তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -০৮

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

সামির কথা শুনে ‘থ’ মে’রে গেলাম। তীব্র কিভাবে জানলো আন্টিদের ঠিকনা! ওপাশ থেকে সামি কয়েকবার হ্যালো বলতেই আমার হুশ আসে। ফাঁকা ঢোক গিলে বললাম, ‘তুই সিউর আন্টিরা ওখানে নেই!’

‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে প্রানেশা? তীব্র ভাইকে বিয়ে করে কি সব বোধবুদ্ধি হারিয়ে গেছে? আমি গেছিলাম নিজে।’

‘এখন কি হবে সামি?’

‘আমি দেখতেছি তুই চিন্তা করিস না।’

সামি কল কেটে দেয়। আমি বসে পড়লাম। সামির চিন্তিত কন্ঠ শুনে আমার নিজেরও চিন্তা বেড়ে গেলো। এটা কি আসলেই তীব্রর কাজ! কিন্তু তীব্র আন্টির বাসার ঠিকানা কোথায় পেলো? সেদিন যে আমি আন্টিদের বাসায় গেছিলাম কোনোভাবে কি উনি আমাকে ফলো করেছেন! মাথা হ্যাং মেরে গেলো। আমার লাইফ থেকে যেনো সমস্যার লাইন গুলো সরছেই না৷ আমি ওভাবেই বসে রইলাম। একটু পরই দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালাম। এতোরাতে তীব্র কোথায় গেছিলো! উনি নিজের মতো রুমে ঢুকে জ্যাকেট খুলে বসতেই আমি ধীর কন্ঠে বললাম,

‘এতো রাতে কোথায় গেছিলেন?’

তীব্র শান্ত গলায় বললেন, ‘কাজ ছিলো৷ তুমি জেগে আছো কেনো? ঘুমাওনি!’

আমি উত্তর দিলাম না৷ কাঁপা কাঁপা পায়ে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিছু বলবে?’

শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘আন্টিরা কোথায়?’

তীব্র কপালে ভাজ ফেলে তাকালেন৷ না বুঝার মতো করে বললেন, ‘মানে? কোন আন্টি আর কোথায় মানে!’

রেগে গেলাম। রাগে চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। হিংস্র রুপ ধারণ করলাম মুহুর্তেই। তীব্রর শার্টের কলার চেপে ধরে রাগ নিয়ে বললাম, ‘এখন নাটক করছেন! কিছু বোঝেন না আপনি? কোন আন্টি জানেন না! জিনিয়াকে তো মে’রেই ফেলেছেন এখনও কেনো আন্টিদের পেছনে পড়ে আছেন! আপনার কি লজ্জা বলতে কিছু নাই? এবার অন্তত ওদের মুক্তি দেন। জুই একটা ছোট মেয়ে।’

রেগে গেলে আমার কান্না পেয়ে যাই। এটাই সমস্যা! যতটা না হিংস্র হয়ে উঠি তার চেয়েও বেশি আমার করুণ অবস্থা হয়। তীব্র কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে কলার থেকে হাত ছুটিয়ে দিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘আমি কাউকেই কিছু করিনি। আর জিনিয়ার ফ্যামিলি কোথায় এটাও আমি জানি না।’

উনার কথায় জ্বলে উঠলাম। চেঁচিয়ে বললাম, ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি যদি কিছু না করেন তাহলে কে করেছে!’

‘কান্না বন্ধ করো প্রাণ।’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে ওখানেই বসে পড়লাম। মাথা চেপে ধরে কান্না করতে শুরু করলাম। কেমন মানুষ এরা! জুই তো ভীষণ ছোট একটা মানুষ ওর সাথেও কেনো এমন করছে! তীব্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এরপর টেনে তুললেন আমাকে। আমি উনার দিকে তাকাতেই উনি দু’হাতে আগলে নিলেন। কন্ঠ নরম করে বললেন,

‘শান্ত হও প্লিজ! এমন পাগলামি করো না। আমি সত্যিই জানি না জিনিয়ার ফ্যামিলি কোথায়!’

আমি ছিটকে সরে আসলাম। ঘৃ’ণার দৃষ্টি ছুঁড়ে বললাম, ‘আপনাকে একটুও বিশ্বাস করি না আমি। আপনি একদম টাচ করবেন না আমাকে। সময় থাকতে ওদের ছেড়ে দিন। নয়তো ভালো হবে না তীব্র।’

তীব্র মুহুর্তেই রক্তিম চোখে তাকালেন। আমার কাছে এসে চেপে ধরলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি কাউকে কিছু করিনি মানে করিনি। তাশজিদ শেখ তীব্রর রে’প করার প্রয়োজন নেই। সে চাইলে এমনেই হাজারটা মেয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিবে। আর যদি থাকে ওর ফ্যামিলির কথা! তাহলে শোনো তীব্র কাউকে খুঁজতে চাইলে তুমি তাকে পাতালে লুকিয়ে রাখলেও তাকে খুঁজে পাবেই। শুধু তুমি কেন তোমার চৌদ্দগুষ্টিও তাকে এতোদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। অযথা আমাকে ব্লেইম করা বন্ধ করো।’

আমি ‘থ’ মে’রে গেলাম। এতগুলো কথা কখনো আমি নিজের মাথাতেই আনিনি। তীব্র আমাকে ছিটকে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পানে। তীব্রর কাছে কোনো মেয়েকে পাওয়াটা জাস্ট চুটকির মতো। সে যেমন আজাদ শেখের ছেলে হিসেবে পরিচিত তেমনই নিজেরও একটা পরিচয়ে সে পরিচিত। তাকে পাওয়ার জন্য যেকোনো মেয়ে রাজি হয়ে যাবে সহজেই সেখানে উনার কেনো প্রয়োজন পড়লো এতো জ’ঘ’ন্য এটা কাজ করার! কিন্তু আমি নিজে চোখেও তো জিনিয়াকে দেখেছি। জিনিয়া নিজে মুখে সবটা বলেছে আমাকে। তাহলে! এতো চাপ নিতে পারলাম না। অসুস্থ শরীরে এতো চিন্তা নিয়ে উঠতে না পেরে সেন্স হারিয়ে পড়ে রইলাম ফ্লোরে।
_________

নিজেকে কারো বাহুতে আবিষ্কার করে চমকে উঠলাম। সেন্স ফিরার সাথে সাথেই মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেলো। মাথাটা ওপরে তুলে তীব্রকে চোখে পড়লো। তীব্র গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। আরো একবার চমকালাম৷ উনার দৃষ্টিতে থমকে গেলাম। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই উনি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। মুখ গুজে দিলে চুলে। থতমত খেয়ে উনাার শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। উনি ভাঙা ভাঙা ভাবে কি যেনো বললেন বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার নিজেরও এতো ক্লান্তিতে কিছু বলতে ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ পড়ে রইলাম উনার বুকে। মাথাটা ভার হয়ে আছে তখনো। ওভাবে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে নিজের পাশটায় তীব্রকে দেখলাম না। উনাকে না দেখে ঘুম উধাও হয়ে গেলো। উনি কই গেলেন! আচ্ছা উনি কি রাাতে এসেছিলেন নাকি রাতের সবটাই আমার ভ্রম ছিলো! মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। এতো না ভেবে চুপচাপ উঠে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নিলাম। এই ঠান্ডার মধ্যে শাওয়ার নিয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। কোনোমতে শাড়ি পড়ে নিচে নামতেই দেখলাম সবাই সেখানে হাজির। তাড়াহুড়োতে ঘড়ি না দেখলেও এখন টের পেলাম ভালোই সকাল হয়েছে। নানু আমাকে দেখে বললেন,

‘তোমার নাকি শরীর ভালো না তাই আর সকাল সকাল ডাকি নাই। তা এখন কেমন আছে?’

ধীর স্বরে বললাম, ‘জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।’

আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখংলাম তীব্র নেই। তানহা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো অনুসরণ করে নিজের দিকে তাকালাম। ভেজা চুলগুলোর দিকে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিজের চুলের দিকে তাকিয়ে আরেকবার নানুর দিকে তাকালাম। নানু মুচকি মুচকি হাসছেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আসলে ওরা কি রেখে কি ভাবছে! নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালাম। তিহা আর মিলি দুজন আমার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ বাদেই তীব্র আসে। টি-শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে ঘুরছেন তিনি। নানাভাইয়ের সাথে গেছিলেন বোধহয় কোথাও। উনারা আসতেই সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসে গেলাম। তীব্র আমাকে টেনে ফিসফিস করে বললেন,

‘এই জ্বর নিয়ে এতো সকালে শাওয়ার নিছো কেন?’

আমি উত্তর না দিয়ে সরে আসলাম। খাওয়ার সময়ই আমতা আমতা করে নানাভাইকে বললাম, ‘নানাভাই আমি যদি আজ একটু ভার্সিটিতে যাই তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে!’

সবাই খাওয়া ছেড়ে ড্যাবড্যাব করে তাকালেন। শুধু তীব্র স্বাভাবিক চোখে তাকালেন। তিনি বোধহয় জানতেন এমন কিছুই হবে। যদি এমন না হতো তবেই বোধহয় তিনি অবাক হতেন! মামি কটুক্তি করে বললেন,

‘বাড়িতে নানাশ্বশুর সহ আরো আত্মীয় আসছে আর তিনি নাকি ভার্সিটিতে যাবেন!’

আমি মাথা নত করে নিলাম। এখানে আমি চাইলেও জবাব দিতে পারি কিন্তু প্রথমত আমি নতুন বউ আর তাছাড়া বড়দের সাথে খারাপ ব্যবহারটা করতে চাচ্ছি না। নানাভাই গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘কেনো? কোনো কারণ আছে?’

‘জ্বি। আসলে…’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে তীব্র খাওয়ার মুখে দিতে দিতে বললেন, ‘নানাভাই প্রানেশার যাওয়াটা একটু জরুরী। তাছাড়া কাল উনার ফ্রেন্ডও কল করছিলো একটু প্রয়োজন আছে ওকে। আর ওর নোটও নিতে হবে। চিন্তা করো না আমি তাড়াতাড়ি উনাকে নিয়ে আসবো।’

আর কেউ কিছুই বললেন না। তানহা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নাই।’

এপর্যায়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি শান্ত থাকলেও তীব্র থাকলেন না। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, ‘আগে নিজের ভদ্রতা ঠিক কর এরপর অন্য কাউকে বলবি! প্রাণ খাওয়া শেষ হয়ে গেলে জলদি আসো।’

আমি মাথা নাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লাম। উনার পিছু পিছু এসে চুপচাপ বোরকা পড়ে হিজাব করে নিলাম। ‘ও’ বাড়িতে থাকার সময় বোরকা পড়েই অভ্যাস হয়ে গেছিলো আর এখনো সে অভ্যাসটাই আছে। তীব্রও রেডি হয়ে নেয়। দুজন একসাথে বের হলাম। উনি ভার্সিটির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুধু এটুকুই বললেন,

‘যা করতে চাচ্ছো করে নাও। তবে নিজে বিপদে পড়বে এমন কিছু কখনোই করো না।’

ব্যাস এতটুকুই! আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলাম। এরপর চুপচাপ ভার্সিটিতে ঢুকলাম। যেখানে সব ফ্রেন্ডরা আড্ডা দেই সেখানেই দ্রুত গেলাম। সবাই কিছু বলার আগেই সামির হাত টেনে দুরে সরিয়ে আনলাম। ব্যস্ত গলায় বললাম,

‘কিছু জানতে পেরেছিস? আন্টিরা কোথায়?’

সামি মলিন মুখে বললো, ‘জানি না রে। অনেক খুঁজার চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। তুই তীব্র ভাইকে কিছু বলেছিস?’

আমি রাতের কোনো কথায় সামিকে বললাম না। সামি সন্দেহের চোখে তাকালেও আমি তা ঘুরিয়ে দিলাম। ফাঁকা ঢোক গিলে বললাম, ‘একবার যাবি ওই বাড়িতে! যদি কোনো ক্লু পাই!’

সামি কিছুক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে যায়। আমি আর সামি দ্রুত বের হয়ে গেলাম ভার্সিটি থেকে। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকে তানজিলা, সাবিহা। কিন্তু আমরা জবাব না দিয়েই ছুট লাগালাম। দুজনেই টেনশন করতে করতে ছুটলাম আন্টির বাড়ির দিকে। টেনশনে ফোনটাও অফ করতে ভুলে গেছি। অবশ্য এখন আর ফোনই বা অফ করে কি হবে! আন্টির বাড়ি আসতে আসতে প্রায় আধাঘন্টা লেগে গেলো। সামি নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। বাড়িতে ঢুকে ৩ রুম আগে ভালোমতো খুঁজে নিলাম কিন্তু কোথাও কারো টিকিটাও নেই। পুরো বাড়িতে কিছু না পেয়ে যখন হতাশ হয়ে লিভিং রুমে এসে বসলাম তখনই হাতের সাথে বেঁধে গেলো কিছু একটা। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে হাতে নিতেই দেখলাম একটা ব্রেসলেট। এইরকমের একটা ব্রেসলেট তীব্রর কাছে দেখেছিলাম৷ ভালোমতো উল্টে পাল্টে দেখতেই অবাক হলাম। ব্রেসলেটে স্পষ্ট ভাবে একটা নাম খোদাই করা। চোখে থেকে মুহুর্তেই দু ফোঁটা জল গড়ালো। অস্পষ্ট স্বরে বললাম,

‘তীব্র!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here