তুই আমার প্রেমময় নেশা পর্ব -০২

#তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা
#মিফতা_তিমু
২.

বছরের শেষের আর শুরুর দিকের মাস দুটো ডিসেম্বর আর জানুয়ারি।আর এই ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতেই সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে।বাংলাদেশে শীতকাল মানেই বিয়ের মৌসুম।এই সময় একের পর এক শুধু বিয়ের দাওয়াতই আসতে থাকে।বিয়ের দাওয়াত মানেই খাওয়া দাওয়া।সুন্দর করে সেজে গুঁজে যাব বিয়েতে ছবি তুলতে আর কব্জি ডুবিয়ে খেতে।কিন্তু বিয়ের মৌসুমে যদি নিজের বাড়িতে বিয়ে লাগে তাহলে ফুরসৎই মেলে না একদন্ড বসার।

এই দিক দিয়ে নিভ্র ভাইয়ার বদৌলতে আমি বেশ আরামসে আছি।আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে অথচ আমার কোনো কাজ নেই। নিভ্র ভাই আমাকে আজাইরা বসিয়ে দিয়েছে।এই দিক দিয়ে ওর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।আমি আবার বড্ড আলসে মানুষ। কাজকর্ম ঠিক করতে পারিনা মানে চাইনা করতে তাই।

ভাইয়ের বিয়েতে ঠান্ডা পানির সুইমিং পুলে হাত পা ডুবিয়ে বসে থাকার মতো সৌভাগ্য কারোর হয়না।সেই সৌভাগ্য যে আমার হয়েছে তা কম কি।আমি আরামসে সুইমিং পুলে হাত পা ডুবিয়ে বসে আছি।
ভাইয়ার মেহেদীর অনুষ্ঠান অথচ আমার হাতে মেহেদি নেই আর থাকবার কথাও না। ওসব হাতে রং চং মেখে সং সাজার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।আমি আবার মেহেদী দেওয়া পছন্দ করিনা। বাড়ির সকলে আমার এই স্বভাবের জন্য খেপায় এই বলে যে মেহেদী দেওয়া পছন্দ না হলে যখন আমার নিজের বিয়ে হবে তখন কি করবো।তখন তো দিতেই হবে কিন্তু আমিও পাল্টা যুক্তি দিতে জানি।সোজা বলে দিছি বিয়েই করবো না,দরকার পড়ে চাকরি করে পুরো বাংলাদেশ ঘুরবো তবুও বিয়ে করবো না।

আজিজ তালুকদার, শুভম চৌধূরী এবং মেহেরান হোসেন তিন বন্ধু।তিন বন্ধুর মধ্যে আজিজ তালুকদার হলেন আমাদের বাবা।আমরা তিন ভাই বোন। আমি জান্নাতুল তিরানা নিদ্রা, আমার যমজ বোন জান্নাতুল তিরানা তন্দ্রা আর আমাদের দুজনের বড় শুভ্র তালুকদার হলো আমাদের ভাইয়া।আমরা দুই বোন যমজ হলেও একেবারেই একই রকম দেখতে না।আমাদের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও ব্যবহার খানিকটা একইরকম।

শুভম আংকেলের আবার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় মেয়ে নীলাদৃতা চৌধুরী যার বিয়ে আমার ভাইয়ার সাথে হচ্ছে।দুজনের প্রণয়ের বিয়ে।ছোটো ছেলে নিরব চৌধুরী যে আমার, অভ্রর আর তন্দ্রার বয়সী আর আমরা চারজনে বেস্ট ফ্রেন্ড।আমাদের কে দেখলে যে কেউ ভাই বোন বলবে কারণ আমাদের মাঝে এত ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

মেহেরান আংকেলের আবার দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে মেহেরহান হোসেন নিভ্র যে স্বভাবের দিক থেকে একেবারে গম্ভীর আর বদমেজাজি। ছোটো ছেলে মেহেরাব হোসেন অভ্র যে একেবারেই আমার মত চঞ্চল আর আমার বয়সী।আর সবার ছোট হলো নিশিতা হোসেন নিতা।বয়স ২০ বছর।আমরা সকলেই ওকে নিশি বলে ডাকি।একদম মিষ্টি একটা মেয়ে।সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।

আমি জান্নাতুল তিরানা নিদ্রা।বয়স পঁচিশ বছর।সবেমাত্র মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি।আমি,তন্দ্রা, অভ্র আর নিরব চারজনেই আমরা মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে আর চারজনই কমার্স সেক্টরে জাহাঙ্গীর নগরে অধ্যয়নরত।

মনটা আজ বড্ড খারাপ। আঁধারের দেওয়া শাড়ি বোধহয় আমার আর পড়া হবে না। নিভ্র ভাই তো বলেই দিয়েছে আমি ভাইয়ার বিয়ের হলুদে যেতে পারবো না।বিয়ের হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমার মন খারাপ হচ্ছে না।মন খারাপ হচ্ছে যখন হাজার লোকের মাঝে মিশে থাকা আঁধার আমাকে হলুদ শাড়ির ভাজে দেখবে না তখন তার কেমন লাগবে। আঁধারের মন খারাপ হবে ভাবতেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।

সুইমিং পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে দুই পায়ের উরুতে হাত রেখে গালে হাত ঠেকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছি। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতি টের পেলাম।মুখ ফিরিয়ে দেখলাম বেগুনি রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা রঙের পাজামা পরিহিত ভাইয়া।ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিস্তর হেসে বললো,
ভাইয়া: এভাবে মন খারাপ করে ঠান্ডার রাতে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে আছিস কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।নিজের চিন্তা একেবারেই নেই।তোর কিছু হলে ঐদিকে আরেকজনের যে হৃদয় দহন হবে সেটা কি তোর জানা আছে?

আমি অবাক হয়ে বললাম,
নিদ্রা: কার?
ভাইয়া: আর কার।আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু নিভ্রর।
আমি ভেংচি কেটে সামনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
নিদ্রা: উনার আবার আমার জন্য কষ্ট লাগে নাকি? উনি তো হৃদয়হীন।আমি হীনা উনি বেশ সুখেই আছেন। আমাকে ছাড়া থাকা শিখে গেছেন।এখন আর আমার প্রয়োজন পড়েনা উনার।আমার কথা ভাবলে ঘর ভর্তি লোকের সামনে চর মারতেন না।
আবার আমাকেই আমার ভাইয়ের বিয়ের হলুদে যেতে মানা করেছেন।

ভাইয়া: তুই যে অনেক কিছুই বুঝেও বুঝিস না নিদ্রা।তুই যদি বুঝতি তাহলে নিভ্র কে তোকে মারতে হতো না। নিভ্র তোকে কেন মেরেছে সেটা তুই বুঝলে হয়েই যেত।যাক যখন সময় হবে তখনই বুঝবি। নিভ্রর তোকে প্রয়োজনীয়তা কমে যায়নি বরং ওর প্রয়োজন তুই বুঝিস না।
নিদ্রা: ও এখন তো তুমি তোমার বন্ধুর হয়েই কথা বলবে।তোমার বন্ধু আগে না আমি আগে? আমি তোমার বোন আর ও তোমার বন্ধু।বন্ধু গেলে আবার আসবে কিন্তু বোন আসবে না।
ভাইয়া: তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান।কেউ কারোর থেকে কোনো অংশে কম নয় বরং দুজনেই খুব প্রিয়।এমন বন্ধু গেলেও আর আসবেনা আর এমন বোন গেলেও আসবে না তাই কাউকেই হারাতে চাই না।তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান।
নিদ্রা: নিভ্র ভাইয়া তো সবার সঙ্গেই অনেক ভালো ব্যবহার করে।তাহলে আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার কেন করে? ও কি বুঝে না ওর এই ব্যবহার আমার হৃদয় কে প্রতি নিয়ত ব্যর্থতার আগুনে দগ্ধ করে। প্রতি নিয়ত আমার হৃদয় দহনে দগ্ধ হচ্ছে কিন্তু সেটা নিভ্র ভাইয়ার চোখে পড়ে না।

আমার প্রশ্নের জবাবে ভাইয়া কিছু বললো না।আমিও আর আশা করলাম না ভাইয়ার থেকে কোনো উত্তর।একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি।আমাদের বাড়ির সুইমিং পুল আমাদের বাড়ির ছাদে। এখানে সুইমিং পুলে বসলে সুইমিং পুল থেকে পুরো ঢাকা শহর দেখা যায়। দৃশ্যটা অনেক জোস।কেউ না চাইতেও একবার সেদিকে তাকালে চোখ আর ফেরাতে পারে না।আমি সেইদিকে একমনে চেয়ে আছি।

কিছুক্ষণ ভাইয়া আর আমি একসাথে বসে থাকার পর আমাদের রাতের খাবারের ডাক এলো।এখন খেতে যেতে হবে। মেয়ের বাড়ির লোক চলে গেছে সেই সাথে নীলা আপু আর নিরবও।আমি আর ভাইয়া উঠে নিচের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম।নিচে আসতেই দেখি নিভ্র ভাইয়া এখনো নিচে আসেনি খেতে।এই সুযোগ এই ফাঁকে খেয়ে উঠে যাবো।

আমি সুযোগ বুঝে সবার আড়ালে প্লেট অল্প কয়টা ভাত নিলাম আর কয়টা চিংড়ী। গপাগপ কোনরকমে গিলছি যেন কেউ না দেখে ফেলে।দেখলে আর নিস্তার নেই।তাড়াতাড়ি খেয়ে যেই না উঠে রানাঘরের দিকে পা দিবো ওমনি কেউ পিছন থেকে আমার হুডির ক্যাপ ধরে টান দিল।আমি ভয়ার্ত চোখে আস্তে আস্তে পিছন ফিরলাম।

যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই হলো। নিভ্র ভাই আমার হুডি ধরে দাড়িয়ে আছেন।উনার পরণে ব্ল্যাক শার্ট উইথ ব্ল্যাক সুট।উনার কালো রং খুব পছন্দ তাই কালো রংটাই বেশিরভাগ পড়েন।আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি শান্ত দৃষ্টিতে।উনার দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারছি আমার প্রতি উনার রাগ এখনও কমেনি।উনি আমার হুডির ক্যাপ আস্তে করে দুইহাতে ধরে আমার মাথায় দিয়ে দিলেন হুডি।

আমার হাত থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে বললেন,
নিভ্র: তোমার হাইটের জন্য তোমাকে পিচ্ছি বলি, ব্যবহারের জন্য আর চেহারার ভাবভঙ্গির জন্য পিচ্ছি বলি তারমানে এই নয় তুমি সত্যি সত্যি পিচ্ছি আর পিচ্চির মত খাবার খাবে।তুমি পিচ্ছি নাকি বুড়ো সেটা আমি চাইলে এখনি বুঝিয়ে দিতে পারবো।আজ বাসর করলে কাল প্রেগনেন্ট হয়ে যাবে তাই চুপচাপ বসো আর আমি যতটুকু খাইয়ে দিচ্ছি খাবে।

উনার এমন কথায় আমার নাক কান লাল হয়ে যায়।মানুষটা আসলেই অসভ্য আর খোক্ষস নাহলে বাড়ির বড়দের সামনে কেউ এরকম লাজ শরমহিন কথাবার্তা বলে।আমি চুপচাপ এখনো দাড়িয়ে আছি দেখে নিভ্র ভাইয়া আমায় টেনে হিচড়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।উনাকে দেখে খাওয়ার টেবিলে ইতিমধ্যে সব আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে।উনি খাওয়ার টেবিলে কথা বলা পছন্দ করেন না তাই উনার সামনে কেউ খাওয়ার টেবিলে কথা বলে না।

~ চলবে ইনশাল্লাহ্

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here