ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -১৯+২০+২১

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৯)
#হালিমা রহমান

আজকে খুব গরম পড়েছে।একদম ঘাম ঝড়ানো গরম।কার্তিকের শুরুতে এতো গরম পড়ে?কে জানে! আবহাওয়ার দিকপাল খুঁজে পাওয়া যায় না এখন।ইরফান শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দেয়।গরম লাগছে খুব।ছোট হোটেলের একপাশে কাজ করছিলো সোনাই।ওকে ডাক দেয় হাত নেড়ে।

_” এই সোনাই,এদিকে আয়।”

দৌড়ে আসে সোনাই।বিনয়ী ভঙ্গিতে বলেঃ” কিছু লাগব ভাই?”

_” ফ্যানটা আরেকটু বাড়ায় দে তো ।”

_” আর বাড়ব না, ভাই।এর স্পিড কম।”

_” ধুর।তাইলে আমাকে একগ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়া।আছে নাকি?”

মাথা চুলকায় সোনাই।ইতস্ততভাবে বলেঃ” আসলে এইটাও নাই ভাই।”

_” তাইলে তোর ভাইরে একগ্লাস ঠান্ডা কোকাকোলা খাওয়া।এইটা আছে? “__ইরফানের বদলে রাফায়েত ফরমায়েশ দেয়।
রাফায়েতের প্রশ্নে ইতিবাচকভাবে মাথা নাড়ায় সোনাই।ব্যস্ত গলায় বলেঃ” এখনি দিতাছি, ভাই।”

সোনাই একছুটে চলে যায়।রাফায়েত আবারো বিরিয়ানীর প্লেটে হাত দিলেও ইরফান দেয় না।ভাবলেশহীন চোখে সামনের রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে।ওই যে ওখানে,ঠিক ওখানে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো তথা।ভার্সিটি বা টিউশনি থেকে ফেরার পর এই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার কিনতো।আর ইরফান হোটেলের ভিতর এককোনে বসে চুপিচুপি প্রেয়সীকে দেখতো।কি সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো! স্বপ্নময় অদ্ভূত সুন্দর কিছু মুহূর্ত ছিল।আজও সব আছে শুধু তথাই নেই।মোটে আট-নয়দিন হয়েছে তথাকে দেখে না ইরফান।অথচ মনে হয় যেন কত বছর,কত যুগ কেটে গেছে। আচ্ছা তথা কি আগের মতোই আছে?এখনও কি ছেলেদের সাথে কথা বলার সময় কপাল কুঁচকে ফেলে? খুশি হলে মুচকি হাসে?কিছুক্ষণ পরপর কপালের একপাশে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলোকে অবহেলায় কানের পাশে গুজে দেয়?কে জানে!
তথা যাওয়ার পর থেকে এদিকে এতোদিন আসেনি ইরফান।অবশ্য সময় কোথায়?তাছাড়া, ভালোও লাগে না এদিকে আসতে।সবটা কেমন যেন খালি খালি লাগে।আজ রাফায়েতের কথায় এসেছে। শুক্রবার বলে আসতে পেরেছে,নাহয় অন্যদিন হলে তাও পারতো না।

_” ইরফান, মেয়ে কেমন দেখলি?”

বিকালের কথা মনে পড়তেই মুহূর্তে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ইরফানের।কপাল কুঁচকে বলেঃ” তুই কার কাছে শুনলি?”

_” আঙ্কেলের কাছে।বিয়ের দাওয়াত পাব নাকি?”

_” না।ওই মেয়ে বিবাহিত।”

_” কি!”—রাফায়েতের হাতের লোকমা পড়ে যায় প্লেটে।অবাক চোখে চেয়ে থাকে সে বন্ধুর দিকে।

ইরফান ভাবলেশহীনভাবে বলেঃ” মেয়ের জামাই আছে।ওর ফুফাতো ভাই আশিকের সাথে বিয়ে হয়েছে পনেরো দিন আগে।”

_” মানে কি! বিয়ে হলে আবার তোরা দেখতে যাবি কেন?মেয়ে যে বিবাহিত তা তোদেরকে বলেনি আগে?”

বিরক্তিতে তেতো হয়ে যায় ইরফানের ভিতরটা।এই ছেলের মাথায় কি বুদ্ধি নেই?মেয়ের বাবা জানলে কি আর ওদেরকে মেয়ে দেখতে দিতো?

_” জিনিয়া পালিয়ে বিয়ে করেছে।আত্মীয়ের মাঝে আত্মীয় পছন্দ করেন না তৌকির আঙ্কেল।তাই পালিয়ে বিয়ে করেছে দুজনে।”

_” জামাই কি করে?”

_” বিদ্যুৎ অফিসে চাকরি করে।”

_” তো পরিবারকে জানাবে কবে?”

_” আমি কি এতোকিছু জানি রাফাইত্তা?আমারে মেয়ে ঘরের মধ্যে আটকে এতোটুকুই বলেছে।বলেছে ওকে জোর করে বিয়ে করলে, পরেরদিনই জামাইয়ের সাথে পালিয়ে যাবে।মানে চিন্তা কর,কেমন আক্কেল মেয়ের।ও বিবাহিত জানার পরেও আমি জোর করে বিয়ে করব! আমি কি সিনেমার হিরো যে জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে করব?বেয়াক্কেল মেয়ে।ইচ্ছে করেছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে চলে আসি।ফাজিল কোথাকার।”

ইরফানের কথা শুনে খাওয়া রেখে কুটকুট করে হাসে রাফায়েত।এক চুমুক পানি খেয়ে বলেঃ” কি ব্যাপার, ইরফান? মেয়েরা তোকে শুধু রিজেক্ট করছে কেন?বাংলাদেশের মেয়েরা তোকে বয়কট করলো নাকি?”

রাফায়েতের কথা বুঝতে পারে না ইরফান।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” মানে?”

_” সুন্দর,স্মার্ট,কর্মঠ ইরফান সাদিক খালি রিজেক্টই হচ্ছে।আজকে তাকে রিজেক্ট করলো জিনিয়া, কিছুদিন আগে তথা।আল্লাহ মালুম আর কতো মেয়ে তোকে রিজেক্ট করার জন্য বসে আছে।”

বাম পায়ের চটি জুতো খুলে রাফায়েতের হাঁটুর দিকে উড়িয়ে মারে ইরফান।নিচু গলায় রাফায়েতকে কিছু অশ্রাব্য গালি দেয়।ছেলেটার মুখের ভাষা মাশাল্লাহ রেকর্ড করে রাখার মতো।শুনলে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

_” ভাই,এই যে ঠান্ডা।”

_” রাখ এখানে।”—সোনাইকে ফরমায়েশ করতেই ইরফানের চোখে পড়ে মাহাদীকে।সোনাইয়ের দিকেই আসছে সে।

_” সোনা ভাই,দুই প্যাকেট বিরিয়ানি দিয়ো তো।আর্জেণ্ট লাগবে।একটু তাড়াতাড়ি দিয়ো।”

মাহাদীর মুখটা কেমন শুকনো ঠেকছে।মোটাসোটা ছেলেটার চোয়াল ভেঙে গেছে। চোখদুটোর নিচেও একটু কালির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।মাহাদীর পরিবর্তন খট করে চোখে বাজে ইরফানের ।যেচে মাহাদীর সাথে কথা বলে সে।

_” কি খবর ছোট ভাই? শরীর ভাল?”

এতোক্ষণ হয়তো ইরফানকে চোখে পড়েনি মাহাদীর।ইরফানের কথা শুনতেই বিনয়ী ভঙ্গিতে সালান দেয় সে।

_” আসসালামু আলাইকুম, ভাই। ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?”

_” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। এই চেয়ারটাতে বসো। বাড়ির সবাই ভালো আছে?”

চেয়ার টেনে বসতে বসতে মলিন মুখে মাথা নাড়ে মাহাদী।

_” না,ভাই।আম্মু অসুস্থ।রুবি আপাও অসুস্থ।”

_” কি হয়েছে?”

_” রুবি আপার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে।অপারেশন করতে হবে।এই টেনশনে মা আজ দুইদিন যাবৎ অসুস্থ। বিছানা থেকে শরীর উঠাতে পারে না।”

_” আহা রে।কান্নাকাটি করে লাভ আছে?আন্টিকে শক্ত হতে বলো।”—-রাফায়েতের সহানুভূতির কন্ঠ কানে আসে।

_” সবাই বুঝায়।কিন্তু আম্মু বুঝেই না।তথা আপুর চিন্তায়ও আম্মু অর্ধেক শেষ।”

_” কেন কি হয়েছে তথার?কোনো বিপদ নাকি?”—ইরফানের অস্থির কন্ঠ কানে আসতেই মনে মনে হাসে রাফায়েত।
হায়রে ইরফান! এ আর মানুষ হলো না।

_” তথা আপুর খবর পাচ্ছি না আমরা।যতবার ফোন দেই, ততোবার শুধু ফোন বন্ধ দেখায়।”

ইরফানের ভিতরটা তেতো হয়ে আসে।হৃৎপিন্ডে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প হলো যেন।কি বললো মাহাদী?ফোন বন্ধ দেখায়? হ্যাঁ, সত্যিই তো ফোন বন্ধ তথার।কাল রাতে, আজ সকালে,বিকালে কতবার কল করলো ইরফান।প্রতিবার সেই ঘ্যানঘ্যানে যান্ত্রিক স্বরটা একই কথা বলেছে।ইরফান উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করেঃ” কবে থেকে ফোন বন্ধ পাচ্ছো?আমিও আজকে ফোন দিলাম, কিন্তু প্রতিবার বন্ধই বললো।”

_” আম্মুর সাথে শেষ কথা হয়েছিলি সেই দুই তারিখে।এরপর আর কথা হয়নি।তথা আপুর যেই ডিরেক্টর,উনি নাকি খারাপ লোক।আমাদের গ্রামের তো,আম্মু চিনে।আম্মু তথা আপুকে বলছিল ঢাকা চলে আসতে।আপু কথা শুনে নাই।পরে আম্মু রাগারাগি করে কল কেটে দিয়েছিল। পরেরদিন থেকে আর যোগাযোগ করতে পারেনি।আম্মু সকালবেলা থেকে যতবার কল করেছে ততোবার ফোন বন্ধ বলেছে। এখন পর্যন্ত ফোন বন্ধ।”

_” ডিরেক্টর যে খারাপ,এটা আগে জানতো না?”

_” আম্মু মনে হয় ডিরেক্টরের নাম শুনে নাই আর।শুনলে যেতে দিতো না।”

_” তোমার বাবা কি বলছে? উনি কি পঞ্চগড় যবেন নাকি?তথার তো খোঁজ নেওয়া দরকার।বিপদ-টিপদও হতে পারে।”

_” রুবি আপু অসুস্থ না থাকলে হয়তো যেতো।আম্মুও অসুস্থ, আপুও অসুস্থ। আব্বু কি করে যাবে?”

কথায় যুক্তি আছে।ইরফানের মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে।বিপদ না হলে এতোদিন যাবৎ কারো ফোন বন্ধ হয়?তথার বিপদই হয়েছে।নিশ্চিত গুরুতর কোনো বিপদ হয়েছে।ইরফানের হাসফাস লাগে।শ্বাস আটকে আসে।ইরফানের সর্বস্ব জুড়ে একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে_মেয়েটা ভালো নেই,একটুও ভালো নেই।

_” মাহাদী,এই নেও।”

মাহাদী উঠে দাঁড়িয়ে খাবারের প্যাকেট হাতে নেয়।পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ” আসছি, ভাই।আসসালামু আলাইকুম।”

_” ওয়া আলাইকুম আসসালাম।”

মাহাদীর গমন পথের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ইরফান। মাথাটা ধরে গেছে মুহূর্তেই। আচ্ছা তার এখন কি করা উচিত?পঞ্চগড় যাওয়া উচিত না?অবশ্যই যাওয়া উচিত। সে তো তথার একনিষ্ঠ প্রেমিক।সে না গেলে কে যাবে?কার এতো দায় পড়েছে যে তথাকে খুঁজতে সেই পঞ্চগড় ছুটে যাবে?ঠান্ডা খাবারের প্লেটটাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয় ইরফান।পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।রাতটুকু কখন শেষ হবে?

_”ইরফান,ইরফান।”

_” হুম।”

_” টেনশন করিস না।তথার কোনো বিপদ হয়নি।”

_” আল্লাহ তোর কথা কবুল করুক।”

_” হ্যাঁ, তুই চিন্তামুক্ত থাক।বিপদের আশঙ্কা থাকলে নিশ্চয়ই তথার কাকা নিজে মেয়ের খোঁজে যেত।তাই না?ইরফান,ইরফান।”

_”হু?কি বলছিলি?”

রাফায়েত বিরক্ত হয়।ইরফানের কানে কি কথা ঢুকছে না?মুহূর্তের মাঝেই কেমন অমনোযোগী হয়ে গেল।হতচ্ছাড়া বদমায়েশ কোথাকার।রাফায়েত বিরক্ত মুখে বলেঃ” বলছি তুই চিন্তামুক্ত থাক।যাদের মেয়ে তারাই টেনশন করুক। ”

_” তাদের চিন্তার আশায় আমি বসে থাকব?তুই আমাকে চিনিস না?”

_” কি করবি তুই?”

চেয়ারে হেলান দেয় ইরফান।নির্দ্বিধায় বলেঃ” আমি কাল শ্যামলী থেকে হানিফ পরিবহনের একটা বাসে উঠব।তারপর পঞ্চগড় যাব তথার খোঁজে।ডাহুক নদীর কাছেই একটা জমিদার বাড়ি আছে।তথা সেখানেই আছে।তুই যাবি নাকি,ডাহুক নদীর তীরে? ”

***

রাত পৌনে বারোটা বাজে।শহরাঞ্চলে এটা খুব বেশি রাত নয়।কিন্তু গ্রামের জন্য এই রাত পৌনে বারোটাই অনেক কিছু।সারাদিনের খাটাখাটুনির পর মানুষগুলো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে।কার্তিকের শুরু হওয়ায় রাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়ে।খুব সকালে কুয়াশার মতো একটু ঘোলাটে দেখায় সবকিছু।এই সময়টা খুব ভালো লাগে মামুনের।খুব ঠান্ডাও না,খুব গরমও না।ফুল স্পিডে ফ্যান ছেরে কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকার মজাই আলাদা এখন।
রাতের স্বপ্নময় সুখনিদ্রাকে বয়কট করে, জমিদার বাড়ির পিছন দিকে হাঁটছে মামুন।ভারী কেডসের নিচে শুকনো পাতা ভাঙে মরমর করে।আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার।একটুখানি চাঁদ আছে আকাশে তবে খুব বেশি আলো নেই।ডানপাশে ফেলে আসা আমগাছের নিচু ডালে একটা পেঁচা বসেছিল।সেদিকে নজর দেয় না মামুন।অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে চলে আরো সামনে।জমিদার বাড়ির পিছনে অনেক গাছ।আম,জাম,করমচা,কাঁঠাল,অর্জুন,ঝাউ,দেবদারু
ইউক্যালিপটাস —কি নেই সেখানে।বিশাল বিশাল বয়স্ক গাছ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।
মামুনের নাকে ভেসে আসে তীব্র হাসনাহেনার ঘ্রাণ।কোথায় যেন একটা গাছ হয়েছে।রাতেরবেলা বেশ ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আশেপাশের কোনোকিছু বিচলিত করতে পারে না মামুনকে।দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে যায় অর্জুন গাছের কাছে।অর্জুন গাছের সামনে চার দেয়ালের একটা জীর্ণ ঘর আছে।দেয়াল ফাটা,দরজায় মরচে ধরা তালা ঝুলানো।মামুন সেই ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।এটাই সেই জায়গা, যেখানে জমিদার বংশের সবাইকে গনকবর দেওয়া হয়েছে।তবে পুরো জায়গাটা এখন সমতল।আহমেদ ইউসুফ পরবর্তীতে এই জায়গাটাকে কবরস্থানের মতো যত্ন করতে পারতো।কিন্তু করেনি।দেখা গেল তার কোনো আগ্রহই নেই এ বিষয়ে। মামুন পকেট থেকে ফোন বের করে ইউসুফের ফোনে কল দেয়।দু’বার রিং হতেই ফোন ধরে ইউসুফ।

_” বলো মামুন।”

_” আপনি কি এখন আসবেন স্যার?”

_” হ্যাঁ। ট্রাক এসেছে?”

_” না স্যার।”

_” আচ্ছা।আসছি আমি।দশ মিনিট সময় লাগবে। ”

_” ওকে স্যার।”

ফোন রেখে দেয় মামুন।পকেট থেকে চাবি বের করে।গোডাউনটা এখানেই।মামুন এদিক-ওদিক হালকাভাবে চোখ বুলায়।আশেপাশে অন্ধকারে বেশি কিছু চোখে পড়ে না।তবে উপরে তাকালে নিশ্চিত অবাক হতো মামুন।কারণ,নারিকেল গাছের উপর থেকে একজোড়া তীক্ষ্ম চোখ চেয়ে আছে তার দিকে।

***

মোবাইলটা পকেটে পুরলো ইউসুফ।ট্রাউজারের পকেটে রিভলবারটাও ঢুকিয়ে নিলো।দরজা খুলে বের হওয়ার আগে আয়নায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। ঠিক তখনই। তখনই দরজার ঠকঠক আওয়াজ হল।মৃদু আওয়াজ।ইউসুফ অবাক হয়।এ সময় আবার কে এলো?
দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই আকাশ থেকে পড়ে ইউসুফ।তথা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।পরনে ধবধবে সাদা রঙের সুতির শাড়ি। চুলগুলো ছেড়ে রাখা।ইউসুফের পেটে ডান হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দেয় তথা।আদুরে স্বরে আবদারের ভঙ্গিতে বলেঃ” চাঁদ দেখতে যাবেন?আকাশে আজ কাঁচির মতো একফালি বাঁকা চাঁদ জেগেছে।দেখবেন?
নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে….”

গুনগুন করে গান গেয়ে ভিতরে ঢুকে তথা।তথার আচরণ বুঝে আসে না ইউসুফের।হতভম্ব গলায় বলেঃ” আপনি ঠিক আছেন, কামিনী ফুল?”

_” উঁহু। আমার কঠিন অসুখ হয়েছে।একদম মরণ অসুখ।এক হাতুড়ি ডাক্তারের উপর পা পিছলে গেছে। এখন কি করি বলুন তো?”#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২০+২১)
#হালিমা রহমান

ইউসুফ খুব সহজে ঘাবড়ায় না।সে বেশ শক্ত-পোক্ত লোক।শরীরের দিক দিয়েও,মনের দিক দিয়েও।তবে এই নিঝুম রাতে সে ঘাবড়ে গেছে।ঘাবড়ে গেছে নিতান্ত সহজ-সরল এক বাঙালি মেয়ের সামনে।ইউসুফের দু’হাত সামনেই তথা দাঁড়ানো।মাথা নিচু করে দু আঙুলে শাড়ির আঁচল পেচাচ্ছে।মাঝে মাঝে হাসছেও মিটমিট করে।রাতদুপুরে ধবধবে সাদা শাড়ি আর ছেড়ে রাখা চুলে তথাকে একদম পরীর মতোন লাগছে।মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে এক সাদা পরী নেমে এসেছে ইউসুফের ঘরে।এসেছে এই নিস্তব্ধ রাতে এক মধুর আবদার নিয়ে।
ইউসুফ ঢোক গিলে। গলা শুকিয়ে আসছে।মনের মাঝে হাজার হাজার নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগেছে সেই কখন! কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।ডান হাতের উল্টো পিঠে তা মুছে নেয় ইউসুফ।চোখ বন্ধ করে বড় এক দম নিয়ে মনকে শাসন করে।এখন কোনো তিড়িং-বিড়িং করা যাবে না।আগে তথাকে বুঝতে হবে,ওর কথা শুনতে হবে,তারপর যা করার করতে হবে।তথার শরীর থেকে ভেসে আসছে তীব্র জেসমিনের ঘ্রাণ। ঘ্রাণে দম বন্ধ হয়ে আসে ইউসুফের। কামিনী ফুল এই পাগল করা পারফিউমটা কেন যে গায়ে মাখে!

_” আপনি কি যাবেন না?”

গলা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করে ইউসুফ। মিনমিন করে বলেঃ” আপনার কথা আমি কিছুই বুঝত্ব পারছি না,কামিনী ফুল।”

_” হাহ!”—বিরক্তির শ্বাস ফেলে ইউসুফের খাটে যেয়ে পা ঝুলিয়ে বসে তথা।মুচকি হেসে বলেঃ” রোগীর কপালে চুমু দিতে পারেন,রোগী ঘুমিয়ে থাকলে চুপিচুপি ঘরে ঢুকেন,আর এখন এতো সহজ কথা বুঝতে পারছেন না?আশ্চর্য! ”

_” রোগী তো ঘুমিয়েই ছিল। তাহলে কি করে বুঝলো, ডাক্তার চুপিচুপি তার ঘরে ঢুকেছে?”

_” আপনার রোগী ভীষণ স্মার্ট।দুর্বৃত্ত চিনতে ভুল করে না।ডাক্তার দুর্বৃত্তের মতো ঘরে ঢুকবে, তারপর কপালে চুমু দেবে আর আমি বুঝব না! এটা কি সম্ভব?”

_” আপনি জেগে ছিলেন?”

_”জ্বি।এখন আর কোনো কথা নয়।চলুন না চাঁদ দেখতে যাই।ঢাকায় এরকম খোলামেলা পরিবেশে চাঁদ দেখা যায় না।যাবেন না আমার সাথে?”

মোহাবিষ্টের মতো তথার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যায় ইউসুফ।তথার সামনে পৌঁছে হাঁটুগেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।গলায় একরাশ আবেগ ঢেলে বলেঃ” আমার কামিনী ফুল যা বলবে তাই হবে।কিন্তু তার আগে বলুন,এই এতো রাতে আমার ঘরে আসতে আপনার ভয় করলো না?”

_” উঁহু। সাহেবের উপর আমার ভরসা আছে।”

_” এতো ভরসা?”

_” হুম,এতো ভরসা।”—দু’হাত দুইদিকে প্রসারিত করে নির্ভরতার পরিমাপটুকু বুঝিয়ে দেয় তথা।তা দেখে মুচকি হাসে ইউসুফ।খাটের উপর কনুই রেখে, হাতের তালুতে মাথা ঠেকায়।কৌতুকের সুরে বলেঃ” কামিনী ফুলের পা কিভাবে হাতুড়ে ডাক্তারের উপর পিছলে গেল ?”

_” হাতুড়ে ডাক্তার দুর্বৃত্তের মতো আমার ঘরে ঢুকলো।তারপর চুপিচুপি মন্ত্র পড়ে আমার কপালের ঠিক মাঝখানে দুটো চুমু দিল।চুমুটা মন্ত্রপুত ছিল।তাই সাথে সাথেই আমার পা পিছলে গেল।এখন তাকে ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না।কি একটা অবস্থা বলুন তো?”

_” হ্যাঁ, খুব ভয়ংকর অবস্থা।এখন কি করা যায়?”

_” কি জানি! এটা তো সেই হাতুড়ে ডাক্তার জানে।তার রোগী সে কিভাবে ভালো করবে, সেটা সে জানে।আমি তো কিছু জানি না।”—- মুখ টিপে হাসে তথা।
ইউসুফের খুব খুশি খুশি লাগছে।নিঃসন্দেহে আজকের রাতটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত।এতো সহজেই তথা প্রেমে পড়বে জানলে চুমু দুটো আরো আগেই দিত।এখন কি করা উচিত ইউসুফের?তথাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরা উচিত না?হ্যাঁ তাই করা দরকার।এতো ভালো একটা কথা বললো তথা।প্রেম মেনে নিলো।একটু উদযাপন তো করাই যায়,তাই না?

_” এভাবে ফ্লোরে বসে আছেন কেন? উঠুন।”

_” আমার খুব ভালো লাগছে।”

_” এই ভালো লাগায় রাত পাড় করে দিলে খবর আছে আপনার।আজ চাঁদ না দেখতে গেলে আপনার সাথে আর কথাই বলব না।”

উঠে দাঁড়ায় ইউসুফ।ট্রাউজারের পিছনে ঝাড়তে ঝাড়তে বলেঃ” দূর আকাশের চাঁদ এতো সাধ করে দেখার কি আছে?আপনার সাহেবের চেহারাটাই তো মাশাল্লাহ চাঁদের মতো সুন্দর।এই খাটের উপরে বসে আমাকেই আরাম করে দেখুন।”

_” ভন্ডামি বাদ দিয়ে চলুন।নেহাৎ এই বাড়িতে ভূত আছে বলে,নাহয় এতোক্ষণে আমি নিজেই যেতাম।”—তথাও খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।সুতি শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দেয়।

প্রেয়সীকে মন ভরে দেখে ইউসুফ।মেয়েটা যা পরে তাতেই ভালো লাগে।এই যে এখন সাদা রঙে কি সুন্দর পবিত্র দেখাচ্ছে!একদম একটা ফুটন্ত কামিনী ফুলের মতো দেখাচ্ছে।ইউসুফ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে।তথার দিকে দু’ পা এগিয়ে যেয়ে বলেঃ” আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরি, কামিনী ফুল?একটুখানি ধরব। এই এতোটুকু।”— এক আঙুলের মাথায় আরেক আঙুল দিয়ে পরিমাপ দেখায় ইউসুফ।

তথা কিন্তু প্রশ্রয় দেয় না।বাম হাতে ইউসুফের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে নিজেই একপা পিছিয়ে যায়। নরম গলায় বলেঃ” এখন না।সময় হোক।আমি আগে বৈধ হতে চাই।আমার সাহেবের বৈধ বেগম।এখন এই এতোটুকু স্পর্শই আমার শরীরে কাটার মতো ফুটবে।আগে বিয়ে হোক।”

_” তবে চলুন কামিনী ফুল, কালকেই বিয়ে করি।আমার প্রাণ বাগিচার ফুলটা হৃদয়রানী হোক।আমার ঘর আলো করা আদুরে বেগম হোক।”

_” ইশ! আপনি এতো কিপ্টা কেন? এভাবে বিয়ে করে খরচ বাঁচানোর চিন্তা করছেন, তাই না?এভাবে চলবে না।আমি পুরান ঢাকার মেয়ে।ওখানের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।”

_” কিরকম?”

_” বিয়ের আগে অনেক অনুষ্ঠান আছে।ওগুলো সব পালন করতে হবে।আমার কাকা-কাকির কাছ থেকে আমাকে চেয়ে আনতে হবে।ওই যে আগের দিনের রাজপুত্ররা যেভাবে ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজকন্যাকে আনতে যেতো,ঠিক সেভাবে আপনার রাজ্যে আমাকে আনতে হবে।পারবেন না?”

ইউসুফ মাথা নুইয়ে মুচকি হাসে।আবেগী গলায় বলেঃ” কামিনী ফুলের জন্য আমার জান কোরবান।।আর এ তো কিছুই না।আপনি যা বলবেন তাই হবে।আমার কামিনী ফুলকে রানীর মতো ঘরে তুলব।”

_” আল্লাহ কবুল করুক।এখন চলুন তো।দেরি হয়ে যাচ্ছে।আমরা কিন্তু নদীর তীরে যেয়ে চাঁদ দেখব।”

_” এতো দূরে!”

_” দূর কোথায়?ডানপাশের রাস্তাটা দিয়ে মাত্র সাত মিনিট লাগে।আপনার ভয় করছে নাকি?”

_” হাহ! আহমেদ ইউসুফ ভয় পাওয়ার বান্দা না।আমি নিজেকে নিয়ে কখনোই ভয় করি না।”

_” আচ্ছা,চলুন তবে।”

তথা দরজার দিকে পা বাড়ায়।পিছনে ফিরে ইউসুফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেকেন্ডের মাঝে আবারো পা থামিয়ে ফেলে।বিরক্তির সুরে বলেঃ” আবার কি?”

_” আপনি বাইরে দাঁড়ান,কামিনী ফুল।আমি দু’মিনিটেই আসছি।”

_” ঠিক আছে, জলদি আসুন।”

তথা বেরিয়ে গেলে ইউসুফ আরেকবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। সিল্কি চুলগুলোতে আরেকবার চিরুনি চালায়।গায়ে মাখে পারফিউম। সবকিছুই নিজেকে আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।প্রেমিকার সাথে প্রথমবারের মতো কোথাও যাচ্ছে।একটু সাজ-গোজ না করলে হয়?

ইউসুফ ফোন বের করে মামুনকে কল দেয়।মামুন কল ধরলে নিচু গলায় বলেঃ” আমি আজকে আসতে পারব না, মামুন।তুমি ম্যানেজ করতে পারবে না?”

_” পারব স্যার।তাহলে আমি প্রোডাক্টগুলো গোডাউনে ঢুকিয়ে ফেলব?”

_” হ্যাঁ। ট্রাক এসেছে?”

_” মাত্র আসলো।”

_” কেউ আশেপাশে ছিলো না তো?”

_” না,স্যার।”

_” ওকে।গুড লাক।”

_” মি. ইউসুফ,আমি কিন্তু চলে যাচ্ছি।”—বাইরে থেকেই তথার চওড়া গলা শোনা যায়।ইউসুফ তাড়াতাড়ি ফোন পকেটে রেখে বেরিয়ে পড়ে।দরজায় বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিয়ে বলেঃ” আসছি তো।এতো অধৈর্য্য হলে চলে?”

_” আমি এমনই, চলবে?”

_” দৌড়াবে।চলুন কামিনী ফুল,চন্দ্র বিলাসে যাই।”

নিজেদের মাঝে দু-হাতের তফাৎ আনে তথা।মাথায় দেয়া আচঁলটাকে কপালের দিকে আরেকটু টেনে দেয়।তারপর পা মেলায় ইউসুফের সাথে।

***

_” এদিকে রাখো জিনিসগুলো।হ্যাঁ, এদিকটায়।দরজার একটু কাছে রেখো।”

ট্রাক ড্রাইভারের সাথে আরো দুজন কর্মচারী এসেছে ঢাকা থেকে।এরাও ইউসুফের এজেন্ট।আজকে অনেকগুলো ড্রাগস এসেছে ঢাকা থেকে।এতোগুলো বাক্স গোডাউন পর্যন্ত টেনে নিতে বেশ কষ্ট হবে মামুনের।মামুন ইউসুফের উপর একটু বিরক্ত।আজকে কাজের চাপ আর আজকেই উনি আসবেন না।আশ্চর্য! সবকিছু একজনের উপর ফেলে রাখলে চলে?

জীর্ণ ঘরের পিছনেই একটা বিরাট অর্জুন গাছ। মামুন চলে যায় সেদিকে।ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দরজার তালা খুলে। এটাই গোডাউন।এই ঘরটার সামনে একটা দরজা,পিছনে একটা দরজা। পিছনের দরজাটাই ব্যবহার করা হয়।তাই সামনের তালায় মরচে ধরা।পিছনের দরজাটা অর্জুন গাছের কাছে না গেলে দেখা যায় না।তাই সোনালীর চোখে এই দরজাটা সেদিন পড়েনি।দরজাটা চোখে পড়লেই সে বুঝতে পারতো,এ বাড়িতে কোনো গুপ্তঘর নেই।আছে অযত্নে পড়ে থাকা স্যাতস্যাতে এক গোডাউন।

***

দোতলার বারান্দা ধরে দ্রুতপায়ে হাঁটছে শাফিন।
জুতো খুলে হাতে নিয়েছে। পুরো শরীর চুলকাচ্ছে তার।নারিকেল গাছে দম খিচে বসে ছিল এতোক্ষন।গাছে কি ছিল কে জানে!গলা, বুক,দুহাতের তালু জ্বলছেও। গলার কাছটায় চুলকাতে চুলকাতে সোনালীর ঘরে ঢুকে শাফিন।দরজা খোলাই ছিল।শাফিন ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।একছুটে চলে যায় সোনালীর কাছে।বুক অবধি কাঁথা টেনে দিয়ে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।শাফিন খাটের কাছে যেয়ে ফ্লোরে বসে।সোনালীর মাথায় দু আঙুল দিয়ে বিলি কেটে বলেঃ” এই সোনালী,সোনালী। ওঠ,সোনালী।আর ঘুমাস না।ঘুমাতে এসেছিস এখানে?এই,এই।”

ঘুম পাতলা হওয়ায় জাগতে খুব বেশি সময় লাগে না সোনালীর।চোখ খুলে শাফিনের মুখ দেখেই লাফ দিয়ে উঠে বসে।আশেপাশে নজর বুলিয়ে তথাকে খোঁজে। সদ্য ঘুম ভাঙা গলায় বলেঃ” তুই এখানে কেন?তথা আপু কই?”

_” রিল্যাক্স।দম ফেল।তথা আছে।”

_” তুই ওখানে কিভাবে আসলি?তুই কি পাগল শাফিন্না?পাশের ঘরটাই ইউসুফের।তুই ভুলে গেছিস?বলদ।”

শাফিন বিরক্ত হয়ে সোনালীর চুল টেনে দেয়।গলায় বিরক্তি নিয়ে বলেঃ” ইউসুফ শালার পো প্রেম করতে গেছে।ঘরে নেই।এই সুযোগেই এসেছি।”

_” প্রেম করতে গেছে মানে?”—অবাক হয় সোনালী।পাশে নজর বুলিয়ে তথার জায়গাটা খালি দেখতেই শাফিনের কথার মানে বুঝতে পারে।খিটখিটে গলায় বলেঃ” তথা এতো বেয়াক্কেল কেন? গাধা কোথাকার।একটা গুন্ডার সাথে রাতদুপুরে প্রেম করতে গেছে। ব্রেইনলেস স্টুপিড।”

_” বলদের মতো কথা বলিস না সোনালী।তথার সাথে ইউসুফ প্রেম করতে গেছে বলেই আমি এখানে আসতে পেরেছি।নাহয় আসতে পারতাম?তথা বরং ভালো কাজই করছে।ওরা প্রেম করুক,আমরা শান্তিতে আমাদের কাজ করি। ”

_ ” তবুও আমার গা জ্বলে।”

_” মানুষের কথা বাদ দে।এখন আমার কথা শোন।এ বাড়িতে কোনো গুপ্তঘর নেই।বাড়ির পিছনে একটা অর্জুন গাছ আছে।তুই ওইদিন একটা ঘরের কথা বলেছিলি না?”

_” হ্যাঁ। ”

_” ওই ঘরটাই গোডাউন।ঘরের পিছনে একটা দরজা আছে। ওই দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকে।আমি একটু আগে মামুনকে ঢুকতে দেখলাম।”

_” তুই পিছু নিয়েছিলি?”

_ ” নারিকেল গাছে বসে ছিলাম।সেখান থেকেই দেখেছি।আমার সামর্থ্য এতোটুকুই ছিল। এবার তোর কাজ।ওখানে তোকেই ঢুকতে হবে।মামুনের কাছে চাবি আছে।কিভাবে জোগাড় করবি তা তুই জানিস।”

শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেলে সোনালী।বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলেঃ” খালি প্রমান,প্রমান আর প্রমান।এতো প্রমাণ ধুয়ে পানি খাবে উপরমহল। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।কেন তোরা এখন কোনো স্টেপ নিতে পারিস না?এতোদিন আমরা ওদের সাথে যোগাযোগ কর‍তে পারছি না।অথচ দেখ তো, হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের খোঁজে কেউ এলো?মানে আমরা বেঁচে থাকি বা মরে যাই তাতে ওদের কোনো মাথাব্যাথা নেই।কাজ হতেই হবে।যত্তসব!”

_” বোকার মতো কথা বলিস না সোনালী। দুবছর আগেও আমরা চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রমাণের অভাবে ইউসুফকে ধরতে পারিনি।নাকের ডগা দিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। ওর হাত কত লম্বা তা জানিস না?ইউসুফ কোনো স্টেপ না নেওয়া পর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারব না।আর প্রমাণ ছাড়া ওকে আটকানো তো দূরের কথা একরাতও জেলে রাখতে পারব না।বুঝলি?”

সোনালী কিছুই বলে না।চুপ করে থাকে।পুরো বিষয়টা ও নিজেও বুঝতে পারছে।কিন্তু কেন যেন এবাড়িতে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না।নিজের বাড়িতে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে।কতোদিন বাড়ি যাওয়া হয় না! বাবা-মায়ের সাথে কথাও হয় না।সোনালীর শরীরটাও ইদানীং ভালো যায় না।প্রতি রাতে জ্বর আসে।ভিতরে আবার কি অসুখ বাধলো কে জানে! প্রথম প্রথম খুব আগ্রহ থাকলেও, এখন আর এসব কাজ ভালো লাগে না। কবে এখানের কাজ শেষ হবে?কবে সোনালী বাড়ি যেতে পারবে?অসুস্থ শরীরে এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না।

( পর্ব-২১)
চাঁদের আলোয় নদীটাকে কেমন যেন অপার্থিব লাগছে। নদীর পাড়ের স্নিগ্ধ বাতাসে তথার মন জুড়িয়ে যায়।মাথায় টেনে দেওয়া আঁচলটা পড়ে গেছে অনেক আগেই।বাতাসে তথার লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়,শাড়ির আঁচল উড়ে ।তথা ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দেয়।মনে মনে কয়েকটা গানের সুর বাজছে।এই নিঝুম রাতে গলা ছেড়ে গান গাইলে কেমন হয়?

ইউসুফ অপলক চোখে চেয়ে থাকে প্রাণপ্রিয় রমনীর দিকে।সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে।আচ্ছা,এটা সত্যিই তথা তো?বিশ্বাস হয় না।তথা এতো সহহে প্রেমে পড়লো! এতো সহজেই স্বীকার করে নিলো ইউসুফের বশ্যতা! সত্যিই কি সবটা এতো সহজ?হতেও পারে।প্রেমে পড়ার কোনো কারণ লাগে?উঁহু। জীবনের পঁয়ত্রিশতম বসন্তে যদি ইউসুফ প্রেমে পড়তে পারে,তবে তথা কেন পারবে না?তার তো সবে একুশ চলছে।বয়সটাই তো প্রেমে পড়ার।এক পশলা বসন্ত হাওয়া ছুঁয়ে দেয় ইউসুফের হৃদয়। জীবন এতো সুন্দর কেন?এই আকর্ষনীয় রমনীর সাথে আরো অনেক বছর বাঁচতে চায় ইউসুফ।গুনে গুনে একশ বছরের আয়ু প্রার্থনা করে মনে মনে।ইউসুফের ঝুলিতে খুব বেশি মিষ্টি অনুভূতি জমা নেই।তথার সাথে সব ধরনের মিষ্টি মধুর অনুভূতি অনুভব করতে চায় ইউসুফ।ছুঁয়ে দিতে চায় নাগালের বাইরে থাকা অস্পর্শ সুখগুলোকে।ডজন ডজন আদুরে সকাল, স্নিগ্ধ বিকাল অথবা দীর্ঘ রাত যাপন করতে চায় শুধুমাত্র এই মেয়েটার সাথে।ইচ্ছে-পূরণ কি হবে না?অবশ্যই হবে। অসম্ভব নামের কোনো শব্দ হয় নাকি?সব সম্ভব।ইচ্ছে থাকলেই সব জয় করা যায়।
ইউসুফ চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকায়।একটুখানি বাঁকা চাঁদ।দেখতে ভালোই লাগছে।ইউসুফ চোখ ঘুরিয়ে তথার দিকে তাকায়।দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে।ইউসুফ শান্ত গলায় প্রেয়সীকে ডাকে।

_” কামিনী ফুল ।”

_” হুম”

_” চাঁদটা সুন্দর,তাই না?”

_” হুম।অনেক সুন্দর। ”

_” আমার চাঁদটা আরো সুন্দর।ওই দূর আকাশের ছোট্ট চাঁদের চাইতে বেশি সুন্দর। ”

অকারণেই খিলখিল করে হাসে তথা।কৌতুকের সুরে বলেঃ” বাতাসে প্রেমের গন্ধ পাচ্ছি।কি ব্যাপার সাহেব?খুব বেশি সিনেম্যাটিক হয়ে যাচ্ছে না সব?অনেক বাংলা ছবি দেখেন নাকি?”

_” জীবনেও দেখিনি। হুট করে কথাটা মাথায় আসলো তাই বলে ফেললাম।আমার কাছেও খুব সিনেম্যাটিক লাগলো।হাহ! আহমেদ ইউসুফও আজকাল প্রেমিকার রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমান্টিক কথা বলে।কি দিনকাল যে আসলো।সত্যি করে বলুন তো আপনি কি জাদু জানেন?”

_” হুম জানি।আমি ভয়ংকর সব ম্যাজিক জানি।পুরুষদেরকে ভেড়া বানিয়ে রাখতে পারি, পাগল বানিয়ে পিছু পিছু ঘুরাতে পারি,আত্মসম্মানবোধ চুষে নিতে জানি।আমি এক ছদ্মবেশী ভয়ংকরী।আমার থেকে দশহাত দূরে থাকুন,সাহেব।”

_” আমি এই ভয়ংকরীকেই চাই।প্রতিটা সেকেন্ডে,প্রতিটা নিঃশ্বাসে,প্রতিটা মুহূর্তে চাই।”

তথা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।ইউসুফের কথার বিপরীতে কিছুই বলে না।বেশ কয়েক সেকেন্ড নিরব থাকার পর নরম গলায় বলেঃ”জানেন, আপনি আমার দেখা দ্বিতীয় পাগল প্রেমিক।”

ইউসুফ কপাল কুঁচকে ফলে।পকেটে দু-হাত গুজে প্রশ্ন করেঃ” দ্বিতীয়? ”

_” হুম।”

_” প্রথমজন কে?”

_” আমাদের এলাকার কাউন্সিলরের ছেলে,ইরফান।ওনার মতো ছেলে আজকাল দেখাই যায় না।”

_” আমার কামিনী ফুলকে খুব বেশি ভালোবাসতো?”

_” হয়তো এখনো বাসে।আমি আসার আগে বাস স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে।আমি সেদিন তাকে কাঁদতে দেখেছি।একজোড়া টলটলে চোখ সেদিন বুঝিয়েই ছাড়লো,মানুষটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।আগে ভাবতাম তার ক্ষ্যাপাটে আচরণগুলো হয়তো সাময়িক মোহ।কিন্তু সেদিন বাস স্টেশনে মানতেই হলো,আমি ইরফানের সাময়িক মোহ নয়।দীর্ঘদিনের লালন করা অনুভূতি।”

ইউসুফ বিরক্ত হয়। নিজের প্রেমিকার মুখে আরেক পুরুষের ভালোবাসার কথা শুনতে ভাল লাগে?বিরক্তি নিয়ে বলেঃ” আমার আর ভালো লাগছে না, কামিনী ফুল। আপনি অন্য কথা বলুন।”

_” আমারো আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।ঘুম পাচ্ছে খুব।রাত কত হলো?”

_” দেড়টা বাজে।”

_” দেড়টা! এতো সময় এখানে কাটিয়েছি! বাড়ি চলুন মি. আহমেদ।প্রেমের প্রথম দিন হিসেবে আমরা অনেকটাই সাহস দেখিয়ে ফেলেছি।এতোটা উচিত হয়নি।”

তথা হাঁটা ধরলেও পা চালায় না ইউসুফ।ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

_” কি হলো চলুন।যাবেন না এখন?”

_” আমার কাছে এখনো সবটা স্বপ্নের মতো লাগছে,কামিনী ফুল।মনে হচ্ছে রাত পেরোলেই সব মিলিয়ে যাবে।”

ইউসুফের দিজে দু’পা এগিয়ে যায় তথা। পাশে দাঁড়িয়ে নির্ভরতার সুরে বলেঃ”কোনোটাই স্বপ্ন নয়।সব সত্যি।আমি ছিলাম,আছি। ভবিষ্যতে থাকব কি না তা আল্লাহ জানে।ভবিষ্যত তো আর আমি বলতে পারব না।”

_” আপনি ভবিষ্যতেও থাকবেন।আল্লাহ আপনাজে কোথা থেকে সৃষ্টি করেছে,জানেন?”

_” উঁহু। ”

_” এই যে এই জায়গা থেকে। এই ইউসুফের বাম পাজরের হাঁড় থেকে।আপনি আমার ভাগ্যে থাকবেনই থাকবেন।আপনার স্থান এই ইউসুফের মাঝেই। মিলিয়ে নিয়েন কথাগুলো।”

_” আচ্ছা।আমিও সেই আশায় রইলাম।দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়।”

***

ফজরের আজান দিয়েছে ঘন্টাখানেক আগে।এর মাঝেই ইরফানের সবকিছু গোছানো শেষ।রাতটুকু কিভাবে কাটিয়েছে, তা জানে না ইরফান।ছোট একটা ট্রাভেল ব্যাগে কয়েক সেট জামা-কাপড় ভরে নিয়েছে।আর নিয়েছে ব্রাশ,পেস্ট,দড়ি আর একটা ধারালো ছুড়ি।ইরফান তো আর বেড়াতে যাচ্ছে না।যাচ্ছে প্রেমিকাকে খুঁজতে। এমনও তো হতে পারে,সেখানে বিপদ আছে।তাই আত্মরক্ষার জন্য কিছু জিনিস নিয়ে নেয়াই ভালো।গোসলটাও সেড়ে ফেলেছে ইরফান।প্যান্টের পকেটে হাজার ত্রিশেক টাকা ও দুটো ফোন ভরে নিলো।কখন কি দরকার পড়ে তা তো বলা যায় না।সবকিছু আগে থেকে ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নেওয়াই ভাল।
শার্ট গায়ে চাপিয়ে নিচে নামতেই মায়ের সাথে দেখা।
ইরফান কপাল চাপড়ায়।ভেবেছিল কাউকে কিছু না বলেই যাবে।কিন্তু এতো সকালেই মায়ের সাথে দেখা হবে,তা ভাবেনি ইরফান।

ইরফানকে এতো সকালে এই বেশে দেখে চমকে যান খালেদা বানু।হাতের তজবি টেবিলের উপরে রেখে অবাক গলায় বলেনঃ” এতো সকালে কই যাও, আব্বা?”

_” ট্যুরে মা।”—সকাল সকাল একটা মিথ্যে বলে জ্বিভ কাটে ইরফান।কিন্তু কিছু করার নেই।এখন সত্যিটা কিছুতেই বলা যাবে না।

_” ট্যুরে! এহন!”

_” জ্বি,মা।সাজেক যাব তো। তাই সকাল সকাল বেরোচ্ছি।”

_” আগে তো কও নাই।”

_” কালকেই ঠিক হলো, মা।তাই বলার সময় পাইনি।তুমি প্লিজ বাবাকে বুঝিয়ে বলো।বাবা হয়তো রাগ করবেন।”

_” কিন্তু,কথা হুনো বাবা…

দাঁড়ায় না ইরফান।মায়ের পাশ কেটে বাইরে চলে যেতে যেতে বলেঃ” এখন সময় নেই,মা।পৌঁছে কল দেবনি।চিন্তা করো না,মা।ভালো থেকো।আমিও ভালো থাকব।”

সত্যিই কি ইরফান ভালো থাকবে?যদি তথা ও ইউসুফের প্রেম কাহিনীর নগ্ন উত্থান ইরফানের চোখের সামনে ঘটে।যদি তথা-ইউসুফের সুখী মুখগুলো ইরফানের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়,তথা এখন অন্যকারো।কোনো ইরফান নামক পাগলকে নিয়ে ভাবার সময় তার নেই।তখন কেমন হবে? ভাবনার বিষয় বটে।

তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় ইরফান।বাস ধরতে হবে শ্যামলীতে। যদি রাস্তায় জ্যাম পড়ে! যদি দেরি হয়ে যায়! এই চিন্তা করেই খুব সকালে বাড়ি ছাড়ে ইরফান।যেভাবেই হোক,পঞ্চগড় পৌঁছাতেই হবে।তথার খোঁজ নিতেই হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here