ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -২২+২৩

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২২)
#হালিমা রহমান

ঘরের জানলায় দুটো পাখি বসেছে।ছোট্ট দুটো চড়ুই পাখি।পুরোনো দেয়াল থেকে খুটে খুটে কি যেন খাচ্ছে পাখি দুটো।জানলার ওপাশেই একটা বিশাল আমগাছ।আমগাছের একটা বিশাল ডাল জানলা ছুঁয়েছে।সেখান থেকে তিনটে বড় পাতা ছিঁড়ে নেয় সোনালী।আমপাতা দিয়ে সে খুব সুন্দর করে তালা বানাতে পারে।ছোটবেলায় এই গুণ থাকায় অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না তার।শাফিন কতদিন পিছু পিছু ঘুরেছে।সকাল-বিকাল সোনালীর কাছে তালা বানানোর পদ্ধতি শিখতে চেয়েছে।কিন্তু শেখায়নি সোনালী।কেন শেখাবে?শাফিনও যদি শিখে যায়, তবে সোনালী আর পাত্তা পাবে? সোনালী -শাফিন মাত্র সাতাশ দিনের ছোট-বড়।শাফিন বড়,সোনালী ছোট।দুজনের শৈশব,কৈশোর কেটেছে একসাথেই।দুজনের মাঝে ভাই-বোনের সম্পর্কের চাইতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বেশি।শাফিন কোন মেয়ের সাথে হাঁটছে,কথা বলছে,কার সাথে কতদিনের জন্য সম্পর্কে জড়াচ্ছে– এসব খবর যেমন সোনালী জানে, তেমনি সোনালীর কখন মার্কেটে যায়,বাড়ি থেকে পালিয়ে ট্যুরে যায়, ইভটিজিংয়ের অপরাধে কোন ছেলের হাত ভেঙেছে সোনালী,কোন ছেলের পা ভেঙেছে—এসব খবর শাফিনের নখদর্পনে। পেটে পেটে খাতির দুজনের।এ কারণে বাড়ির লোকে বহুবার দুটোকে ধরে-বেঁধে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।এক্ষেত্রে শাফিনের বিশেষ কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও সোনালীর তীব্র আপত্তি ছিল।শাফিন একইসাথে ভাই ও বন্ধু।সোনালীর সব সমস্যা সমাধান কে করে?শাফিনই তো।একটু এদিক-ওদিক হলে কার চুল টেনে ছিঁড়ে সোনালী? সেটাও শাফিনের।শাফিন ভাই। ভাই মানে ভাই।ভাইয়ের সাথে আবার বিয়ে কীসের?হোক সে চাচাতো ভাই।দু-জনের মাঝের সম্পর্কটা তো আর দশটা সাধারণ ভাই-বোনের মতো নয়।শাফিনকে স্বামীর আসনে কল্পনা করতেই গা ঘিনঘিন করে সোনালীর।শাফিন হয় ভাই নাহয় বন্ধু।স্বামী কখনোই নয়।তাছাটা,বিয়ের পর হয়তো শাফিন আধিপত্য বিস্তার কর‍তে চাইবে সোনালীর উপর।সম্পর্কটা আর আগের মতো থাকবে না।সোনালীর ব্যবহার,দুষ্টুমি আর আগের আগের মতো সহ্য করতে পারবে না শাফিন।ঝগড়াঝাটি হবে দুজনের মাঝে।কথা বলবে না একে অন্যের সাথে। তখন কি হবে?সোনালী এসব সহ্য করতে পারবে?উঁহু, কখনোই না।

স্নিগ্ধ সকালের আকাশে তেজহীন সূর্য।জানলা গলে একফালি সরু সোনালী রঙা আলো সগর্বে ঘরে ঢুকেছে। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সোনালীর আধ-ভেজা চুল ছুঁয়ে দেয়।সোনা রঙা আলো লুটোপুটি খায় কমলার কোয়ার মতো নরম তুলতুলে ঠোঁট দুটোতে।মেয়েটা সুন্দর।স্বাভাবিকভাবে যতটুকু সুন্দর হলে মানুষের চোখে পড়া যায়, ঠিক ততোটুকুই সুন্দর সোনালী। অবশ্য এখানে যারা এসেছে তাদের সবাইকে সুন্দরীদের দলেই ফেলা যায়।সুন্দর না হলে আহমেদ ইউসুফের এখানে আসতে পারতো ?
কিছু মানুষ আছে যাদের সঠিক বয়স আন্দাজ করা যায় না।বয়স হলেও চেহারায় শেষ কৈশোরের ছাপটা থেকেই যায়।সোনালীকে সেই দলে ফেলা যায়।ঊনত্রিশের ঘরে পা দিলেও মেয়েটাকে ঠিক অষ্টাদশী কিশোরীর মতো দেখায়।খুব সহজে বয়স বোঝা যায় না।এ কারণেই তথা,মামুনসহ এখানের সবাই ওকে খুব ছোট ভাবে।গুনে গুনে আটবছরের বড় হওয়ার পরেও হাঁটুর বয়সী মেয়ে তথাকে আপু ডাকতে হয়।হাহ! কি একটা অবস্থা।

সোনালী জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকায়।ঠান্ডা লেগে গেছে হঠাৎ করেই।গলা ভেঙে গেছে।নাক বন্ধ হয়ে আসে।জ্বিভ তেতো হয়ে আছে। মাঝরাতের দিকে জ্বরও এসেছিল।ভোররাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়েই গোসল করতে হয়েছে সোনালীকে।ঘর্মাক্ত শরীরে থাকতে পারে না সে।কেমন যেন ঘিনঘিন করে শরীর।ঢাকায় যেয়েই ভাল একটা ডাক্তার দেখাতে হবে।শরীরটার যে কি হলো! এই বিপদের মাঝেই অসুস্থ হতে হলো?ভালো লাগে না আর।

চোখে রোদ লাগায় ঘুম ভেঙে যায় তথার।কাল খুব রাত করে ঘুমিয়েছে। তাই সকাল সকাল উঠতে পারেনি আজ।হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতেই চোখ পড়ে সোনালীর উপর।জানলায় মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পিছন থেকেই ডাক দেয় তথা।

_” সোনালী”

_” হুম।”

_” কয়টা বাজে?”

_” সাড়ে দশটা বোধহয়। ”

_”আল্লাহ এতো বেলা হয়ে গেছে! মরার ঘুম ঘুমিয়েছিলাম।কিছুই বলতে পারি না।”—মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলে তথা।শরীরে ওড়না চাপিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।চুলগুলোকে হাত খোঁপা করতে করতে ঘর থেকে বেরোনোর উদ্যোগ নিতেই,পিছু ডাকে সোনালী।

_” তথা আপু,একটা কথা বলব?”

_” হুম, বলো।”

_” তুমি যা করছো তা কি ঠিক?”

সোনালীর কথা ঠিক বুঝতে পারে না তথা।কপাল কুঁচকে বলেঃ” কিসের কথা বলছো?”

_” কাল রাতে তুমি ঘরে ছিলে না।তুমি বোধহয় আহমেদ ইউসুফের সাথে ছিলে, তাই না?তুমি ঘরে ফিরেছো ঠিক মাঝরাতে।আমি কি ভুল?”

_” উঁহু। ঠিক ধরেছো।আমি কালকে ইউসুফের সাথেই ছিলাম।আমাদের মাঝে কালরাতে অনেক কথা হয়েছে। জানো,ইউসুফ আগে থেকেই আমাকে ভালোবাসতো।আমারও ওনাকে ভালো লাগে।তাই রাখ-ঢাক করে আর লাভ কী?কাল রাতে প্রেম নিবেদন করেই ফেললাম।বিষয়টা সুন্দর,তাই না?”— একটু লাজুক দেখায় তথার মুখ।

সোনালী কোনো উত্তর না দিয়ে বিরক্ত চোখে চেয়ে থাকে।একটা মানুষ কিভাবে এরকম হুট করেই প্রেমে পড়তে পারে? আশ্চর্য! প্রেম কি আম-জাম যে গাছ থেকে পাড়লাম আর খেয়ে ফেললাম? তারপরেই প্রেম হয়ে গেল। কি অদ্ভূত! তাছাড়া কি দেখে ইউসুফের প্রেমে পড়লো তথা? সৌন্দর্য?হ্যাঁ এটাই হবে।সৌন্দর্য ছাড়া আর কি আছে ওই হারামজাদার? মনের সৌন্দর্য তো একটুও নেই।এখানের সবচেয়ে খারাপ লোকটার প্রেমে পড়েছে তথা।সে কি বুঝতে পারছে কত বড় ভুল করেছে?মাশুল কি দিতে হবে না?অবশ্যই হবে।ভুলের মাশুল দিতে তার প্রাণটাই না বেরিয়ে যায়।

_” তথা আপু,এতোরাতে একটা পরপুরুষের ঘরে যাওয়া উচিত হয়নি।দিনকাল ভাল না এখন।তোমার সাথে কাল খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো।”

_” আরে না পাগল,বিশ্বাস না থাকলে কি যেতাম?ওনাকে আমি খুব বিশ্বাস করি।আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওনার কাছেই আমি পুরোপুরি নিরাপদ।”

মুহূর্তেই বিরক্তে তামা তামা হয়ে যায় সোনালীর মেজাজ।কত বলদ মেয়েটা! এতো কনফিডেন্স নিয়ে নিরাপত্তার কথা শোনাচ্ছে সোনালীর কাছে।ইউসুফের কাছে নাকি ও নিরাপদ! ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে। “নিম্ন জাতের গাধা”–মনে মনে গালি দেয় তথাকে।

_” শোনো তথা আপু,আজকাল মেয়েরা নিজের ঘরেই নিরাপদ না।আর তুমি অচেনা জায়গায় এসে অচেনা এক ছেলের কাছে নিজেকে নিরাপদ ভাবছো?কতটুকু চেনো ইউসুফকে? এই আট-নয় দিনের সাক্ষাতেই একদম জীবন -মরণ প্রেম হয়ে গেল তোমাদের?তা কিসের প্রেমে পড়লে?আহমেদ ইউসুফের রূপের নাকি টাকার?”

স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। তথার কানে খট করে বাজে সোনালীর বলা শেষ কথাটি।মুহূর্তেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। শক্ত গলায় বলেঃ” তোমার জ্বিভ সামলাও সোনালী।মুখ খুললেই যদি এতো নিম্নমানের কথা বেরোয় ,তবে মুখটা বন্ধই রাখো।তোমার এসব থার্ডক্লাস কথা শোনার পর আমার কি ইচ্ছে করছে জানো?ইচ্ছে করছে দু গালে ঠাস ঠাস করে চারটে চড় মারি।কিন্তুও মারব না।কারণ তোমার মতো এতোটা নিচে নামতে পারিনি এখনো।আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে হবে না তোমায়।আমি কোথায় নিরাপদ,আর কোথায় অনিরাপদ তা তোমার চাইতে ভালো বুঝি।”

ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যায় তথা।সোনালী তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে।নেহাৎ তথাকে তার ভালো লাগতো বলে সাবধান করতে গিয়েছিল। কিন্তু এমন হবে জানলে কখনোই পরোপকারের নাম মাথায় আনতো না।আবার জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সোনালী।তথা মরুক বা বাঁচুক তাতে কিছুই যায় আসে না সোনালীর।সোনালী তো সাবধান করার চেষ্টা করেছিল,তথা যে ভুল করছে তার একটুখানি ইঙ্গিত তো দিয়েছিল।এর বেশি আর কি করা যায়? ” তুই মরবি তথা”– জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আপনমনে বিরবির করে সোনালী।

***

_” ওই যে দেখ,আমার পাগল আশিক আসছে।”—- হাতের ইশারায় মামুনকে দেখায় সোনালী।

শাফিন ভ্রু কুঁচকায়।গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” পাগল আশিক মানে?তোকে পছন্দ করে?”

_” হুম।অনেক পছন্দ করে।”

_” তুই কি করে জানলি?”

_” মানুষের ভাব-ভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায়।আজকে সকালে আমি গোসল করে ঘরে যাচ্ছি,তখনই আমার সাথে দেখা।গলার স্বর শুনেই বুঝলো ঠান্ডা লেগেছে।এই ঠান্ডা নিয়ে এতো সকালে গোসল করা উচিৎ নয়,এ নিয়ে দশ মিনিট লেকচার দিলো।তারপর আবার আমার ঠান্ডা কমানোর জন্য নিজের জ্যাকেট এনে দিয়েছে ঘর থেকে।বলেছে, যতদিন ঠান্ডা না কমে ততোদিন ফেরত দেওয়ার দরকার নেই।দেখলি কি কেয়ারিং।”

_” আল্লাহ রে! কত প্রেম! দেখলে চোখ পুড়ে যায়।”

_” তোর সবকিছু পুড়ে যাক।এখন এখান থেকে যা তুই।”

_” কেন?”

_” আমি একটু মামুন সাহেবের সাথে কথা বলব।দু-কান ভরে তার মিষ্টি গলার স্বর শুনব।”

শাফিন দু-হাতে সোনালীর চুল টেনে দেয়।শাসনের সুরে বলেঃ” ওই হারামজাদার সাথে এতো মেলামেশার কি দরকার?তোর কথা -বার্তা ভালো লাগছে না।ওইদিন সৌরভও আমাকে বললো।”

সৌরভের নাম শুনে বিরক্ত হয় সোনালী।সৌরভ ওদের কলিগ।কিন্তু সবসময় সোনালীর পিছনে লেগে থাকে।অকারণেই খোঁচা মেরে কথা বলে।এসব একদম সহ্য হয় না সোনালীর।কপাল কুচকে বলে ঃ” আমার আচরণ ভালো না লাগলে তোরা নিজেরা কাজ কর।আমার আশায় বসে আছিস কেন?তোরা পাঁচটা পুরুষ একটা মেয়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছিস।আচ্ছা কাপুরুষ তো!”

_” ইশ! গলার জোর বেড়েছে।”

_” হুম বেড়েছে।শোন, আজ বিকালে একটু বাজারে যাবি।যেভাবেই হোক মনির স্যারের সাথে যোগাযোগ করবি।আর আসার পথে ফার্মেসী থেকে দুটো হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ আনবি।মনে থাকবে?”

_” ঘুমের ঔষধ দিয়ে কি হবে?আর আমি তো কোনো ঘুমের ঔষধের নাম জানি না। ”

_” তুই একটা বলদ।তুই।নাম জেনে কি করবি?ফার্মেসীতে বললেই তো দেবে।যা ভাগ এখন।আমি একটু আমার আশিকের সাথে খোশগল্প করে আসি।”

শাফিনকে পিছনে ফেলেই হাঁটা ধরে সোনালী।সকালবেলা মামুনের কাছে একগোছা চাবি দেখেছিল।ওখানেই হয়তো গোডাউনের চাবি আছে।সোনালী দেখেছে চাবিগুলো মামুন মানিব্যাগে রেখেছে।ওই চাবিগুলো দরকার সোনালীর।আজ রাতেই দরকার।যেভাবেই হোক আজ গোডাউনে ঢুকতেই হবে।দেখতেই হবে কি আছে সেখানে।

***

__” অ্যাকশন”___

ডিরেক্টরের উচ্চ আওয়াজ কানে আসতেই মৃদু হাসি হাসে তথা।আবার শুটিং শুরু হয়েছে তবে আজকে তথার কাজ নেই। তথা জমিদার বাড়ির বিশাল রান্নাঘরে বসে আদর্শ গৃহিনীর মতো রাঁধছে।চুলায় ভাত-ডাল বসিয়ে বটিতে ইলিশ মাছ কুটছে।সকালবেলা রোকসানা খালা এসে সবার জন্য রান্না করে বাড়ি চলে যায়।তারপর আবার শেষ বিকালে আসে।রান্নাঘর খালি পেয়ে আজ রাঁধতে বসেছে তথা।ইলিশমাছ খুব সুন্দর করে রাঁধতে পারে সে। তথা মন-প্রাণ দিয়ে ইলিশ মাছ রাঁধছে। ইউসুফকে কখনো দুপুরে খেতে দেখেনি।আজ নিজের হাতে রান্না করছে দু-জনে একসাথে খাবে বলে।নিচু চুলা।তাই পিঁড়ি পেতে বসেছে তথা।ডানপায়ের তালুতে বটি চেপে নিষ্প্রাণ মাছটাকে কুঁটছে।

খানিক বাদে কোথা থেকে উড়ে আসে ইউসুফ।তথাকে নিচে বসে কাজ করতে দেখে নিজেও আসাম করে বসে পড়ে তথার সামনে।দু আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে।আঁশটে গন্ধ সহ্য হয় না তার।তথার দিকে চেয়ে ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলেঃ” শুভ সকাল,কামিনী ফুল।”

_” দুপুর বারোটা বাজে শুভ সকাল হয় না।”

_” কি করব বলুন।কালকে ঘুমটা এতো ভালো হলো সকাল সকাল ভাঙলোই না।”

_” ভালো।”

_” আপনাকে কাজ করতে কে বলেছে?মাছের গন্ধ নাকে যাচ্ছে না?”

_” উঁহু, একটুও না।আমার এতো সাহেবিয়ানা নেই।মাছের গন্ধ,গোবরের গন্ধ সব সহ্য হয়।”

_” তাই বলে মাটিতে বসে মাছ কাঁটতে হবে?উঠুন।”

মাছের পেটি বের করতে করতে বিরক্ত চোখে তাকায় তথা।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” রান্নাঘরে আপনার কাজ কী?যান ঘরে যান।আমার কাজ শেষ হলেই আমি আসব।”

_” কত সাহস মেয়ে! আমাকে ধমক দেয়।”

_” আরেকটা কথা বললে খুন করব।এই যে বটিটা দেখছেন।অনেক ধার এতে।আপনার মাথাটা ফেলার জন্য এক কোপই যথেষ্ট।আমি কতো কষ্ট করে তার জন্য রান্না করছি,আর সে এসেছে খবরদারি করতে।সাহস কতো!”

প্রশ্রয়ের হাসি হাসে ইউসুফ।প্রসন্ন কন্ঠে বলেঃ” ওহ,আমার জন্য রান্না হচ্ছে।কি সৌভাগ্য আমার! তাহলে আমিও একটু সাহায্য করি।”

চুলার দিকে এগিয়ে যায় ইউসুফ।ভাত বোধহয় হয়ে গেছে।মাড় দেখা যায় না।

_” কামিনী ফুল,ভাত নামিয়ে ফেলব?”

_” উঁহু, মাড়ি ফেলতে হবে।”

_” আমি করে দেব?”

গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করে তথাঃ” আপনি পারবেন? করেছেন কখনো?”

_ ” করিনি কিন্তু ট্রাই করে দেখতে পারি।”

_” দরকার নেই।এ এতো সোজা কাজ নয়।পরে দেখা যাবে হাত-পায়ে মাড় ফেলে পুড়িয়ে ফেলবেন।”

_” আরে আপনার
সাহেব এতো বোকা না।কত কঠিন কাজ করি আর এটা তো একদমই সহজ।এই যে দেখ, পাতিল ধরলাম আর এই তো এখানে ফেলে…
আহ! উফ. ”

ইউসুফের হাত থেকে আগুন গরম ভাতের পাতিল ছিটকে পড়ে যায় দূরে।সবকিছু ঠিকই ছিল।কিন্তু ভারী পাতিলটা পিছলে যাওয়ায় অঘটনটা ঘটলো।সসপ্যানে মাড় না পড়ে পড়লো ইউসুফের বামহাত ও পায়ের উপর। হাঁটুতে মাথা ভর দিয়ে ডানহাতে পায়ের পাতা চেপে ধরে ইউসুফ।জ্বলে যাচ্ছে একদম।তথা দৌড়ে আসে ইউসুফের দিকে।রক্তমাখা হাতে পুড়ে যাওয়া পায়ের পাতায় ঘষে দেয়। ব্যতিব্যস্ত গলায় বলেঃ ” নিষেধ করেছিলাম আমি।কোনো কথা শুনতে চান না কেন, বলুন তো?ব্যাথা করছে খুব? চলুন পানি দেবেন।উঠুন।”

সজোরে আরো কয়েকবার ইউসুফের পায়ের পাতা দুটো ঘষে দেয় তথা।ইউসুফের জানটা মনে হয় বেড়িয়ে যাবে।পোড়া জায়গায় কেউ এতো জোরে ঘষাঘষি করে? বহু কষ্টে তথার হাত সরায় ইউসুফ।নির্জীব গলায় বলেঃ” পা ভেজানোর জন্য একটু পানি দিন, কামিনী ফুল। এভাবে ঘষলে আমার চামড়াগুলোই উঠে যাবে।”

তথা হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পারে।দ্রুত গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলেঃ” আমি এক্ষুণি আসছি।আপনি একটু অপেক্ষা করুন।”

তথাকে দরজা দিয়ে বেরোতে দেখে তড়িৎ গতিতে দেয়ালের ওপাশে চলে যায় শাফিন।পানি খেতে এসেছিল এখানে।কিন্তু এমন একটা সিনেমা দেখা হয়ে যাবে, তা ভাবেনি।তথার উপর খুব সন্তুষ্ট শাফিন।বুদ্ধির অভাবে পোড়া জায়গায় ঘষে দিয়ে ভালোই করেছে।আরেকটু ঘষামাজা করা উচিৎ ছিল।ঘষতে ঘষতে চামড়া তুলে নিলে ভালোই হতো।শালা রান্নাঘরে গেছে পোদ্দারি করতে।হতচ্ছাড়া বদমায়েশ একটা।

***

শনিবারে হাট বসে এইগ্রামে।বিকাল থেকে হাট শুরু হয় আবার এশারের আগেই শেষ হয়ে যায়।পঞ্চগড়ের এই অজপাড়া গাঁয়ের মিলনমেলাই হলো এই হাট।শাফিন বিকেলের শেষদিকে তিনি বেরিয়েছে।সিনিয়র অফিসার মনিরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।সবার ফোন গায়েব করে ফেলেছে ইউসুফ।ফলস্বরূপ সেই দুই তারিখের পর থেকে হেডকোয়ার্টারে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।আজ যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতেই হবে।এখানে ফ্লেক্সিলডের দোকান আছে নিশ্চয়ই।সেখান থেকেই একটা কল করবে শাফিন।এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে হাঁটছে শাফিন।কাঁচা রাস্তার দু’ধারে বিক্রেতারা সবজি নিয়ে বসেছে।গাছের টাটকা সবজি,পুকুরের জ্যান্ত মাছ।শাফিনের চোখ জুড়িয়ে যায়।ঢাকায় এরকম তাজা সবজি-মাছ পাওয়া আর বাঘের চোখ পাওয়া একই কথা।এখন তো সবকিছুতেই ভেজাল।নির্ভেজাল কিছু পাওয়া যায় আজকাল?

শাফিন মাস্ক পড়ে এসেছে।তবু তার বেশভূষা ভিন্ন বলে অনেকেই কৌতূহলী চোখে দেখছে তাকে।তবে সেদিকে পাত্তা দেয় না শাফিন।দেরি করলে চলবে না।তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে।কিছু দূরে পৌঁছাতেই কিছু মানুষের জটলা চোখে পড়ে।মানুষগুলো কি যেন দেখছে গোল হয়ে।বেশ কৌতূহল বোধ করে শাফিন।কোনো সমস্যা হলো নাকি ওখানে? দ্রুতপায়ে জটলার দিকে এগিয়ে যায় শাফিন।দু-হাতে ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দু-জন লোক ও একটি উল্টে যাওয়া রিকশা চোখে পড়ে।এক্সিডেন্ট হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে।রিকশাওয়ালা উঠে বসলেও আরোহী উঠতে পারেনি।উপুড় হয়ে মাটির উপর পড়ে আছে।শাফিন সেদিকেই এগিয়ে যায়।কালো শার্ট-প্যান্ট পরা একটা ছেলে।কাছে যেয়ে সোজা করে ছেলেটাকে।অজ্ঞান হয়েছে নিশ্চিত।সোজা করে মুখের মাস্ক খুলতেই চমকে যায় শাফিন।অত্যন্ত পরিচিত একটি মুখ,পরিচিত মানুষ।শাফিন আস্তে আস্তে চড় দেয় ছেলেটার গালে।হতভম্ব গলায় ডাকতে শুরু করেঃ ” ইরফান,ইরফান….”
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৩)
#হালিমা রহমান

উত্তেজনায় লাফ দিয়ে উঠে বসে ইরফান।মুহূর্তেই সরকারী হাসপাতালের নড়বড়ে খাট ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে।ইরফানের হাঁটুতেও ব্যাথা অনুভব হয়।এক্সিডেণ্ট ছোট হলেও হাঁটুতে বেশ বড়সড় চোট পেয়েছে।কপালে ব্যান্ডেজ,হাঁটুতে ব্যান্ডেজ,কনুয়ের দিকটায় চামড়া উঠে গেছে।ইরফান সাদিকের অবস্থা এখন অনেকটাই শোচনীয়।তবে শারীরিক অসুস্থতাকে খুব বেশি একটা পাত্তা দেয় না ইরফান।উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করেঃ” কি বলছো এগুলো, শাফিন?তোমরা এতো সাংঘাতিক একটা ক্রিমিনালের বাড়িতে আছো !”

_” হ্যাঁ, কি আর করা। এটাই আমাদের প্রফেশন।”

_” তথা কেমন আছে?”

_” একটু আগেই তো সব খুলে বললাম তোমাকে।ভুলে গেছো?”

ইরফান খানিক মিইয়ে যায়।বহুদিনের ব্যবহৃত কালচে সাদা রঙের বালিশে হেলান দিয়ে মলিন স্বরে বলেঃ” ভুলিনি,মনে আছে।”

_” তাহলে প্রশ্ন করছো কেন? আমরা কেউই খুব বেশি একটা নিরাপদ নই এখনো।অন্যান্যদের চাইতে আমরা ছয়জন বেশি ঝুঁকিতে আছি।তবে আমার মনে হয়, সবগুলো মেয়ের মাঝে তথা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। আহমেদ ইউসুফের পেয়ারের মানুষ বলে কথা।”

তথার বিষয়টা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যায় ইরফান।বিষন্ন গলায় বলেঃ ” গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ছয়জন এসেছে?”

_” হুম।”

_” তবুও তোমরা কিছু করতে পারছো না?এতোগুলো পুলিশ একসাথে আছো,তবুও..”

_” ভাই,আমরা তো সুপারম্যান না।আমরাও তোমাদের মতো মানুষ।দেখলাম আর খপ করে ধরে ফেললাম–বিষয়টা এমন না।অপরাধীকে ধরার কতগুলো প্রসেস আছে।আর ক্রিমিনাল যদি হয় আহমেদ ইউসুফের মতো জাত বজ্জাত,তাহলে তো কথাই নেই।ভেবে-চিন্তে পা ফেলতে হয় সেখানে।তাছাড়া,এখানে আসার আগে কি অর্ডার দেওয়া হয়েছে জানো?”

_” কি?”

_” প্রমাণসহ আহমেদ ইউসুফকে জীবন্ত ঢাকা নিতে হবে।বুঝতেই পারছো ,বিষয়টা সহজ নয়।”

_” বুঝলাম।”

শাফিন চোখ ঘুরিয়ে হাত ঘড়ির দিকে নজর দেয়।আযানের সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আযান শেষ হয়েছে।চারদিকে এক পশলা বৃষ্টির মতো ঝুপ করে নেমে এসেছে অন্ধকার। বাড়ি ফেরা দরকার।ইরফানকে এখানে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল শাফিন।ইরফান এখানে কেন আসবে? তার তো এখানে আসার কথা নয়?
স্থানীয়দের সাহায্যে অজ্ঞান ইরফানকে নিয়ে ছুটে এসেছে বাজারের হাসপাতালে।ভাগ্য ভালো এখানে একটা সরকারী হাসপাতাল আছে।নাহয় এই বিকেলবেলা অসুস্থ ইরফানকে নিয়ে বেশ কষ্ট হতো।শাফিন আড়চোখে একবার তাকায় ইরফানের দিকে।কপালের চামড়া কুঁচকে কি যেন ভাবছে সে।শাফিন হাসে মনে মনে।ইরফানের অবস্থা এখন অনেকটা আনাড়ি হাতের আটার রুটির মতো।ত্যাড়াব্যাকা, ফাটা-ফুটো।বেচারা! কত কষ্ট করে প্রেমিকার খোঁজ নিতে এতোদূর ছুটে এসেছে।অথচ, শুরুতেই এক্সিডেন্ট।কি দূর্ভাগ্য!
ইরফানের জ্ঞান ফিরেছে কিচ্ছুক্ষণ আগে।শাফিনকে শিয়রের কাছে বসে থাকতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই খুব অবাক হয়েছে সে।তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে শাফিনের কথা শুনে।শাফিন যখন একে একে তাদের কথা, জমিদার বাড়ির কথা, ইউসুফের কথা,তথার কথা,শুটিংয়ের কথা খুলে বললো; তখন ইরফানের মুখটা দেখার মতো ছিল।বেচারা বোধহয় এতোকিছু একসাথে আশা করেনি।

_” তথা সত্যিই ভালো আছে,শাফিন?”

ইরফানের কন্ঠে তীব্র বিষাদের ছাপ।শাফিন বামহাতে আগলে ধরে ইরফানের ডানহাত।মৃদু চাপ দিয়ে বলেঃ” সত্যি বলছি,তথা ভালো আছে।ইনফ্যাক্ট খুব ভালো আছে।তুমি চিন্তা করো না।”

_” ওই হারামী লোকটার সাথে সময় কাটাতে একটুও গা ঘিনঘিন করছে না ওর? অথচ,আমি একটু কথা বলতে গেলেই কত কঠিন কঠিন কথা শোনাতো আমাকে।আমি নাকি বাড়াবাড়ি করতাম। আমার আচরণ নাকি বিরক্ত লাগতো ওর কাছে।কি আশ্চর্য! আমার চাইতে এই আহমেদ ইউসুফ ভালো?”— বাতিকগ্রস্তের মতো প্রশ্ন করে ইরফান।তার প্রশ্নে আগাগোড়া অভিমান জড়ানো।গলায় কোনো জোর নেই। খুব কষ্ট করে কথা বলছে যেন।

_” দেখো,তোমাদের চোখে হয়তো তথার কাজটা ভালো লাগছে না।কিন্তু আমার চোখে তথার কাজটা ভালো লাগছে।ও প্রেম করছে বলেই ইউসুফের মনোযোগ অন্যদিকে আছে।যতক্ষণ ইউসুফ তথার সাথে আছে, ততোক্ষণ আমরা নিশ্চিন্তে আছি।ইউসুফ কালরাতে প্রেমে ব্যস্ত ছিল বলেই আমি সহজে মামুনের পিছু নিতে পেরেছি।আজ রাতে আবারো ও প্রেম করতে যাবে,আর সোনালী যাবে গোডাউনে। ইউসুফ যত তথার দিকে ঝুকে পড়বে,আমাদের কাজ ততো তাড়াতাড়ি শেষ হবে।তথা এখন আমাদের জন্য সোনার হরিণ।কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই শিকারীকে আঁটকে রাখার ক্ষমতা তার আছে।”

_” তোমার চিন্তা-ভাবনা আমার কাছে ভালো লাগে না।তোমার কথাগুলোও খুব প্রফেশনাল।”

_” তুমি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতে।সবাইকে সহজে রক্ষা করার জন্য এটাই এখন সবচেয়ে ভালো উপায়।তাছাড়া এতো মন খারাপের কি আছে?একটু প্রেমই করছে।প্রেম করলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।আর ওদের যতোই জীবন-মরণ প্রেম হোক না কেন,তথার সাথে ইউসুফের বিয়ের কোনো চান্সই নেই।দেশে যেহেতু আছে সেহেতু ইউসুফের শাস্তি নিশ্চিত। তবে যদি পাকিস্তানে চলে যায় তবে সেক্ষেত্রে হয়তো একটু এদিক-ওদিক হবে।”

_” তবুও আমার ভাবতেই খারাপ লাগছে,তথা অন্যকারো সাথে প্রেম করছে।আমি ভেবেছিলাম ওর হয়তো এসব প্রেম-ট্রেম ভালো লাগে না।কিন্তু এখন দেখছি এসবে আগে থেকেই ইন্টারেস্ট ছিল,শুধু আমিই তার অপছন্দের মানুষ ছিলাম।”

শাফিন উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাত গুজে বলেঃ” এসব এখন বাদ দেও।বিয়ের আগে দু-চারটে প্রেম করলে আহামরি ক্ষতি হয় না।তুমি এমন করছো যেন তথা বিরাট কোনো পাপ করে ফেলছে।হাহ! তথা শুধু একটুখানি প্রেম করছে।তাও একজনের সাথে।এখনকার দিনে বিয়ের আগে দু-তিনটে প্রেম সবারই থাকে।এই আমাকেই দেখো না,আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডগুলোকে হাতে গুনে শেষ করা যায় না।কোন বয়স থেকে প্রেম করছি তা নিজেরই মনে নেই।আর ক্রাশ শব্দটা তো আমার জন্য ডাল-ভাত।এখানে এসেও চারটে মেয়েকে ভালো লেগেছে।কি যে করি!”

_” হুম,মানুষের বেলায় বলাই যায়।তুমি যদি জানতে পারো তোমার প্রেমিকা আগে আরেক পুরুষকে ভালোবেসেছে,মিষ্টি হেসে কথা বলেছে,যত্ন নিয়েছে,তার সাথে প্রেমময় সময় কাটিয়েছে ,তখন কেমন লাগবে?গা জ্বালা করবে না?”

ফিচেল হাসে শাফিন।এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে মৃদু গলায় বলেঃ” আমাকে এই গল্প শোনাতে এসো না বেয়াই মশাই।আমি আমার গার্লফ্রেন্ডের চৌদ্দতম বয়ফ্রেন্ড। আর সে আমার কততম তার হিসাব নেই।এসব ছোট-খাটো বিষয়ে এখন আর আমার গা জ্বলে না।ওই যে কে যেন বলেছিল না,সব প্রেমই প্রথম প্রেম।কথাটা আমার সেই লাগে।ভাই এই বয়সে প্রেম না করলে কবে করব? বুড়ো বয়স তো নাতি-পুতিদের সাথে গল্প করার বয়স।তখন বুক ফুলিয়ে বলতে পারব–তোদের দাদু জোয়ানকালে মেয়েদের চোখের মনি ছিল।উফ! কি একটা ভাবের কথা।আর তোমাদেরকে দেখলে আমি অবাক হই।এক মেয়ের পিছনে ঘুরতে বিরক্ত লাগে না? পৃথিবীতে কি মেয়ের অভাব?ওই যে দেখ ওই নার্সটাও কিন্তু সুন্দর।আমাদের দিকে কয়েকবার তাকিয়েছে।আমাদেরকে হয়তো তার ভালো লেগেছে।তুমি যদি বলো তো তোমার জন্য ঠিকঠাক করে দিতে পারি।কি বলো,করব?”

ইরফান দু’হাত একসাথে করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলেঃ” না ভাই,মাফ চাই।বহু রানী জয় করার সাধ্য আমার নাই।আমি একজন নিয়েই সন্তুষ্ট। তোমার মতো বারো….

_” আহ,আস্তে ইরফান।আমি জানি তোমার মুখ খারাপ।তাই বলে সামনাসামনি স্ল্যাং ইউজ করবা?আমারও মানসম্মান আছে।আচ্ছা,এসব বাদ দেও।আমাদের বাড়ির খবর জানো কিছু? কেমন আছে সবাই?”

_” ভালো। তবে তোমার জন্য চিন্তা করছে সবাই।”

_” হ্যাঁ, সেটা ত করবেই।কতদিন যোগাযোগ হয় না!আচ্ছা তবে থাকো।আমি এখন আসছি।”

_” এতো তাড়াতাড়ি? ”

_”হুম।কাজ আছে একটু।ফ্লেক্সিলড থেকে ফোন করতে হবে,দুটো ঘুমের ঔষধ কিনতে হবে, তারপর বাড়ি ফিরতে হবে।দেরি করলে যদি আবার কেউ সন্দেহ করে।”

কিছুক্ষণ ভাবে ইরফান।ভাবুকের মতো বলেঃ” তোমার কাছে তো ফোন নেই,তাই না?”

_” হুম।আমার ত্রিশ হাজার টাকার ফোন।ওই শালা কি করেছে আল্লাহ মালুম।ফোনটা না থাকায় বিপদে আছি।”

_” আমার কাছে দুটো ফোন আছে।তুমি একটা নিয়ে যাও শাফিন।তোমার কাজে লাগবে।”

মনে মনে খুব খুশি হয় শাফিন।একটা ফোনের খুব দরকার এখন।খুশিতে গদগদ হয়ে বলেঃ” তোমার সমস্যা হবে না তো?”

_” না।একটাই কাজে লাগে আমার।আর তোমার কাছে একটা ফোন থাকলে আমারও সুবিধা।সময়ে-অসময়ে খোঁজ-খবর নিতে পারব।”

_” না,ওটা বোধহয় পারবে না।কারণ,ফোনটা লুকিয়ে রাখব।তাই বেশিরভাগ সময় হয়তো বন্ধ থাকবে।”

_” তাহলে তুমিই সময় করে ফোন দিও।বুঝতেই পারছো,কোনো খোঁজ-খবর না পেলে আমার চিন্তা হবে।”

_” আচ্ছা।”

ব্যাগ থেকে ছোট-খাটো একটা ফোন বের করে ইরফান।দুটো ফোন এনে ভালোই হয়েছে।প্রয়োজনে কাজে লাগলো।শাফিনের হাতে ফোনটা দিতে দিতে বলেঃ” আমি এখন কি করব? জমিদার বাড়িতে না গেলে আমার মনটা খচখচ করবে।”

_” তুমি এখন ঢাকার বাস ধরবে।তারপর এই ভাঙাচোরা হাত-পা নিয়ে নিজের বাড়িতে যাবে।”

অবুঝের মতো এক আবদার করে ইরফান।নরম গলায় বলেঃ” আমাকে একটু তোমার সাথে নিয়ে যাও না।ওখানে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ো,প্লিজ।তথা এতো বাজে একজনের সাথে আছে,এতোদূর থেকে আসার পরে ওকে একনজর না দেখলে ভালো লাগবে না আমার।নেয়া যায় না আমাকে?”

_” নেওয়া যায়। তবে কাল সকালেই তোমার জানাজা পড়ার ইচ্ছে আমার নেই।মরার এতো শখ কেন?আর কেউ না চিনলেও তো তথা তোমাকে চেনে।ওর মুখ দিয়ে একবার তোমার পরিচয় বের হলেই হয়েছে।তুমি শেষ।তাছাড়া, ওখানে যেয়েই কি করবে?আহমেদ ইউসুফের হাত থেকে প্রেমিকাকে রক্ষা করবে?”

_” সাধ্য থাকলে করতাম।কিন্তু ওই লোক নাকি অনেক ডেঞ্জারাস?”

_” হুম, হাড় বজ্জাত।শয়তানের ছাও একটা।”

আরো দু-চার মিনিট কথা বলে শাফিন।আলগোছে হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলায়।সন্ধ্যা সাতটা।বেশি দেরি করা যাবে না।সোনালী ঘুমের ঔষধ দিয়ে কি করবে কে জানে?এতো জিজ্ঞেদ করলো কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই বললো না। গোঁয়ার একটা! সবকথা পেটে রেখে কিভাবে বেঁচে আছে এই মেয়ে?

***

নিচতলায় এসে এদিক-ওদিক নজর বুলায় সোনালী।টেবিলের ওপাশে,সোফার পাশে,দরজার কাছে।না, কেউ নেই।সবাই বোধহয় যে যার ঘরেই আছে।সোনালী বিরাট একদম নেয়।পা টিপে টিপে পৌঁছে যায় শাফিনের ঘরে।মামুনের ঘরের পাশের ঘরটাতেই সমীর ও শাফিন থাকে।সমীরও শাফিনদের দলের।শাফিনের মতো সেও গোয়েন্দা সংস্থার লোক।
ঘরে ঢুকে দ্রুতহাতে দরজা আটকে দেয় সোনালী।সমীর ও শাফিন বিছানায় বসে ছিল।সোনালীকে দেখে উঠে বসে।সোনালী বিছানার কাছে আসতেই ধমক দেয় শাফিন।

_” তোকে এখানে কে আসতে বলেছে?সেন্স নাই কোনো?পাশের ঘরেই মামুন আছে।তুই ভাবিস না এতোরাতে বাইরে ঘুরঘুর করতে দেখলে মামুন তোকে ছেড়ে দেবে।গলায় পারা দিয়ে মেরে ফেলবে।”

খুব বিরক্ত হয় সোনালী।শাফিনের দিকে আঙুল।তুলে বলেঃ” বেশি কথা বলবি না,শাফিন্না।এতোরাতে আমি গল্প করতে আসিনি।যা আনতে বলেছিলাম,তা এনেছিস?”

_” হুম,দাঁড়া দিচ্ছি।”

এতোক্ষণে মুখ খোলে সমীর।শাফিন ও সোনালীর জুনিয়র সে।বিনয়ী ভঙ্গিতে বসেঃ” কোনো প্রমাণ পেয়েছেন,ম্যাম?”

_” না।তবে,আজকে গোডাউনে যাব।দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা।”

শাফিন দুটো ট্যাবলেট এগিয়ে দেয় সোনালীর কাছে।বিরক্ত গলায় বলেঃ” ঘোড়ার ডিম আনতে দিয়েছিস।বাজারে একটাই ফার্মেসী।সেখানে আবার একটা পিচ্চি ছেলে বসেছিল আজ।সে নাকি মালিকের ছেলে।আমি তো আর ঔষধের নাম জানি না।ওর কাছ থেকেই এই ঔষধ আনতে হলো।বহু গবেষণা করে এই দুটো ট্যাবলেট দিয়েছে।ঠিকঠাক দিয়েছে নাকি দেখ তো?

_” কি ঔষধ এটা? ক্যা-ল-ব ডি,ক্যালব ডি?এটা ঘুমের ঔষধ? “—হতভম্ব কন্ঠে প্রশ্ন করে সোনালী।শাফিনের নির্বুদ্ধিতা যেন মেনে নিতে পারছে না।

সোনালীর প্রশ্নের উত্তর শাফিন দিতে না পারলেও সমীর দেয়।বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেঃ” না, ক্যালব ডি তো ঘুমের ঔষধ না।এটা ক্যালসিয়ামের ঔষধ। আমার আম্মা প্রতিদিন এটা খায়।”

বোকার মতো চেয়ে থাকে শাফিন।মিনমিন করে প্রশ্ন করেঃ” কি বলছো, সমীর? এটা তো ঘুমের ঔষধ। ছেলেটা আমাকে বলল।”

_” আরে না, স্যার।এটা ক্যালসিয়ামের ঔষধ।”

_” কিন্তু আমি তো…., আহ..”

পায়ের জুতো ছুঁড়ে মেরে শাফিনের মুখ বন্ধ করে সোনালী।দাঁত কিড়মিড় করে বলেঃ” একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না।এটার নাম শুনলেই তো বুঝা যায়,এটা কীসের ঔষধ। বলদ জানি কোন দেশের।এটা খাইয়ে মামুনকে ঘুম পাড়াবো?আজকেও গোডাউনে যাওয়া হলো না।আমি আর পারব না।এরপর তুই যাবি।মামুনের মানিব্যাগে একগোছা চাবি দেখেছিলাম।আজকেই ওটা হাতাতে পারলে কি লাভটাই না হতো! কত প্ল্যান করেছিলাম,সব নষ্ট হয়ে গেল।ধুর,ভালো লাগে না।”

দুই ভাই-বোনের দিকে একবার নজর বুলায়।শাফিন মাথা নিচু করে আছে।সোনালীও কপালের দু’পাশে দু-আঙুল চেপে মাথা নিচু করে রেখেছে।তার সব পরিকল্পনা নষ্ট হওয়ায় খুবই রেগে আছে সে।সমীর এবার মুখ খুললো।সোনালীর চিন্তা কমানোর জন্য বললঃ” আমার কাছে ক্লোরোফর্ম আছে ম্যাম।আপনার হয়তো কাজে লাগবে।দেব?”

ঝট করে মাথা তোলে সোনালী।কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেঃ” কি আছে?”

_” ক্লোরোফর্ম।ঘুমের ঔষধ দিয়ে যেই কাজ করবেন সেটা তো এটা দিয়েও করা যায়।”

_” সত্যিই আছে তোমার কাছে!”—সমীরের কথা যেন বিশ্বাস কর‍তে পারে না সোনালী।এই অসময়ে ক্লোরোফর্ম এক অমূল্য নেয়ামত।

_” আমার কাছে সত্যিই আছে ম্যাম।দাঁড়ান আপনাকে দেখাচ্ছি।”

সমীর উঠে গেলে নড়ে-চড়ে বসে শাফিন।গলায় একরাশ প্রশ্ন নিয়ে বলেঃ” এটা দিয়ে কি হবে?”

_” আমার আশিককে ঘুম পাড়িয়ে চাবি চুরি করব।”

_” অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যায় না?আজকে মোটে দশ তারিখ।”

_” হোক দশ তারিখ।আমার আর ভালো লাগছে না এখানে।প্রত্যেকদিন জ্বর আসে।শরীরটা আরো অসুস্থ হওয়ার আগেই কাজ গুছিয়ে রাখতে চাই।”

চিন্তিত দেখায় শাফিনের মুখ।ডান হাতের উল্টো পিঠে সোনালীর কপাল ছুঁয়ে বলেঃ” আবার জ্বর এসেছে নাকি?”

_” একটু আগে ছিল।”

_” তবে আজ আর যেয়ে কাজ নেই।আমি তো আছি।তোর কাজ আমি শেষ করে রাখবনি।”

_” চাবি জোগাড় করতে পারবি না তুই।আমি একটু চেষ্টা করলেই পারব।মামুনের সাথে আমার খাতির ভাল।শত হলেও আমি তার পেয়ারের মানুষ”—মুখ টিপে হাসে সোনালী।ততোক্ষণে সমীরও এসে গেছে।হাতের শিশিটা সোনালীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেঃ” এই যে ম্যাম।”

_” এটা কেন এনেছিলে তুমি?”

_” আমার বাবাও এস.বি অফিসার ছিলেন।বাবাকে দেখতাম কোনো মিশনে যাওয়ার আগে রিভলবারের পাশাপাশি ছুঁড়ি,দড়ি,ক্লোরোফর্ম, আরো হাবিজাবি অনেককিছু নিয়ে যেত।তাই আমিও এবার বাবার প্রসেস ট্রাই করলাম।ভালোই হলো।কাজে লেগে গেল।”

_ ” বুদ্ধিমানের কাজ করেছো।এখন শোন শাফিন,আমি একটু পরেই বেরোব।মামুনের কাছ থেকে চাবি জোগাড় করে গোডাউনে যাব।কিছু পেলে তো ভালোই।আমি আর এখানে থাকব না।প্রমাণ নিয়ে সোজা ঢাকা চলে যাব।এরপর ইউসুফকে ঢাকা অবধি নিয়ে যাওয়া তোদের কাজ।”

_” আর যদি কিছু না পাস?”

_” পাব না কেন?কিছু না কিছু তো নিশ্চয়ই থাকবে।আর না পেলে কি আর করার। আরো অপেক্ষা করতে হবে।”

শাফিন উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাত গুজে বলেঃ” ঠিক আছে চল তাহলে।এখনই বেরিয়ে পড়ি।”

অবাক হয় সোনালী।এক ভ্রু উপরে তুলে বলেঃ” তুই কোথায় যাবি?”

_” তোর সাথে।তোকে একা ছাড়ব নাকি?”

_” আমি বাচ্চা না শাফিন।আমি পারব।পাগলামি করিস না প্লিজ।”

_” কেন আমি সাথে গেলে কি সমস্যা?”

_” অনেক সমস্যা।আমি আমার সময় -সুযোগ বুঝে তারপর যাব।তুই সাথে থাকলে ঝামেলা হবে।”

_” তাহলে একাই যাবি?”

_” হুম।”

দু-পা এগিয়ে আসে শাফিন।বোনের মাথায় আদুরে ভঙ্গিতে ডান হাত বুলিয়ে দেয়।

_” সাবধানে থাকবি সোনালী। যেকোনো সমস্যা হলেই আমাকে জানাবি,যত রাতই হোক।আমি জেগে থাকব।আর সকাল সকাল আপডেট দিস।”

_” আচ্ছা।জেগে থাকতে হবে না।ঘুমিয়ে থাক।দুটো রিভলবার নিয়ে যাচ্ছি।তোর বোন দূর্বল নয়।”

_” আমি জানি।তবুও চিন্তা হয়।আল্লাহ তোকে ভালো রাখুক।”

_” আসছি।”

_” আচ্ছা।”

আবারো দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেয় সোনালী।কচ্ছপের মতো মাথা বাড়িয়ে বসার ঘরটা দেখে।না কেউ নেই।টুকটুক পায়ে হেঁটে যাওয়ার আগেই পিছু ডাকে সমীর।মৃদু গলায় বলেঃ” বেস্ট অফ লাক, ম্যাম।আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”

পিছু ফিরে একবার মুচকি হাসে সোনালী।ঠোঁট নেড়ে ইশারায় বলেঃ” আমি ফিরে আসব।আল্লাহ হাফেজ।”

খোলা দরজা দিয়ে আবার একছুটে বেরিয়ে যায় সোনালী।কেউ দেখার আগেই তাড়াতাড়ি রুমে যেতে হবে।

****

ইউসুফ হাত ও পায়ের দিকে একবার নজর দিলো।পুড়ে গেছে জায়গাগুলো।এখনও ব্যাথা করে। টি-শার্ট আস্তে আস্তে গায়ে দেয় ইউসুফ। হাতটা পুড়ে ভালো হয়নি।যেকোনো কাজ করতেই এখন বেগ পেতে হয়।

_” আসব সাহেব?”

ইউসুফ দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।তথা দাঁড়িয়ে আছে।তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে যেয়ে বলেঃ” কামিনী ফুলের সুবাস ছড়াতে অনুমতি লাগে?”

_” সারাদিন কি এসব কথা ঠোঁটের উপরেই থাকে?”

_” হুম।পঁয়ত্রিশ বছর যাবৎ সিঙ্গেল থাকার পরে প্রেমিকা যখন চোখের সামনে থাকে,তখন এসব কথা বন্যার পানির মতো বেরিয়ে আসে।”

_” বুঝেছি।এখন রাস্তা ছাড়ুন।হাত-পায়ের কি খবর এখন?”

_” ভালো।আজকে আবার আমার ঘরে? কোনো প্ল্যানিং আছে নাকি?”

_” উঁহু, ঘুম আসছিলো না। তাই চলে এলাম গল্প করতে।”

_” কিন্তু আমায় যে এখন বেরোতে হবে।”

_” এখন! এই রাতে কোথায় যাবেন?”

_” একটু কাজ আছে।কয়েকটা জায়গায় ফোন করতে হবে।অনেকদিন কাজের খোঁজ-খবর নেওয়া হয় না।একটু খোঁজ নিতে হবে আরকি।”

মন খারাপ করে তথা।মুখটাকে চিমসে বলেঃ” আমি আরো ভাবলাম আপনি ফ্রি আছেন।”

_” মন খারাপ করবেন না কামিনী ফুল।একটুখানি কাজ।আমি একটু পরেই ফিরে আসব।আপনি জেগে থাকবেন।”

_” না তাহলে আজ আর দরকার নেই।আমি বরং ঘুমিয়েই যাই।কাল কাজ আছে আমার।”

_” আচ্ছা, আপনার ইচ্ছে।”

তথা বেরিয়ে গেলে সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ইউসুফ।একটু মিথ্যা বলেছে সে।ইউসুফ তো এখন গোডাউনে যাবে।কাল প্রোডাক্টগুলো আসার পর একবারও দেখা হয়নি।একবার দেখতে হবে।নিজের চোখে না দেখা অবধি মনটা খচখচ করবে তার।অবশ্য এখনো করছে।কত কষ্ট করে কামিনী ফুল এসেছিল তার ঘরে।আবার ফিরে গেল।কাজটা কি ঠিক হলো? আজ বোধহয় গোডাউনে না যেয়ে গল্প করলেই ভালো হতো।কামিনী ফুলের কত আশা ছিল।মেয়েটা নিশ্চয়ই রাগ করেছে!

***

মামুনের জ্যাকেটের হাতার কাছটায় স্প্রে করে নিলো সোনালী।খুব বেশি ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করেনি সে।বেশি ব্যবহারে মৃত্যু হতে পারে।মামুনকে মারার ইচ্ছে নেই তার।কয়েক ঘন্টা অজ্ঞান করে রাখতে চায় শুধু।সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামে সোনালী।তথাকে ইউসুফের ঘরে ঢুকতে দেখেছে।বিষয়টা স্বস্তি দিলো সোনালীকে।ইউসুফ সেখানে ব্যস্ত থাকুক,মামুন অজ্ঞান থাকুন।মাঝ দিয়ে সোনালী একবার গোডাউন থেকে ঘুরে আসুক।দ্রুতগতিতে নিচে নেমে মামুনের ঘরের সামনে যায় সোনালী।দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তোলে।মামুন হয়তো ঘুমিয়ে ছিল।প্রায় মিনিট পাঁচেকের মতো দরজা ধাক্কানোর পর ভিতর থেকে আওয়াজ শোনা যায় মামুনের।সে গলা বাড়িয়ে প্রশ্ন করছেঃ” কে?”

উত্তর দেয় না সোনালী।কড়া নেড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।ভিতর থেকে মামুনের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সোনালী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।এখন কথা বলার সময় নেই।
এতোরাতে নিজের ঘরের সামনে সোনালীকে দেখে অত্যন্ত অবাক হয় মামুন।ঘুমঘুম চোখগুলোকে দু-হাতে রগড়ে নেয়।বিস্মিত কন্ঠে বলেঃ” ছোট্ট মেয়ে,আপনি এতো রাতে কোনো সমস্যা?”

_” হুম।আগে আমাকে ঘরে ঢুকতে দিন।”

মামুনকে ঠেলে ঘরে ঢুকে সোনালী।দ্রুতহাতে ছিটকিনি আঁটকে দেয়।মামুন হতভম্বের মতো চেয়ে থাকে।বোকার মতো প্রশ্ন করে ঃ” কি করছেন?”

_” কিছু না।এই আপনার জ্যাকেটের হাতার কাছটায় এতো গন্ধ কীসের? এতো গন্ধ,ছিঃ! আমার বমি আসছে।আপনি আমায় আরেকটা জ্যাকেট দিন তো।অনেক ঠান্ডা লাগছে।জ্যাকেট না হলে মরেই যাব এখন।”

কপাল কুঁচকায় মামুন। গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কি বলছেন এগুলো? দেখি কোথায় গন্ধ?”

সোনালী নির্দিষ্ট হাতাটা এগিয়ে দেয় মামুনের দিকে।নাকের কাছে নিয়ে একবার গন্ধ নেয় মামুন।একবার,ঠিক একবার।ব্যাস, সেখানেই চিৎপটাং সে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে দু-হাতে আগলে নেয় সোনালী।টেনে -হিঁচড়ে মামুনের অসার শরীরটাকে খাটের উপর ফেলে।দ্রুতগতিতে এদিক -ওদিক নজর দেয়।হ্যাঁ, ওই তো।বেডসাইড টেবিলের উপর মানিব্যাগটা দেখা যাচ্ছে।সেদিকে যেন উড়ে যায় সোনালী।সকালে এটার ভিতরেই চাবির গোছা দেখেছিল সে।
সোনালীর ভাগ্য ভালো বলতে হয়।একগোছা চাবি পেয়ে যায় মুহূর্তেই।হয়তো চাবিটা এখানেই রাখে মামুন।একগোছা চাবির কোনটা গোডাউনের চাবি তা জানা নেই।এতো সহজে চাবি পেয়ে যাবে তা মোটেও ভাবেনি সোনালী।খুশিমনে চাবি হাতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।যাওয়ার আগে মামুনের ঘরের দরজা আঁটকে দেয় সোনালী।এদিক-ওদিক তাকায় না।বাড়ির দরজা খুলে পা বাড়ায় বাইরের দিকে।

***

রাত দেড়টা।জমিদার বাড়ির পিছনে একটা মেয়ে দৌড়াচ্ছে।সাদা শার্ট,কালো জিন্স আর একজোড়া কেডস পায়ে দেওয়া সোনালী মৃদু গতিতে দৌড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য অর্জুন গাছের সামনের গোডাউনে পৌঁছানো।বিরাট আমগাছের সামনে যেতে থমকে দাঁড়ায় সোনালী।ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক,সামনে-পিছনে তাকায়।মনে হচ্ছে কেউ অনুসরণ করছে। খুব মনোযোগ সহকারে সোনালীর পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করছে কেউ।অস্থির লাগে সোনালীর।কার্তিকের রাতের মৃদু ঠান্ডায় ঘামতে শুরু করে।সত্যিই কি কেউ পিছু নিয়েছে? কে হতে পারে? শাফিন? না করার পরেও পিছু পিছু এলো?সোনালী তীক্ষ্ম নজরে এদিক-ওদিক তাকায়।রিভলবার বের করতে যেয়েও করে না।কাউকে দেখা যাচ্ছে না তো আশেপাশে। চারদিকে আধো আলো,আধো অন্ধকার।খোলা আকাশের চাঁদে আজ আলাও বেশি।চারপাশে সাবধানী নজর বুলিয়ে আবারো রাস্তা ধরে সোনালী।কেউ নেই।মনের ভুল তাড়িয়ে দ্রুতপায়ে অর্জুন গাছের দিকে ছুটে যায় সোনালী

আমগাছ থেকে অর্জুন গাছের দূরত্ব বেশি নয়।সাত-আট মিনিটের মাঝেই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায় মেয়েটা।এবার আর সামনের দরজায় চোখ দেয় না।হাজির হয় ঘরের পিছনের দিকে।একটা বিশাল স্টিলের দরজায় আধ-পুরোনো তালা ঝুলছে।তালার চেহারা বলে দেয় বহুবার ব্যবহার হয়েছে এটা।সোনালী মনে মনে হাসে।বুদ্ধি আছে বটে।সামনের দরজাকে কঙ্কালের মতো ফেলে রেখে এই দরজা ব্যবহার করা হচ্ছে।কত সতর্কতা! একে একে দু-তিনটা চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করে সোনালী।হচ্ছে না।একগাদা চাবির ভিতর থেকে সঠিক চাবিটা বের করতে বেশ বেগ পেতে হয়।ছোট্ট চাবিটাকে ব্যবহার করে বিরাট তালা খুলেই চওড়া হাসি দেয় সোনালী।সবকিছু এতো সহজেই হয়ে যাচ্ছে! কি আশ্চর্য! ভাগ্য আজ এতো সুপ্রসন্ন?
খুশিমনে দরজা খোলে সোনালী।ভেবেছিল পুরোনো দরজা,খোলার সময় ক্যাচক্যাচ শব্দ হবে।কিন্তু না।হলো না।কোনোরকম শব্দ ছাড়াই খুলে গেল দরজা।সোনালী চাবিটা পকেটে ঢুকায়।তালাটাকে হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকে।অন্ধকার ঘর।সোনালী টর্চ লাইট জ্বালে।আসার সময় পকেটে করে একটা টর্চ লাইট নিয়ে এসেছিল। মুহূর্তেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয় নানা আকারের কতগুলো বাক্স।একটা কাঠের চেয়ারও চোখে পড়ে।চেয়ারের উপর লাইট রেখে পিছু ফিরে।দরজাটা লাগাতে হবে তো।
কিন্তু ঠিক তখনই, তখনই সোনালীর নিঃশ্বাস আঁটকে আসে।হৃৎপিণ্ড মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে।সোনালীর গলা শুকিয়ে যায়,মাথা চক্কর দেয়।দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইউসুফ।সোনালী চোখ বন্ধ করে আবার খুলে।হতে পারে এটা মনের ভুল।ইউসুফ তো তথার সাথে ছিল।এখানে কি করে আসবে? তবে ভুল ভাঙে সেকেন্ডের মাঝেই।পকেটে দু-হাত গুজে এদিকেই আসছে সে।দরজাটাকে আঁটকে দিয়ে সোনালীর দিকেই আসছে। গুনগুন করে গান গাইছে ইউসুফ। তার ঠোঁটের কোনে বিজয়ের হাসি।সোনালী আলগোছে হাত ঢুকায় জিন্সের পকেটে।হ্যাঁ, রিভলবারটা এখানেই আছে।বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন।
ইউসুফ সোনালীর বেশ কাছাকাছি চলে আসে।নরম গলায় বলেঃ” আসসালামু আলাইকুম, অফিসার সোনালী আহমেদ।এতো তাড়াতাড়ি আপনার আসল রূপ দেখব তা কিন্তু ভাবিনি আমি?আমাকে এখানে আশা করেছিলেন আপনি?”

চলবে…..
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here