তুই হৃদহরণী পর্ব ১১

#তুই_হৃদহরণী
#Sabriha_Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ১১

“প্রতিটা কালো অতীত কিছু গল্প রেখে যায়।”

তুরফা ঠিক বুঝতে পারছে না কিছু। কি আছে এই লোকের মাঝে? কি সেই কালো অতীত? যেই আলো অতীতে তলিয়ে আছে এই লোক? তুরফা ধ্যান ধরে ভাবছে সে কথা। বুঝে উঠার চেষ্টা করছে উত্তর গুলির। তবে সবই বিফল, ধোঁয়াশাপূর্ণ।

“মিস তুরফা।”
তুরফা চমকে তাকাল।

“ভয় পেলেন হৃদহরণী?”

“….

“এনিওয়ে কাজের কথায় আসা যাক। এই ফাইল গুলি চেক করে আমায় দিন। আজ দুপুরে একটা মিটিং আছে অফিসে সব স্টার্ফ নিয়ে।”

“করছি।”

“উঠে যাচ্ছেন কোথায়? এখানে বসে কাজ করুন।”

“মানে?”

“যা শুনেছেন।”

“আমি আমার টেবিলে যাচ্ছি।”

“ভুলেও নয়।”

“আপনি বেশি করছে।”

“তাই মনে হচ্ছে তুর?”

“আমি তুর নই। তুরফা। তুরফা আমি।”

“জানি আপনি বিরল বস্তু। তবে আপনি আমার তুর।”

“….

রাগে আর কিছু বলতে পারল না তুরফা। বারণ করার পরেও সে পর্দার ওপারে গেল। আহরার কিছু বলল না শুধু স্লান হাসল।

স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মোনতাহ্। ঘড়ি আর রাস্তায় তার নজর। কখন আসবে তুরফা তার অপেক্ষা। স্কুলের মাঠে বিশাল বড় এক কালো গাড়ি এসে থামল। মোনতাহ্ ভ্রুকুটি করে সে দিকে তাকাল। কে গাড়ি তে তা দেখার জন্যে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। যেই দেখল ফিরাত বেড়িয়ে আসছে গাড়ি থেকে ওমনি সে রেগে পোয়াপিঠা হয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বুতবুত করছে। বিড়বিড় করে বলল,
“এই আপদ এখানে কি করে?”
ফিরাত মোনতাহ্ কে দেখেই খুশি হয়ে গেল। নেচে উঠল তার মন ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে। ঠোঁটে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল মোনতাহ্ এর দিকে। বলল,
“বান্দা হাজির মহারাণী।”
মোনতাহ্ মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট উল্টে রাগ করছে শুধু। ফিরাত সেটা খুব বুঝতে পারছে তার জন্যেই ঠোঁটে তার দুষ্টমি হাসি।

“কি হলো? চাঁদ কথা বলছেন না যে?”

“….

“মাই মুন।”

“কি কিসের মুন? আমার নাম মুন নয়। যদি হয়েও থাকে তবে মাই কি? হ্যাঁ মাই কি? কাওলা করে রেখেছেন না নাকি?”

“কাওলা নয় ম্যাম। আমানত হিসেবে রেখেছি আপনায়।”

মোনতাহ্ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ফিরাতের মুখের দিকে।

“এখন চলেন।”

“….

“চলেন ম্যাম।”

“চ চলব মানে?”

“মানে শপিংয়ে না যাবেন?”

“আমি আপনায় বলেছি?”
বেশ রাগ দেখিয়ে বলল মোনতাহ্।

“আমি আমার বান্ধবী তুরফা কে বলেছি আসতে। সে আসলে যাবো।”

“তোমার তুরফা বান্ধবীই বলেছে আমায় আসতে। এখন চলো।”
ফিরাত এ কথা বলে মোনতাহ্ র হাত ধরল টেনে নিয়ে গেল গাড়ির দিকে। মোনতাহ্ বারণ করছে তবুও কিছু হলো না। গাড়ির ভেতরে বসিয়ে সিট বেল লাগিয়ে দিল ফিরাত। নাকের ঢগায় আঙ্গুলের নাড়া দিয়ে মুচকি হাসল সে। তারপর ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল ফিরাত। মোনতাহ্ ফিরাতের কান্ডে হতবাক হয়ে বসে রইল চোখ বড়বড় করে। কান্ডের কথা ভাবছে শুধু। সাহস কত লোকের।

দুপুরে সবাই কনফারেন্স রুমে বসে আছে। ওয়েট করছে তুরফা আর আহরারের জন্যে। তুরফা রুমে ঢুকলে তার দিকে সবার তীক্ষ্ণ নজর গেল। এত গুলি চোখের মাঝেও তার চোখ আগে গেল মিহিরের দিকে। অন্যদের মতো সে তীক্ষ্ণ নয় বরং, শান্ত ও মুগ্ধ দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তুরফার হাসি পেল। নেকাব পরা তুরফা কে মিহির হতবাক হয়ে দেখছে। একটুপরই রুমে এলো আহরার। সবাই দাঁড়িয়ে পরল।

আহরারের পাশে তুরফা বসেছে। ল্যাপটপে সব ঠিক করে রেখেছিল আগেই। সেটা এগিয়ে দিল আহরারের দিকে। আহরার তাকাল। মিটিংয়ে মন দিল। হঠাৎ চোখ গেল মিহিরের দিকে। মিহির তুরফার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মিটিংয়ে মন বলতে নেই। আহরার রেগে ফেটে পরল একদম। তুরফার দিকে তাকাল। সে নিজের মতো ল্যাপটপে কাজ করছে। আহরার বিষয় টা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারছে না। এবার খুব জোরে ধমক দিল।
“মিটিংয়ে মন কোথায় থাকে আপনাদের? মন না থাকলে জব করেন কেন? সেক করতে হবে নাকি?”
ফুসফুস করা রাগ নিয়ে আহরার কথা গুলি বলল দ্রুত। সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছে না কার ভুল। কিন্তু যাকে মিন করে ইনডাইরেক কথা বলেছে সে ঠিকি বুঝেছে। মিহির যেন নেতিয়ে গিয়েছে। মাথা নিচু করে বসে আছে। তুরফা সবাই কে দেখল। সবাই তো সবাই কে দেখছে অথচ মিহির মাথা নিচু করে আছে। তুরফা বুঝল। মিটিং শুরু করার কথা জানাল আহরার কে।

মিটিং চলাকালীন মিহির ধ্যান ধরে দেখেনি তুরফা কে। তবে আড়চোখে মাঝে মাঝে নজর দিয়েছে মাত্র। তুরফাও খেয়াল করেছে সেটা। মনে মনে ঠিক করেছে, মিহির কে বিষয় টা জানাতে হবে। এমন করলে তার চাকরি থাকবে না।

মিটিং শেষে আহরার কথা বলছে তিন জনের সাথে। যাদের উপর দায়িত্ব থাকবে প্রজেক্টের। বাকি রা আস্তে আস্তে রুম ছাড়ছে। তুরফার গলা শুনা গেল।
“মিহির আপনি বাহিরে গিয়ে দাঁড়ান আমি আসছি। কথা আছে।”
মিহির কিছু না বলে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল।
কথাটা শুধু মিহির নয়। শুনল আরো একজন। সে ব্যক্তি আহরার। অবাকের চূড়ান্ত সীমায় সে। তুরফা কি না….

গম্ভীর গলায় আহরার আস্তে করে জানাল,
“আপনারা যান, আমি পরে ডেকে নিব।”

তুরফা চলে গিয়েছে। বাকি তিন জনও রুমে নেই।আহরারের মাথায় খুন চেঁপেছে। রাগে রক্ত টগবগ করছে। গরম তেলের মতো ফুটছে। চোখ বন্ধ করে টেবিলে সজোরে ঘুষি দিল। কোটের একটা বোতাম খুলে জোরে নিশ্বাস ফেলল। হনহন করে বের হলো কনফারেন্স রুম থেকে। একটু যেতেই দেখল মিহিরের কাছে সবে গিয়ে দাঁড়াল তুরফা। ২ সেকেন্ড সময়ও দেয় নি আহরার। তুরফার বাহু ধরে সবার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল নিজের কেবিনে। তুরফা বারবার না করছে। হাত ছাড়ার কথা বলছে কিন্তু আহরার শুনল না। খুব তাড়াতাড়ি তুরফা কে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকল। মৃদু ধাক্কা দিয়ে তুরফা কে ঠেলে দিল ভেতরে। ঠাস করে দরজা বন্ধ করল। রাগে ফুলে ফেঁপে যাচ্ছে সে। ‘ডালিমের ভেতর থেকে যেমন রঙ্গিম লাল দানা বের হয়ে আসে এখনি তার ভেতর থেকে যেন হিংস্র আরেক টা আহরার বের হয়ে আসবে।’ আহরার কোট টা খুলে ফেলল। সেটা সোফার দিকে ছুড়ে দিল। ইং করা শার্টে হাতা বোল্ট করতে করতে এগিয়ে এলো তুরফার দিকে। সে তো কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে দানাদানা ভয় জন্মাতে লাগল।

“তুই তুরফা..”

একটু থেমে আহরার ঘাড় ফিরায় পাশে। আবার তুরফার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুরফা।”
বাঘের থাবার মতো এসে এক হাতে তুরফার গাল দুটি চেঁপে ধরল। খুব শক্ত করেই ধরল।
“তুই তুরফা কে মারতে আমার এক মিনিটও লাগবে না কিন্তু বুকের এই খানে বাঁধবে। তুই প্রথম দিন আমার মন কেড়েছিস। হৃদয় চুরি করেছিস সেদিনই। তাই আহরারের কাছে এত কদর পাচ্ছিস তুই। এই জন্যে চোখে চোখে রাখছি তোকে। তোর দেখায় আমি বাকি মেয়েদের সঙ্গ ছেড়েছি, বিছানা ছেড়েছি তাদের। শুধু তোর ওই স্নিগ্ধ মুখের এক পলশার মতো দৃষ্টি দিয়ে। তোকে জীবনের নূর মেনেছি আমি আহরার। সেই তুই.. মিহিরের সাথে এত ডলাডলি কেন? কিসের এত চাওয়া চাওয়ি? এত কথা কিসের তোর ওর সাথে? দেখাস আমায়? জ্বলাতে চাস? আরে তোর দূরত্ব, তোর এড়িয়ে চলাতেই তো আমি জ্বলছি। প্রতিদিন জ্বলছি। মদের রেশে সেই জ্বলা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েও পারি না আমি। প্রতিটা রাত স্বপ্নে থাকে এক মায়াবি মানবি। অস্পষ্ট ধোঁয়াসা। ভুলেও আর এমন করিস না তুই। তুরফা শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছি। এত অবহেলা দিস না। পুরনো ক্ষত তে আঘাত লেগে মারাত্মক অসহনীয় ব্যথায় জ্বলে।”

এক নাগাড়ে কথা শেষ করে আহরার দম ছাড়ল। নেতিয়ে যাওয়ার মতো দেখাচ্ছে তাকে। আহরার গাল ছেড়ে দিল তুরফার। খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়াল। নিশ্বাস প্রবল গতিতে চলছে। লোক টা ঘামছে খুব। ততক্ষণে ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি চলে এলো তুরফার। তবুও বিবশ দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আহরারের পানে। অদ্ভুত রহস্য ঘেরা এই মানব।

চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here