ধরে সেখানে নিয়ে যাবে। বাইকে বসো একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

– কোথায়?

– আগে ঠিক করে বসো আর স্থির হয়ে থাকো। গেলেই তো দেখতে পারবে। এত অস্থির হওয়ার কিছু হয়নি।

নীলের কথার জবাব দিলাম না। তাকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথাটা ঠেকিয়ে বাইকে বসলাম। চোখটা বন্ধ করে তাকে অনুভব করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিল পরম শান্তির কোনো যাত্রায় আমি এগিয়ে যাচ্ছি। যে যাত্রা শেষ করতে ইচ্ছে করছে না। শুধু যাত্রাপথটা সুন্দর করে এগিয়ে নিতে ইচ্ছা করছে। এ যাত্রার শেষ গন্তব্য যেন অজানা। শত শান্তির মাঝেও যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে এ যাত্রার শেষ কী হবে এটা ভেবে। চোখের কোণে ক্রমশেই শিশির বিন্দু জমাট বাঁধতে শুরু করল। বিন্দুটা কখন গড়িয়ে পড়বে সে অপেক্ষায়। আর কিছু ভালো লাগছে না। কেন জানি না ভালোলাগার সকল জায়গা নীল দখল করে রেখেছে। চোখটা ভিজে আসছে ক্রমশেই। নীলকে হারানোর কথা চিন্তা করলে নিজেকে বেশ ছন্নছাড়া আর অস্থির লাগে।

বাইকটা থেমে গেল। হালকা ব্রেক কষা হলো। আমি নীলকে আরও জোরে চেপে ধরলাম। নীল বাইকটা থামিয়ে আমার হাত দুটো তার বুকে আরও চেপে ধরে বলল

– ছাড়বে না?

– ইচ্ছা করছে না।

– ছেড়ে একটু বাইক থেকে নামো। চারপাশটা দেখো। এখনও চোখ বন্ধ করে আছো?

– হুম। এভাবে থাকতেই ভালো লাগছে ভীষণ।

– তাহলে ৫ মিনিট এভাবেই থাকো। তবে চোখটা খুলো ভালো লাগবে।

– কোথায় এসেছি আমরা?

– চোখ না খুললে বুঝবে কী করে? আমাকে ছেড়ে চোখটা খুলে দেখো।

নীলের হাতটা চেপে ধরলাম আমিও, চোখটা খুলে চারপাশে তাকালাম। নিরিবিলি একটা জায়গা। দুপুর বেলাতেও বেশ শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে৷ খানিক দূরে নদী বয়ে গেছে। চারপাশটায় হাজারো গাছের মেলা। আশেপাশে কেউ নেই। মনে হচ্ছে না এখন ভর দুপুর। এখানের পরিবেশ জানান দিচ্ছে এখন সবে সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে। চারপশটা বেশ শীতল। বাতাস এসে কানে ভালোবাসার সুর তুলছে। নদীর কলকল পানির শব্দও যেন কানে আসছে। নীলের হাতটা ছেড়ে দিলাম। বাইক থেকে নামলাম। মুগ্ধ নয়নে চারপাশটা অবলোকন করলাম। নীল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার আমিও তার দিকে তাকালাম। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে উঠলাম

– এ জায়গা তুমি চিনো কী করে? আগে কী কখনও এসেছো? এত সুন্দর জায়গা অথচ কখনও নাম শুনলাম না।

– তোমার পছন্দ হয়েছে?

– ভীষণ…। বললে না তো এ জায়গার সন্ধান কোথায় পেলে তুমি?

– মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে এ জায়গায় চলে আসি। একদিন বাইক দিয়ে শহরে যাচ্ছিলাম জায়গাটায় হুট করে চোখ গেল দূর থেকে। কাছে আসার পর মনে হলো এর চেয়ে সুন্দর জায়গা আর কোনোটায় হতে পারে না। সেদিন মন খারাপ ছিল প্রচন্ড। কেন জানি না এ জায়গায় আসার পর মন খারাপের কারণ টা ফিকে হয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। যখন মন খারাপ হয়ে যায় তখনই এখানে চলে আসি। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি তারপর আবার বাসায় চলে যাই। এখন তো রোগীর চাপ, সময় তেমন পাই না তাই অনেকদিন আসা হয়নি। আজকে তোমায় নিয়ে আসলাম।

আমার মুখে ইষৎ হাসি। হালকা গলায় বললাম

– ভালোবাসি তোমায়।

নীল আমার হাতটা ধরে তার বুকে চেপে ধরে জবাব দিল

– তোমাকেও বড্ড ভালোবাসি আমি। চলো সামনে যাওয়া যাক।

নীলের হাতটা ধরে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। এ প্রথম নীলের হাতটা ধরে পাশাপাশি হাঁটছি। এ হাঁটার দৃশ্যটায় আমার স্মৃতিতে প্রিয় স্মৃতির তালিকায় থাকবে। মৃদু বাতাস গায়ে লেপ্টে পড়ছে। নীলের হাতে ক্ষণে ক্ষণে চিমটি কাটছি আবার ক্ষণে ক্ষণে চেপে ধরছি। হাঁটতে হাঁটতে নদীর কিনারায় আসলাম। নিস্তব চারপাশ। নদীর পানির কলকল শব্দ ব্যতীত আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। নদীর পাড়ে দুজনেই বসে পড়লাম। পাশাপাশি এভাবে বসার মধ্যেও ভালোবাসার মাতাল সুখ খুঁজে পাচ্ছিলাম। সময়টা এখানে থমকে গেলে কতই না ভালো হত। কত ভাবনা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নীলের মোলায়েম সুর কানে আসলো

– এখানে আমরা বিয়ের পরও আসব। তখন সূর্য ডুবা দেখে যাব। এখন তো একসাথে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকা সম্ভব না। যখন আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে তখন এখানে এসে অর্ধরাত পার করব। তুমি আমার কাঁধে হেলান দিয়ে থাকবে আর আমি তোমার মাথায় মাথা ঠেঁকিয়ে রাখব। তারপর মুগ্ধ নয়নে দুজন আকাশের প্রশস্ত চাঁদটা দেখব। দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলব। তারপর চোখ বন্ধ করে দুজন দুজনকে অনুভব করব।

নীলের কথাগুলো আমি চোখ বন্ধ করেই শুনছিলাম। এ দৃশ্যটা যেন চোখে ভেসে উঠল। কিছু না বলেই নীলের কাঁধে মাথাটা ফেলে দিলাম। কতক্ষণ মাথা ফেলে চুপ ছিলাম জানি না। নীরবতার রেশ কাটে একটা অচেনা মেয়েলী কন্ঠসুরে।

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here