তুই আমার প্রেমময় নেশা পর্ব -০১

ঘর ভর্তি লোকের মাঝে আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।সমানে নিজের পায়ের নখ দিয়ে মেঝে খুতে চলেছি।মেঝে খুঁটতে খুঁটতে আমার পায়ের নখ ভেঙে যাচ্ছে তবুও আমার পা থামছে না।আমি নিচে তাকিয়ে আছি সেই থেকে গালে হাত দিয়ে ।প্রচন্ড জোড়ে আঘাতের ফলে গাল ফুলে পুরো টনটন করছে। সকলে আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে।আমাকে সকলের সহানুভূতি দেখানোর কারণ হচ্ছে মাত্র আমার ফুলের মত নরম গালে থাপ্পড় মারা হয়েছে আর থাপ্পড় টা যেই অপরাধে আমি খেয়েছি সেই অপরাধই আমার জানা নেই।

আমি অশ্রু ভরা চোখে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিঃশব্দে কাদছি।আমাকে থাপ্পড়টা মেরেছে নিভ্র ভাই যে এখন খুব শান্ত ভাবে আমার সামনে থাকা সোফায় বসে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।লজ্জায় আমি তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।তার দিকে না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারছি উনি শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনার দৃষ্টি শান্ত হলেও বড্ড ভয়ংকর যেই দৃষ্টি আমার চোখে পড়লে আমার বুক কেপে উঠে।

আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি।আমাকে নিভ্র ভাই থাপ্পড় মেরেছে এই কথা শুনে আমার বড় ভাই শুভ্র দৌড়ে এলো।বসার ঘরে ঢুকেই দেখলো আমি চুপচাপ দাড়িয়ে চোখের জল ফেলছি আর নিভ্র ভাই সামনের সোফায় বসে আমার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে আছে।

বন্ধুকে শান্ত করার জন্য ভাইয়া নিভ্র ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলো।তার পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
শুভ্র: কি হয়েছে? হঠাৎ এই ভোর সন্ধ্যায় মেয়েটা মারছিস কেন?
শুভ্র ভাইয়ের প্রশ্নই যেন যথেষ্ট ছিল নিভ্র ভাইয়ের রাগ কে বাড়িয়ে তোলার জন্য।উনি বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে আমার দিকে তেড়ে আসেন।আমার কাছে এসে আমার গাল চেপে ধরে বলেন,
নিভ্র: ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে অনেক ভালো লাগে তাইনা? ছেলে দেখলেই মন লাফায় তাইনা?

অপমানে আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে তবুও আমি টু শব্দটি করিনি।আমি যতই দুর্বল হইনা কেন বাইরের লোকের সামনে কখনো নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করিনা আর বর্তমানে আমি এমন জায়গায় আছি যেখানে বাইরের লোক ভর্তি।এমনিতে শুধু নিভ্র ভাইয়া থাকলে কেদে দিতাম কিন্তু এখন অন্য লোক আছে এখানে তাই জোর করে হলেও চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দিচ্ছিনা।

আমার চোয়াল শক্ত করে রেখেছি বুঝতে পেরে নিভ্র ভাইয়া আরও জোরে চেপে ধরলেন আমার মুখ।উনার পাঁচ আঙ্গুল যেন আমার মুখের মাংস ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যাবে। দাতের সাথে উনার আঙ্গুল বারি খাচ্ছে।আমি চুপচাপ চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে দাড়িয়ে আছি।আমার চোখের কোনে অশ্রুর আবির্ভাব দেখে নিভ্র ভাই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

উনার ধাক্কা দেওয়ায় আমি ছিটকে টি টেবিলের উপর পড়লাম। টি টেবিলের কোণায় লেগে আমার কপাল কেটে গেছে।কপাল থেকে অল্প বিস্তর রক্ত বের হচ্ছে কিন্তু নিভ্র ভাই সেদিকে চোখ নেই।উনি আমার দিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললেন,
নিভ্র: শুভ্রর গায়ে হলুদে যেন তোকে না দেখি…দেখলে এর থেকেও বাজে অবস্থা হবে কথাটা বলেই উনি বেরিয়ে গেলেন।

আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম তারপর শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে এলাম।ঘরে এসেই বিছানায় বালিশে মুখ গুজে কাদতে লাগলাম। কাদতে কাদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারলাম না।

ছাদের এক কোনায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সিগারেট খাচ্ছে নিভ্র।আজ হৃদয়ে অনেক বড় দহন লেগেছে যেটা পোড়ানোর ক্ষমতা একমাত্র এই সিগারেটেরই আছে।একজন কাছে থাকলে অবশ্য খানিকটা ক্ষতটা তে প্রলেপ লাগতো কিন্তু তার উপর বেজায় ক্ষেপে আছে নিভ্র তাই তার সান্নিধ্যে এখন না যাওয়াটাই ভালো।

হঠাৎ নিজের কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করে নিভ্র।তবুও পিছন ফিরে তাকায় না মানুষটার দিকে। নিভ্র জানে মানুষটা শুভ্র। শুভ্র মলিন কণ্ঠে বলল,
শুভ্র: এতই যখন ভালবাসিস নিদ্রা কে তখন ওকে বললেই পারিস।শুধু শুধু মেয়েটা কে কেন কষ্ট দিচ্ছিস? দেখেছিস মেয়েটা তোর এমন ব্যবহারে কত কষ্ট পেয়েছে? তুই এত পাষাণ কবে হলি রে? আমার বোনের কষ্ট তোর চোখে পড়ে না?

নিভ্র সিগারেটের ধোঁয়া মুখ থেকে ছাড়তে ছাড়তে বলে,
নিভ্র: যেই জিনিস অতি সহজে পাওয়া যায় তার মূল্য নেই শুভ্র। দুর্লভ যা তা নিজের কষ্টে অর্জন করতে হয়।নিদ্রা তার নিজ দোষেই আমার থেকে এমন ব্যবহার পেয়েছে।সে যদি নীরবের সঙ্গে এত ক্লোজ না হতো তাহলে এত কিছু হতই না।আর পাষাণ আমি নই তোর বোন।সে কেন বুঝে না তার না বোঝার কারণে একজনের হৃদয় প্রতি নিয়ত দহনে দগ্ধ হচ্ছে ।সেই হৃদয়ের দহনের কাছে নিদ্রার কষ্ট কিছুই নয়।

নিদ্রা সেই মানুষটার ভালোবাসা বুঝতে পাড়লেই বিষক্রিয়া হবে সেই মানুষটার বিষাক্ত ভালোবাসায়। বিষাক্ত ভালোবাসায় দহন না হওয়া অব্দি নিদ্রার নিস্তার নেই।

নিভ্রর কথায় শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
শুভ্র: যা মন চায় কর কিন্তু আমার বিয়ের হলুদে যেন আমার বোনের মুখে হাসি দেখি। ও যদি বিয়ের হলুদে না আসে তাহলে আমি বিয়ের হলুদ গাঁয়ে ছোঁয়াবো না আর এটা আমার প্রমিজ বলেই চলে গেলো শুভ্র। নিভ্র শুভ্রর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবারও সিগারেট খাওয়ায় মন দিল।

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আমার ঘুম ভেংগে গেল।ঘুম ভেংগে আশেপাশে তাকালাম।পুরো ঘর ডিম লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে। সন্ধ্যা ছয়টা বাজতেই টাইমারের জন্য আমার রুমের ডিম লাইট অন হয়ে যায় তাও আবার ছোটো ছোট হলুদ রঙের। মৃদু হেসে ঘরটা কে দেখে নিলাম।

বিছানায় আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই পায়ের কাছে খচখচ আওয়াজ হলো।মনে হচ্ছে কোনো কাগজ আছে। বিছানা হাতড়ে ভাঙ্গা চশমাটা খুঁজে নিলাম যেটা নিভ্র ভাইয়ের থাপ্পড়ে ভেঙে গেছে।আমি ভাঙ্গা চশমাখানা চোখে দিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম।টেবিল ল্যাম্প জ্বালাতেই ঘরের খানিক্টা অংশ আলোকিত হলো।

টেবিল ল্যাম্পের কাছে বসে কাগজটা খুললাম। কাগজটা কারোর চিঠি। চিঠির প্রথম লাইনটা পড়তেই মন ভরে উঠলো। চিঠিটা বুকে চেপে বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে হাসিমুখে বললাম ‘ রাত ‘ ।

জানিনা মানুষ টা কে কিন্তু যখনই আমার মন খারাপ থাকে কিংবা যেদিনই নিভ্র ভাই আমাকে বকাবকি করেন সেদিনই আমার মন ভালো করতে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি দেন।জানিনা কোন ফাঁকে কখন আমার ঘরে আসেন কিন্তু আমি নজর রেখেও কোনোদিন তার হদিস পায়নি। কিছু না কিছু একটা করে হুট করে আমার চোখের সামনে চিঠি হাজির করে।

পুরনো কথা ভাবা বাদ দিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম।

প্রিয় রাত,

কেমন আছেন? ভালো থাকার কথা নয় যতটুকু আমি জানি কারণ… কারণটা আপনি জানেন তবুও বলছি।আজ আবারও আপনার সেই হিটলার নিভ্র ভাই আপনাকে বকেছে তাই না? জানি তো লোকটা অনেক বড় খোক্ষস নাহলে আপনার মত পিচ্ছি বাচ্চা কিউট মাসুম মেয়েকে কেউ এভাবে বকে?আমি হলে আপনাকে মাথায় তুলে রাখতাম,কখনো কাদতে দিতাম না আর আপনার সব ভুল! সব ভুল মুচকি হেসে মেনে নিতাম সঙ্গে আপনাকে বুঝাতাম যেন ভুলটা দ্বিতীয়বার না করেন।আপনার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হয় কারণ আপনার আশেপাশে থাকা ভিড়ের মাঝেই মিশে আছি আমি।প্লিজ মন খারাপ করবেন না আর আপনার ঘরে আপনার পড়ার টেবিলের উপর বক্সে থাকা কাচা হলুদ শাড়িটা আমার শালা বাবু থুক্কু শুভ্র ভাইয়ের বিয়েতে পড়বেন কিন্তু।

ইতি,
আপনার মন ভালো করার মানুষ
আঁধার

চিঠিটা পড়ে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। চিঠিতে থাকা মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা বেড়ে গেলো। মানুষটা আমার দুঃসময়ের সঙ্গী।আমার যখনই মন খারাপ হয় তখনই মানুষটা আমায় হাসায়।

মনের অজান্তে উনাকে নিজের মনে বন্ধুত্বের জায়গা দিয়ে ফেলেছি যেটা আমার কাছে অনেক বড় কিছু।মানুষটা আমার সুখে দুঃখে সবসময় আমার পাশে ছিল তাই কোনোদিন মানুষটার খারাপ সময় তার পাশে থাকার সুযোগ পেলে সেই সুযোগ হাতছাড়া করবো না।এগিয়ে দিবো সাহায্যের হাত।

আমি উনার চিঠিটা সযত্নে আমার ডায়েরির ভাজে তুলে রাখলাম আর সেখানে রেখে দিলাম একটা তাজা গোলাপ। ডায়েরী বন্ধ করে বইয়ের ফাঁকে রাখলাম তারপর হাত দিলাম টেবিলের উপর থাকা কালারিং কাগজে মোড়ানো গিফটটাতে। গিফট খুলতেই চোখের সামনে উন্মোচিত হলো একটা হলুদ শাড়ি।আসলেই রংটা কাচা হলুদ। হলুদ রঙের সুতির শাড়ী তার সঙ্গে ম্যাচ করা হলুদ রঙের মধ্যে গোল্ডেন পারের ব্লাউজ। শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু এটা বিয়েতে পড়বো কি করে? নিভ্র ভাইয়া তো বিয়ের হলুদের আশেপাশেও যেন আমাকে দেখতে না পায় সেই ওয়ার্নিং দিয়েছে। নিভ্র ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো।নিচে এখন ভাইয়ার মেহেদীর অনুষ্ঠান হচ্ছে অথচ কেউ আমার খোঁজ অব্দি করেনি।সবাই নিভ্র ভাইকে ভালোবাসে,কেউ আমাকে ভালোবাসে না।

~ চলবে ইনশাল্লাহ্

#তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা
#মিফতা_তিমু
১.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here