#ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৪)
#হালিমা রহমান
তথার ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে।প্রকৃতি কার্তিকে সেজেছে।তাই শেষরাতে বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগে।মাথার কাছের জানলাটা খোলা।হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে ঘরে।কাঁথা গায়ে না দেওয়ায় তথার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।মৃদু ঠান্ডায় ঘুম পালায় দু-চোখ থেকে।তথা উঠে বসে।শরীরে সুতির ওড়না জড়ায়।খাটের অন্যপাশ খালি দেখে তথা অবাক হয়।এতো সকালে কোথায় গেল সোনালী? এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলো আজ!
অলস পায়ে খাট থেকে নেমে জানলার কাছে যায় তথা।প্রাণভরে শ্বাস নেয়।কতদিন মুক্ত বাতাস নেওয়া হয় না।এতো সকালে সচরাচর ঘুম ভাঙে না তার। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার।হালকা কুয়াশা চোখে পড়ে ।শহরে কার্তিকের কুয়াশা খুব একটা পাত্তা পায় না।তাই তাদেরকে দেখাও যায় না।তবে, প্রত্যন্ত গ্রামে এদের উপস্থিতি চোখে পড়ে মাসের শুরু থেকেই। বাড়ির পিছনের বিশাল গাছগুলোর মাথায় অশরীরীর মতো ভর করেছে কার্তিকের কুয়াশা।
জানলায় মোটা পর্দা টেনে দেয়।এখন আর ঘুম আসবে না।হাত-মুখ ধুয়ে সোনালীকে খুঁজতে বেরোনোর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পায়ের নিচে কাগজের অস্তিত্ব পায় তথা।হাঁটু ভেঙে কাগজ তুলতেই চোখে পড়ে গুটিগুটি কতগুলো অক্ষর।এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেলে।
তথা আপু,
খুব জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হচ্ছে।ফিরব কিনা জানি না।সবাই ঘুমিয়ে আছে, তাই কাউকে বলতে পারলাম না।তুমি একটু কষ্ট করে সবাইকে জানিয়ে দিও, প্লিজ।কাজের মাঝ থেকে চলে আসার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।তোমাদের সবাইকে খুব মিস করব।ভালো থেকো,আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
সোনালী।
খুব অবাক হয় তথা।আরো কয়েকবার লাইনগুলো পড়ে।কখন গেল সোনালী? তথার স্পষ্ট মনে কালরাতে সে যখন ইউসুফের ঘর থেকে ফিরে এসেছিল,তখন সোনালী ছিল না ঘরে।তথা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল সোনালীর জন্য।কিন্তু যখন দেখলো সোনালী ফিরছে না, তখন দরজায় ছিটকিনি না দিয়ে চাপিয়ে রেখেছিল।এরপরের কথা আর বলতে পারে না তথা।কারণ, সোনালীর জন্য আর অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে।তথা উঠে দাঁড়ায়।কতগুলো প্রশ্ন তার মাথায় আসে।সোনালী কি পরে রুমে এসেছিল? নাকি তথা যখন ইউসুফের ঘরে ছিল তখনই বেরিয়ে গেছে? কিন্তু তখন বেরোলে চিঠি লেখবে কেন? তথা তো তখন জেগেই ছিল।তথা আলমারির কাছে যায়।আলমারির পাল্লা খুলতেই শুধু তার জামা-কাপড় চোখে পড়ে।সোনালীর ব্যাগটা নেই এখানে।ওর জামাগুলো সব ব্যাগে ভরা ছিল।তথা আলমারির পাল্লা আটকে দেয়।মনটা খচখচ করছে তার।এইটুকু একটা মেয়ে।এতোদূরে একা একা যেতে পারবে? এখান থেকে বাস স্টেশন অনেক দূরে।কতরাতে ঘর থেকে বেরিয়েছে কে জানে! তাছাড়া এতোরাতে বাস পেয়েছে ও? ঢাকা অবধি পৌঁছাতে পারবে তো? সোনালীর জন্য খুব চিন্তা হয় তথার।ফোনটা নেই।ফোন থাকলেও ভালো হতো।সোনালীর সাথে যোগাযোগ করতে পারতো।যোগাযোগের কথা মাথায় আসতেই আরেকটা বিষয় মাথায় খেলে যায় তথার।সোনালীরও তো ফোন নেই।তাহলে? ঢাকায় কি এমন জরুরি কাজ পড়লো? তাছাড়া জরুরি খবর সোনালী অবধি আসবে কিভাবে? ফোন ছাড়া ও যোগাযোগ করল কিভাবে?
তথার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।সোনালীর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না যেন।কিন্তু এই চিঠি?এটাও তো সোনালীই লিখে গেছে।তার মানে যেভাবেই হোক রাতের বেলা সোনালী পঞ্চগড় ছেড়েছে।এতো সকালে কি ঢাকা পৌঁছাতে পেরেছে?আখতার হোসেনের কাছে সোনালীর ডিটেইলস আছে।সেখানে নিশ্চয়ই সোনালীর অভিভাবকের ফোন নম্বর আছে।ওখান থেকে নম্বর নিয়ে ইউসুফের ফোন দিয়ে ওদেরকে কল করলে কেমন হয়? সোনালী যদি পৌঁছে যায় তবে ওর সাথে কথা বলতে পারবে।আর না পৌঁছালেও জানতে পারবে।চিন্তা তো কমবে।নাহয় সোনালীর জন্য খুব চিন্তা হবে তথার।তথা বেরিয়ে পড়ে।সে এখন ইউসুফের কাছে যাবে।আখতার হোসেনের সাথে ইউসুফের ভালো সম্পর্ক চোখে পড়েছে তথার।সে নিশ্চয়ই ডিরেক্টরের কাছ থেকে সোনালীর ডিটেইলস নিয়ে দিতে পারবে।পাশের ঘরটাই তো ইউসুফের।ইউসুফ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে।এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে তথার কথা মতো কাজ করবে কিনা কে জানে! তবে আখতার হোসেনের কাছ থেকে ডিটেইলস না নিয়ে দিলে খবর আছে ইউসুফের।প্রেমিকার জন্য এতূটুকু করতে না পারলে সে আবার কেমন প্রেমিক?
ইউসুফ ঘুমিয়ে ছিল।বুক অবধি কাঁথা টেনে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল।শব্দহীন পায়ে ইউসুফের খাটের কাছে যেয়ে দাঁড়ায় তথা।মাথা ঝুকিয়ে আলতো স্বরে ইউসুফকে ডাকে।
_” ইউসুফ, ইউসুফ। ”
কোনো হোলদোল দেখা যায় না ইউসুফের মাঝে।সে ঘুমে ব্যস্ত।আরো কয়েকবার ডাক দেয় তথা।কিন্তু না,ইউসুফের ওঠার কোনো নাম-গন্ধ নেই।তথা বিরক্ত হয়।ডানহাতে ইউসুফের সুন্দর চুলগুলো টেনে দেয়।চুলে হাত দিয়েই বুঝতে পারে ইউসুফের চুলগুলো ভেজা। তার মানে ইউসুফ সকালের দিকেই গোসল করে ঘুমিয়েছে।কি আশ্চর্য! এতো সকালে গোসল কেন করলো?
_” এই ইউসুফ,ইউসুফ, উঠুন না।ইউসুফ, ইউসুফ।”
এতোক্ষণে নড়ে উঠে ইউসুফ।বিরক্ত হয়ে চোখ খুলতেই চোখে পড়ে তথার সদ্য ঘুম ভাঙা সুন্দর মুখ।ঘুম থেকে উঠেই আরেক দফা মুগ্ধ হয় ইউসুফ।মেয়েটার সবকিছুতেই মুগ্ধতা জড়ানো।তার চলনে,বলনে,বেশ-ভূষায়,সুগন্ধে—সব কিছুতে।সুন্দর মুখে একটি সুন্দর হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে উঠে বসে ইউসুফ।বিরবির করে বলেঃ” আমার বাসি কামিনী ফুল।”
_” কতক্ষণ ধরে ডাকছি,ওঠার নাম নেই।এতো ডাকা লাগে কেন?”—খুব বিরক্ত শোনায় তথার স্বর।
ইউসুফ হাই তুলে। তথার দিকে চেয়ে বলেঃ” আপনি ডেকেছেন কেন? আগেই চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতেন।আমি আরো আগেই উঠতাম।”
_” আমি চুলে হাত বুলাইনি,বিরক্ত হয়ে টেনে দিয়েছি।বাজে কথা বাদ দিন।আমাকে একটু হেল্প করতে হবে।”
_” আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।আর কীসের হেল্প?”
__” ডিরেক্টরের কাছ থেকে সোনালীর ডিটেইলস নিয়ে দিন না প্লিজ।”
ইউসুফ কপাল কুঁচকায়।গা থেকে কাঁথা নামিয়ে বলেঃ” কেন?”
_” সোনালী ঢাকা চলে গেছে।ওর সাথে একটু কথা বলব।ওর ফোন তো নেই,তাই ওর বাড়িতেই কথা বলব।ওর খোঁজ-খবর নেব একটু।”
_” আপনাদের শুটিং কি শেষ?”
_” উঁহু। ”
_” কাজের মাঝ থেকে গেল! কান্ড জ্ঞানহীন কেন এরকম? টাকা নেওয়ার সময় তো ঠিকই নিতে পেরেছে। এখন কাজের বেলায় ফাকি দিলে চলবে?ও কি কাউকে জানিয়ে গেছে? মানে এরকম কাজের মাঝ থেকে চলের যাওয়ার তো কোনো রুলস নেই।”
ভয়াবহ বিরক্ত হয় তথা।কীসের জন্য ডাকলো আর এ কি বলছে।ইউসুফের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেঃ” এই যে এটা পড়ে দেখুন।ও জরুরি কাজে গেছে,শখে যায়নি।তাছাড়া,যেই ঘোড়ার কাজ হয় এখানে।এখানে থাকার চাইতে না থাকা ভালো।আমিই তো বলেছি এমন ভুংভাং কাজ দেখলে এখানে আর থাকবই না।বাড়ি চলে যাব।”
চিঠিটা বারকয়েক পড়ে ইউসুফ।তারপর তথার দিকে চেয়ে বলেঃ” মেয়েটা তো বললোই ওর কাজ আছে তাই চলে গেছে।ওর খোঁজ নেওয়ার জন্য আপনি এতো উতলা হচ্ছেন কেন?”
_” আমার কেমন যেন লাগছে।ওর কাছে ফোন নেই যে জরুরি খবর আসবে।কি এমন কাজ পড়লো যে এতো রাতেই পঞ্চগড় ছাড়তে হলো? তাছাড়া ও তো একটুখানি মেয়ে,যেতে পারলো কি না।”
_” এতো চিন্তায় আপনার কি কাজ? ”
_” আশ্চর্য! আমার রুমমেটের খবর আমি না নিলে কে নেবে? আর আপনিই এতো খবরদারি করছেন কেন? আমি কোনো পাপ করছি? আমি আপনার উপর খবরদারি করেছি? এই যে আপনি এতো সকালে গোসল করেছেন, আমি কি এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছি? আপনি দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন,আমি এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেছি? করিনি তো। তাহলে আপনি কেন এতো প্রশ্ন করছেন? সামান্য ডিটেইলস জোগাড় করতে বলেছি,খুন করতে বলিনি।তাতেই এতো প্রশ্ন আপনার।কেমন প্রেমিক আপনি?”— এক নাগাড়ে এতোগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে তথা।কথার শেষে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
ইউসুফ মুচকি হেসে বলেঃ” বলেননি কিন্তু বলতে বলতে আবার সবই বলে ফেলেছেন।গরম লাগছিলো বলে সকালে গোসল করেছি আর দরজা আঁটকানোর কথা মনেই ছিল না।আর আপনিও একটা পাগল কামিনী ফুল।কয়টা বাজে দেখেছেন?মাত্র সাড়ে পাঁচটা।ডিরেক্টর এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছে? ঘুম থেকে তুলে তো আর আরেক মেয়ের খবর নিতে পারি না।আরেকটু সকাল হোক,ডিরেক্টর ঘুম থেকে উঠুক।”
ইউসুফের হাত থেকে খপ করে চিঠিটা নিয়ে নেয় তথা।সকাল সকাল একদম বিরক্ত করে ফেললো খাটাশ লোকটা।তথা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে আঙুল তুলে বলেঃ” তাহলে ডিরেক্টরের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করুন আপনি।আমি আসছি।কিন্তু সোনালীর বাড়ির নম্বর যদি আমাকে না নিয়ে দিয়েছেন,তবে খবর আছে আপনার।কথাই বলব না আর। মনে থাকে যেন।”
ধুপধাপ পা ফেলে বেড়িয়ে যায় তথা।যাওয়ার সময় ঠাস করে দরজা আঁটকে দেয়।ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়েটা বোকা।শিয়ালের কাছে মুরগীর খবর নিতে এসেছে।ইউসুফ আস্তে আস্তে নিচে নেমে দাঁড়ায়।হাত-পায়ের পোড়া জায়গাগুলো থেতলে গেছে একদম।হাঁটুটাও ব্যাথা।মেয়ের শরীর তো নয় যেন আস্ত লোহা।মেয়েমানুষ এতো শক্ত-পোক্ত হবে কেন? এরা মোমের মতো নরম হবে। ছুঁয়ে দিলে গলে যাবে।সোনালী মেয়ে? বাবারে বাবা! এক মেয়েকে সামলাতে জানটা বেরিয়ে গেছে ইউসুফের।ইউসুফ ফোনে চোখ বুলায়।আরেকটু সকাল হলেই দুজন বডিগার্ড আসবে।দরজায় পাহারা বসাতে হবে।কেউ যাতে বেরোতে না পারে বাড়ি থেকে।ভাগ্যিস সেই নদীর পাড়ে সোনালীর মারকুটে ভাব দেখে ইউসুফের সন্দেহ হয়েছিল।তারপরে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিতেই তো থলের বিড়াল বেরিয়ে এলো।নাহয় ইউসুফ জানতেই পারতো না, সোনালী এস.বি অফিসার।তাছাড়া,কাল রাতে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যদি মামুনের ঘর থেকে সোনালীকে বেরিয়ে যেতে না দেখতো,সোনালীকে অনুসরণ না করতো,তবে সোনালী কি করতো আল্লাহ মালুম।কাল খুব বাঁচা বেঁচে গেছে ইউসুফ। এখানে আসার আগেই বডিগার্ড নিয়ে আসা উচিত ছিল।কোনোরকম নিরাপত্তা ছাড়া এখানে এসে একটুও ভালো হয়নি।খুব ভুল হয়ে গেছে।ভুলের মাশুল কীভাবে দিতে হয় আল্লাহ মালুম।সোনালী নিশ্চয়ই একা আসেনি। আরো কয়জন এসেছে কে জানে।গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর এসেছে অনেকগুলো অফিসার এসেছে এখানে।কিন্তু খোলামেলা কারো নাম জানতে পারেনি ইউসুফ।ওর বিরুদ্ধে এবার এতো উঠেপড়ে লেগেছে কেন সবাই? তথাকে নিয়ে খুব বেশিদিন থাকা যাবে না এখানে। মেয়েগুলোর একটা গতি করেই পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে হবে।ততোদিন ভালোয় ভালোয় দিন কাটলেই হয়।ইউসুফ খুড়িয়ে খুড়িয়ে জানলার কাছে যায়।ওই যে বয়স্ক অর্জুন গাছটা দেখা যাচ্ছে।গাছের সামনে জীর্ন-শীর্ণ বহু পুরোনো ঘরের একাংশও দেখা যাচ্ছে।ইউসুফ ঘাড় উচিয়ে আরো দূরে নজর দেয়।অদ্ভূত দুটো সবুজ মনি দিয়ে একটা কবর খোঁজে।অপক্ক হাতে করা কাঁচা একটা কবর,যার মাঝে শুয়ে আছে ভীষণ সাহসী একটা মেয়ে।তবে মানুষের শেষ ঠিকানা চোখে পড়ে না ইউসুফের।সে ঘাড় নামিয়ে ফেলে।ঠোঁটের কোনে অহংকারের হাসি ফুটে ওঠে। আহমেদ ইউসুফের পতন এতো সহজ নয়।
***
খাটের উপর মামুনের অর্ধেক শরীর।ঠিক কোমড়ের নিচের অংশটুকু খাটের নিচের দিকে ঝুলে আছে।মামুনের ঘরে দুটো জানলা।দুটো জানলাই বন্ধ।তাই সকালের আলো এখনো ঘরে আসেনি।ঘরের লাইটটা জ্বলছে এখনো।মামুন চোখ খোলে ধীরে ধীরে।মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করেছে।চোখ খুলে ঘাড় নাড়ানোর চেষ্টা করে মামুন।শুধু ঘাড় নয় হাত-পা-কোমড় সব নাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু হচ্ছে না।সব যেন একে অন্যের সাথে আঁটকে গেছে।মামুন বহু কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানপাশে তাকায়। বাদামী রঙের জ্যাকেটটা দেখা যাচ্ছে খাটের একপাশে।মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় কাল রাতের ঘটনা।সোনালী এসেছিল,তারপর জ্যাকেট চাইলো,মামুন জ্যাকেটের হাতা শুকলো, তারপর….।ডানহাতের আঙুল তুলে কপাল চেপে ধরে মামুন।জ্যাকেটের হাতায় কিছু ছিল।খুব সম্ভবত ক্লোরোফর্ম ছিল। বোকার মতো সোনালীর কথা শুনে জ্যাকেটের গন্ধ নেওয়া উচিত হয়নি।মামুন উঠার চেষ্টা করে।শুয়ে থাকলে চলবে না এখন।প্রথমে ঘাড় তোলে,তারপর মাথা,তারপর কোমড়ের উপরের অংশ,তারপর পা দুটো।অসাড় শরীরটাকে সচল করতে টানা দশ মিনিট সময় লাগে মামুনের। মেয়েটা ভীষণ চালাক।বুদ্ধি করে পঙ্গু করে দিয়েছে একদম।মামুন ধীরে ধীরে উঠে বসে।হাত-পা ঝাড়া দেয়।গলা শুকিয়ে কাঠ।শরীরের জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা হচ্ছে।সোনালীর উপর খুব রাগ জমে মামুনের।আজকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবে।এরপর যা থাকে কপালে।রাতদুপুরে অজ্ঞান করে কি লাভ হলো মেয়েটার? মামুন টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নেয়।ঢকঢক করে শেষ করে বোতলে অর্ধেক পানি।ঘড়ির দিক্ব নজর বুলায় একবার। সারে নয়টা বাজে।ধীরগতিতে দরজার কাছে যায় মামুন।ছিটকিনি দেওয়া নেই।অলস হাতে দরজা খোলার আগেই হাত গুটিয়ে নেয় মামুন।বাইরে থেকে দুটো গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।ফিসফিস করে কথা বলছে তারা।দুটো পরিচিত কন্ঠস্বর।মামুনের কপাল কুঁচকে যায়। কি এতো ফিসফিস করছে এরা? সে কান পেতে রাখে দরজায়।কাঠের দরজার সাথে একটা কান একদম চেপে ধরে।হ্যাঁ, ওই তো শোনা যাচ্ছে এখন।খুব গোপন কথাগুলো স্পষ্ট কানে আসছে মামুনের।মামুন মনোযোগ দেয়।মন-প্রাণ-মস্তিষ্ক সব সচল হয়ে উঠে মুহূর্তেই।
শাফিন তথার উপর বিরক্ত হয়।ফিসফিস করে বলেঃ” এটা সোনালীর হাতের লেখা নয় তথা।”
_” আপনি বললেই হলো? এটা সোনালীর হাতের লেখা না হলে কার লেখা হবে? আমি নিজে আমার ঘরে পেয়েছি এটা।”
_” সোনালীর হাতের লেখা আমি খুব ভালো করে চিনি।”
তথা কপাল কুঁচকায়।গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আপনি কি করে চিনেন? আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? এখানে আসলে কি হচ্ছে বলুন তো?”
শাফিন ফাঁকা ঢোক গিলে।তথাকে খুলে বলবে সব? সোনালীর ব্যাপারে,বাকি সবার ব্যাপারে? না,এখনও বোধহয় সময় হয়নি।তথার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নেয় শাফিন।ভাঁজ করে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলেঃ” আপনি যতটুকু জানেন,তাই নিয়ে খুশি থাকুন।সবটা জানানোর সময় হলে আমি নিজেই জানাব আপনাকে।”
তথাকে অতিক্রম করে সামনে যেতে চাইলে বাধা দেয় তথা।নিচু স্বরে বলেঃ” আমার আর ভাল লাগছে না শাফিন।সত্যি আর ভাল লাগছে না।একটা বাজে লোকের সাথে অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত আমি।যতবার তার সামনে যাই ততোবার দুঃখে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।যতবার তার যত্ন নিতে হয়, ভালোভাবে তার সাথে কথা বলতে হয়, ততোবার নিজের উপর ঘৃণা হয়।এর শেষ কোথায় শাফিন? আপনি না এস.বি অফিসার? স্টেপ কবে নেবেন আপনি?”
এই প্রথম তথার জন্য খুব খারাপ লাগে শাফিনের।মেনে নেয় অভিনয় করতেও কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।শাফিন কথা সাজিয়ে নেয়।নরম গলায় বলেঃ” আরেকটু কষ্ট করুন তথা।আর একটু প্লিজ।আমি সবটা গুছিয়ে নেব খুব দ্রুত।”
সামনে পা বাড়িয়েও আবার থেমে যায় শাফিন।পিছু ফিরে বলেঃ” আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম তথা।ইরফান এসেছে আপনার খোঁজ নিতে।কালকে এসেছে। এখনো আছে বোধহয় এখানেই।আমার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।”
আর দাঁড়ায় না শাফিন।দ্রুত গতিতে সামনে চলে যায়।পিছনে ফেলে যায় হতভম্ব তথাকে।তার কান জুড়ে ঝুমঝুমিয়ে বাজে কেবল দুটো শব্দ।ইরফান এসেছে।হ্যাঁ, এসেছে।সেই টলটলে চোখের প্রেমিক পুরুষ এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে।কারণ?কারণ তথা।একমাত্র তথার জন্যই এসেছে সে।গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের শেষে কালবৈশাখীর উত্তাল হাওয়া যেমন প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেয়,ঠিক তেমনি এক পশলা ঠান্ডা হাওয়া তথার সর্বস্ব ছুঁয়ে দেয়।তথার মন-প্রাণ বসন্ত বাতাসে নেচে উঠে।তথা কান পেতে সুখ কাব্য শোনে।আশেপাশে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দুটো শব্দ। মন শান্ত করা জাদুকরী দুটো শব্দ।ইরফান এসেছে,ইরফান এসেছে,ইরফান এসেছে।।।
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৫)
#হালিমা রহমান
ইউসুফের খুব বিশ্বাসী মানুষটার নাম মামুন।বিশ্বাসী বলতে একদম বিশ্বাসী।দরজার এপাশে দাঁড়িয়েই মামুন চিনতে পারে গলার স্বর। বুঝতে পারে বাইরে এতোক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলছিলো শাফিন ও তথা।খুব বড় ষড়যন্ত্র চলছে এখানে।মামুন দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।তথা তখন শাফিনকে স্টেপ নেওয়ার কথা বলল।তার মানে শাফিনও সোনালীর মতো গোয়েন্দা।আর তথা নিজেও সব জানে।ইউসুফের সাথে তার ভালো ব্যবহার অথবা এতো ঘনিষ্টতা সম্পূর্ণ অভিনয়।দুয়ে-দুয়ে চার মেলাতে খুব কষ্ট হয় না মামুনের।সবকিছু পরিষ্কার হতেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়।এতো ছলনা! ছিঃ! ইউসুফ যেমনই হোক, তথার বিষয়ে সে একদম স্বচ্ছ।তথাকে সে সত্যিই খুব পছন্দ করে।প্রতাপশালী আহমেদ ইউসুফের দূর্বলতা বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা একমাত্র তথা।তথার বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা জমে মামুনের মনে।হয়তো ইউসুফের কাজ-কর্ম সম্পর্কে সে সবকিছু জেনে ফেলেছে।কিন্তু তাতে কি? ইউসুফের গন্ডি থেকে বাইরে বেরোতে পারবে সে? ইউসুফের নাকের ডগা দিয়ে ঢাকা যাওয়ার ক্ষমতা আছে তথার? উঁহু, কখনোই নেই।আর শাফিনের সাথে বন্ধুত্ব করেছে ওই বোকা মেয়ে।মামুন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।সোনালীও অফিসার, শাফিনও অফিসার।সোনালীকে সে ইউসুফের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেবে না।প্রয়োজন হলে অজ্ঞান করে ঘরে শুইয়ে রাখবে।তবুও ইউসুফের মুখোমুখি হতে দেবে না। আর বাকি রইলো শাফিন।ও আর এমন কে? গলায় দুটো আঙুল চেপে ধরলেই হবে।ওই একটিখানি ছেলেটার প্রাণ বের করা খুব কষ্ট নাকি?
বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়েই পুরো পরিকল্পনা সাজায় মামুন।কিভাবে কি করতে হবে, কিভাবে চলতে হবে –সব।তথাও এখন ইউসুফের বিরুদ্ধে।এতো বড় খবরটা ইউসুফকে জানাতে হবে না? মামুন ইউসুফের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজা খোলে।বসার ঘরে কতগুলো মেয়ে বসে বসে গল্প করছে।একপাশে ডিরেক্টরকেও দেখা যায়।মামুন আঁতিপাঁতি করে সোনালীকে খোঁজে।চোখের সামনে পেলেই ঠাটিয়ে চড় মারবে।নিশ্চয়ই কালকে অভিযানে বেরিয়েছিল। আগেরবার মামুন দেখে ফেলেছিল বলেই হয়তো কাল অজ্ঞান করে রেখে গেছে।কত সাহস! মেয়ের সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারে না মামুন।সোনালীকে না দেখলেও চোখে পড়ে তথা। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইউসুফের সাথে কথা বলছে।মুখে তার মিষ্টি হাসি।ইউসুফের মুখেও হাসি।কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে দুজনে! মনে হচ্ছে একটি সুখী দম্পতি একান্তে সময় কাটাচ্ছে।ইউসুফের হাসি দেখে কষ্ট হয় মামুনের।মানুষটা জানে না একজন সফল অভিনেত্রীর অভিনয় চলছে ওখানে।তথার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় মামুন।ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। ওই মেয়ের সবটা জুড়েই কেবল ছলনা আর ছলনা। মামুন হাম্মামখানার দিকে পা বাড়ায়।হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেতে হবে আগে।তারপর নাহয় ইউসুফের কাছে যাওয়া যাবে।ততোক্ষণ মন ভরে আরেকটু অভিনয় করুক তথা।
***
_” আমার কামিনী ফুলটা আজকে একটু বেশিই খুশি।”
_” হ্যাঁ, একটু না এই এতোখানি খুশি।”– দু-হাত প্রসারিত করে প্রসন্নতার মাত্রা বোঝায় তথা।
_” এতো খুশির কারণ?”
_” বসন্ত বাতাসের খোঁজ পেয়েছি।আমি খুশি না হলে কে খুশি হবে?”
ইউসুফ বারান্দার রেলিঙে পিঠ ঠেকায়।এক ভ্রু তুলে বলেঃ” বসন্ত বাতাস! সেটা আবার কি জিনিস? এখন তো শীতের হাওয়া বইছে। ”
_” এগুলো আপনি বুঝবেন না।এগুলো বুঝতে হলে ঠিকঠাকভাবে প্রেমে পড়তে হয়। আমি তো পড়েছি,তাই এসব বুঝি।”— বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে উত্তর দেয় তথা।
ইউসুফ মৃদু হাসে।তথার দিকে মাথা ঝুকিয়ে বলেঃ” আমি প্রেমে পড়িনি? ”
_” উঁহু, একটুও না।”
_” কে বলল?”
_” আমিই বললাম।প্রেমিকের চোখ দেখলেই বোঝা যায় সে প্রেমে পড়েছে।অথচ আপনার চোখ আমি বুঝতেই পারি না।আপনার চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন লাগে। আপনার মতো আপনার চোখও অন্যরকম।”
_” সেটা কি আর আমার দোষ? আপনাদের মতো কালো মনি আল্লাহ আমায় দেয়নি। এখন আমি আর কি করতে পারি।কিন্তু আমার এই ভিন্নরকম চোখের উপরেই সেকেন্ডে কত মেয়ে ক্রাশ খায় তার হিসাব জানেন? আপনার সাহেবের রূপটাও তো সহজ নয়।”— চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে দেয় ইউসুফ।
তথা ভালোভাবে একবার নজর বুলায় ইউসুফের উপর।হ্যাঁ, এটা মানতেই হবে।ইউসুফের মতো এমন রুপ সহসা চোখে পড়ে না।এরকম কাটকাট বডি অথবা নজরকাড়া স্টাইল শুধু গুটিকয়েক নায়কের মাঝে দেখেছে তথা।যেকোনো মেয়েকে আকর্ষণ করার তীব্র ক্ষমতা আছে আহমেদ ইউসুফের। তথা চোখ ফিরিয়ে নেয়।শারীরিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হলেও মনের সৌন্দর্য কি আছে? উঁহু, একট নেই।সবাই তো আর তথার মতো ভিতরের খবর জানে না। তথার ভালো লাগে না ইউসুফকে।একটুও ভালো লাগে না।তার তো ভালো লাগে ওই পুরান ঢাকার ছেলেটাকে।যার একজোড়া চোখ টলটল করে প্রেয়সীর প্রস্থানে,যে ভীষণভাবে নির্লজ্জ, রাস্তা-ঘাটে কানের কাছে যে ভ্যানভ্যান করে প্রেমের কথা বলে,যার যন্ত্রণায় শান্তিতে রাস্তায় বেরোতে পারে না তথা,যে প্রেতাত্মার মতো সকাল-বিকাল অনুসরণ করে — তাকে খুব ভালো লাগে তথার।কিভাবে কি হয়ে গেল জানা নেই।তবে এখানে আসার পর কাকা-কাকি,রুবি,মাহাদী এই চারজনের পর যদি আর কারো কথা মনে পড়ে তবে সে একমাত্র ইরফান। বাস স্টেশনে ইরফানের পাগলামিগুলো প্রায়ই মনে পড়ে তথার।অজান্তেই তথার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে। আসলেই একটা পাগল লোকটা।
_” কামিনী ফুল ”
_” হুম।”
_” আমরা বিয়ে করব কবে?”
তথা হাসে।শান্ত গলায় বলেঃ” এতো তাড়া কীসের? আস্তে-ধীরে হোক সবকিছু।এখন তো আমি প্রেমিকা।বিয়ে হলেই বউ হয়ে যাব।তখন সবকিছুতে খবরদারি করব। হয়তো তখন আর ভালো লাগবে না আমাকে।আমি শুনেছি ছেলেদের বউয়ের চাইতে প্রেমিকা বেশি পছন্দ।”
_” এসব ফাউল কথা-বার্তা কে বলে আপনাকে? আমার বউও চাই, প্রেমিকা চাই। প্রেমিকাকেই বউ হিসেবে চাই।আমরা বিয়ের পর লাহোর চলে যাব, ঠিকাছে?”
ইউসুফের চোখ একরাশ স্বপ্ন দেখে।তবে ইউসুফের কথা শুনে তথার চক্ষু চড়কগাছ। কত সাহস হারামজাদার! লাহোরে যাবে! হুহ,মামা বাড়ির আবদার।
তথা মুখ ভোঁতা করে বলেঃ” মোটেও না।আমরা এখানেই থাকব। ডাহুক নদীর তীরের এই বাড়িতেই থাকব।এই জায়গাটা খুব পছন্দ আমার।বিয়ের পর বউ নিয়ে লাহোর যেতে হলে অন্য মেয়ে খুঁজে নিন।লাহোর-টাহোর যেয়ে থাকতে পারব না আমি।”
_” এখানেই থাকবেন?”
_” হুম,এখানেই থাকব।”
ইউসুফ তথার দিকে একপা এগিয়ে যায়।অপলক চোখে প্রেয়সীর দিকে চেয়ে বলেঃ” আচ্ছা,ঠিকাছে।আমার বেগম যা বলছে তাই হবে।আমরা এখানেই থাকব।এই বাড়িটাকেই নতুন করে সাজাব।বাড়ির সামনে উঠানটুকুতে ফুলের বাগান করব।হরেক রকম ফুল ফুটবে এখানে।আর আমি সতেজ ফুলগুলো যত্ন করে তুলে বেগমের খোঁপায় গুজে দেব। আমার বেগম প্রতিদিন শাড়ি পড়ে রান্নাঘরে লেপ্টে বসে রান্না করবে আর আমি দু-চোখ ভরে দেখব।বিকালগুলো কাটাব এক কাপ চা ভাগাভাগি করে।অথবা কখনো নদীর তীরে ঘুরতে যাব।সন্ধ্যাগুলো আরো রোমাঞ্চকর হবে।আমার বেগম মৃদু আলোয় সন্ধ্যার নাস্তা বানাবে, আমি পাশে বসে সাহায্য করব।সে যেদিকে যাবে আমিও আঁচল ধরে তার পিছু পিছু যাব। একদম বাধ্য স্বামীর মতো।আমি কিন্তু খুব বেশি বাংলা পড়তে জানি না।আমাকে ওই মোটা মোটা উপন্যাসের বই পড়ে শোনাতে হবে।অথবা আমরা কচ্ছপের মতো এক কাঁথার নিচে শরীর লুকিয়ে মুভি দেখব।ঠিকাছে?”
তথা ফাঁকা ঢোক গিলে। কত কত স্বপ্ন তাকে ঘিরে! একটা নির্দয় অপরাধীর চোখেও এতো স্বপ্ন থাকতে পারে? তথা আশ্চর্য না হয়ে পারে না।ইউসুফের কাছ থেকে একটু দূরে সরে বলেঃ” আগে আগে এতো চিন্তা-ভাবনা করা উচিত না।ভবিষ্যতের ভাবনাগুলো ভবিষ্যতের উপরেই ছেড়ে দিন।আমিও পালিয়ে যাচ্ছি না, আর আপনিও আছেন।তাহলে আগে-ভাগেই এতো পরিকল্পনা করে লাভ আছে?”
ইউসফ খানিক বিরক্ত হয়।কপাল কুঁচকে বলেঃ” সবকিছুর আগেই প্ল্যানিং করা উচিত।একটু রোমান্টিক হতে শিখুন, কামনী ফুল।আমি তো ভাবছি ফ্যামিলি প্ল্যানিংটাও সেড়ে রাখব এখনি।আগামী বছরেই ইনশাআল্লাহ কামিনী ফুলের কলি আসবে আমার ঘরে।আমার কামিনী ফুলের মতো সেও একদম মিষ্টি একটা ফুল হবে।ছোট দুটো হাত থাকবে,দুটো পা থাকবে।আমি এভাবে দু-হাতে আঁকড়ে ধরব। আমাকে বাবা ডাকবে, আপনাকে মা। উফ! আমার ভাবতেই ভালো লাগছে।কত দিনের শখ আমার।জানেন আমার কিন্তু বাচ্চা খুব পছন্দ।বছর ঘুরতেই আবার আরেকটা কলি আসবে, তারপর….”
_” স্যার”
মামুনের কন্ঠ পেয়ে কথা থামিয়ে দেয় ইউসুফ।বিরক্ত চোখে তাকায় মামুনের দিকে।কোনো সময় -জ্ঞান নেই ছেলেটার।কত ভালো সময় কাটাচ্ছিল ইউসুফ।মামুনের দিকে চেয়ে বিরক্ত চোখে বলেঃ” কিছু বলবে,মামুন?”
_” জ্বি,স্যার।”
_” স্টাডি রুমে যেয়ে বসো।আমি দু-মিনিটে আসছি।”
_” ওকে স্যার।”
তথার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মামুন।অভিনয় কাকে বলে, এবার তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে এই মেয়ে।গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে স্টাডি রুমের দিকে পা বাড়ায় মামুন।
_” আসছি, কামিনী ফুল।আধ-ঘন্টার মাঝেই আবার ফিরে আসব।আপনি অপেক্ষায় থাকুন।”
তথার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টাডি রুমের দিকে চলে যায় ইউসুফ ইদানিং নিজেকে খুব সুখী সুখী লাগে।মনে হয় যেন না চাইতেই সব পেয়ে গেছে।এতো সহজে এতোকিছু হবে তা কল্পনাও করেনি ইউসুফ।মাঝে মাঝেই এখন তীব্র আফসোস হয় তার।তথার সাথে আর দশ বছর আগে কেন দেখা হলো না? তাহলে ইউসুফের পৃথিবীটা আরো আগেই রঙিন হতো।
***
সমীর,মলয়,শাফিন ও আরিফকে অশ্বত্থ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল সৌরভ।চারজনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে।সৌরভ এগিয়ে যেতেই সমীরের কন্ঠ কানে আসে তার।সে বেশ জোর দিয়ে শাফিনকে বলছেঃ” স্যার,ম্যাম কালকে বলেছিলেন তিনি প্রমাণ পেলেই ঢাকায় চলে যাবেন।এমনও তো হতে পারে, ম্যাম ঢাকা চলে গেছেন।সেখানে পৌঁছে আমাদেরকে খবর দেবেন।”
শাফিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় সমীরের কথা। হাত নেড়ে বলেঃ” অসম্ভব।সোনালী কোনো আপডেট না দিয়ে কেন যাবে? আর যাবেই বা কীভাবে? এতো রাতে গাড়ি কোথায় পাবে ও?”
মলয় বলেঃ ” শাফিন, সোনালীর জামা-কাপড়ও পাওয়া যাচ্ছে না।হতেই পারে সে আমাদেরকে জানানোর সময় পায়নি।আগেই চলে গেছে।ঢাকা পৌঁছে আমাদেরকে আপডেট দেবে।”
শাফিন দু-আঙুলে কপাল চেপে ধরে।ধরা গলায় বলেঃ” সব আমার দোষ।কাল কেন যে ওকে একা যাওয়ার অনুমতি দিলাম! সোনালীর ঢাকা যাওয়ার কথাটা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।তাছাড়া এই চিঠিটাও ভুয়া।এটা মোটেও সোনালীর লেখা না।তাই চিন্তা আরো বেশি হচ্ছে।”
এতোক্ষণে মুখ খোলে সৌরভ।শাফিনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেঃ” কি হয়েছে, শাফিন?”
_” সোনালীকে খুঁজে পাচ্ছি না সকাল থেকে।কাল রাতে অভিযানে বেরিয়েছিল। তারপর থেকেই আর কোনো খোঁজ নেই।”
_” রাতে তোমাদের সাথে কোনো কথা হয়নি ওর?”
_” হয়েছিল স্যার।ম্যাম আমাদেরকে বলেছিল,কোনো প্রমাণ পেলেই ঢাকা চলে যাবে।কিন্তু স্যার এই কথাটা মানতেই চাইছে না।”— সৌরভের প্রশ্নের উত্তর দেয় সমীর।
সৌরভ আবার কিছু বলার আগেই আরিফ বলেঃ” আমারও তোমার কথা মানতে কষ্ট হচ্ছে সমীর।ও কি পেলো না পেলো তা জানাবে না কাউকে! সোনালী এতোটা কান্ড-জ্ঞানহীন নয়।”
_” এক্সাক্টলি। ঠিক এই কথাটাই বুঝাতে চাইছি আমি।”— আরিফের কথায় যেন প্রাণ ফিরে পায় শাফিন।মলয়ের দিকে চেয়ে বলেঃ” বুঝতে পারছো মলয়? আমি এই কথাটাই বলছি আমি।”
মলয় কয়েক সেকেন্ড ভাবে।তারপর ভাবুক স্বরে বলেঃ” তাহলে আমাদেরও একবার বাড়ির পিছনে যাওয়া উচিত। এমনও হতে পারে ওখানে কিছু পেতেও পারি।”
আরিফ তার চশমার ফ্রেমটাকে উপরের দিকে ঠেলে বলেঃ” তবে এক কাজ করি।আমি যাই শুধু।সবার একসাথে যাওয়ার কি দরকার? তোমরা এদিকে খেয়াল রাখো,আর আমি ওদিক দিয়ে সুযোগ পেলেই চলে যাব। গোডাউনটা যেন কোথায় শাফিন?”
_” অর্জুন গাছের সামনে।তবে ঘরের পিছনেও একটা দরজা আছে,সেদিক দিয়েই ঢুকতে হয়।চাবি ছাড়া ঢুকতে পারবে না কিন্তু।চাবি ইউসুফ ও মামুনের কাছে আছে।ঢুকতে হলে ওখান থেকে চাবি কালেক্ট করতে হবে।বুঝতে পেরেছো?”
আরিফকে সবটা বুঝিয়ে দেয় শাফিন। অস্থিরতা কাজ করছে খুব। সকাল থেকে এ নিয়ে চৌদ্দবার পুরো বাড়ি খোঁজা শেষ। কোথায় নেই সোনালী।
—” সোনালী যেন ঢাকায় চলে যায়।ওকে ভাল রেখো খোদা”–সৃষ্টিকর্তার কাছে আরেকবার প্রাণ ভরে দোয়া করে শাফিন।কেন যে কালকে একা ছাড়লো সোনালীকে? এত বড় ভুলটা না করলেই হতো।অনুশোচনায় ভিতরটা পুড়ে যাচ্ছে শাফিনের।বোনকে সঙ্গ না দিয়ে ঘুমানোর অপরাধে দেয়ালে মাথা ফাটিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।এতো বড় ভুল কি করে করতে পারলো শাফিন?
***
মামুনের দিকে একগোছা চাবি ছুঁড়ে মারে ইউসুফ।বেতের চেয়ারে বসতে বসতে বলেঃ” শরীর কেমন এখন?”
মামুন এক নজর তাকায় চাবির দিকে।এটা তো মানিব্যাগে ছিল।এখানে কি করে এলো?
বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করেঃ” এটা আপনার কাছে কি করে এল স্যার?”
_” উদ্ধার করেছি।কাল সোনালী তোমার ঘর থেকে চুরি করেছিল এটা।আমি ওর পিছু নিয়েছিলাম।”
মামুন ফাঁকা ঢোক গিলে।অস্থির লাগছে খুব।সোনালী গোডাউন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল! আর ইউসুফ তার পিছু নিয়েছিল মানে? ইউসুফ কি সব জেনে ফেললো?
মামুন ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেঃ” ছোট্ট মেয়ে এখন কোথায় আছে স্যার?”
_” যেখানে আগে গনকবর ছিল সেখানে।গোডাউনে রক্তমাখা কতগুলো ছুঁড়ি আছে।ওগুলোর কোনো একটা ব্যবস্থা করো তো।রক্ত হয়তো শুকিয়ে গেছে।সময় করে ফেলে দিও একসময়।আরে মামুন,কোথায় যাচ্ছ? মামুন…”
হতভম্ব ইউসুফকে পিছনে ফেলে পাগলের মতো বেরিয়ে গেল মামুন।তার দমটা আঁটকে আছে।ইউসুফের কথা শোনার সময় কোথায় তার? তাকে এখন ছুটতে হবে।একছুটে চলে যেতে হবে তার প্রাণপ্রিয় প্রিয়তমার কাছে।
***
জমিদার বাড়ির পিছনে বিশাল অর্জুন গাছের পাশেই জমিদার বংশের মানুষদেরকে গনকবর দেওয়া হয়েছিল।তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। কবরের উঁচু মাটি নিচু হয়ে গেছে।মামুন কতবার এই জায়গার উপর দিয়ে হেঁটে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।গনকবরের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কখনোই গা কাঁপেনি মামুনের।কিন্তু এখন কাঁপছে। উঁচুু মাটির স্তূপের দিকে চেয়ে তীব্রভাবে শরীর কাঁপছে মামুনের। হাত-পা কাঁপে থরথর করে।হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে মামুন।কিভাবে এ অবধি এসেছে তা জানা নেই।বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।মনে হচ্ছে কেউ যেন অনবরত ছুঁড়িকাঘাত করছে। মাছের মত ঘোলা চোখে আশেপাশে তাকায় মামুন।গাছের পাতা ঝরে পড়েছে কবরের উপর।মাটিতেও জুতোর ছাপ।এবড়োখেবড়ো মাটিতে বড় কালো পিঁপড়েদের আনাগোনাও চোখে পড়ে। মামুনের প্রাণপ্রিয় রমনী খুব অযত্নে শুয়ে আছে এখানে।মামুনের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।আশেপাশে মনে হচ্ছে অক্সিজেনের খুব অভাব।শ্বাসকষ্টের রোগীদের মতো থেমে থেমে শ্বাস নেয় মামুন।যন্ত্রণার স্বাদ এতো তেতো? মনে হচ্ছে মামুন মরে যাচ্ছে।হামাগুড়ি দিয়ে বহু কষ্টে কবরের কাছে এগিয়ে যায় মামুন।উঁচু -নিচু মাটির এ মাথা- ও মাথা সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয়।পারলে বুকের সব প্রেম ঢেলে দিত মামুন।টুপটুপ করে ঝরে পড়ে মামুনের চোখের জল।মাথা এলিয়ে দেয় কাঁচা কবরটার উপর। একটুখানি মাটির উপর ঠোঁট বুলায়।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আমি এসেছি প্রিয়তমা।আপনার ব্যর্থ প্রেমিক হয়ে এসেছি।আপনি কি শুনতে পারছেন?”
চলবে…
চলবে….