তুই আমার প্রেমময় নেশা পর্ব -০৩

#তুই_আমার_প্রেমময়_নেশা
#মিফতা_তিমু
৩.

নিভ্র ভাইয়া আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর আমি খেতে খেতে উনাকে এক দৃষ্টিতে দেখছি।মানুষটা বড়ই অদ্ভুত।শুধু আমার উপর রাগ আর চোটপাট করে।এটা বুঝে না যে তার এমন ব্যবহার আমায় কষ্ট দেয়।আমার কথা হয়তো তার আর মনে পড়েনা।আমি শুধু তার রাগ ঢালার পাত্রী।

আমি কেন উনার জন্য আমার বন্ধুদের থেকে দূরে থাকবো।উনি শুধু আমার উপর তেজ দেখাবেন আর আমাকে উনার বাড়ির চার দেওয়ালে বন্ধ করে রাখবেন আর সেটা আমি হতে দিবো? কখনোই না। জান্নাতুল তিরানা নিদ্রার উপর আজ অব্দি কেউ জোর খাটাতে পারেনি আর ভবিষ্যতেও পারবে না।আমার বাবা মা কখনোই আমি যেটা চায়নি তাতে জোর করেনি তাই বাইরের কেউও আমার উপর অধিকার দেখানোর ক্ষমতা রাখেনা। যে আমার কথা ভাবে না সে আমার কেউ না ভাবতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিতেই নিভ্র ভাই কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর প্লেটে পানি ঢেলে উঠে দাড়ালেন।আমায় বললেন,
নিভ্র: আমার সঙ্গে বেসিনের কাছে চল।
নিদ্রা: যাবো না আমি।আমার মুখ আমি ধুতে পারি।আমি এখনও বাচ্চা নই যে তোমাকে আমার মুখ ছোটবেলার মত ধুয়ে দিতে হবে।আমি পারি নিজের কাজ নিজে করতে।

আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে নিভ্র ভাইয়া কিছু শুনলেন না।আমায় টেনে নিয়ে গেলেন বেসিনের কাছে।আমি জানতাম এটাই হবে।উনি কখনোই আমার কথা শুনেন না তবুও আমি সবসময়ই বলে যাই।আমি রাগে মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে রইলাম।উনি প্রথমে নিজের হাত ধুলেন অতঃপর আমার মুখ ধুয়ে দিয়ে আমায় ইশারা করলেন আমার ঘরে যেতে।

উনার ইশারা পাওয়া মাত্র ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ি দিয়ে উঠে এলাম কিন্তু ঘরে গেলাম না সোজা ছাদে সুইমিং পুলের কাছে চলে এলাম। আবারও জিন্সের পা গুটিয়ে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসলাম। শীত না পড়লে এই রাতে এখন গোসল করতাম কারণ আমি আবার গোসল প্রিয় মানুষ। গরমকালে দিনে তিনবার গোসল করি।

আমি ছাদে এসে পা ডুবিয়ে বসলাম।বাবা মেহেরান আংকেলের সঙ্গে ছাদ সাজানোর কাজে তত্ত্বাবধায়কের দিকটা দেখছিল।ভাইয়ার পরশু বিয়ে সেই খুশিতে তালুকদার বাড়ি অনেক ঘটা করে সাজানো হচ্ছে।আমাদের পরিবারে আমার বাবাই একমাত্র ছেলে আর একমাত্র ছেলেরও একমাত্র ছেলে আমার ভাইয়া।তাই ভাইয়ার বিয়েতে কোনোকিছুর কমতি রাখতে চাচ্ছে না বাবা। সবদিক দিয়ে যেন সবটা ঠিক হয় সেই ব্যবস্থা করছে।

মেয়েকে এই শীতের রাতে আনমনে সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে দেখে মিস্টার আজিজ তালুকদারের কপালে ভাঁজ পড়ল।বন্ধুকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে ভ্রুকুটি কিঞ্চিৎ কুচকে এগিয়ে গেলেন সুইমিং পুলের দিকে।পা গুটিয়ে মেয়ের পাশে বসে পড়লেন।মেয়ে তার পাশে কারোর উপস্থিতি পেতেই পাশ ফিরে তাকালো।বাবা কে দেখেও কিছু বললোনা।মেয়ের এহেন ব্যবহারে আজিজ তালুকদার অবাক হন।তার মেয়ে কখনোই তাকে দেখে এত চুপচাপ শান্ত থাকেনা। তার দুই মেয়ে বড় আদরের। বড়টা শান্ত হলেও ছোটটা চঞ্চল আর বাবা প্রিয় বেশি তাই ছোটোজন বাবা কে দেখলেই বাবা কে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।আজিজ তালুকদার বুঝলেন মেয়ের মন খারাপ তাই মেয়ের মন ভালো করার উদ্দেশ্যে কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,
আজিজ: আমার ছোটো আম্মুটা চুপ করে আছে কেন? আজ বাবাকে দেখেও কিছু বললো না।আমার আম্মুর কি মন খারাপ?

বাবার কথার প্রতি উত্তরে কিছু বললাম না।আমার নিস্তব্ধতা বাবা কে কষ্ট দিচ্ছে।বাবা আবারও বললো তবে এবার আর আগের মত খুশি মুখে নয় বরং মলিন কণ্ঠে,
আজিজ: কি হয়েছে আমার আম্মুর?এভাবে একাকী ঠান্ডার মধ্যে বসে আছে কেন?
নিদ্রা: আচ্ছা বাবা আমরা যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি সেই কেন আমাদের কষ্ট দেয়?

মেয়ের এহেন প্রশ্নে অবাক হন না মিস্টার আজিজ তালুকদার কারণ মেয়েটা তার অল্পতেই মন খারাপ করে কারণ নিদ্রা বেশ ইমোশনাল।আজিজ তালুকদার আলতো হেসে বললেন,
আজিজ: আম্মু আমাদের যে ভালোবাসে সেই আমাদের বেশি কষ্ট দেয় কারণ সে সেটা আমাদের ভালোর জন্যই করে।তারা মনে করে আমাদের ভালোর জন্য যদি তারা আমাদের কষ্ট দে তাহলে তাদের একটু খারাপ ব্যবহারে আমরা ভালো থাকবো। বস্তুত কথাটা কিছু ক্ষেত্রে সঠিক আবার কিছু ক্ষেত্রে সঠিক নয় কারণ অনেকেই সেই ব্যবহারের কারণে এতটাই ভেঙে পড়ে যে জীবনে তারা এগিয়ে যেতে চায় না।তাই আপনজনদের কাছ থেকে আঘাত পেলে ভেঙে না পরে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।মানুষ টাকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমরা ভাঙতে নয় গড়তে জানি।

কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন।মেয়েটা কে এখন একটু সময় দেওয়া দরকার।এই বয়সে একটু আবেগের হেরফের হয়ই তাই বলে তাকে প্রশ্রয় দিতে নেই বরং সময় দিতে হয়।মেয়েটা তার একটু সময় পেলেই সবটা গুছিয়ে উঠবে।

বাবা চলে গেলেও আমায় একরাশ চিন্তা ভাবনা দিয়ে গেলো।আমাদের আপনজনরা আমাদের ভালোর জন্যই আমাদের কষ্ট দে? কিন্তু এমন কষ্ট দেওয়ার কি দরকার যেখানে সেই কষ্টের জন্যই আমাদের খারাপ হয়। ব্যাপারটা গোলমেলে তবে অসম্ভব নয়।

ভাবনা কাটিয়ে উঠলাম।এইখানে আর বসে থাকা যাবে না। স্লিপার পড়ে ছাদের আরেক কোনায় এগিয়ে গেলাম।ছাদ সাজানো হচ্ছে হলুদ রঙের রঙ বেরঙের ফুল দিয়ে কারণ কাল এখানেই ভাইয়ার বিয়ের হলুদ হবে।ছেলে আর মেয়ে দুজনের হলুদ একসঙ্গেই হবে।কাল নীলা আপু আর নিরবও আসবে।

নিজের বাড়িকে এই প্রথম রঙিন সাজে সেজে উঠতে দেখে মন ভরে উঠলো।মনটা নিমেষেই বদলে গেলো। আঁধারের জন্য হলেও কাল যাবো।মানুষটা হাজার মানুষের ভিড়ে আমায় হলুদ রঙের শাড়ির মাঝে না দেখলে কষ্ট পাবে।আমি আমার আপনজন থেকে আঘাত পেলেও আমি যার আপনজন তাকে কষ্ট পেতে দিবো না।

আমি স্মিত হেসে নিচে চলে এলাম।রাত জাগা যাবে না।রাত জাগলে চোখের নিচে কালি পড়বে যেটা আমি একেবারেই সহ্য করবো না।এমনিতেই চশমার জন্য আমার চোখের নিচে কালি পড়েছিল যেগুলো অনেক কসরত করে উঠিয়েছি।এখন চোখের নিচে কালি পড়লে কাল হলুদে বাজে দেখতে লাগবে।

হলুদের অনুষ্ঠানে মেকআপ করার মতো ইচ্ছা আমার নেই।আমার মতে হলুদের অনুষ্ঠানে মেকআপ না করে প্রত্যেক কে তার আসল রঙেই সেজে উঠা উচিত তাতে অনুষ্ঠান আরো বেশি সুন্দর হয়।তাই আমি কাল কোনো ধরনের মেকআপ করছি না।এখন শুধু ঘরে গিয়ে আই মাস্ক পরে শুয়ে পড়ব তাহলে সাথে সাথে ঘুম এসে যাবে।

ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পরে নিলাম।তারপর চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম।সারাদিনের ধকল আর নিভ্র ভাইয়ার থাপ্পড়ে ঘুম আসতে বেশিক্ষণ লাগলো না।মিনিটের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে কাদা। মাঝরাতে মনে হলো কেউ একজন আমার কপাল ছুঁয়ে দিচ্ছে তার উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে যেই ছোঁয়া আমার বহু পরিচিত। ছোঁয়াটা ঘুমের মাঝে পাওয়ায় তেমন পাত্তা দিলাম না।এরকম টা আমার প্রায়ই মনে হয় যে ঘুমের মাঝে কেউ আমায় ছুঁতে চাইছে কিন্তু ব্যপারটা একেবারেই আমার মনগড়া তাই সেইদিকে আর বিশেষ মাথা ঘামাই না।

নিদ্রা….নিদ্রা….নিদ্রা ওঠ মা…. তোর ভাইয়ের আজকে হলুদ।অনেক বেলা হয়ে গেছে।এখন না উঠলে দেরি হয়ে যাবে।অনেক কাজ পরে আছে, আমাকে আবার কাজে যেতে হবে।আমি তোকে ডাকার পিছনে সময় নষ্ট করতে পারবো না- কথাগুলো বলতে বলতে মা বিছানা ঠিক করে।

আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। ঘড়িতে দেখি বেলা দশটা বাজে।এগারোটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু আর মা আমায় এখন ডাকছে।মায়ের দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে লাফ দিয়ে উঠে কাল রাতে আঁধারের দেওয়া শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভেজা চুল পরিষ্কার করছি।আমার পরণে আঁধারের দেওয়া সেই কাচা হলুদ রঙের শাড়ি।আমার হাতে, কানে আর গলায় শোভা পাচ্ছে রুপোর অলঙ্কার।চুলগুলো খানিক টা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে ছেরে দিলাম।আমার চুল খুবই পাতলা যদিও চুল পড়েনা কিন্তু আমার চুল জন্মগতভাবে কিছুটা লাল আর পাতলা।অবশ্য পাতলা চুলের জন্য মা অনেক আপসোস করে কারণ তন্দ্রা আর মায়ের চুল অনেক ঘন।

আমি যখন নাকে নাকফুল পড়তে ব্যস্ত তখনই ঘরে শাড়ির ব্লাউজের ফিতা লাগাতে লাগাতে ঢুকলো তন্দ্রা।আমাকে দেখে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে হাত পা ছুরে রাগে অতঃপর বলে,
তন্দ্রা: ব্লাউজের ফিতা লাগিয়ে দে না।কিছুতেই পারছিনা লাগাতে।

আমি ওর ফিতা লাগাতে লাগাতে বললাম,
নিদ্রা: এত তাড়াতাড়ি হাইপার হস কেন? একটু ধৈর্য্য ধরলেই সব পারিস তুই।
তন্দ্রা: সময় আর দশ মিনিট এরপরও ধৈর্য্য ধরবো?
নিদ্রা: এই কিন্তু লাস্ট।আমি বাবা আর পারব না তোর শাড়ি আর জামার ফিতা লাগাতে।তোর হবু বর অভ্র কে বলিস লাগাতে।শুধু একবার তোর বিয়েটা হোক তারপর আমি বাঁচি।তোর জ্বালায় ফুরসৎ মেলে না।
আমার কথায় তন্দ্রা হেসে আমায় দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
তন্দ্রা: খুব তো ভালই কাটাচ্ছিস সিঙ্গেল লাইফ।তোর সিঙ্গেল লাইফের বারোটা বাজানোর জন্য কাউকে দরকার।
আমি ভেংচি কেটে বললাম,
নিদ্রা: এক নিভ্র ভাইয়ের জ্বালাতেই বাঁচতেছিনা আবার নাকি আরেকজন।আমার দরকার নেই বাপু।
তন্দ্রা আমার কথায় কিছু বললো না শুধু আলতো হাসলো।

~ চলবে ইনশাল্লাহ্

শব্দসংখ্যা: ১২৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here