ডাক্তার সাহেব পর্ব ২৩+২৪

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৩

নীরবতার রেশ কাটে একটা অচেনা মেয়েলী কন্ঠসুরে। খানিকটা চমকে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বরফের মতো হিম হয়ে গেলাম। মিহু, কবিতা, তুর্য,সায়রান,শুভ্রা,সৌভিক,তনয়, তামান্না দাঁড়িয়ে আছে। চোখ আমার কপালে উঠে গেল। এরা এখানে আসলো কী করে। সব যেন এলোমেলো লাগছে। উত্তর মেলাতে পারছিলাম না। কিছু বলে উঠার আগেই জোরে চিৎকার কানে আসলো। সবাই এক জোট হয়ে বলে উঠল

– হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ৷

আমার বিস্ময়ের রেশ আরও বেড়ে গেল। আমার জন্মদিন আমিই ভুলে গিয়েছিলাম। প্রতিবছর মা এদিনে সকাল সকাল পায়েস রান্না করে দিত। মায়ের পায়েসের সুঘ্রাণেই মনে করিয়ে দিত আমার জন্মদিন। এবছর মা অসুস্থ থাকায় নিজের জন্মদিনের কথা বেমালুম ভুলে বসে ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথায় বের হচ্ছে না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পরিকল্পনাটা কার বুঝতে পারছি না। নীরবতা আমাকে বেশ ভালোভাবেই গ্রাস করছে। আমিও নীরবতা কাটানোর চেষ্টা করিনি। মিহুর কথা শুনতে লাগলাম দাঁড়িয়ে।

– ভাইয়া এত দেরি কেন হলো? আপনারা তো বাইকে এসেছেন। আমাদের আগে চলে আসার কথা। সে কখন আমরা চলে এসেছি। আপনি যেভাবে প্ল্যান করেছিলেন সেভাবেই সব গুছিয়ে রেখেছি। পরে আপনার মেসেজ পেয়ে বুঝতে পারলাম আপনাদের আসতে দেরি হবে। ফোন দিলাম অনেকগুলো ধরলেন না।

নীলের মুগ্ধ কন্ঠসুরে উত্তর আসলো

– আরে ঝামেলায় পড়েছিলাম। সে কাহিনি পরেও বলা যাবে। তোমার বান্ধবীর মাথার তার তো কয়েকটা ছেড়া জানই। সারাদিন যা করেছে কী আর বলব। সহজ কাজগুলো জটিল করেছে। কেক নিয়ে এসেছো তো?

কবিতা চিৎকার করে বলে উঠল

– আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই সবটা করেছি। ঐ তো দূরে কেক সাজানো।

সবার কথোপকথনে বুঝতে পারলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার পরিকল্পনাটা নীলেরেই ছিল। এমনভাবে সারপ্রাইজ পাব কল্পনাও করতে পারিনি। মায়ের অসুস্থতার জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম আজকে ২৭ সেপ্টেম্বর। এত কাহিনির সম্মুখীন হয়েছি যে নিজের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক না। এমন সময় নীল আমার চোখটা চেপে ধরল। আমি নীলের হাতটা ধরে বলতে লাগলাম

– আরে করছো কী? চোখ ছাড়ো।

তনয় আর সৌভিক উঁচু গলায় হাসতে হাসতে বলল

– সিঁথি তুই এত অস্থির কেন? তোকে তো আর ভাইয়া কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে না। চোখ যখন ধরেছে কারণ তো অবশ্যই আছে।

– তোরা ঠিক কী করছিস বলতো? মিহুর বাসা থেকে সকালে বের হলাম সেও কিছু বলল না। আমার থেকে তোদের কাছে নীল বেশি হয়ে গেল তাই না?

তুর্যের অট্ট হাসি কানে আসলো

– বললে কী আর এমন সারপ্রাইজ হতি? শুন.. আমরা তোর ফ্রেন্ড, তোকে খুশি করতে কেউ চাইলে বাঁধা দিব না কিন্তু কেউ কষ্ট দিলে অবশ্যই বাঁধা দিব। নীল ভাইয়া তো তোর হাসিমুখটায় দেখতে চেয়েছে সেখানে বাঁধা দিই কী করে।

সবার কথা শুনছিলাম আর অন্ধের মতো সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। মনের ভেতরটা প্রশান্তিময় হয়ে উঠল। কী জানি অপেক্ষা করছে জানি না। তবে ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে সেটাই বুঝতে পারছি। দিনকে দিন নীল আমার মনের সমস্ত জায়গা বিচরণ করে নিচ্ছে। এ জায়গাটা কখনও যেন খালি হয়ে না যায় সে চিন্তা করতেই মনে অজানা ভয়ও গ্রাস করে নেয় মাঝে মাঝে। একদিকে তার প্রতি অধিক ভালোবাসাও কাজ করে অপরদিকে তাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাও গ্রাস করে। এ দুটানা চিন্তা বেশ যন্ত্রণা দেয়। আমি থেমে গেলাম। নীল আমার চোখটা ছেড়ে দিল। সামনের দিকে তাকিয়ে আরও বেশি সারপ্রাইজ হলাম। পাশাপাশি দুটো নৌকা নদীর কিনারায় দাঁড় করানো। একটা নৌকার মেঝেটা সাদা আর লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো। ছাউনির এক পাশে থেকে অপর পাশ পর্যন্ত কয়েকটা ইংরেজি অক্ষর দিয়ে সাজিয়ে লেখা আছে ‘হ্যাপি বার্থ ডে’। ফুলের মাঝখানে একটা কেক। নৌকার কার্ণিশটা বেলুন দিয়ে সাজানো। ছাউনির ভেতরটায় কী আছে দেখা যাচ্ছে না। আমি কোনো কথায় যেন বলতে পারছিলাম না। জীবনের প্রথম এরকমভাবে জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে। চোখ দিয়ে গড়গড় করে অশ্রু ঝরছে। এ অশ্রুটা কষ্টের না আনন্দের। আবেগটা ধরে রাখতে পারিনি বলেই চোখ দিয়ে অশ্রু নামিয়ে আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালাম। নীলকে কেন জানি না ঝাঁপটে ধরলাম। এমন সময় পার্টি স্প্রে এর আগমনে মনে হচ্ছিল তুলার মতো চারপাশে বরফ কণা উড়ছে। হ্যাপি বার্থ ডে টু সিঁথি ধ্বনিতে যেন চারপাশ মুখরিত। নীলও আমাকে জোরে ধরে বলতে লাগল

– আরে পাগলি কাঁদছো কেন? নিজেকে সামলাও।

– আমি কষ্টে কাঁদছি না। আমি ভাবতেও পারিনি কেউ কখনও আমাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিবে। কতটা ভালো লাগছে বুঝাতে পারব না।

– সবকিছু আমাদের ভাবনার মধ্যে হয় না পাগলি। আমি চাইব সবসময় তোমাকে এরকম ভাবনার বাহিরের সুখগুলো খুঁজে দিতে। বৃদ্ধ হলেও তোমার প্রেমিক রোমন্টিক আছে।

– তোমাকে তো কখনও আমি বৃদ্ধ বলি না। সবসময় তোমায় আমি টগবগে যুবক বলি।

– তোমার বয়সের তুলনায় আমি বৃদ্ধ, বেমানান বটে। এবার আমাকে ছাড়ো। তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল কী না কী ভাবছে। নিজেকে সামলাও।

নীলের কথায় নিজেকে সামলে তাকে ছেড়ে দিলাম। সাজানো নৌকায় আমি আর নীল উঠলাম আর পাশের নৌকাটায় আমার বন্ধুমহলের সবাই উঠল। কেকটা কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলাম। দুজন মাঝি ততক্ষণে নৌকায় এসে হাজির হলো। দুটো নৌকা চলতে লাগল। আমি আর নীল এক নৌকায় অপর নৌকায় তারা। নৌকাটা মাঝ নদীতে আসতেই নীল ছাউনি তল থেকে একটা পাখির খাঁচা নিয়ে আসলো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– এ পায়রা নিয়ে এসেছো কেন?

– পায়রাটাকে মুক্ত করে দাও। ধরে নাও ভালোবাসার স্মৃতিস্বরূপ একটা বন্দি পাখিকে আমরা ডানা মেলে উড়তে দিয়েছি।

নৌকায় দাঁড়ালাম। পেছন থেকে সে আমাকে ধরে রেখেছে। পায়রাটা হাতে নিয়ে আকাশে ছেড়ে দিলাম। সথে সাথে আরও কতগুলো পায়রা যোগ হলো। পাশের নৌকা থেকে আমার বন্ধুমহলের সবাই আরও পায়রা মুক্ত করল। গ্যাস বেলুন গুলো উড়তে লাগল। নীল আমার হাতে একটা ফানুস ধরিয়ে দিল। ফানুসটাও অজানা গন্তব্যে উড়তে ছেড়ে দিলাম। সে আমাকে ধরে নৌকায় বসালো। নৌকায় বসে আকাশটার দিকে তাকালাম। পায়রা গুলো ছুটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। ফানুসটা জ্বলতে জ্বলতে ছুটে চলেছে অচেনা শহরে। গ্যাস বেলুনগুলো গন্তব্যহীন হয়ে হেল দুল খাচ্ছে। এত মুখরিত পরিবেশ যেন মনটাকে শীতল করে দিল। এবার নীলের দিকে তাকালাম। সে আমার পা ‘টা টেনে তার হাঁটুর উপর রাখল। ততক্ষণেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না সে কী চাচ্ছে। বুঝে উঠার জন্য খুব বেশি অপেক্ষাও করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা রূপার পায়েল পায়ে পড়িয়ে দিল। তারপর আমার হাতটা ধরে চোখে চোখ রেখে বলল

– প্রতিজ্ঞা করছি সারাজীবন তোমার পাশে এভাবে থাকব। তোমার ছোট ছোট খুশি গুলোকে যত্ন করে রেখে দিব। তোমাকে কখনও কষ্ট পেতে দিব না। কষ্ট দিলেও চেষ্টা করব তোমার কষ্টটা কমিয়ে দিতে। তোমাকে আমি ভালোবাসি। বড্ড ভালোবাসি। সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই এভাবেই ভালোবাসতে চাই।

নীলের বুলিতে নিজেকে মিশিয়ে ফেলেছি কখন জানি না। চোখের নেশায় কখন ডুবে গিয়েছি জানি না। অকোপটে বলতে লাগলাম

– জানি না তোমায় এত ভালো কী করে বাসলাম। তোমার চোখে কেন আমি ডুবে যাই জানি না। তোমার মায়া কাটিয়ে উঠা বড় দায়। তোমাকে এত ভালোবাসি বলেই কী তোমাকে হারিয়ে ফেলার এত ভয় পাই। তুমি আমার অস্তিত্বের সমস্ত জায়গায় বিচরণ করছো। কখনও তোমাকে হারিয়ে ফেললে আমি শুধু তোমাকে হারাব না বরং আমার অস্তিত্বটাকে বিলীন করে ফেলব। হয়তো সেদিন মরেই যাব।

নীল আমার মুখটা তার হাত দিয়ে চেপে ধরল। কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে জবাব দিল

– মরে যাওয়ার কথা একদম বলবে না। এ কথা ফের যদি বলেছো চাপায় একটা দাঁত ও থাকবে না। কষিয়ে চড় দিয়ে সব ফেলে দিব।

নীলের কথা শুনে হালকা হাসলাম। এ শাসন কষ্ট দেয় না। এ মিষ্টি শাসন আরও ভালোলাগার অনুভূতি দেয়। নীলের বুকে মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম। হাসতে হাসতে বললাম

– কখনও যদি হারিয়ে যাই কী করবে?

– খুঁজে নিব।

– মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছে করে লুকিয়ে পড়ব আর তুমি আমাকে কীভাবে খুঁজো সেটা দেখব। তোমার অস্থিরতা আমি অবলোকন করব। তোমাকে মিষ্টি যন্ত্রণা দিব।

– লুকিয়ে থেকো হারিয়ে যেও না। তোমাকে হারালেও বড্ড কষ্ট আমার হবে। যন্ত্রণা আমাকে ঘিরে ধরবে। স্বাভাবিক কাজগুলো আমি করতে পারব না। তোমাকে হারানোর ভয় আমারও কাজ করে। তফাত এটাই তুমি সবসময় বলে প্রকাশ করো আমি করতে পারি না। এ বলদটা তো মনের অব্যক্ত কথাগুলোও বলতে পারে না সাজিয়ে।

– আমি এ বলদটাকে কথা বলা শিখিয়ে নিব।

– যখনই বলদ ডাকার সুযোগ পেলে হাত ছাড়া করলে না। কী অকোপটে নিজের ভবিষ্যত স্বামীকে গালি দিচ্ছ।

নীলের কথা শুনে আরও হেসে দিলাম। এখন মনে হচ্ছে নীল আমার বয়সে ছোট আমি তার বয়সে বড়। মাথাটা তার বুকে ঠেঁকিয়ে বললাম

– বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

কোনো এক চিৎকারের আওয়াজ আবারও কানে আসলো সে সাথে আরও বড় একটা সারপ্রাইজ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখের কথাও যেন উড়ে গেল।
#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৪

কোনো এক চিৎকারের আওয়াজ আবারও কানে আসলো সে সাথে আরও বড় সারপ্রাইজ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখের কথাও যেন উড়ে গেল। আকাশটা তারকা বাজিতে ভরপুর। পাশের নৌকা থেকে ফুলের পাপড়ির ছিটা আসছে। নৌকাটা ভসতে ভাসতে তীরে এসে পৌঁছাল। তীরের পাশে একজন ছেলে আর মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা নীল পান্জাবি আর মেয়েটা নীল শাড়ি পরেছে। প্রশ্নের জট পাঁকছে মনে উনারা কে এটা ভেবে। নীল আমার হাতটা ধরল। বুঝে উঠার আগেই কোলে তুলে নিল। আমি তার ঘাড় ধরে আছি শক্ত করে। নৌকা থেকে নামিয়ে আনা হলো আমাকে। কোল থেকেও নামানো হলো। নৌকা থেকে নেমে অচেনা দুজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। কিছুই বুঝতে পারছি না হচ্ছে কী বা হবে কী! বেশ সংশয় নিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– উনারা কে?

নীল আমার প্রশ্নটা বেশ বিলম্ব করে দিচ্ছে। পাশের নৌকা থেকে ইতোমধ্যে আমার বন্ধুরা নেমে গেছে। এ প্ল্যানটা তাদেরও হয়তো অজানা। তাই তারাও বেশ নীরব হয়ে কাহিনি পর্যবেক্ষণ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নীলের মুখ থেকে বিলম্বিত উত্তর আসলো

– আমার বেস্ট ফ্রেন্ড রনক আর তার সহধর্মিণী এবং আমার মেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড তুষা। স্কুলে আমরা একসাথেই পড়াশোনা করেছি৷ তারপর আমি এডমিট নিয়েছি মেডিকেলে আর ওরা এডমিট নিয়েছে ভার্সিটিতে। সামনেই ওদের বাড়ি। অফিস থেকে ছুটি পেয়েছে দুজনেই তাই বেড়াতে এসেছে। ভাবলাম তোমাকে নিয়ে এবং বাকি সবাইকে নিয়ে একটু ঘুরে আসলে মন্দ হয় না।

বলেই নীল হাঁটু ঘেড়ে বসে পড়ল। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি৷ পকেট থেকে সে একটা আংকটি বের করে আমার হাতটা ধরল। তারপর হালকা হেসে বলল

– আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলেছিল আমার হবু বউকে যখন আংকটি পরাব তখন তাদের সামনে যেন পড়াই। আমি তাদের কথা রাখতেছি। আমি বিয়ে করলে তোমাকেই করব৷ সার্টিফিকেটে তোমার বয়স হয়তো এখনও কমপ্লিট হয়নি তবে সময়মতো আমি তোমাকে আমার করে নিব। এ আংকটিটা তোমায় পরিয়ে দিচ্ছি। খবরদার যত বাঁধায় আসুক খুলবে না। কখনও যদি আমি হারিয়েও যাই তবুও খুলবে না। হুট করে একদিন ফিরে এসে হাতে এ আংকটিটা দেখতে চাইব। আই লাভ ইউ পাগলি বুড়ি।

হাত তালির শব্দ কানে আসলো। রনক ভাইয়া আর তুষাও হাসতে হাসতে বলল

– অটুট থাকুক এ ভালোবাসা।

আংকটিটা আমার হাতে পরানো হলো। হাতটা থরথর করে কাঁপছে। বুকটাও কাঁপছে। এ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কীভাবে করলে সেটা উপযুক্ত হবে বুঝতে পারছি না। তবে কিছু অনুভূতি অব্যক্ত রাখায় শ্রেয়। আমার বন্ধুমহলের সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। নীলের মধ্যে এমন নাছোরবান্দা আবেগ ফুটে উঠবে তারা হয়তো বুঝতেই পারেনি। নিস্তব্ধ হয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। বসা থেকে উঠে নীল ঠিক আমার সামনে দাঁড়াল। আমার মুখ ভার হয়ে যেতে লাগল। কথা বলতে চেয়েও যেন জিহ্বা নড়াতে পারছিলাম না। শুধু তাকে দুচোখ ভরে দেখে যাচ্ছিলাম। বয়স তো আমার থেকে অনেক বেশি তার, তবুও এখন তাকে একদম অল্প বয়স্ক যুবক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই তো সে ও স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজের পাঠ চুকাচ্ছে। তার ভেতরের আবেগ প্রকাশের ধরণটা তার বয়সের সাথে বেশ বেমানান হলেও এ আবেগ প্রকাশের ধরণটা আমাকে দিয়েছে সর্বোচ্চ শীতলতা। এদিকে জিহ্বা নাড়ানোর যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেও জিহ্বা নাড়িয়ে কথা বলতে ব্যর্থ হলাম। সে আমার হাতটা ধরে সামনের দিকে এগুতে লাগল। আমাদের সামনেই রনক ভাই আর তুষা আপু হাঁটছে। পাশ দিয়ে বাকি সবাই হাঁটছে। খুব বেশি না, পাঁচ মিনিট হাঁটার পরেই একটা বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। বাড়িটা টিন দিয়ে তৈরী হলেও এর ডিজাইনের বাহারি মহীমায় একটা রাজকীয় ভাব ফুটে উঠেছে।

বাড়িটার মূল ফটক রঙিন টিন দিয়ে করা। গেইটের কার্ণিশটা কাঠ দিয়ে ছবির ফ্রেমের মতো বাঁধাই করা। কাঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারুকাজ। গেইটের ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকতেই ডান পাশে একটা ছোট জায়গা বেশ সুন্দর করে ফ্লোরের মতো মসৃণ করে রেখেছে, সেখানে একটা পাটি পাতা আছে। পাটির উপর কিছু কুশন রাখা। কুশনের কভার গুলো রঙধনুর সাতটি রঙে সাজানো। সে জায়গাটাও টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া। জায়গাটা আয়তাকার এবং চারপাশ একহাত পরিমাণ ইটের দেয়াল দিয়ে ভরাট করা। বাম পাশটায় একটা বড় ছাতার মতো প্রশস্ত করে রঙিন টিনের ছাউনি দেওয়া। সেখানে টেবিল আর চেয়ার রাখা আছে। বুঝায় যাচ্ছে এ জায়গা বিকেল বেলায় চায়ের আসর জমানোর জন্য রাখা হয়েছে। এর থেকে দশ কদম সামনে টিনের ঘরটা দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধাংশ কাঠ দিয়ে তৈরী বাকি অর্ধাংশ টিন দিয়ে তৈরী। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার এক কোণে রান্না করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা ঘরের দিকে এগুচ্ছি। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মধ্য বয়স্ক কপোত, কপোতি। বুঝতেই পারছিলাম উনারা রনক ভাইয়ের মা, বাবা। উনাদের কাছে গিয়েই আমরা সবাই কৌশল বিনিময় করলাম। উনাদের প্রাণোচ্ছল হাসিটায় মনটা প্রশস্ত হলো।

এবার ঘরের ভেতর ঢুকলাম। পাশাপাশি তিনটে ঘর। আমরা সবাই বসলাম মাঝখানের ঘরটায়। আমরা সবাই চুপ। কথার আসর রনক,নীল,আর তুষা এ তিনজনেই জমিয়ে ফেলেছে। আমার বন্ধুমহল শুধু চুপ করে কথা শ্রবণ করছিল, আমিও সে দলেরেই অন্তর্ভুক্ত। তাদের কথার আসর বেশ জমে উঠেছে। এর মধ্যে তুষা আপু বলে উঠল

– আরে নীল ওদেরও বলার সুযোগ দে। ওরা তো চুপ থেকে বোরিং ফিল করছে।

নীল হালকা হাসলো, আমি নীলের পাশে বসা আর বাকিরা খানিক দূরে। নীল বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল

– শালক শালিকারা তোমরাও কিছু বলো। চলো একটা গেইম খেলা যাক।

তামান্না বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল

– কিসের গেইম?

– টুকরো কাগজে লটারি দিব যার কাছে যে বিষয় যাবে সে ঠিক ঐ বিষয়ে পারফর্ম করবে।

যেই বলা সেই কাজ। ছোট ছোট কাগজ টুকরো করা হলো। সবাইকে একটা একটা করে দেওয়া হলো। আমিও বাদ পড়েনি এ খেলায়। আমিও তুলে নিলাম একটা কাগজ। রনক ভাই আর তুষা আপুর একদম সঠিক ম্যাচ হয়েছে, তাদের ডান্স পারফর্ম করতে হবে একসাথে। তাদেরকে দিয়েই আমাদের খেলা শুরু হলো। মোবাইলের অডিওতে গান বেজে উঠল। রনক ভাই আর তুষা আপু সে তালে তাল মিলিয়ে পারফর্ম করছে। মনেই হচ্ছে না তারা এ বিষয়ে আনাড়ি। নীলকে ফিসফিস করে বললাম

– উনারা তো অনেক ভালো নাচে।

– আরে ওরা সবসময় ডুয়েট নাচ দিয়ে কলেজ,ভার্সিটিতে মাতিয়ে রেখেছে। বুঝই তো বারো বছর প্রেম করে বিয়ে করেছে। এ বারোটা বছর তারা বিশ্বাস রেখেই একে অপরের পাশে ছিল। কখনও কাউকে ছাড়েনি।

ভাবতে লাগলাম বারো বছরের সংগ্রামটা মোটেও সহজ ছিল না। যেখানে আমি একমাসে হাঁপিয়ে যাচ্ছি সেখানে তারা দীর্ঘ বারো বছর একসাথে কাটিয়েছে। বন্ধন কত গভীর হলে এটা সম্ভব তা আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম। গানটা থেমে গেল। চারদিক থেকে হাততালির শব্দ কানে আসলো। রনক ভাই আর তুষা আপু হাসছে। আমি শুধু তাদের হাসি লক্ষ্য করছিলাম। রনক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– সিঁথির কাগজে কী লেখা দেখি।

আমি ভয়ে চুপসে গেলাম। মুখটা ছোট হয়ে গেল। আস্তে গলায় বললাম

– গান। তবে আমার গানের গলা ভীষণ খারাপ। আমি মোটেও গান পারি না। সুর খারাপ বলেই গানের প্রেকটিস কখনও করিনি।

তুষা আপুর হাসির হালকা শব্দ কানে আসলো। মিহি কন্ঠে বলল

– আরে এটা তো আর প্রতিযোগিতা না। গেয়ে ফেলো কোনো একটা গান।

নীল আমার পাশেই বসে। ভরসা কন্ঠে বলল

– যেমনই হোক গাও। কেউ জাজমেন্টাল করবে না।

পাশের ইতর গুলো নীলকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে বলল

– আরে ভাইয়া ওর গানের গলা অনেক ভালো। শুধু শুধু ন্যাকামি করছে। এত ন্যাকামি করার সুযোগ দিয়েন না।

কপাল কুঁচকে ওদের দিকে তাকালাম। বাঁশ মারার জন্য শত্রু পক্ষের দরকার হয় না। মাঝে মাঝে দু চারটা এমন বন্ধুই যথেষ্ট। দেখা যাবে তারা যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আমার রাগী চাহনীতে তাদের ভ্রূক্ষেপ ও হলো না। বরং জোরে হাসি দিল। কানে তাদের হাসির লিরিক আসতে লাগল। রাগটা বাড়লেও দমিয়ে নিলাম। এর শোধ পরেও নেওয়া যাবে। রনক ভাইয়া আর তুষা আপু পুনরায় বলে উঠল

– আরে সিঁথি শুরু করো।

অগত্যা কোনো উপায় না পেয়ে গান গাওয়া শুরু করলাম। নীলের দিকে আমার চোখটা একনিষ্ঠভাবে তাক করা।

“আমারও পরাণ ও যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমারও পরাণও যাহা চাই।”
“তুমি ছাড়া এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো,
আমারও পরাণও যাহা চায়।”

গানটা গাইতে গাইতে সেখানে ডুবে গেলাম। কখন যে শেষ করলাম জানি না। নীলের দিকে চোখ এখনও তাক করা। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এ পানি অনুভূতির সুক্ষ্ণ বিচরণ। সবাই করতালি দিতে লাগল। তালির শব্দে যেন নিজের মধ্যে সম্ভিত ফিরে পেলাম। প্রশংসা ধেয়ে আসলো। সে প্রশংসায় যোগ হলো রনক ভাইয়ার মা বাবাও। বলতে লাগল বেশ সুন্দর গানের গলা। তবে এ প্রশংসা আমাকে আরও লজ্জাবতী করে দিচ্ছে।

ঘটনার প্রবাহমানে একে একে সবাই পারফর্ম করল। গণাণাচক্রে সর্বশেষে নীল আসলো। সবাই এক জোট হয়ে জানতে চাইল তার কাগজে কী লেখা। নীল কিছুটা মলিন মুখে বলে উঠল

– ডায়লগ ছাড়তে হবে।

রনক ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল

– রোমান্টিক কোনো ডায়লগ ছেড়ে দে।

তুষা আপুও সে কথায় সম্মতি প্রদান করল।

নীল ডায়লগ বলা শুরু করল। নীলের এ ডায়লগ কতটা রোমান্টিক ছিল জানি না তবে এ রোমান্টিকতরা মুর্ছনায় সবার হার্ট এটাক হবার উপক্রম। কারণ

চলবে?

(কপি করা নিষেধ)
চলবে?

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here