#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৭)
#হালিমা রহমান
মামুনের শীতল কন্ঠে সোনালীর হৃৎপিন্ডের গতি তীব্র হয়। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়।হাত-পা কাঁপে থরথর। এই কঠিন মুহূর্তেও মাথা ঠান্ডা রাখে সোনালী।কঠিন পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার অদ্ভূত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা।বড় এক দম নেয় সোনালী।বুকে হাত দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।ক্ষনিকের মাঝে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে মামুনের দিকে ফিরে তাকায়।
_” এভাবে পিছু নেয় মানুষ? ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে।”
সোনালীর কথায় মামুনের কোনো ভাবান্তর হয় না।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন আপনি?”
_” হাম্মামখানায়।আর কোথায় যাব।ওখানে আর কিছু আছে নাকি?”
_” এতো রাতে হাম্মামখানায়?আশ্চর্য! ”
_” কেন? ওখানে খালি দিনের বেলায় যাওয়া যায়?রাতের বেলায় যাওয়ার নিয়ম নেই নাকি?”—খানিকটা কঠিন শোনায় সোনালীর কন্ঠ।
_” না তা বলছি না।কিন্তু এতো সেজেগুজে কে হাম্মামখানায় যায়?আপনার বেশভূষায় রীতিমতো অবাক হচ্ছি আমি।”
আলগোছে নিজের দিকে একবার নজর বুলায় সোনালী।শার্ট-জিন্স-কেডস।চুলগুলো মাথার উপর উঁচু করে বাঁধা।সোনালী যে অন্যকোথাও যাচ্ছিল তা পাগলেও বুঝবে।তবে দমে গেলে চলবে না।যখন আত্মরক্ষার জন্য সহজলভ্য কোনো অস্ত্র থাকে না তখন গলাবাজি করতে হয়।এই নীতিটা সবসময় মেনে চলে সোনলী। এই বিপদের সময়ও সেই মোক্ষম অস্ত্রটাই ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলো সে।গম্ভীর গলায় বললঃ” আপনি কি আজকাল মেয়েদের পোশাক নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেছেন? ”
_” না।কিন্তু চোখের সামনে উল্টা-পাল্টা কিছু দেখলে অবশ্যই আমি প্রশ্ন তুলব।আমার মনে হচ্ছে আপনি অন্যকোথাও যাচ্ছিলেন।”
_” হাম্মামখানা ও কয়েকটা দেওয়াল ছাড়া কি আছে সেখানে?আমাকে ভূত মনে হয় আপনার?দেয়ালের মাঝ দিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাব?তাছাড়া,এই রাত-বিরেতে কোথায় যাব আমি?অথবা,ধরুন আমি অন্যকোথাও গেলাম।তাতে আপনার কি?এখানে আছি আমি।যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতেই পারি।আমরা তো আর এখানে বন্দী নই।আমি দেশের স্বাধীন নাগরিক। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাব ।ইচ্ছে হলে রাতের বেলায় চাঁদ দেখতে ছাদে যাব।আপনার কি হ্যাঁ? আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করার কে?আর প্রশ্ন করলেই কি আমি আপনায় কৈফিয়ত দেব?এতো সোজা-সাপ্টা,লুতুপুতু মেয়ে আমি নই।বুঝলেন?”–একটানা এতোগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে সোনালী।কথার শেষে বড় এক নিঃশ্বাস ছাড়ে।চোরের উপর বাটপারি করতে সে ভালোই জানে।
_” সবই বুঝলাম।কিন্তু লুতুপুতু মানে আবার কি?”
_” জানি না।মুখে এসেছে বলে ফেলেছি।আমি এতো ভাবনা-চিন্তা করে,অর্থ বুঝে কথা বলতে পারি না।আর আপনিই এতো রাতে কি করছেন এখানে?এটা তো আপনার বাড়ি না।এটা আমার ক্রাশের বাড়ি।তাহলে আমিও আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি,আপনি কেন এতো রাতে ঘুরঘুর করছেন?এতো রাতে আপনার কি কাজ?”
মামুন এক-ভ্রু তুলে চেয়ে থাকে কেবল।মুখে কিছুই বলে না।সোনালী আড়চোখে তাকায় একবার মামুনের দিকে।সে বোধহয় মনে মনে কিছু ভাবছে।অথবা সোনালীকে সন্দেহ করছে।এই মামুনকেও দেখতে পারে না সোনালী।খারাপের সাথে কি আর ভালো মানুষ চলে?মামুনও খারাপ।সেও ইউসুফের মতো পঁচা আপেল।সোনালী বিরক্ত হয় খুব।এই লোক এখন আবার কি প্রশ্ন করবে আল্লাহ মালুম।
_” আপনি না হাম্মামখানায় যাবেন?তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান।”
_”এখন আর যাব না।বিরক্ত বানিয়ে ফেলেছেন আপনি আমায়।এতো কথা বলেন আপনি।”
বোকার মতো চেয়ে থাকে মামুন।বিস্মিত কন্ঠে বলেঃ” আমি বেশি কথা বললাম! আমি?আশ্চর্য মানুষ আপনি ছোট্ট মেয়ে।কথা তো বললেন আপনি।বেশি কথা বলে আমার কানের পোকা বের করে ফেলেছেন।”
_” রাস্তা ছাড়ুন।রাত-বিরেতে মেয়েদের পিছু নেওয়া খুবই বাজে স্বভাব।আমি নিতান্ত ভালো মেয়ে বলে কিছু বললাম না।আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে আজকে খবর ছিল আপনার।”
মামুনকে অতিক্রম করার পর হাঁফ ছাড়ে। ভাগ্য ভালো থাকায় আজ ধরা পড়েনি।মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয়।
_” আর কখনো এতো রাতে বাইরে বের হবেন না, ছোট্ট মেয়ে।আর কখনো যাতে না দেখি।কথাটা মনে রাখবেন।”— খুব কঠিন শোনায় মামুনের কন্ঠ।মনে হচ্ছে সে শাসন করছে সোনালীকে।সোনালীর পা থেমে যায়।মুহূর্তেই রাগ উঠে যায় মামুনের কথা শুনে।হারামজাদা বেয়াদব।সবকিছুতে তোর নাক গলাতে হবে কেন ?” মূর্তিমান শয়তান”—বিরবির করে মামুনকে গালি দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে ঘরে চলে যায় সোনালী।তা দেখে মুচকি হাসে মামুন।ডানহাতের মুঠোতে রাখা ছোট্ট কাগজটাকে কয়েক টুকরো করে একপাশে ফেলে দেয়।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আল্লাহর কসম,আপনাকে আমি বাঁচাব ছোট্ট মেয়ে।অন্য কারো জন্য নয়,নিজের জন্য বাঁচাব আপনাকে।জীবনের বাকি সকালগুলো আপনার সাথেই দেখব, প্রিয়তমা। আপনার ও আমার মাঝে কোনো পর্দা নেই।আপনি যেমন আমার সবকিছু জানেন, তেমনি আমিও আপনার সবটাই আমি।আপনাকে আমি পোষ মানিয়েই ছাড়ব।”
বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে থাকে মামুন।শত্রুর সাথে নিজের জীবন জড়াতে চাইছে সে।মামুনের জন্য সোনালীর অপর নাম মৃত্যু। সোনালীকে ছোঁয়া মানে নিজের ধ্বংসকে সাদরে আহ্বান করা।তবুও সেটাই করবে মামুন।হুট করেই সোনালী নামের চোরাবালিতে আটকে গেছে সে।এখানে থেকে উপরে উঠার রাস্তা আছে কিনা তা জানে নেই।জানার ইচ্ছেও নেই।প্রেমের মহাসমুদ্রে ডুবে যেতে চায় মামুন।হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চায় মৃত্যুসম ভয়ংকর কিছু অনুভূতিকে।
***
পেটের ভিতর কেমন যেন শব্দ হচ্ছে।মেঘ ডাকলে যেমন গুড়গুড় শব্দ হয়,ঠিক তেমন।নাভীর কাছটায় ব্যাথা হচ্ছে খুব।তলপেটটা ভারী লাগছে আবার।মনে হচ্ছে একটা বিশাল পাথর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেখানে।তথা দম খিচে শুয়ে রইলো।দু-হাতে আকঁড়ে ধরলো বিছানার চাদর।তবে শেষ রক্ষা হলো না আর।আবার পেট মোচড় দিয়ে উঠলো।মনে হচ্ছে যেন পেটের ভিতর ভয়ংকর এক ভূমিকম্প হচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড পরেই অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল পুরো পেটে। আর সহ্য করতে পারলো না তথা।দূর্বল শরীরের ভার দুটো পায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে বহুকষ্টে ওয়াসরুমে গেল।সকাল থেকে এ নিয়ে পনেরো বার বাথরুমে ছুটতে হয়েছে।তথার শরীর আর চলছেই না।
কাল রাতে মন ভরে নারিকেলের নাড়ু খেয়েছিল তথা।এ বাড়িতে রানাবান্নার কাজ করেন রোকসানা নামের একজন মহিলা।কিভাবে যেন রান্না করেন তিনি। রান্নাগুলো এতো ভালো হয়!প্রতিবেলা খাবার শেষে দশ মিনিট হাতের আঙুল চাটে তথা।মাঝে মাঝে রোকসানা খালার হাতটাও চেটে ইচ্ছে করে তার।কাল রাতে নারিকেলের নাড়ু বানিয়েছিলেন তিনি।নাড়ু তো নয় যেন অমৃত। গোটা বিশেক নাড়ু খেয়েছে তথা। রাতটুকু ভালোই কেটেছে।কিন্তু সকাল হতেই তথার পেটের অবস্থা পাল্টে গেল।ওয়াসরুমে ছুটতে ছুটতে প্রাণ যাওয়ার জোগাড়।এর মাঝে বমিও করেছে বার তিনেক।সব মিলিয়ে তথা এখন চোখে শুধু অন্ধকার দেখেছে।
এবাড়িতে ইউসুফের ঘর ছাড়া আর কোনো ঘরে এটাচড বাথরুম নেই।মেয়েদের জন্য আছে দুইতলার হাম্মামখানা এবং ছেলেদের জন্য আছে নিচ তলার হাম্মামখানা। রুম থেকে বেরিয়ে হাম্মামখানা অবধি যাওয়ার সামর্থ্য নেই তথার। তাই তার ঠাই মিলেছে স্বয়ং আহমেদ ইউসুফের শোবার ঘরে।
টানা পনেরো মিনিট পর বাথরুম থেকে বের হলো তথা।পেটে আর কোনো খাবার নেই বোধহয়।হুড়হুড় করে পানি বেরোচ্ছে কেবল।রুমে পা দিতেই সোনালী ও মালিহাকে চোখে পড়লো তার।সোনালী।চিন্তিত মুখে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, মালিহা স্যালাইন বানাচ্ছে।তথাকে দেখতে পেয়ে সোনালী ছুটে যায় তার কাছে।তথার হাত টেনে ধীরে ধীরে খাটের কাছে নিয়ে আসে।চিন্তিত সুরে বলেঃ ” এ নিয়ে কতবার?”
_” পনেরো।”
_” আল্লাহ! রক্ত-টক্ত যায় নাকি?”
তথা মাথা নেড়ে না বলে।কথা বলার শক্তি ফুরিয়ে গেছে তার।
_” তথা আপু,মাথাটাকে একটু উপরে তুল।একটু স্যালাইন খাও।হা করো দেখি।এই তো আরেকটু, আরেক চুমুক।”
বেশ যত্ন সহকারে তথাকে স্যালাইন খাওয়ায় মালিহা।একটু একটু করে পুরো একগ্লাস স্যালাইন ঢেলে দেও তথার মুখে।স্যালাইন না খেলে শক্তি হবে কেন?
_” তথা আপু,পা সোজা করো।একটু তেল মালিশ করে দেই।ভালো লাগবে।”—কোথা থেকে যেন একটা সরিষার তেলের বোতল জোগাড় করেছে সোনালী।
তথা বিব্রত হয়।ইশারায় মাথা নেড়ে বলে ঃ”প্রয়োজন নেই।”
_” বেশি কথা বলো তুমি।প্রয়োজন নাকি অপ্রয়োজন তা জানতে চেয়েছি আমি?”
জোর করে তথার পায়ে তেল মালিশ করে দেয় সোনালী।মালিহা আলতোহাতে তার চুলে বিলি কেটে দেয়।আরামে ঘুম চলে আসে তথার।এই মেয়ে দুটো না থাকলে কি যে হতো আজ!
_” এক্সকিউজ মি,আমি একটু ভিতরে আসব?”
দরজার বাইরে থেকে ইউসুফের কন্ঠ পেয়ে ত্বড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায় মালিহা।মেয়েটা ইউসুফকে অকারণেই ভয় পায়।সোনালীও উঠে দাঁড়ায়।ইউসুফকে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে।এর ছায়া দেখলেও জ্বিভের আগায় গালি চলে আসে মেয়েটার।সোনালী গলা বাড়িয়ে বলেঃ” তথা আপু এখানে শুয়ে আছে।আপনি একটু পরে আসুন।”
ইউসুফ কিন্তু পাত্তাও দিলো না সোনালীর কথায়।হাতে একটা স্যালাইন ও কিসব ঔষধের বোতল নিয়ে ঢুকে পড়লো ঘরের ভিতর।তার পিছন পিছন মামুনও ঢুকলো।তার হাতে খাবারের প্লেট। সোনালী একবার উঁকি দিয়ে দেখলো। কাঁচকলার খিচুড়ির মতো কি যেন আছে সেখানে। হাতের জিনিসগুলো টেবিলের উপর রেখে সোনালীর দিকে শান্ত চোখে একবার তাকায় ইউসুফ।শক্ত কন্ঠে বলেঃ” এতোক্ষণ ওর খেয়াল রাখার জন্য ধন্যবাদ।আপনাকে আর প্রয়োজন হবে না মিস।আপনি আসতে পারেন এখন।”
_” মানে কি?আপনি এখন থাকবেন এঘরে!”
_” মামুন,খাবারটা এখানে রেখে এদেরকে নিয়ে চলে যাও এখন।মেয়েটা একটু ঘুমাচ্ছে। মিস সোনালীর গলার আওয়াজে ওর ঘুম ভেঙে যাবে।”
সোনালীকে এবারেও পাত্তা দেয় না ইউসুফ।মামুনকে আদেশ দিয়ে তথার ঔষধ-পত্র তৈরি করে।তথার পাশে বসে পড়ে আস্তে করে।
_” চলুন ছোট্ট মেয়ে।এখানে আর কাজ নেই আপনার।”—হতভম্ব সোনালীকে একপ্রকার টেনেটুনে রুম থেকে বের করে মামুন।মালিহা বেরিয়ে গেছে অনেক আগেই।
চোখটা লেগে এসেছিল তথার।খাটের পাশে খুটখুট আওয়াজ পেয়ে চোখ মেলে তথা।হাতের কাছেই ইউসুফকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। তড়িঘড়ি করে উঠতে যেয়ে খাটের পাশের টেবিলের সাথে হাতে ব্যাথা পায়।
_” আস্তে, কামিনী ফুল।”
_” আপনি এখানে কেন? মালিহা,সোনালী কোথায়?”
_” ওদেরকে দিয়ে কি হবে?রোগীর দরকার ডাক্তারকে।তাই আমি আছি।”
_” আপনি ডাক্তার?”
_” পুরোপুরি সার্টিফিকেট পাওয়া ডাক্তার নই।ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলাম।শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাইনি।কাটা-ছেড়া ভালো লাগে না আমার।”
অত্যন্ত অস্বস্তি হচ্ছে তথার। ইউসুফ একদম কাছেই বসে আছে।বড়জোড় আধ-হাতের দুরূত্ব দুজনের মাঝে। তথার দম আটকে আসে।মনে হয় যেন,ইউসুফ নামক কঠিন এক দেয়ালের একপাশে চাপা পড়ে আছে।তথা মাথা উঠানোর চেষ্টা করে।দূর্বল গলায় বলেঃ” আপনি একটু সরে বসুন।”
কপাল কুঁচকায় ইউসুফ। খিচুড়ির প্লেটটাকে কোলের উপর রেখে প্রশ্ন করেঃ” কেন?”
_” অস্বস্তি হচ্ছে আমার।ডাক্তারি করা লাগবে না।আপনি সরুন।আমি এমনিই ভালো হব।”
তথার কথায় কিছুই বলে না ইউসুফ। প্রেয়সীর ঘাড়ের নিচে আলতোভাবে হাত দিয়ে তথাকে বসতে সাহায্য করে।উত্তেজনায় পুরো শরীর কাঁপে তথার।রাগে তার দূর্বল শরীরটা কাঁপে থরথর।নিজের দূর্বল হাত দিয়ে ইউসুফের হাত সরিয়ে দেয় তথা।শীর্ণ কন্ঠে বলেঃ” আপনি এখন এখান থেকে চলে যাবেন।আমার ভালো লাগছে না এসব।”
এবারেও ইউসুফ কিছু বলে না।কোলের উপর থেকে খাবারের প্লেট আবারো টেবিলের উপর রেখে দেয়।তথার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।কয়েক সেকেন্ড পরে হুট করেই তথার কপালে ঠোঁট বুলায় ইউসুফ। তথার হাতদুটো এক হাত দিয়ে আঁটকে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয় প্রাণপ্রিয় রমনীর কপালে।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আনা বেহিবাক,কামিনী ফুল।আনা বেহিবাক।”
কিছুই বুঝতে পারলো না তথা।বুঝার চেষ্টাও করলো না।জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে চোখ বেয়ে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো তথার।পেটের ভিতর আবারো গুড়গুড় করছিল।অনেকক্ষণ যাবৎ একদলা বমি আঁটকে ছিল গলার কাছে।এদিক-ওদিক তাকায় না তথা।চোখ বন্ধ করে বমি করে দেয়।ভাসিয়ে দেয় ইউসুফের গলা ও বুকের একাংশ।
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৮)
#হালিমা রহমান
প্রাণের বন্ধু সাজ্জাদ, তার ছেলের জন্য জিনিয়াকে পছন্দ করেছে বলে তৌকির সাহেব খুব খুশি হলেন।ইরফানকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ তার।ছেলেটা নম্র-ভদ্র,সুন্দর,কর্মঠ।পছন্দ না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।তৌকির সাহেবের রাজকন্যাকে সে ঠিক ভালো রাখবে।তিনি অনেক আগেই ইরফান ও জিনিয়ার বিয়ের কথা সাজ্জাদ সাহেবের কানে দিতে চেয়েছিলেন।তবে মেয়ের বাবা বলে কথা।খুব ইচ্ছা থাকলেও বলতে পারেননি।তার মেয়ে তো সস্তা নয়।সাজ্জাদও খুব ভালো করেই জিনিয়াকে চিনে। ছেলের জন্য উপযুক্ত মনে করলে নিজেই বিয়ের কথা তুলবে।
একটু আগে সাজ্জাদ সাহেব তার বাড়িতে পা রেখেছেন।একা আসেননি অবশ্য।ইরফান ও মেয়ের জামাই শফিককেও বদলদাবা করে নিয়ে এসেছেন।উদ্দেশ্য মেয়ে দেখা। বিয়ের আগে একটু আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে চান তিনি। তৌকির সাহেব মেহমানদারি করতে করতে খুব অস্থির হয়ে পড়লেন।তার মুখের হাসিই বলে দিচ্ছে তিনি কতটা খুশি।ধবধবে সাদা টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে একবার এদিক তো আবার ওদিকে নজর দিচ্ছেন।ঘরের ভিতর যেয়ে স্ত্রীকেও কয়েকবার হুশিয়ার করে দিয়েছেন।নাস্তা যেন ভালো হয়।মেয়ের ঘরে যেয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছেনঃ” আমার সম্মানটা রাখিস মা।”
সাদা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মাথাটাকে নিচের দিকে দিয়ে ভদ্র ছেলে সেজে বসে আছে ইরফান।বাবার সাথে মেয়ে দেখতে এসেছে সে।কিভাবে এসেছে তা জানা নেই।ইরফানের খুব মাথা ব্যাথা করছে।কিছুদিন আগে প্রতিজ্ঞা করেছিল তথাকে আর মনে করবে না,ফোন দেবে না।কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেনি ইরফান।এখানে আসার আগে কয়েকবার ফোন দিয়েছে তথার ফোনে।ইচ্ছে ছিল তথাকে আরো একবার প্রেম নিবেদন করবে।আরো একবার নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবে।হতে পারে ইরফানের অনুভূতি তথাকেও ছুঁয়ে দেবে।মেয়েটা প্রেমে পড়বে ইরফানের।মেনে নেবে ইরফানের প্রথম প্রেমকে।যেভাবেই হোক রাজি করাবে বাবাকে।তারপর দুজনে বিয়ে করবে,প্রেম করবে,স্বপ্নময় কিছু মুহূর্ত কাটাবে,তারপর,তারপর….
এসব কিছুই হতে পারতো। কিন্তু হলো না।ইরফানের স্বপ্নরাজ্য আবারো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেল।একটু আগেও তথার ফোনে কল দিয়েছিল।কিন্তু এবারেও ফোন বন্ধ বলছে।যতবার কল দিলো ততবার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। আশ্চর্য! ওখানে কি নেট নেই? নাকি তথার ফোনে চার্জ নেই?খুব কাজের চাপ বুঝি?ফোন চার্জে দেওয়ারও সময় পায় না।অনলাইনেও দেখা যায় না।কাল রাতে ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ দিয়েছিল ইরফান।তারপর কতোক্ষণ অপেক্ষা করলো। এই বুঝি তথা অনলাইনে আসে।এই বুঝি ম্যাসেজ সিন করে রিপ্লাই দেয়।কিন্তু তথা আসলো না। ইরফানের প্রতীক্ষাই বৃথা গেল।বেশ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফোন-টোন ছুড়ে ফেলে আবারো নতুন করে প্রতিজ্ঞা করলো ইরফান।তথাকে আর কখনো মনে করবে না,ফোন দেবে না, ম্যাসেজ করবে না।তথার সাথে আড়ি, আড়ি,আড়ি।অভিমানে চোখ-মুখ বুজে শুয়ে ছিল ছেলেটা।কিন্তু সকাল হতেই সব ভুলে গেল ইরফান।এবারেও প্রতীজ্ঞা টিকলো না।এখানে আসার আগে আবারো ফোন দিলো মেয়েটাকে।ইরফান ভীষণ নির্লজ্জ, বেহায়া।নাহয় এতোকিছুর পরেও কোনো মেয়ের পিছনে পড়ে থাকে?একবার,দুবার করে বেশ কয়েকবার দেওয়ার পরেও যখন যান্ত্রিক আওয়াজটা ফোন বন্ধ বলল,তখন আবারো আশা ছেড়ে দিল ইরফান।না,এই জীবনে তথা আর ভাগ্যে নেই।
_” আসসালামু আলাইকুম ভাই,ভালো আছেন?”
ইরফানের পাশে ধুপ করে বসে পড়লো একটা ছেলে।ছেলেটাকে চিনে না ইরফান। এই বাড়ির কেউ হবে বোধহয়। কথা বলার ইচ্ছা না থাকলেও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতে হয় ইরফানকে।মুখে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে বলেঃ” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
_” এই তো ভাই, আছি একরকম।আপনিই বুঝি ছেলে?”
কেমন খাপছাড়া প্রশ্ন! বিব্রত হয় ইরফান।মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই ফিচেল হাসে ছেলেটা।নিচু গলায় বলেঃ” মেয়ে দেখেছেন নাকি কখনো? আপনার সাথে কখনোই মানাবে না মেয়েটাকে।আপনি তো শুকনা-শাকনা।কিন্তু মেয়েটা একটু ভারী স্বাস্থ্যের। আপনার সাথে দাঁড়ালে পুরো বড়বোন আর ছোটভাইয়ের মতো লাগবে।”
হতভম্ব ইরফানকে রেখেই উঠে দাঁড়ায় অসভ্য ছেলেটা।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একটা আঙুর মুখে দিয়ে সামনে হাঁটা দেয়।তা চোখে পড়ে তৌকির সাহেবের।তিনি হাঁক দিয়ে বলেনঃ” কোথায় যাচ্ছ,আশিক? ”
_” রান্নাঘরে মামির কাছে যাচ্ছি।জিনিয়াকে নিয়ে আসতে হবে না?কতক্ষণ আর মেহমান বসে থাকবে।”
_” ঠিক আছে যাও।”
কিছুক্ষণ পর চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকে শফিক।গুরুত্বপূর্ণ একটা কল আসায় বাইরে গিয়েছিল সে।ইরফানের পাশে যেয়ে বসতেই নিচু গলায় প্রশ্ন করে ইরফান।
_” শাফিনের কোনো খবর পেলেন, দুলাভাই?”
_” না রে,ভাই।কি একটা অবস্থা বলো তো! আজ তিনদিন যাবৎ কোনো খবর পাচ্ছি না।না ভাইটার, না বোনটার।”
_” এতো ঝুঁকির কাজ করে কেন?গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি না করলেই পারতো।”
আরেকবার শাফিনের ফোনে কল দেয় শফিক।হতাশ গলায় বলেঃ” ওকে কি আর কম বুঝালাম?শাফিনটা খুব গোঁয়ার। যা ইচ্ছে হবে তাই করবে।সাথে জুটেছে আমার চাচাতো বোনটা।দুটো পাগল একেবারে।”
_” ওই যে শাফিনের বয়সী মেয়েটা, সোনালী না নাম?”
_” হুম।তুমি ওকে দেখেছো নাকি?”
_” না।আপার কাছে ওর কথা শুনেছি।”
_” ওহ।দুটোর একটার সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না।বাড়িতে মা কাঁদে,বাবা চিন্তা করে।কি যে করি।”
_” থাক চিন্তা করবেন না ভাই।এরকম মিশনে তো আরো গেছে।কাজ শেষ হলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।দরকার ভেবেই হয়তো ফোন বন্ধ রেখেছে।”
কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে,কপালের সীমানা অবধি আঁচল টেনে, চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ধীরপায়ে ঘরে ঢুকলো জিনিয়া।নিচু গলায় সালাম দিল সবাইকে।সাজ্জাদ সাহেব, তৌকির সাহেব ও শফিক সোজা হয়ে বসলেও ইরফান আগের মতোই মাথা নিচু করে রাখে।কিছু ভাল লাগছে না তার।এতো আয়োজন,এতো আড়ম্বর–সব যেন কাঁটার মতো ফুটছে গায়ে।
_” এখানে বসো, জিনিয়া মা।ভালো আছো তো?”
ইরফানের বিপরীতে যেয়ে বসে জিনিয়া। নিচু গলায় উত্তর দেয়ঃ” জ্বি, আঙ্কেল। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।”
_” চাকরি-বাকরির কি খবর? সব চলছে ঠিকঠাক?”
_” জ্বি।”
তৌকির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেনঃ” সবাইকে চা এগিয়ে দাও ,মা।”
ধীরহাতে চায়ের কাপ সাজ্জাদ সাহেবের হাতে তুলে দেয় জিনিয়া।শফিককেও দেয়।তবে বিপত্তি বাধে ইরফানকে দেওয়ার সময়।মেয়েটা বোধহয় খুব বিব্রত বোধ করছিল।ইরফানের সামনে যাওয়ার সময় তার পা কাঁপলো,হাত কাঁপলো।ফলস্বরূপ কাপের আগুন গরম চা ছলকে পড়লো ইরফানের পায়ের উপর। এরকম এক দূর্ঘটনায় আঁতকে উঠে জিনিয়া।তড়িঘড়ি করে বলেঃ” সরি,সরি আমি ইচ্ছে করে করিনি।”
_” সমস্যা নেই।আমি ঠিক আছি।”
মেয়ের প্রতি খানিক বিরক্ত হন তৌকির সাহেব।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেনঃ” কি করলে এটা, জিনিয়া?”
_” আহ,চুপ কর তৌকির।ও কি আর ইচ্ছে করে করেছে? ইরফান, যাও পানি দিয়ে আসো পায়ে।বেশি লাগেনি তো?”
_” না,বাবা।আমাকে ওয়াসরুমটা একটু দেখিয়ে দিলে ভালো হতো।”
_” আমার সাথে আসুন।”
ইরফানকে সাথে নিয়ে ড্রয়িং রুম ছাড়ে জিনিয়া।আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।দোতলার শুরুর ঘরটাই তার।নিজের রুমে যাওয়ার সাথে সাথে যেন শক্তি ও সাহস বেড়ে যায় মেয়েটার।মাথা থেকে আঁচল ফেলে ফ্যান ছেড়ে দেয়।কাঠের দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে ইরফানের দিকে এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দেয়।মিহি গলায় বলেঃ” আজ খুব গরম পড়েছে,তাই না ইরফান সাদিক?”
কিসের পানি আর কিসের কি?পুরো ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকে ইরফান।এটাই কি কিছুক্ষণ আগের সেই ভদ্র জিনিয়া?হতভম্ব গলায় বলেঃ” দরজা লাগিয়ে দিলেন কেন? দরজা খুলুন। আমি বাইরে যাব।”
দরজা খুলে না জিনিয়া।উল্টো দরজার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। ইরফানের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলেঃ” এখন যাওয়া যাবে না।আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব।মন দিয়ে শুনবেন,ঠিকাছে?”
***
জমিদার বাড়িতে শুটিং চলছে ঢিমেতালে।ডিরেক্টরের ইচ্ছে থাকলে সবাই কাজ করছে আর ইচ্ছে না থাকলে করছে না।এর মাঝে তথার ডায়রিয়া হওয়ার কারণে ঢিমেতালের শুটিংটাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।দেখা গেল ডিরেক্টরসহ বাড়ির মালিকের খুব দরদ তথার জন্য।একজনের ডায়রিয়ায় সবাই যেন মিলেমিশে শোক দিবস পালন করছে। কি বিরক্তিকর একটা ব্যাপার! ইউসুফ বা আখতার হোসেনকে দেখলেই এখন বিরক্ত লাগে পুনমের।একটা মেয়েকে ঘিরে এতো ঢং করার কোনো কারণ আছে?ডায়রিয়া কি ভালো হয় না? একজনের ডায়রিয়া হয়েছে বলে সবাইকে হাত গুটিয়ে ঝিমানো মুরগির মতো বসে থাকতে হবে?দু’দিন যাবৎ এদের ঢং দেখতে দেখতে চোখটা পুড়ে যাচ্ছে পুনমের।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকাল দেখছিল পুনম।এখানে ভাল লাগছে না একদম।কাজটা যে কবে শেষ হবে! কাজটা শেষ হলেই এই বিরক্তিকর ডিরেক্টরের চেহারায় লাথি মেরে বাড়ি চলে যাবে পুনম।এর চাইতে আরো ভালো একটা কাজ পেয়েছিল সে।কিন্তু সাইড ক্যারেক্টার বলে রাজি হলো না।তাছাড়া,ঢাকা থাকতে কত বড় বড় কথা বলেছিল এই হারামজাদা ডিরেক্টর। তুমি একবার আমার সাথে কাজ করো,ক্যারিয়ার গড়ে দেব,নাটকটা অন এয়ার হওয়ার পরে ডিরেক্টরা তোমার পিছু ঘুরবে,তুমি অভিনয়ের জন্য একদম পার্ফেক্ট —এরকম হাজারটা কথা বলেছে আখতার হোসেন।এখন কি হচ্ছে? কোনো কাজ হচ্ছে এখানে?বাড়িতেও কথা বলতে পারছে না,ফোনটা চুরি হলো।সবাই নিশ্চয়ই খুব্ল দুশ্চিন্তা করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনম।কবে যে বাড়ি যাবে!
_” পুনম, কি করছো এখানে দাঁড়িয়ে? ”
চন্দ্রানীর কথায় ধ্যান ভাঙে পুনমের।স্নিগ্ধ আকাশের দিকে চোখ রেখে বলেঃ” কিছু না।কিছু করার আছে এখানে?”
_” সেটাই।আমার মেজাজটা পুরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।এদের কান্ড-কারখানা দেখছো?”
_” তুমিই দেখ।আমার গা জ্বলে এসেব দেখলে।”
ঠোঁটে করুণ হাসি ফুটিয়ে তুলে চন্দ্রানী।মলিন স্বরে বলেঃ” তুমি তো তাও ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পেরেছো,আমি তো তাও পারিনি।এখানে না আসলেই ভালো হতো।”
_” এসব বলে আর লাভ আছে?”
_” হুম।আচ্ছা, ওই তথা নামের মেয়েটা কি খুব বড় মাপের কেউ?ওর জন্য কেমন ব্যতিব্যস্ত সবাই।”
_” জানি না।স্টুপিডটার নাম নিয়ো না তো।ওই হারামজাদীর নাম শুনতেও বিরক্ত লাগে এখন।”
_” আমারো।মনে হয় না একমাসের মাঝে কাজ শেষ হবে।”
_” কাজের আশা বাদ দাও।ওই যে আহমেদ ইউসুফের চ্যালাটা আবারো ইউসুফের ঘরের দিকে যাচ্ছে।ওই ফাজিল মেয়েটা তো ওই ঘরেই শুয়ে আছে মনে হয়।”
_” হ্যাঁ। একটু আগে ইউসুফকেও দেখলাম ওই ঘরেই ঢুকলো।এদের কি চোখের চামড়া নেই? কিভাবে পারছে এমন? লোকটাও কেমন যেন।কোনো বাছ-বিচার নেই।”
_” লজ্জা থাকলে আর এমন করতে পারতো?সন অফ এ পিগ।মেয়েটারও কোনো লজ্জা নেই।যখন-তখন আরেক ছেলে ঘরে ঢুকবে কেন? মেয়েটার ইন্টারেস্ট না থাকলে এতো সাহস পায়?আমি তথার জায়গায় থাকলে জুতোপেটা করে ছেড়ে দিতাম।”
চন্দ্রানী আর কিছুই বলে না।ইউসুফের আচরণ অতিমাত্রায় চোখে লাগছে সবার।তথার কষ্টে যেন সে মরে যায় একদম।অসহ্য! এতো ঢং যে এরা কোথায় পায়।
***
আলমারিতে টি-শার্ট খুঁজছিল ইউসুফ।ঘরের মাঝে রাখা বিশাল খাটে ঘুমিয়ে আছে তথা।তথা ঘুমিয়ে থাকলেই কেবল এঘরে আসে ইউসুফ।জেগে থাকলে আসে না।কারণ জেগে থাকলে তথা মাথাটাকে নিচু করে রাখে।কাল রাতে স্যালাইন দিতে হয়েছে। স্যালাইন দেওয়ার সময়ও চোখের পাতা টিপে জোর করে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।একবারো চোখ মেলে ইউসুফের দিকে তাকালোই না।ইউসুফ কতরাত পর্যন্ত প্রেয়সীর পাশে বসে ছিল! স্যালাইন শেষ হওয়ার পর ঘুমাতে গেছে।এতো এতো ঘন্টার মাঝে তথা একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না।কি নিষ্ঠুর! সেদিন প্রেম নিবেদন করতেই কিভাবে বমি করে ভাসিয়ে ফেললো! ভাবতেও শরীর ঘিনঘিন করে ইউসুফের। শুধু তথা বলে সহ্য করেছে।অন্য কেউ হলে খবর ছিল।দু’দিনের ডায়রিয়ায় শরীরের অর্ধেক শক্তি ফুরিয়ে গেছে তথার।ওকে এখন একটা নেতানো ফুলের মতো দেখা যায়।
_” আসব স্যার?”
তথা ঘুমিয়ে থাকায় মামুনকে ঘরে ঢুকার আদেশ দিলো না ইউসুফ। নিজেই দু’ পা এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
_” কিছু বলবে নাকি?”
_” জ্বি,স্যার।আজ রাতে কিছু প্রোডাক্ট আসবে।”
_ ” আজকে?রিভলবার তো আজ আসার কথা নয়।”
_” রিভলবার না ড্রাগস।ঢাকা থেকে আসছে।”
_” গোডাউনটা পরিষ্কার না?”
_” কয়েকটা ছুড়ি দেখলাম স্যার।আর কিছু নেই।ছুড়িগুলো কাজে লাগবে কোনো?”
একপেশে হাসি হাসে ইউসুফ।মাথা নেড়ে বলেঃ” হ্যাঁ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ সাড়ব ওগুলো দিয়ে।ওগুলোকে কিছু করো না।”
_” ওকে স্যার।আপনি কি থাকবেন আজ?”
_” হ্যাঁ। কখন আসবে?”
_” রাত বারোটার দিকে।”
_” বাড়ির সামনেই থাকব আমি।তুমিও থেকো সময়মতো ”
_” ওকে স্যার।”
মামুনকে বিদায় করে আবার ঘরে আসে ইউসুফ।কি সুন্দর মাথার নিচে একটা হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে! লোভ সামলাতে পারে না ইউসুফ।টুপ করে চুমু দেয় তথার কপালে।
***
তথার খুব বড় অসুখ হয়েছে।কিন্তু সে কাউকে বলছে না।সবসময় বুক ঢিপঢিপ করে,গাল লাল হয়ে যায়,হাত-পা কাঁপে। ইউসুফকে দেখলেই এমন হয়। কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার!
নিজের উপর এতোদিন শতভাগ বিশ্বাস ছিল তথার।একশভাগ নিশ্চিত ছিল বিয়ের আগে কোনো প্রেম করবে না,কোনো ছেলে তার সংযমের বাঁধ ভাঙতে পারবে না।সব ঠিকঠাক চলছিল।কিন্তু সেদিনের চুমুটাই সব এলোমেলো করে দিল।বিদ্যুতের মতো ইউসুফের ঠোঁটের স্পর্শ তথার কপালে পড়লো আর সাথে সাথে সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল।তথা কিছু বলতেই পারলো না ইউসুফকে।ইউসুফ সামনে আসলেই গলার স্বর আঁটকে আসে।বোবা হয়ে যায় তথা।আজকে বিকেলেও যখন চুমু দিল,তখনও তথা জেগেই ছিল।কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না।ইদানিং ইউসুফ সামনে আসলেই অসার হয়ে যায় তথা।চোখ বন্ধ করে রাখে।লোকটার অদ্ভূত সুন্দর মুখের দিকে তাকাতেই পারে না।তথা মনে হয় ইউসুফের প্রেমেই পড়েছে।অকারণেই প্রেমে পড়েছে সে।অবশ্য প্রেমে পড়তে কোনো কারণ লাগে না।হাতের কাছে কাজ না পেলেই মানুষ প্রেমে পড়ে।
_” কি খবর,হাগুকন্যা? একা একা হাসছো কেন? ”
_” খবর ভাল। কিন্তু হাগুকন্যা আবার কেমন নাম?”
তথার পাশে ধপ করে বসে পড়ে সোনালী।ফিচেল হেসে বলেঃ” পেট পাতলা মেয়েদেরকে আমি হাগুকন্যাই বলি।”
_” আমার পেট টাইট এখন।এইসব নাম আমার সাথে যায় না।”
_” হ্যাঁ, যেই হারে স্যালাইন দিল,সেবাযত্ন করলো–ভালো না হয়ে উপায় আছে?”
উদাস হয় তথা।উদাসমনে বলে ঃ” হ্যাঁ, লোকটা খুব কেয়ারিং।খুব যত্ন নেয় আমার।ভালোই লাগে।”
_” এই তথা আপু,কি হয়েছে তোমার?প্রেমে -টেমে পড়লে নাকি?”
_” কি জানি! আহমেদ ইউসুফকে ইদানিং খুব ভালো লাগে আমার।সে আমায় চুম্বকের মত টানে আমায়।
উত্তেজনায় উঠে বসে সোনালী।হতভম্ব গলায় বলেঃ” কি বলো এসব? পাগল তুমি? মানুষ এভাবে কিভাবে প্রেমে পড়তে পারে? তোমার ব্রেইনটা হাগুর সাথে বেড়িয়ে গেছে নাকি?”
চলবে…