তমসার জল পর্ব -১০ ও শেষ

#তমসার_জল
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
।।পর্ব১০।।
(কার্টেসী ব্যতীত কপি নিষেধ)

দুই বছর ধরে চলে বর্ষণ হ*ত্যা মামলার বিচার।আসামী পক্ষের আইনজীবী না থাকায় আর জলের মুখ থেকেও বিন্দুমাত্র কথা বের করতে না পারায় কেসটা আগায় না।সেদিন ছিলো বর্ষণ হত্যা মামলার রায় দেওয়ার দিন।পুলিশ ভ্যান থেকে নেমেই জল বর্ষাকে দেখতে পায়।কোলে একটা বাচ্চা মেয়ে।পাশে রিশাদ।জলকে দেখে বাচ্চাকে রিশাদের কোলে দিয়ে দৌড়ে যায় বর্ষা।জড়িয়ে ধরে জলকে।
অন্যান্য নারী পুলিশ কর্মীরা বাধা দিতে নিলে উপমা তাদের হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়।প্রিয়জনের একড়ু ছোঁয়ার দরকার আছে জলের।মেয়েটার মনে অনেক কষ্ট। আর এই কষ্টই ওকে মানসিক রোগী বানিয়েছে।বর্ষা জলকে জড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।কিন্তু জল কাঁদছে না।মুচকী হাসি তার ঠোঁটে।

” ধুর পাগলি!কাঁদার কি আছে?”

” আমায় ক্ষমা করে দাও ভাবী।আমি যদি আগে বলতাম তোমায় সব তাহলে পানি হয়তো এতদূর গড়াতো না।”

” পরিস্থিতি ভাগ্য তোমায় আগে বলতে দেয় নি।এতে তোমার কোনো দোষ নেই। Past is past…বর্তমান আর ভবিষ্যতে ফোকাস করো।মিষ্টি একটা মেয়ে হয়েছে।ওর কথা ভেবে হলেও অতীত ভুলে যাও আমায় ভুলে যাও।”

” তোমার কি মনে হয় ভোলার মতো মানুষ তুমি?”

” হু,তাও ঠিক জঘন্য মানুষকে ভোলা খুব কঠিন।স্বামীকে খুন করেছে যে মেয়ে সে মেয়েকে তো আরও ভোলা কঠিন।”

” ভাবী!”

বর্ষার কথা শুনে ইনস্পেকটর উপমার সন্দেহ হয়।সে বর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,,,,

” আপনি কি কিছু জানেন?”

বর্ষা কিছু বলতে যাবে ঠিক তার আগেই জল বর্ষাকে ইশারায় থামিয়ে দেয়।জল চায় না মানুষটার হিংস্রতা পৃথিবী জানুক।ঝোঁকের বশে যা বলে ফেলেছে ফেলেছে।আর না।জল কথার প্রসঙ্গকে ঘুরিয়ে বলে,,,

” মায়ের সাথে যোগাযোগ হয়?উনি কেমন আছেন?”

” যার জন্য আমার বাবা কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছেড়েছে তার সাথে যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজন দেখি না।থাক সে টাকা সম্পত্তি নিয়ে।শুনেছি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে তার।”

” এভাবে বলে না বর্ষা।হাজার হলেও তিনি তোমার মা।আমি না হয় পরের মেয়ে।কিন্তু তুমি তো তার পেটের মেয়ে।খোঁজ খবর নিও উনার।দেখেছো?মেয়ের নামই জানা হলো না।নাম কি আমার মায়ের।”

” জল।পৃথিবীর বুক থেকে জলকে হারাতে দেবো না আমি।যুগে যুগে তোমার মতো নীরব প্রতিবাদী সাহসী জলের দরকার পৃথিবীর। তাই ওর নাম রেখেছি জল।”

বর্ষার কথা শুনে জল নিজের গলার হারটা খুলে উপমার দিকে তাকায়।শান্ত গলায় বলে,,,

” আমি কি ওকে আমার পক্ষ থেকে এই উপহারটা নিজ হাতে ওকে পরিয়ে দিতে পারি?আদর করতে পারি।”

উপমা আর না করে না।জল রিশাদের কাছে গিয়ে রিশাদের কোলে থাকা ছোট্ট জলের গলায় ইংরেজিতে “জে” অক্ষর লিখা লকেট ওয়ালা হারটা নিজ হাতে পরিয়ে দেয়।মাথায় আলতো করে চুমু খেয়ে হাত বুলায় জল।পেছন থেকে উপমা বলে,,,

” জল দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

জল বর্ষা রিশাদের থেকে বিদায় নেয়।হতে পারে এটাই শেষ বিদায়।জীবনের শেষের দিক গুলোতে জল কাওকে পাশে পায় নি।নিজের জন্মদাতা বাবা মাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কারণ জল খুনী।তাতে অবশ্য জলের কোনো আফসোস নেই। চাঁদ পৃথিবীর সব প্রশংসা কুড়িয়েও একা।জল না হয় ঘৃণাই কুড়ালো।

_______°_°

আদালত জলের ফাঁসির রায় না দিলেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।জল খুব করে চেয়েছিলো ফাঁ*সি হোক জলের।দুনিয়াটা জলের কাছে নরকের মতো হয়ে গিয়েছে। বর্ষকে হারানোর পর জল বুঝতে পেরেছিলো যে জল বর্ষণকে ভালোবাসে।দুনিয়াতে না হয় শারিরীক নির্যাতনের জন্য ভালোবাসা ঘৃণার পাথরে চাপা পরেছিলো।কিন্তু রুহের জগতে তো কোনো শারিরীক নির্যাতনের সুযোগ নেয়।সেখানে না হয় সে বর্ষণকে নিজের করে পেলো।

কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জলের বাম হাত থেকে রক্ত স্রোতের মতো বের হতে লাগে।মুহুর্তেই কাঠগড়ার চারিপাশটা রক্তে ছেয়ে যায়।জল ধপ করে বসে লুটিয়ে পরে।ইন্সপেক্টর উপমা দৌড়ে আসে।দেখে জল ধারালো ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের শিরা কে*টে ফেলেছে।উপমা জলকে নিজের কোলে শোয়ায়।অন্যান্য সদস্যদের বলে এম্বুলেন্স আনতে।জলের তখনও দম ছিলো।জল কাঁপা গলায় বলে,,,

” দয়া করে আমায় এই দুনিয়া থেকে মুক্তি দিন ইন্সপেক্টর।এই দুনিয়ায় আমার মতো মেয়েকে রাখার বৃথা চেষ্টা আর করবেন না।আমি আগে থেকেই আন্দাজ করে রেখেছিলাম এমন কিছু একটা হবে তাই……”

জল কথা বলতে পারে না।গলা ভার হয়ে আসছে তার।তারপরও অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,,,

” ওড়নার কোনে একটা চিঠি রাখা আছে।চিঠিটা বর্ষাকে দিয়েন।এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।আর আপনার কাছে যা প্রকাশ করেছি তা গোপন রাখার অনুরোধ রইলো।”

কথাটা বলে জল চোখ বুজে।অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় জলের।হিমশীতল হয়ে আসে জলের দেহ।জলের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ইনস্পেকটর উপমা বর্ষাকে চিঠিটা দেয়।

বর্ষা,

জীবনে শেষ মুহুর্তগুলোতে তুমি আর ইন্সপেক্টর উপমা ছাড়া কাওকে তেমন পাশে পাই নি। এমনকি বাবা-মা ও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।তুমি তো সব জানোই।
পিরিয়ড চলাকালীন শারীরিক সম্পর্কের জন্য আমার জরায়ু মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে টিউমারের রূপ নিয়েছে।এর পরেই মুলত তোমার ভাইয়ের প্রতি জমে থাকা রাগ ক্ষোপ ঘৃণা আগ্নেয়গিরির ন্যায় ফেটে ওঠে।কিন্তু তোমার ভাইকে হারানোর পর আমি বুঝতে পারি যে মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।না চাইতেও। ভালোবেসেছি বলেই তার হিংস্রতাকে পুরো দুনিয়া থেকে আড়াল করেছি। একদিন দিয়ে মনে হয় ভালোই করেছি আর কাওকে তার হিংস্রতা শিকার হতে হলো না আমার এই পাগলামির জন্য। আদিবার ডায়েরীটা পড়ার পর আমি পুরাতন বর্ষবের প্রেমে পরি।যেই প্রেমই আমায় ধাপে ধাপে কষ্ট দেয়। কাঁদায়। আদিবার ডায়েরীটা আমি কোনো এক কারণে পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।বর্ষণকে শেষ করার পর আমার মাথা ঠিক ছিলো না।কি করেছি না করেছি আমার কিছুই খেয়াল নেই।শুধু খেয়াল আছে আমি মানুষটাকে মে*রেছি।আমি খু*নী।

ঘোর যখন কাটলো তারপর থেকে আমি পুরো অন্ধকারে ছিলাম।দুইটা বছর অপেক্ষা করেছি ফাঁ*সিরর জন্য কিন্তু ভাগ্য আমায় বরাবরের মতো হতাশ করলো।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের ভালোবাসার সাথে নিজেরও খু*নী হবো। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।তোমার ভাইকে এভাবে মা*রার জন্য।

এতদিন পাশে থাকার জন্য ইন্সপেক্টর উপমাকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিও।

ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম মানুষটার হিংস্রতা আড়াল করার জন্য।চিঠিটা পড়ে তুমিও পুড়িয়ে ফেলিও। চাই না মানুষটার হিংস্রতা মানুষ জানুক। হাজার হলেও মানুষটা তো আমারই।আমারই বর্ষণ।তমসার জলের বর্ষণ।

ইতি
তোমার ভাইয়ের খুনী
#তমসার_জল

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here