#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
ঘুম ভাঙে চোখে রোদের আভাস পেয়ে। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আগে চোখে হাত রাখলাম। চারপাশে ছোট ছোট তাকিয়ে দেখলাম এটা সম্পূর্ণ অন্য একটা জায়গা। কাঁচ ভেদ করে সূর্যের আলো এসে চোখে তীক্ষ্ণ রশ্নি ফেলছে। আমি আড়মোড়া ভাঙাতে গিয়ে টের পেলাম পাশে কারো অস্তিত্ব। মাথা উঁচিয়ে দেখলাম তীব্র ঘুমিয়ে আছে। কাল রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠলো। মন ভরে শ্বাস নিয়ে নিজে হালকা করে উঠে ঝুঁকে গেলাম তীব্রর কাছে। তীব্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উনার মুখ বরাবর মুখ নিতেই গরম শ্বাসের আভাস পেলাম। সাথে সাথেই সরে এলাম। বুকের ভেতর ভীষান জোড়ে জোড়ে শব্দ হচ্ছে। হার্টবিট যেনো বেড়ে চলন্ত গাড়ির গতি হয়ে গেছে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আবাারও তাকালাম উনার দিকে। ঘুমন্ত তীব্রকে দেখে এতোটুকুও মনে হচ্ছে না সে কালকের মতো এতোটা হিং’স্র হতে পারে। ঘুমোলে বুঝি মানুষকে এতোটাই নিষ্পাপ মনে হয়! ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলাম। কালকের পুরো ঘটনায় বুঝতে বাকি নেই উনি আমাকে কতটুকু ভালোবাসে! ভাবতেই যেনো মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো। ঠোঁট কামড়ে হাসলাম৷ উনার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম তাকে। মনে এক অদ্ভুত ইচ্ছে জাগ্রত হলো। ঘুমন্ত তীব্রর ওপর সে ইচ্ছে আমি প্রয়োগও করলাম। সে তো ঘুমিয়েই আছে। টুপ করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম। এরপর আর বসলাম না। চট করে উঠে পড়লাম। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। এতটুকু একটা বিষয়ে এতো লজ্জা পাচ্ছি আমি! সিরিয়াসলি? নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালাম। ধীর পায়ে কাবাড খুলে দেখলাম কিছুই নেই। এমা! কিছু না থাকলে আমি পড়বো কি! তীব্রর দিকে কটমট চাহনী নিয়ে তাকিয়ে ওভাবেই ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিলাম। শাড়ি ঠিক করে নিয়ে রুমের সাথে এডজাস্ট করা ব্যালকনিতে ঢুকলাম। ব্যালকনিতে এসে অবাক না হয়ে পারলাম না। দুর থেকে সমুদ্রের ঢেউ দেখা যাচ্ছে। তার আশে পাশে এখনই মানুষ ভীড় করেছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপতেই দৌড় লাগালাম রুমের মধ্যে। তীব্রকে টেনে তুললাম। তীব্র হঠাৎ এমন হওয়ায় খানিকটা চমকালো। ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকাতেই বললাম,
‘হা’বার মতো তাকিয়ে না থেকে জলদি উঠুন। সমুদ্র দেখবো।’
তীব্র খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো। তারপর কটমট করে বললো, ‘এভাবে কেউ ঘুম থেকে উঠায়? আর এই সাত সকাকে কিসের সমুদ্র? বিকেলে নিয়ে যাবো। এখন ঘুমাতে দাও।’
আমি ঠোঁট ফুলালাম। তীব্র শুয়ে পড়তে নিলে উনাকে টেনে ধরলাম৷ মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ন্যাকা স্বরে বললাম, ‘আপনার ১০ টা না ৫ টা না একটা মাত্র বউ। এতো ভালোবেসে সমুদ্র দেখতে চাইছে আর আপনি শুয়ে পড়ছেন! চলুন না প্লিজ!’
তীব্র চোখ মুখ কুঁচকে বললো, ‘নিজে তো সারারাত কুমিরের মতো ঘুমিয়েছো এখন আল্লাহর ওয়াস্তে আমারে ঘুমাইতে দাও। জ্বালাইয়ো না। চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই সমুদ্র দেখো।’
আমি কুমিরের মতো ঘুমাই? সিরিয়াসলি! উনার কথায় রাগ হলেও নিজেকে দমালাম। আপাতত আমি সমুদ্র দেখবো। উনি শুয়ে পড়তে নিলে উত্তেজনায় উনাকে টেনে ধরে কোলের ওপর বসে গলা জড়িয়ে ধরলাম। অনুরোধের স্বরে বার বার বললাম,
‘প্লিজ প্লিজ! চলুন না! একটাই তো আবদার।’
আমি একই কথা কয়েকবার আওড়ালাম। তীব্র ‘থ’ মে’রে গেছে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড় করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উনার এমন রিয়েকশনের প্রথমে মানে না বুঝলেও যখন বুঝলাম কি করে ফেলেছি তখন লজ্জায় সরে আসতে নিলাম। দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে মনে মনে নিজেকেই বকা দিলাম। অনুভব করলাম একজোড়া হাত আমার কোমড় প্যাচিয়ে ধরেছে। চট করে উনার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম বাঁকা হাসি। উনি ফু দিলেন চুলে। তারপর কোমড় চেপে ধরে বললেন,
‘সকাল সকাল রোমান্সের মুড করিয়ে দিলে বউ! এখন?’
আমি দ্রুত উনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম, ‘সবসময় লু’চু’মি না করে আমার কথাটা শুনলেও তো পারেন! সমুদ্র দেখবো। জলদি উঠুন!’
তীব্র বিরক্তি নিয়ে ছেড়ে দিলেন। চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, ‘রোমান্সের মধ্যে সমুদ্রকে ঢোকানোর কোনো মানে আছে? তোমার কি এজন্মে হুশ জ্ঞান কিছু হবে না প্রাণ?’
‘নাহ হবে না। আপনি উঠবেন নাকি আমি একাই যাবো? কোনটা বলুন!’
তীব্র আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলেন। তারপর হাত মুখ মুছে বললেন, ‘এভাবেই যাবে নাকি চেঞ্জ করবা?’
‘চেঞ্জ করার মতো কিছু এনেছেন? খুব তো বড় বড় কথা বলে বাড়ি থেকে বের হলেন তা একবারও কি পড়বো এটা ভেবেছেন!’
তীব্র ভ্র কুঁচকে তাকালেন। তারপর আরাম করে বিছানায় বসে বললেন, ‘তাহলে আর সমুদ্রে গিয়ে কি করবে? তার থেকে বরং ব্যালকনিতে গিয়ে ঝুলে ঝুলে সমুদ্র দেখো।’
‘কি আশ্চর্য! আপনাকে আমি কতবার বললাম সমুদ্র দেখবো! ধুর। থাকুন আপনি। গেলাম আমি!’
একটু এগোতেই তীব্রও ছুটে আসলেন। হাতের ভাজে হাত রেখে হাঁটা লাগালেন। আমি একবার হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। দুজনে সমুদ্রের পাড়ে আসতেই আমি উনার হাত ছাড়িয়ে ছুটে পানির কাছে আসলাম। শীতের দিন হওয়ায় হিম শীতল ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে। তীব্র পেছন থেকে শুধু একটা কথা’ই বললো,
‘সাবধানে!’
আমি পানির সাথে তাল মেলানো শুরু করলাম। যখন ঢেউ আমার দিকে তেড়ে আসে তখন পিছিয়ে যাচ্ছি আর যখন ঢেউ ফিরে যাচ্ছে তখন এগিয়ে যাচ্ছি। ঢেউ আর আমার এই খেলায় মেতে খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠলাম। একবার তীব্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। আমার চোখে চোখ পড়ার পরও নজর সরালো না। আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। নিজের মতো মেতে উঠলাম সমুদ্রের সাথে। ক্লান্তির এক পর্যায়ে তীব্রর কাছে এসে বসে পড়লাম। তীব্র নিজেও পাশে বসলো। আমি গা এলিয়ে তার কাঁধে মাথা রাখলাম। উনি বেশ অবাক হলেও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। আমি বেশ খানিকটা সময় বড় বড় শ্বাস নিয়ে বললাম,
‘কালকে রাতের মতো একটা গান শোনাবেন প্লিজ!’
তীব্র কপালে ভাজ ফেলে আড়চোখে তাকালেন৷ বললেন, ‘মানে সকাল সকাল যে তোমার মাথার তা’র ছি’ড়ে গেছে এটারই প্রমাণ দিচ্ছো একটু পর পর!’
আমি মুখ বাঁকালাম। চট করে মাথা উঠিয়ে তার গাল টেনে আমার দিকে ফিরালাম। মুখ ভেংচি কেটে বললাম, ‘আপনার কোনো সমস্যা আছে? আমি আমার বরকে বলেছি একটা গান শোনাতে। আপনার কি? চুপচাপ গান শোনান!’
তীব্র হাসলেন। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে নিয়ে সুর তুললেন,
‘চলো বলে ফেলি, কত কথা কলি
জন্মেছে বলতে তোমায়
তোমাকে চাই।
ঝ’লসানো রাতের, এ পোড়া বরাতে
তুমি আমার অন্ধকার আর রোশনাই,
কার্নিশে আলতা মাখানো
দিনেরা ঢলে পড়ে রাতে
তারপরে রাত্রি জাগানো
বাকিটা তোমারই তো হাতে
জেগে জেগে আমি শুধু ঘুমিয়ে পড়তে চাই
থেকে থেকে সেই মেঘেতে যাই
বেড়াতে যাই, তোমাকে পাই।’
তীব্র পুরো গান গাওয়া শেষে আমি হাত তালি দিলাম। তীব্র হেঁসে উঠতে উঠতে বলে, ‘হয়েছে গান শোনা। এবার চলো! অনেকটা বেলা হয়ে গেছে আগে কিছু খেতে হবে।’
আমি উনার কথা না শুনে বালুচরের কাছে এগোলাম। সুন্দর করে একটা বড়সড় লাভ আঁকিয়ে হাসলাম। পানি এসে তা ভিজিয়ে দিয়ে অর্ধেক করে গেলো। আমি পেছনে তাকাতেই চোখে পড়লো তীব্রর পেছনে কিছুটা দুরে দাড়ানো জিনিয়ার দিকে। চমকে উঠলাম। লাফিয়ে উঠে ছুট লাগালাম সেদিকে। তীব্র হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে পেছন থেকে কয়েকবার ডেকে নিজেও পিছন পিছন ছুটলো। আমি জিনিয়ার কাছে আসতে আসতে জিনিয়া হুট করেই যেনো কোথায় উধাও হয়ে গেলো। আশে পাশে ব্যস্ত হয়ে তাকাতেই তীব্র আমাকে আগলে ধরলো। ব্যস্ত গলায় বললো,
‘পাগল নাকি তুমি! ছুটছো কেনো? কি হয়েছে?’
আমি কোনোমতে বললাম, ‘তী-তীব্র জ-জিনিয়া!’
তীব্র হতাশ শ্বাস ফেলে আশে পাশে তাকালো। তারপর আমাকে আগলে নিলো। কিন্তু কিছু বললো না৷ আমাকে যখন ছেড়ে দিলো তখন তীব্রর ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি দেখতে পেলাম। কতক্ষণ সে হাসির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তীব্র হাত ধরে হাঁটা লাগালো। আমি তখনো তীব্রর মুখের দিকে তাকিয়ে৷ এই হাসিতে কিছু ছিলো। কিছু রহস্য, কিছু তাচ্ছিল্য! আমি পিটপিট করে তাকালাম। হুট করেই নিজের ভেতরে অস্থিরতা টের পেলাম। অজানা আশঙ্কায় ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। জিনিয়া এখানে! সব রহস্যের সমাধান হয়ে গেলে তীব্রকে হারিয়ে ফেলবো না তো! তীব্রর টি-শার্ট চেপে ধরলাম শক্ত করে। বিড়বিড় করে বার বার একটাই কথা আওড়ালাম,
‘তীব্র আমাকে ছাড়বে না। কখনোই না। সে তো ভালোবাসে আমাকে। আমাকে ছাড়তেই পারে না সে। আমি ভীষণ ভালোবাসি তাকে। আমি পারবো না তীব্রকে ছাড়তে৷ আমি যে তীব্র প্রেমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি। এই তীব্রকে ছেড়ে বাঁচাটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। না না তীব্র ছাড়তেই পারে না আমাকে। কখনোই না।’
চলবে..
(