তবুও তোমায় ভালোবাসি পর্ব ১১+১২

#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১১

আকাশের দিক থেকে চোখ নামাতেই চমকে গেলাম। করণ পাশের ছাদেই আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। পাশাপাশি বিল্ডিং হওয়ায় এ ছাদটা থেকে পাশের ছাদটা স্পষ্ট অবলোকন করা যায়।আয়ান কেমন জানি বিমর্ষ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এর একটু দূরেই আরশি দাঁড়িয়ে আছে। কেন জানিনা আয়ানকে বেশ আনমনা লাগছিল। তবে বুঝতে পারছিলাম না আয়ান পাশের ছাদে আসলো কী করে? আয়ান কী পাশের বিল্ডিংয়ে উঠেছে? আয়ানের সাথে কী তাহলে আরশির বিয়ে হয়ে গেছে? নাহয় এ সময় একসাথে তারা ছাদে কী করছে? প্রশ্ন জাগল মনে। এর মধ্যেই আয়ানের চোখে আমার চোখটা পড়লো। চোখটা পড়তেই নিজের চোখটা নামিয়ে পাশে তাকাতেই পুনরায় চমকে গেলাম। ভাবতে লাগলাম এটা কী আমার কল্পনা নাকি বাস্তবতা? নাকি মতিভ্রম? কারণ পাশেই জাহিন সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললাম

– আপনি এখানে?

জাহিন সাহেবও আমাকে দেখে হালকা চমকালো মনে হচ্ছে। উনি হয়তো এ জায়গায় আমাকে আবিষ্কার করবে সেটা ধারণা করেনি। কিছুটা বিমর্ষ গলায় উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে উঠল

– আমারও তো একই কথা আপনি এখানে?

– আমি তো এ বাসায় আছি দীর্ঘ তিনবছর যাবত। আপনাকে তো কখনো দেখিনি।

– আমিও এসেছি তিনমাস হলো। প্রতিদিন ডিউটি শেষে এ সময়টায় ছাদে কাটাই। আকাশ দেখতে ভালো লাগে বলতে পারেন। কিন্তু আমিও তো আপনাকে দেখেনি।

– হয়তো নতুন এসেছেন। ছাদে উঠি না ছয়মাস যাবত তাই হয়তো আপনি ছাদে আমাকে দেখেননি।

– হয়তো। আর হ্যাঁ আপনার ধারণা ঠিক আমি নতুন এসেছি।

– একা থাকেন নাকি পরিবার নিয়ে?

– পরিবার নিয়ে।

– পরিবারে কে কে আছে আপনার?

– শুধু মা আর বোন আছে। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন হলো।

– দুঃখিত কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

– সমস্যা নেই। ভালোই হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে। আকাশ দেখতে এসে যে পরী দেখতে পারব বুঝতে পারেনি।

– একটু বেশিই বকবক করছেন না? আপনি একটু বেশিই কথা বলেন মনে হচ্ছে।

– তা একটু বলি। ছোট বেলা থেকেই সবসময় মায়ের সাথে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতাম সে অভ্যাসটা যায়নি। তবে সবার সাথে এত কথা বলি না যাকে ভালো লাগে তার সাথে কথা বলি। এমনিতে খুব লাজুক স্বভাবের আমি।

জাহিন সাহেবের কথাটা শোনে হালকা অট্টহাসি দিয়ে পাশে তাকাতেই পুনরায় আয়ানের চোখে চোখ পড়ল। লক্ষ্য করলাম আয়ান আমার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটোতে হালকা জলের আবরণ পড়েছে। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে তখন আকাশ দেখতে ব্যস্ত।আয়ানকে দেখে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার আগেই জাহিন সাহেবের দিকে তাকালাম। জাহিন সাহেব ততক্ষণে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলাম

– তাকিয়ে আছেন কেন?

কথাটা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে উনি চোখটা সরিয়ে বলল

– আপনাকে প্রথম হাসতে দেখলাম।

আমি হালকা লাজুক গলায় একটা কাশি দিয়ে আকাশের দিকে পুনরায় তাকিয়ে রইলাম। জাহিন সাহেব আমার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা গলায় বলল

– মেঘলা আকাশ পছন্দ নাকি মেঘবিহীন?

– রক্তিম আকাশ পছন্দ।

– আচ্ছা আপনার কী করতে ভালো লাগে?

– বই পড়তে।

– হুম খুব ভালো। আপনাকে ঐ সময় কল দিয়ে বিরক্তের জন্য দুঃখিত।

– ইটস ওকে। আমারও তখন এত রাগ হওয়া উচিত হয়নি। যাইহোক বাসায় যেতে হবে। অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে।

জাহিন সাহেব মোলায়েম কন্ঠে বলল

– একটু এগিয়ে দেবো কী?

আমি বিরক্ত চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি হাতজোর করে বলল

– আচ্ছা রাগ করবেন না দয়াকরে।আপনি যেহেতু একা আসতে পেরেছেন একা যেতেও পারবেন। আমি তো এমনিই বলেছিলাম।

আমি হালকা হেসে ছাদ থেকে নীচে নামার আগে পাশের ছাদে আঁড়চোখে তাকালাম। বুঝতে পারলাম আরশি আর আয়ান খুব সুখে আছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেভাবে আকাশটা অবলোকন করছে কোনো সুখী দম্পতি ছাড়া সেটা অবলোকন করা সম্ভব না। নিজের ভেতরের চাপা কষ্টটা যেন আবার উকি দিয়ে উঠল। ভেতরে ভেতরে বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে জাহিন সাহেবকে হালকা গলায় ডাক দিয়ে বললাম

– জাহিন সাহেব আমাকে না আপনি এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? চলুন একসাথে যাওয়া যাক। আপনি কয়তলায় থাকেন?

জাহিন সাহেব আমার কথা শোনে অদ্ভুত মায়াময় একটা হাসি দিয়ে বলল

– আমি ১১ তলায় থাকি। আপনি?

– আমি তো তিন তলায় থাকি।

– সমস্যা নেই চলুন।

বলেই জাহিন সাহেব আমার কাছে আসলো। আয়ান সেটা বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করছে লক্ষ্য করলাম। আমি জাহিন সাহেবের সাথে পাশাপাশি হেঁটে ছাদ থেকে লিফটে উঠলাম। জাহিন সাহেব ১১ তলায় এসে আমাকে বলল

– চলুন আপনাকে আমার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। আমার ছোট বোনটাও আপনার বয়সী। আপনাকে দেখে খুশি হবে। আমার মা ও সারাদিন একা থাকে। একটু কথা বলার সঙ্গী পেলে খুশি হবে।

কেন জানি না জাহিন সাহেবের এ কথাটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলাম

– চলেন যাওয়া যাক।

বলেই জাহিন সাহেবের সাথে উনার বাসার দরজার সামনে গিয়ে নক করলাম। উনার বাসার দরজা খুলেছে একজন মধ্যবয়স্ক সুন্দরী মহিলা। বুঝতে বাকি রইল না উনিই জাহিন সাহেবের মা। আমি উনাকে দেখে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে জাহিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করল

– বাবা মেয়েটা কে?

– গতকালকে তোমাকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম না? নাম আয়রা।

– ওহ মনে পড়েছে। কিন্তু তুই তো বলেছিলি মেয়েটার বাসা কোথায় জানিস না। তাহলে ওকে এ সময় পেলি কোথায়?

– সৌভাগ্যবশত সে আমাদের বিল্ডিং এর তিন তলায় থাকে।

-ওহ আচ্ছা তাই বল।

কথাটা বলে আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে আমার থুতনি টা উপরে তুলে কতক্ষণ অপলকভাবে দেখে বলল

– মাশআল্লাহ ভারি মিষ্টি মেয়ে তো তুমি। কিসে পড়ো?

– অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।

– তোমার বাবা কী করে?

– ছোট খাটো একটা চাকুরি করে।

– কয় ভাই বোন তোমরা?

– দুই ভাই দুই বোন।

– বাহ খুব সুন্দর পরিবার।

আরও কিছু বলতে নিবে এর মধ্যে জাহিন সাহেব বলে উঠল

– মা তোমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি আয়রাকে নিয়ে ঘরে যাবে।

জাহিন সাহেবের কথা শোনে আন্টি হালকা হাসি দিয়ে বলল

– দেখো তো কত পাগল আমি তোমাকে এখানেই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আসো ঘরে আসো।

বলেই হাতটা টেনে ঘরে ঢুকাল। আমি ঘরে ঢুকে সোফায় বসলাম।আন্টির সাথে বেশ কথা বলতে লাগলাম। আন্টি অমায়িক একজন মানুষ। খুব সহজেই আমাকে আপন করে নিল। কথার এক পর্যায়ে আন্টি আনিসা নামের কাউকে ডাক দিল। আন্টির ডাকে সাড়া দিয়ে কেউ ওপাশ থেকে বলল

– আসছি মা।

বুঝতে পারলাম আনিসা জাহিন সাহেবের বোন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আনিসা চলে আসলো। আনিসা আসতেই আন্টি আমার দিকে উনার অঙ্গুল তাক করে বলে উঠল

– এ হচ্ছে…

কথাটা আটকে দিয়ে আনিসা বলল

– আয়রা…. তাই তো!

আমি কিছুটা অবাক হয়ে আনিসাকে জিজ্ঞেস করলাম

– আপনি কী আমাকে চিনেন?

আনিসা হালকা হেসে বলল

– চিনি না তবে আপনার ছবি দেখেছি। আর আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন। আর আমিও তুমি করে বলব।

আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনিসাকে জিজ্ঞেস করলাম

– তুমি আমার ছবি কোথায় পেলে?

আনিসা আমার কথায় হালকা হেসে আমার কথার জবাব না দিয়ে আন্টির দিকে তাকিয়ে বলল

– মা তুমি নাস্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করো আমি একটু আপুর সাথে গল্প করি।

আমি পাশ থেকে বলে উঠলাম

– আন্টি আমি কিছুই খাব না। কিছু আনতে হবে না।

– আরে কী বলো। পুডিং বানিয়েছি খেয়ে যাও। জাহিনের আবার পুডিং খুব পছন্দ। বসো আমি নিয়ে আসছি। আনিসার সাথে গল্প করো।

বলেই আন্টি উঠে গেল। জাহিন সাহেবের কথা বলতেই ভাবতে লাগলাম উনি কোথায় গেল? এতক্ষণ আন্টির সাথে কথা বলতে বলতে উনার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। অপরদিকে জাহিন সাহেবের পুডিং পছন্দ এ কথাটা বলতেই কেন জানি না আয়ানের কথা মনে পড়ে গেল। আয়ানেরও পুুডিং খুব প্রিয় ছিল। যতবারেই আয়ানের সাথে দেখা করতাম ততবারেই পুডিং বানিয়ে নিয়ে যেতাম। এসব ভেবেই পুরনো স্মৃতির সাগরে আবার ডুবে গেলাম। ভাবনায় ছেদ পড়ল আনিসার মোবাইলে ছবি দেখে। কারণ আনিসা তার মোবাইলটা আমার সামনে ধরে বলল

– বলতো এটা কে?

আমি আনিসার মোবাইলে আমার ঘুমন্ত ছবিটা দেখে বেশ অবাক হলাম। এটা তো হাসপাতালে তুলা আমারেই ঘুমন্ত ছবি। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– তুমি এ ছবি পেলে কোথায়?

– ভাইয়া দিয়েছে।

বুঝতে আর বাকি রইল না জাহিন সাহেব আমার ছবিগুলো তুলেছে। এর মধ্যেই জাহিন সাহেবের আগমন ঘটল। জাহিন সাহেব হালকা গলায় আনিসাকে বলল

– মা কোথায়?

– মা তো আপুর জন্য পুডিং আনতে গিয়েছে। তুমি বসো এখানে।

আনিসার কথা শোনে জাহিন সাহেব আমার মুখোমুখি বসলো। একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কারও চোখের পাতা নড়ছে না। চোখের পলক পড়ছে না। এর মধ্যেই আন্টির আগমনে দুজনের চোখ নামিয়ে নিলাম। আন্টি পুডিং দিল খেতে। পুডিং খেয়ে আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আনিসার কাছ থেকেও বিদায় নিলাম।জাহিন সাহেব আমার সাথে বের হলো। বাসা থেকে বের হয়ে চোখগুলো বড় বড় করে বললাম

– আমার পারমিশন ছাড়া আমার ছবি তুলেছেন কেন?

জাহিন সাহেবের মুখে তখন ভয়ের ছাপটা ফুটে উঠল।ভয়ে ভয়ে বলল

– আনিসা আপনাকে ছবি দেখিয়েছে তাই না?

– সেটা তো দেখার বিষয় না কে কী দেখিয়েছে। আপনি আমার ছবি পারমিশন ছাড়া তুলেছেন কেন সেটা বলুন।

ভয়ের ছাপটা আরও বেশি মুখে ফুটে উঠল জাহিন সাহেবের। হালকা ঢুক গিলে বলল

– এজন্য আমি দুঃখতি। এখনেই ডিলেট করে দিচ্ছি।

আমি বেচারার ভয়টা দেখে গলা নামিয়ে বললাম

– থাক ক্ষমা করে দিলাম। দ্বিতীয়বার ছবি তুললে আমাকে বলে তুলবেন। সুন্দর করে সেজে আসব।

আমার কথা শুনে জাহিন সাহেব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভয় ভয় চোখে বলল

– আপনি যা বলবেন তাই হবে।

আমি উনার কথায় মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম ভীতুর ডিম একটা। এর মধ্যে হুট করেই….

#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১২

কিন্তু হুট করেই মাথার ব্যথাটা চড়াও দিয়ে জাগল। লিফটে দাঁড়িয়েই ব্যথায় কাতরাতে লাগলাম। চোখ মুখ অন্ধকার হতে লাগল। কপালটা কুঁচকে ব্যথা সহ্য করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। অসহনীয় ব্যথাটা যেন মাথাটাকে বিগড়ে দিচ্ছে। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও অনেক কষ্ট অনুভব হচ্ছে। চোখগুলো বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ টেনেও যেন খুলতে পারছিলাম না। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই জাহিন সাহেবের হাত দুটো ধরলাম। জাহিন সাহেবের হাত দুটো ধরতেই উনি বলে উঠল

– আপনার কী মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে নাকি। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে আপনার মাথা ব্যথা করছে। ঔষধ কী ঠিক করে খেয়েছিলেন? আপনাকে সন্ধ্যায় একটা ঔষধ দেওয়া হয়েছিল। সেটা এখনো খাওয়া হয়নি হয়তো তাই এরকম হচ্ছে আপনার। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে ধরে আছি। আপনার কিছু হবে না। বাসায় গিয়ে ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।মনে সাহস রাখুন আর একটু ধৈর্য্য ধরুন।

চোখ বন্ধ করে জাহিন সাহেবের কথাগুলো শোনছিলাম আর ভাবছিলাম দুই দিনের পরিচিত একটা মানুষ আমার কত খেয়াল রাখে। উনি এটাও মনে রেখেছে আমার একটা ঔষধ সন্ধ্যায় সেবন করতে হয়। অসহনীয় মাথা ব্যথায় এমন কথা যেন মনটাকে আরও প্রশান্ত করল।আমি চোখ বন্ধ করে উনাকে ধরে রাখলাম। আর উনি আমাকে আস্তে করে আমার বাসার সামনে নিয়ে দরজায় নক করল। দরজা খুলতেই মা আমার এ অবস্থা দেখে কিছুটা চেঁচিয়ে বলল

– আয়রা তোর কী হয়েছে?

তারপর জাহিন সাহেবকে দেখে হালকা চমকে গিয়ে বলল

– বাবা তুমিই বা এখানে এসেছ কী করে?

জাহিন সাহেব মৃদু গলায় বলল

– আন্টি আগে আয়রার ঔষধটা দিন। ওর ব্যথাটা আরও প্রবল হওয়ার আগেই ওকে ঔষধ দিতে হবে। আর আমি এ বিল্ডিং এর ১১ তলায় থাকি। আমাকে একটু আয়রার ঘরটা দেখিয়ে দিন আমি ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি আর আপনি আয়রার ঔষধ টা নিয়ে আসেন।

মা জাহিন সাহেবকে আমার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে ঔষধ আনতে গেল। আর জাহিন সাহেব আমাকে নিয়ে আমার ঘরে গেল। আমি বিছানায় মাথাটা এলিয়ে দিলাম। ব্যথাটার তীব্রতা বাড়তে লাগল। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে লাগল। মা এর মধ্যেই ঔষধ নিয়ে আসলো। ঔষধ টা খাওয়ার পর জাহিন সাহেব হালকা গলায় বলল

– চোখটা বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে যাবে।

আরও কী কী যেন উনি বলছিলেন আমি শুধু শোনেই যাচ্ছিলাম। একটা সময় উনার কথার আওয়াজটা মৃদু হয়ে যেতে লাগল। বুঝতে পারলাম আমার ঘুম আসছে। কখন ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না। ঘুম থেকে উঠলাম রাত আড়াইটাতে। বেশ ক্লান্ত লাগছিল শরীর। পাশে তাকিয়ে দেখলাম জায়গাটা শূন্য। এখানেই তো জাহিন সাহেব বসে ছিল। হুট করে জাহিন সাহেবের কথা কেন মনে পড়ছে বুঝতে পারছি না। লোকটা খুব মিশুক। আবার বেশ হাসাতেও পারে। যদিও একটু বকবক বেশি করে তবুও কেন জানি না ভালো লাগে। সত্যিই জাহিন সাহেবের কথাটা ঠিক, ভালো লাগাটা হুট করেই চলে আসে। আনমনা হয়ে এসব ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে নিলাম লক্ষ্য করলাম জাহিন সাহেব মেসেজ দিয়েছে তাতে লেখা ছিল ঘুম থেকে যখনেই উঠে আমার মেসেজটা পাবেন আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে জানাবেন আপনি কেমন আছেন। আমি মেসেজটা পেয়ে একটু খুশি হলাম। কেউ একজন তো আমার ভালো থাকা নিয়ে ব্যস্ততা দেখাচ্ছে এটা ভেবে। আমি সাথে সাথে মেসেজ দিলাম

– মাত্র ঘুম ভাঙ্গল। আমি ঠিক আছি৷ আপনি যতটুকু করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।

তবে অবাক করা বিষয় হলো আমি মেসেজটা দেওয়ার সাথে সাথে রিপ্লাই আসলো

– যাক শোনে মনটা শান্ত হলো যে আপনি ভালো আছেন।

– আপনি এখনো ঘুমান নি?

– ঘুম আসছিল না। কেন জানি না আপনার মেসেজের অপেক্ষা করতে বেশ ভালো লাগছিল।

– এটা কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। দেখুন এখন আমি শুধু আপনাকে আমার বন্ধুর মতোই দেখি। আপনি এ বিষয়টাকে অন্য চোখে নেবেন না। আর আমি চাইও না আমার জীবনে পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক।

জাহিন সাহেবের রিপ্লাইটা এবার একটু দেরিতে আসলো। উনি লিখলেন

– আপনি যা বলবেন তাই হবে। আপনাকে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি আপনার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেবো না। আপনার মন যা করতে ভালো লাগে তাই করবেন। আমি শুধু আমার বিষয়টা আপনার কাছে ব্যাখ্যা করেছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যপার পুরোপুরি আপনার কাছে।

জাহিন সাহেবের কথাগুলোই বেশ মায়ার আবরণ পেলাম। একটু স্তব্ধ হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। তবে আমার এ অনিশ্চিত জীবনে কাউকে জড়ানো মোটেও উচিত হবে না। জাহিন সাহেবের এ আবেগ কেটে যাবে একদিন। কিছুটা স্তব্ধ হয়ে উনাকে মেসেজ দিলাম

– যাইহোক আপনি ঘুমান আমিও ঘুমাব।

– আচ্ছা ঠিক আছে ঘুমান।

মেসেজটা দেখে ফোনটা রেখে অজু করে আসলাম। কারণ আজকে অনেকদিন পর একটু শান্তি করে হাসতে পেরেছিলাম তার একমাত্র কারণ আমার উপরে যিনি আছেন তিনি আমাকে হাসতে সাহায্য করেছেন। তাই উনার শুকরিয়া আদায় করা জরুরি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম। মোনাজাত করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। তারপর আবার বিছানায় এলিয়ে পড়লাম। এখন কেন জানি না আয়ানের কথা মনে পড়ছে। আয়ান কী সত্যিই আরশিকে বিয়ে করে নিয়েছে এসব ভাবতে লাগলাম। ভাবনার কোনো অন্ত নেই। নিজেকে বুঝালাম আয়ান আর আরশির কথা ভেবে আমি আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি। নিজেকে বুঝাতে বুঝাতে চোখটা লেগে আসলো। এর মধ্যেই একটা বিকট আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ভোরের আলো হালকা ফুটেছে। বেলকনি দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পাশের বিল্ডিং এ মানুষ জড়ো হয়ে আছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে? তবে জানার আগ্রহ নিয়ে নীচে নামলাম সাহস করে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম এক দম্পত্তি গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করেছে৷ তাদের পরনে এখনো বিয়ের সাজ। আমি সাহস করে সে বিল্ডিং এ গেলাম। গিয়ে ঝুলন্ত লাশ দুটো দেখে চমকে গেলাম। আয়ান আর আরশির লাশ ঝুলন্ত ফ্যানে ঝুলছে। সাংবাদিকরা ছবি তোলায় ব্যস্ত। চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে। এর মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল

– আয়ানের সাথে তোমার রিলেশন ছিল না?

কথাটা কোথায় থেকে এসেছে উৎস খুঁজতে গিয়ে দমটা আটকে যেতে লাগল। প্রচন্ড জোরে দম নিতে লাগলাম। সারা মুখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম বের হতে লাগল। চমকে উঠে দেখলাম আমি বিছানায় শুয়ে আছি। মসজিদ থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। হুট করে এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম বুঝতে পারছিলাম না। শোনেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তাহলে কী আয়ান আর আরশির কিছু হয়েছে? আয়ানের কথা ভাবতেই অজানা ভালোবাসা আর ব্যথা টা যেন বুকে উঁকি মেরে উঠল। দৌঁড়ে গিয়ে অজু করে নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষে আয়ান আরশির জন্য দোআ করলাম। বেলকনিতে এসে দাঁড়ালাম। মনটা খুব ছটফট করছিল। কেন জানি না ভীষণভাবে খারাপ লাগাটা ঘিরে ধরেছিল। যতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিলাম ততক্ষণ মনে হয়েছিল সেটা একদম সত্যি একদম বাস্তব। কেন যে এমন দেখলাম বুঝতে পারছি না। চুপ হয়ে বেলকনিতে আনমনা হয়ে বসে রইলাম৷ নীচে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম জাহিন সাহেব আমার দিকে নীচ থেকে তাকিয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখেই বলতে লাগল

– নীচে নামুন। বাইরের এ আবহাওয়ায় হাঁটলে ভালো লাগবে।

আমি জাহিন সাহেবের কথাটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না।ভাবলাম মনটাও বেশ ছটফট করতেছে এসময় একটু হাঁটলে ভালো লাগবে। স্বপ্নের কথা মনে হয়ে বারবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। তাই নীচে নামলাম হাঁটার জন্য। জাহিন সাহেবের সাথে গল্প করছিলাম আর হাঁটছিলাম। উনি একের পর এক কথা বলছে আর আমি হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছি। এর মধ্যেই হুট করে চোখ গেল আরশি আর আয়ানের দিকে। তারাও হাঁটছে। ওদের দেখে যেন ভেতরে একটা প্রশান্তি জাগছে। মনটা যেন শীতল হলো এবার। আমি ওদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে না থেকে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এমন সময় আরশি ডাক দিল আমায়। আরশির ডাকটা এড়িয়ে সামনে এগুতে নিলে আরশি আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আরশির আচমকা দাঁড়ানোতে জাহিন সাহেব ও বেশ ইতস্তত বোধ করছিল। আরশি সামনে দাঁড়িয়ে
আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপ একটা হাসি দিয়ে বলল-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here