#তুই_হৃদহরণী
#সাদিয়া
পর্ব : ১৭
হঠাৎ প্রবল শব্দে এক বজ্রপাতের ধ্বনি তে তুরফা দূরে গিয়েও আচমকা কাছে চলে এলো। আহরার কে জড়িয়ে ধরল হাত চেঁপে। আহরার মুচকি হাসল। এক হাতে শুধু তুরফার মাথায় ভরসার হাত রাখল। অনেকক্ষণ পর আহরার আদরে গলায় ডাকল তাকে।
“তুরফা।”
“….
“তুর শুনো।”
তখনো একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছেই। আর তুরফা আকঁড়ে ধরেছে আহরার কে।
.”তুর এখানে বসো। আমি আছি না। প্লিজ এমন করো না। একটু বুঝার চেষ্টা করো। তুমি নিশ্চয় চাইবে না তোমার সাথে বাজে একটা মুহূর্তে জড়িয়ে যাই আমি। নিজেকে সামলে রাখা টা কত টা কঠিন কাজ তোমাকে বুঝাতে পারব না। এত টা ধৈর্যবান লোক আমি নই। এ ব্যাপারে একদম নই। প্লিজ তুর ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
আহরারের ইঙ্গিত বুঝল তুরফা। ধরফড়িয়ে সরে এলো লোকটার থেকে। নিজের বোরকা ঠিক করে নিল।
“ভয় নেই। আমার কাছে এখন তুমি নিরাপদ ঝিনুকের ভেতর মুক্তার মতো। আগের বিষয় টা অন্য ছিল। আর এখনের টা ভিন্ন। শান্ত হোও হৃদহরণী।”
“…..
“এখানে বসো।”
আহরার টেনে তুরফা কে সোফায় বসাল। তারপর নিজে ফ্লোরে বসল। পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে হৃদহরণীর দিকে। তুরফা চেয়েও যেন সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারছে না। মোমবাতির হাল্কা আলোয় দুজনের মুখ অস্পষ্ট দেখা গেলেও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছে দুজনই। আবার এক ঝমকালো আলোয় রুম আলোকিত হয়ে উঠল। তুরফা ভয়ে চোখ বন্ধ করে আহরারের হাত আকঁড়ে নিল। আহরার খানিক হেসে সেই হাতের উপর নিজের বা হাত রাখল।
“আমি আছি তো। ভয় পেও না।”
ধমকা বাতাসে মোমবাতির আলো নিভে গেলে তুরফা খামছে ধরল আহরারের হাত। এতে সে অল্প ব্যথা পেলেও মুখে কিছু বলল না। কারণ তুরফা সব টাই ভয়ে করছে, জ্ঞানহীন ভাবে করছে। আহরার ফোনের লাইট অন করে দিল। টেবিলে গিয়ে মোমবাতিও জ্বালিয়ে নিল। নিচে তুরফার ফোন পরে থাকতে দেখে সেটা তুলে লাইট অন করল। রুমে এখন বেশ আলো জ্বলছে। আহরার এগিয়ে গেল তুরফার কাছে। নিচে বসে বলল,
“এই ঝড়ে বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। তোমাকে নিয়ে একদমই নয়। তার চেয়ে বরং রাত টা এখানে থাকো। সোফায় ঘুমিয়ে পরো। আমি কেবিনের বাহিরে আছি। আর একটুও ভয় পেও না। দেখো কেবিনে কত আলো। আমি আছি ওখানে।”
আহরার নিজের কোট টা খুলে তুরফার কোলে রাখল। “এটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ো ঠান্ডা লাগবে না।” বলে আহরার কেবিনের বাহিরে গেল।
তুরফা চুপচাপ শুয়ে পড়ল। এখনো একটু একটু ভয় থাকলেও আগের চেয়ে হাজার গুণ লাঘব হয়েছে। কোট টা জড়িয়ে নিলে অদ্ভুত একটা মিষ্টি ঘ্রাণ অনুভব করল তুরফা। এটা পারফিউমের নাকি অন্য কিছু তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। তবে ভেতর থেকে যেন অনুভব করতে পারছে এমন মনে হচ্ছে তার। তুরফা আহরারের দিকে তাকাল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা ঝিলকির কারণে আহরারের মুখ স্পষ্ট দেখা গেল। কেবিনের দিকে চেয়েই আছে মানুষটা। তুরফার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। ভেতরে ভয় না হলেও কি একটা যেন চলছে। মনে হচ্ছে এ ঝড় বাহিরের ঝড়ের কাছে অনু মাত্র।
হৃদহরণী এখন ঘুমিয়ে আছে। বাহিরের ঝড়ের মাত্রা টা কমেছে। শুধু বৃষ্টি হচ্ছে অঝোর ধারে। আহরার এক নজরে তাকিয়ে দেখছে তুর কে। কি মায়াবী সেই মুখ। কি মোহনীয়, বুকের ভেতর শিহরন জাগিয়ে তুলে। নূর উবছে পরছে চেহারা থেকে। আহরার ধ্যান ধরে অবলোকন করছে তুর কে।
ফিরাত আর মোন পাশাপাশি বসে আছে। কেউ টু শব্দ করছে না। দুজনেই চুপ। ফিরাত বলে উঠল।
“মুন বললে না এই গুলি কার?”
“….
“চাঁদ বলো আমায়।”
“প্লিজ এসব কথা বাদ দিন ভালো লাগে না আমার।”
“কিছু হয়েছে কি চাঁদ?”
“কষ্টের জীবনের কথা কাউ কে বলতে আমার আরো কষ্ট লাগে।”
“কি হয়েছে চাঁদ বলো।”
“….
“বলা যায় না?”
“এগুলি আমার বাবার।”
“তবে এত দ্বিধা করছো কেন বলতে?”
“….
“মুন।”
“বাবা এখানে থাকে না।”
“কোথায় থাকে উনি?”
“উনার দ্বিতীয় বউয়ের কাছে।”
“হোয়াট?”
“….
“কি বলো এগুলি?”
“অনার্স ১ম বর্ষে উঠার পর আমার মা মারা যায়। আমার ফুপি আর চাচারা বাবা কে বুঝাল, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তাকে কে দেখবে? উনাকে দেখা শুনার জন্যেও তো একটা মানুষ দরকার। উনি তো আর একা একা বৃদ্ধ জীবন পাড় করতে পারবে না। বাবাও তেমন অমত করে নি। রাজি হয়ে যায়। গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে নেয়।”
“…..
“গ্রামে বাবার অনেক সম্পদ আছে। আর এই বাড়ি টা মায়ের খুব পছন্দের ছিল। নিজের স্বপ্নের বানানো এই বাড়ি। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেক টা বিয়ে করার আগেই এটা আমার নামে লিখে দিয়েছেন। এটার মালিক বর্তমানে আমিই আছি।”
“কথা হয় না উনার সাথে?”
“ইচ্ছে করে না তেমন। উনিও সময় পায় না হয়তো। শুনেছি দ্বিতীয় বউয়ের বাচ্চা হয়েছে। ছেলের বয়স ৪ কিংবা ৫ হবে। ব্যস্ত থাকে হয়তো। তবুও ১৫ দিন পর পর কল দেয়। কখনো ধরি ১ মিনিট কথা বলি তো আবার কখনো মন চায় না। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আসি।”
বলতে বলতে মোনতাহ্ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। ফিরাত স্পষ্ট বুঝল সেই নিশ্বাসে কত টা বিষ আর বিষাক্ত যন্ত্রণা রয়েছে। ফিরাতের বুকে কেউ হাতুরি পেটানো কষ্ট হচ্ছে। কত টা কষ্ট ভেতরে মুনের। ডুবে যাওয়া নিশ্বাসে ঢোক গিলল ফিরাত।
“চাঁদ যাও ঘুমিয়ে পরো গিয়ে।”
“আপনি?”
“ঘুম আসছে না। এখানে পাড় করে দিতে পারব।”
“….
“তুমি যাও।”
মোনতাহ্ খাবারের অফার করলে ফিরাত না করে দেয়। ফলে মোন নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। কিন্তু ঘুম হয় না আর।
সকালের আজান কানে আসতেই তুরফার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেবিন থেকে উঠে বের হয়ে দেখে আহরার বসে বসে ঘুমাচ্ছে। তুরফা এগিয়ে গেল। ঘুমন্ত আহরার কে কাছ থেকে কিছুক্ষণ দেখে আবার চলে গেল।
আহরারের যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন পাশে নিজের কোট দেখল। কেবিনে গিয়ে দেখে তুরফা ফাইল দেখছে। আহরার একটু হাসল।
“কাজ করতে হবে না। বাসায় যান এখন।”
তুরফা মাথা তুলে তাকাল। কিন্তু কিছু বলল না।
“আপনাকে বাসায় যেতে বললাম তুরফা। চলুন দিয়ে আসি।”
“ফাইল!”
“থাক ওখানে। চলুন।”
“তবে আমি নিজে চলে যেতে পারব।”
“এত বেশি কথা বলেন কেন আপনি? চুপ করে চলুন আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।”
আহরার চলে গেল। তুরফা নেকাব লাগিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে রাস্তায় গেল। গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল আহরার। তুরফা কে আসতে দেখে সামনের দরজা খুলে দিল। তুরফা গিয়ে সিটে বসল। আহরার গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে তুরফা কে বলল
“সিট বেল্ট টা লাগিয়ে নিন।”
অদ্ভুত ভাবে তাকাল আহরারের দিকে সে। কিছু না বলেই আহরার বেল্ট টা লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিল।
তুরফার বাসার সামনে এসে আহরার গাড়ি ব্রেক করল। কিন্তু বেশ অবাক হলো। ফিরাতের গাড়ি এখানে? ভ্রু কুঁচকে আহরার গাড়ি থেকে নামল। সাথে তুরফাও। দুজনেই অবাক হয়। একে অপরের দিকে তাকায়। তুরফা দরজার সামনে গিয়ে কয়েক বার কলিংবেল চাঁপল। বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরাত খালি গায়ে এসে চোখ ঢলে দরজা খুলে দিল। সামনে আহরার কে দেখে ফিরাত খানিক ভয় পেল। সাথে তুরফা। দুজনেই তার দিকে অবাক করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে গোল গোল করে। যেন তার সামনে সে নয় এলিয়েন বা ভূত দাঁড়িয়ে আছে। তৎক্ষণাৎ নিজের গায়ের উপর নজর গেলে খেয়াল করল উদাম গা তার। এজন্যেই এভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে দুজনে? ওরা কি ভাবছে? একা মোনতাহ্ র সাথে.. দুজনে কি বিশ্বাস করছে না তাকে? ওরা তাকে সন্দেহ করছে নাকি? আহরার যেন কিছু বুঝতেও পারছে না ফিরাত কে এই অবস্থায় দেখে। সে ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে আছে তার প্রাণের বন্ধুর দিকে। তুরফা ভেতরে হাজার ভয় নিয়ে ফিরাত কে ঠেলে তাড়াতাড়ি করে ভেতরে ঢুকল।
চলবে….