ভরা ক্লাস রুমে মাথানিচু করে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত । আর ক্লাসের সকলে ইতিমধ্যে মুখ চেপে হাসির সাগরে ভাসছে।অন্যদিকে ছলছল চোখে ক্লাসের নতুন টিচারের দিকে তাকালো সে,যদি এই নিরীহ প্রাণীটির মুখ দেখে মন গলে তাঁর। কিন্তু টিচার সেদিকে পাওা না দিয়ে মনযোগ সহকারে ক্লাস নিচ্ছেন।প্রায় পাঁচ মিনিট পর মুখ কাচুমাচু করে অসহায় কন্ঠে সিরাত বললো…..
-‘আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো স্যার’?
প্রতিওোরে ভাবলেশহীনভাবে উওর দিল আবেশ….
-‘যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্লাস শেষ হচ্ছে ঠিক ততক্ষণ’।
-‘সরি স্যার আজকের মতো মাফ করে দিন আর কখনও ক্লাসে লেইট করবো না।একদম ক্লাস শুরুর আধ ঘণ্টা আগে চলে আসবো’।
-‘সেটা কাল থেকে এমনিই করতে হবে।কারণ নইলে ক্লাসে লেইট করে আসার অপরাধে আজকের থেকেও ভয়ানক শাস্তি পাবে’।
আবেশের কথা শুনে মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেলো ওর।ডানে বামে তাকিয়ে চোখ গরম করে তাকালো বন্ধু মহলের প্রতি।কারণ ওদের জন্যই আজ ওর এই দূর অবস্থা।সকলের মুখেই অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।এ যাএায় আবেশের হাত কেউ বাঁচাতে পারবে না এটা ওদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।হতাশ হয়ে মাটির মধ্যে চোখ নিবদ্ধ করে তাকিয়ে রইলো সিরাত।অনেকটা সাহস নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে আবেশের বোন আরোহী অনুনয়ের সুরে বলেই ফেলল…
-‘স্যার আপনার তো দয়ার শরীর আজ কলেজে আপনার প্রথম দিনও।সেই সুবাধে আজকের মত ওকে ছেড়ে দিন’।
কথাটা শেষ হতেই আবেশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পরলো আরোহীর উপর।সাথে সাথে চোখ নামিয়ে মিইয়ে গেলো সে।রুক্ষ কন্ঠে আরোহীর কানের সামনে দাঁত চেপে বললো….
-‘তোমাকে কারো চামচামি করার জন্য কলেজে পাঠানো হয়নি।নিজের কাজ কর।আরেকবার ওর হয়ে কেউ সাফাই গাইলে তোমাদেরকেও ওখানে ওর পাশে থাকতে হবে’।
ভাইয়ের কথায় খুব রাগ হল আরোহীর।এরকম করছে কেন?সবকিছুতেই ভাইয়ের বাড়াবাড়ি।ঠোঁট নাড়িয়ে আরও কিছু বলার আগেই তাঁরও অবস্থান হলো সিরাতের পাশে।আবেশের এহেন আচরণে হচকালো থমকালো সিরাত।ওর জন্য নিজের বোনকেও ছাড়লো না।এটা ওর ভাই নাকি কোনো দৈত্য দানব।ওদের দুজনের এই অবস্থা দেখে আয়ান,মিনার,আয়েশা আর রিয়া একসাথে বলল….
-‘স্যার এবার ওদের ছেড়ে দিন’।
কথাটা বলতে দেরি হল কিন্তু সিরাতের পাশে স্থান পেতে সময় নিল না।এবারে সকলের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।তাঁরা যেটা চেয়েছে সেটা করতে পেরেছে।তাঁদের দোষে বান্ধবী একা শাস্তি পাবে এটা হয় না।তাই সবাই মিলে ওর শাস্তি ভাগাভাগি করে নিল।একে অন্যকে আড়চোখে দেখছে আর মুচকি হাসছে।বিষটা নজর এড়ায়নি আবেশের।ওরা ওকে হেনস্তা করার জন্য এরকম করেছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি তাঁর।সবাইকে কান ধরা অবস্থায় দেখে এবার কিছুটা অস্বস্তি কমেছে সিরাতের।সবার একসাথে শাস্তি পাওয়ার মজাই আলাদা।এজন্যই বন্ধুমহলকে এত ভালোবাসে সে।
প্রায় আধ ঘন্টা আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেছে সিরাতের।ইতিমধ্যে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে সবাই।সিরাত হেঁটে যেতে পারবে না।পা ব্যাথা করছে তাই সবাই রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।সিরাত গাল ফুলিয়ে মুখ কালো করে আছে।কারো সাথে কথা বলছে না।ওদের জন্যই এতটা অপমানিত হতে হলো।আজ আরুর বার্থডে তাই ওট কাছ থেকে সবকয়টা ট্রিট স্বরূপ ঝাল মুড়ি আনতে বাইরে গিয়ে ওকে অপেক্ষা করতে বলে ক্লাসে চলে গেছে।আর সে ওদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিলো।ক্লাসে লেইট হচ্ছে বুঝতে পেরে ক্লাসে আসতেই সকলকে দেখে চমকালো সে।আরোহী আর আয়ান বললো….
-‘সরি দোস্ত রাগ করিস না।আমরা ইচ্ছে করে করিনি।জাস্ট হয়ে গেছে।আমাদের এদিকে আসতে দেখে ভাইয়া জোর করে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিল’।
-‘থাক আর কারো কিছু বলতে হবে না।আগে বল তোর ভাই কবে বাসায় ফিরল আর আমাদের কলেজে জব নিয়েছেন সেটা আমার কাছ থেকে লুকালি কেন?’
-‘আরে গাধী আমি কিছু জানলে না তোদের বলব।গতকাল হঠাৎ ভাইয়া এসে হাজির।শুধু এটুকুই বলেছে একটা জবের এপ্লাই করেছিল আর সিলেক্টও হয়ে গেছে।পরশু জানিয়েছে তাই তাড়াহুড়া করে এসেছে ব্যস এইটুকুই।আর সকালে শুধু বলেছিলো আজকে আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।কিন্তু এই সারপ্রাইজ টা যে এটা আমি ভাবতেই পারিনি’।
-ভ্রু নাচিয়ে ‘সত্যি বলছিস’?
-‘আরে হ্যা রে বাবা সত্যি বলছি’।
-‘যাই বলিস না কেন তোর ভাই সাংঘাতিক একটা চিজ। এইটুকুর জন্য আমার সাথে এমনটা করতে পারল।দেখে মনেই হয়নি আমি তোর বেষ্টফ্রেন্ড বা তাঁর বেষ্টফ্রেন্ডের বোন।এইজন্যই বলে ঘরের শত্রু বিভীষণ।শালা উজবুক কি ভাবটাই না করল যেন আমাকে চিনেই না’।
তাঁদের কথার মাঝেই একটা ভরাট পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল সবাই।মুখ থমথমে হয়ে গেল।সিরাত চোরের মতো মুখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।যেন সে কিছুই করে নি।সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ।ছেলেটাকে বরাবরই ভালো লাগে সিরাতের।এতক্ষণ খেয়াল করেনি এখন ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে গায়ের রঙ ফর্সা আর সুঠাম দেহের অধিকারী।আগের থেকে এখন আটেকটু ফর্সা হয়েছে। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরেছে।।শার্টের হাতা ফোল্ড করা।হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি।সিল্কি চুলগুলো বাতাসের তালে তালে হেলে দুলে পরছে।দেখতে হিরোদের থেকে কম নয়।বেশ লাগছে।ওর ভাবনায় ছেদ পরলো আবেশের কথা শোনে….
-‘লিসেন মিস সিদরাতুল সিরাত এখানে না আমি আপনাকে চিনি আর না ত আপনি আমাকে চিনেন।এখানে সবার একটাই পরিচয় সবাই আমার স্টুডেন্ট এর বাইরে বোন,বোনের বেস্টু,সিয়ামের বোন এগুলো ম্যাটার করে না।তাই সিয়ামের বন্ধু বা আরুর ভাই হিসাবে আমার কাছ থেকে বাড়তি এডভান্টেজ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন।আপনারা ভালো ত আমিও ভালো আপনারা ত্যাড়া ত আমিও ত্যাড়া।আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছ’।
মাথা ঝাঁকিয়ে সবাই সায় জানালো।আমি উনার অগোচরে একটা ভেংচি কেটে দিলাম অনেক কিছু বলে ঝারতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছু বলার মুখ নেই বললে ভাইয়ার কান অবধি কথাটা পৌঁছাতে দু-সেকেন্ড সময় লাগবে না।তারচেয়ে থাক বাবা প্রয়োজন নেই।ইতিমধ্যে যে যার বাড়ীর পথে হাঁটা দিয়েছে।শুধু আরু আর সিরাতই দাঁড়িয়ে আছে।আবেশ আরোহীকে উদ্দেশ্য করে বলল….
-‘আরু এখানে সঙের মত দাড়িয়ে কি করছিস? চল বাড়ী যাওয়া যাক।এখানে বসে অযথা হইচই ফালাফালি লাফালাফি করে লাভ নাই’।
-‘এই ত ভাইয়া যাচ্ছি।আসলে সিরাতের পা ব্যাথা করছে। রিকশাও পাচ্ছে না।ওকে যদি আমাদের সাথে নিয়ে যাই’।
-‘এই শুরু হলো আরেক প্যানপ্যানানি।মেয়ে মানেই উটকু ঝামেলা।তোকে বলাটাই আমার দোষ হয়েছে।এখন আরেকটা দলে টানছিস।ও যেভাবে পারবে সেভাবে যাবে।ওর চিন্তা তোকে করতে হবে না’।
আবেশের কথা শুনে চোখ দুটো আপনাআপনি ভিজে গেলো ওর।আগে কত আগলে রাখতেন।খেয়াল রাখতেন হয়তো উনার বেস্ট ফ্রেন্ড সিয়াম ভাইয়ার বোন সেই সুবাধে।কিন্তু আমি তো সেটা ভাবিনি।আমি ত সেই কিশোরী বয়স থেকে এখনও ভালোবাসি উনাকে।হ্যাঁ উনার অবর্তমানে অন্য একজন এসেছে কিন্তু তবুও উনাকে ভুলতে পারিনি।উনার সবকিছুতে মুগ্ধ আমি।তবে এবার কেন বদলে গেলেন উনি।আগের সেই চিরচেনা আবেশ ভাইয়াকে কেন চিনতে পারছি না।কেন প্রথম দেখাতেই এত রুক্ষ আচরণ।ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে ব্যস্ত আমি আরু গুতো দিয়ে বলল….।
-‘কিরে চল ভাইয়া আমাদের লিফট দেবে।তোকে নামিয়ে আমরা বাড়ী যাব’।
আবেশ ভাইয়ার উপর বর্তমানে এক বস্তা সমপরিমাণ অভিমান জমেছে আমার।যদিও জানি তাঁর কাছে এই অভিমানের কোনো মূল্য নেই তবুও মনকে বোঝাতে পারলাম না।কর্কশ কন্ঠে বললাম….
-‘তুই চলে যা।আমি কারোর থেকে লিফট চাচ্ছি না।আমি ঠিক রিকশা পেয়ে যাবো।নইলে পায়ে হেঁটে বাসায় যাব’।
-‘সিরাত কেন এমন করছিস চল না।এই ভ্যাপসা গরমে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি আর কিছুক্ষণ থাকলে মাথা ঘুরা শুরু করবে।সন্ধ্যায় পার্টিতে যাবি দেরি হচ্ছে জেদ করিস না চল’।
-‘কি বলেছি কানে যাচ্ছে না।আমি যাব না।তোর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে থাক নইলে ফুট’।
আড়চোখে আবেশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে বিরক্তিকর চাহনী দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি সেদিকে আর তাকালাম না।আরু এখনও দাঁড়িয়ে আছে সরছে না।ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে।শাঁকচুন্নি তোর জন্য লোকটার কাছে কথা শুনতে হল আমায়।লোকটা দাঁত চিবিয়ে বলল….
-‘আরু আজ তোর বার্থডে এটা মাথায় রাখিস।আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করিস না যাতে তোর আজকের দিনটার সব আনন্দ মাটি হয়ে যায়।এই ঘ্যাড়ত্যাড়া হাফ মেন্টাল মেয়েটার জন্য আমাদের লেইট হচ্ছে।বাসায় অনেক কাজ পরে আছে।সো হারি আপ’!
ব্যস হয়ে গেলো! আকাশসম রাগ হলো লোকটার উপর।কি বলল আমি পাগল।
-‘এক্সুউজমি!আপনি কাকে মেন্টাল বললেন’?
-‘এই প্রশ্নই প্রমান করে তুমি কি’ বলেই হুড়মুড় করে গাড়িতে বসল সে।আরু আমার দিকে অসহায় ফেস করে তাকিয়ে ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সাথে সাথে হুস করে কয়েক সেকেন্ডে গাড়িটি চলে গেলো বহুদূর।আমি থমকে গেলাম একই জায়গাতে।সত্যি আমাকে ফেলে চলে গেলেন নাকি এটা আমার ভ্রম।কিছুক্ষণ পর ভাইয়া এসে বাসায় নিলে গেল আমায়।
আরুর বার্থডে পার্টিতে এসেছি ঘন্টা খানেক আগে।যদিও এখানে আসার বিন্দু পরিমান ইচ্ছা ছিল না।কিন্তু আরু আর বাকী সবাই মিলে বার বার কল করে আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিল।উপায় না পেয়ে ফোন সুইচ অফ করেও রেহাই মিলে নি।ভাইয়াকে কল করে ম্যানেজ করেছে আরু।আবেশ ভাইয়াও বার কয়েক ফোন করে ভাইয়াকে যেতে বলেছেন।অগত্য আসতে হল আমায়।কিন্তু এখন আনেশ ভাইয়াকে দেখিনি।না দেখা হলেই ভালো।এখন হাসি আনন্দ আড্ডায় মেতে উঠেছে পুরো খান বাড়ী।কেক কাটার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ আয়ান একগাদা কেক এনে আমার পুরো মুখে লেপ্টে দেয়।তখন ওর পিছু নিয়ে পাল্টা দাওয়া করি কিন্তু মাঝ পথে বাঁধে বিপওি।কোনোকিছুর সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও কারো সাথে লেগে আটকে যাই।নিজেকে সামলে উঠার আগেই এমন কিছু ঘটে যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।চোখ থেকে নিমিষেই গড়িয়ে পরতে লাগল কয়েক ফোঁটা নোনাজল।রাগে লজ্জা মিশ্রিত অনুভূতির সমীকরণে এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।আচ্ছা এর থেকে মৃত্যুই ভালো সলিউশন নয় তো।
.
.#তুমি_আমার
#পর্ব_০২
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
.
.
অনেকটা রক্ত চক্ষু নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আবরার আবেশ খান।অতি তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে উনি যে এই কাজ করতে পারেন সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।একটু আগে আয়ানকে কেক মাখাতে গিয়ে ভুলবশত হাতে থাকা সমস্ত কেক উনার মুখ আর ব্লেজারে লেগে যায়।নিজের এই অবস্থা মানতে পারেননি উনি।ব্যাপারটা যখন বোগম্য হলো তখন সরি বলতে যাবো তাঁর আগেই ঠাস করে এক থাপ্পড় পরলো আমার গালে। লজ্জা রাগ মিশ্রিত হয়ে মরে যেতে ইচ্ছে।সামনে থাকা লোকটার দিকে তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না।সামনে পিছে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখেছে কিনা।না আশেপাশে কেউ নেই শুধু খানিক দূরে হ্যাবলার মত দাড়িয়ে আছে আয়ান।আমি চোখ গরম করে তাকাতেই ওখান থেকে কেটে পরলো সে। রাগে ফুস ফুস করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে চোখ দুটো লাল করে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম….
-‘হাউ ডেয়ার ইউ?আপনার সাহস হয় কি করে আমার উপর হাত তোলার’।
লোকটা আরো শতসহস্র রাগ নিয়ে জবাব দিল….
-‘তোমার সাহস হয় কি করে আমাকে কেক মাখানোর।আমার ব্লেজার নষ্ট করার।চড়টা কম হয়েছে যদি তুমি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতে এতক্ষণে তোমার কি হাল হতো আমি নিজেই জানি না’।
আঁখি যুগল জলে টইটুম্বুর হয়ে উঠলো।জলগুলো গড়িয়ে পড়ার আগেই নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলো।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-‘আমি কি আপনাকে দেখে আপনার উপর কেক ছুড়েছি।দুর্ভাগ্যবশত হয়ে গেছে।এই একটা ব্লেজারের জন্য আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন।বলুন কত টাকা দাম আপনার ব্লেজারের।আমি এক্ষুণি টাকা দিয়ে দিচ্ছি কিনে নিবেন।আর আমাকে যেই থাপ্পড় দিয়েছে সেটাও ফেরত নেবেন’।
সিরাতের কথায় সুক্ষ্ম ভাঁজ পরলো আবেশের কপালে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টায় আছে।কারণ ব্লেজারটা ওর প্রিয় খুব যত্ন করে রেখেছে সে।আট আজ কিনা এই অসভ্য মেয়েটাকে নষ্ট করে দিল ভিতর থেকে একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর।এক হাতে কপালে স্লাইড করতে করতে বললো…
-‘আমাকে টাকার গরম দেখিও না।তুমি ভালোমতোই জানো আমার অবস্থা।যাইহোক তোমার থাপ্পড় যেমন কখনও ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।তেমনি আমার ব্লেজারও আগের মতো করে দেওয়া তোমার কেন পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই।ভালোয় ভালোয় সামনে থেকে সরে যাও নইলে আরো খারাপ হয়ে যাবে’।
-‘কি খারাপ করবেন আপনি।আর কি করার বাকী রেখেছেন’।
দাঁতে দাঁত চেপে খানিকটা সামনে এসে বললেন…..
-‘এখনও কিছুই করিনি।সামান্য একটা থাপ্পড় মেরেছি।শুকরিয়া আদায় কর’।
-‘আপনার মাথায় সমস্যা আছে।নরমাল জিনিস গুলোকে সবসময় বড় একটা ইস্যু বানিয়ে ফেলেন।হয়তো কখন কি করেন নিজেই জানেন না বুঝেন না।সকালে তুচ্ছ একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আমাকে পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আর এখন এইটুকুর জন্য আমার গাল ফাটিয়ে দিলেন।ভাববেন না আরুর ভাই বলে সমসময় পার পেয়ে যাবেন’।এক নাগাড়ে একথাগুলো বলে থামলো সিরাত।আবেশ স্থির হয়ে ওর কথাগুলো মনযোগ সহকারে শুনছে।ওর কথা শেষ হতেই এক পা এক পা করে দিকে এগুতে লাগলো।ওকে এগুতে দেখে সিরাতের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। একদম নিজের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখে ও দু কদম পিছিয়ে গেলো।ও পিছাতেই আরো সামনে এগুচ্ছে আবেশ আর মুখে শয়তানি হাসি।এই হাসিই বলে দিচ্ছে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে ওর সাথে।দুপা পিছাতেই খপ করে ওর ধরে ফেললো আবেশ।বিস্মিময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সিরাত আমতা আমতা করে বলল…..
-‘আআপনি এগুচ্ছেন কেন?আমার হাতই বা ধরেছেন কেন?ছাড়ুন বলছি’।হাত ছাড়াতে গিয়েও ছাড়াতে পারলো না।
-‘ছাড়ার জন্য তো ধরিনি।আমি মেন্টালি সিক।কখন কি করি জানিনা। এখন তোমার হাত ধরেছি নাকি কই আমি তো বুঝতে পারছি না’।
হতভম্ব বিস্মিত সিরাত।ওর কথার জালে ওকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে বুঝতে বেগ পেতে হয়নি ওর।ওর আরেকটু কাছ আসতেই আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। কিছুক্ষণ পর কোনোকিছুর সাড়াশব্দ না পাওয়ায় আপনাআপনি চোখ খুলে অবাক সামনে আবেশ নেই আরু আসছে।আরুকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সিরাত।নিজে নিজে নিজেকে হারার খানেক গালি দিতে লাগলো।
কাঁচের জানালা ভেদ করে বাইরের ঝলঝল রোদ রুমে এসে পরছে।এই ঝলমলে উজ্জ্বল রোদ জানান দিচ্ছে বেলা অনেক গড়িয়েছে।আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় উঠলো সিরাত।গতকাল ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো তাই আজ সকালে উঠতে লেইট হয়ে গেছে।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিলো সিরাত।চা বাগানের পাশেই ওদের বাসা।ফোন হাতে দিয়ে টাইম দেখে অবাক ন’টা বাজে কলেজ যেতে দেরি হয়ে যাবে।দেরি হলে আবার আরেক প্যারা।আবেশের কথা মনে হতে মনটা খারাপ হয়ে গেলো ওর।বিষণ্ণ মনে তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো।নিচে এসেই ভাইয়ের মুখোমুখি হলো।মাকে এক কাপ কফি দিতে গিয়ে ভাইয়ের পাশে বসল।কাল থেকে একটা প্রশ্ন বারবার মাথায় আসছিলো সেটা এবার করতেই হবে।ভাইয়া আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো….
-‘কিরে আজ এত সকাল উঠলি যে?সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে’?
-‘তুমি খুঁজে দেখ।আমার কলেজ আছে তাই তাড়াতাড়ি যেতে হবে।আচ্ছা ভাইয়া আবেশ ভাইয়া আমাদের কলেজে জয়েন করেছেন সেটা জানো তুমি’?
-‘হুম জানি’!সহজ সরল জবাব দিলো সিয়াম।
-‘তাহলে আমাকে আগে বলো নি কেন?ওই বান্দর হনুমান ওখানে জব করছে’?
-‘ওমা এটা আমি তোকে বলতে যাবো কেন?তুই তো এমনি দেখতে পাবি’।
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।ভাইয়া ত্যাড়্যা বাঁকা কথাই বলবে।তার চেয়ে মেইন পয়েন্টে আসা যাক।
-‘তুমি জানো তোমার বন্ধু গতকাল আমার সাথে কি করেছে?গতকাল…..
-‘হুম জানি!গতকাল ক্লাসে লেট করে যাওয়ার অপরাধে পুরো ক্লাস কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।অবশ্য এটা নিয়ে ওকে আমার কিছু বলার নেই।কারণ আমি নিজেই তোদের ফার্স্ট ক্লাসে লেইট করার জন্য শাস্তি দিতে বলেছিলাম।এখন আমি হ্যাপী দেখ ওর ভয়ে আজ তাড়াতাড়ি কলেজ মুখো হচ্ছিস।এবার সবকয়টা পড়াচোর ফাঁকিবাজ শায়েস্তা হবি’।কথাগুলো বলে বএিশ পাটি দাঁত বের করে সানগ্লাস ঠিক করতে করতে অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেলো ভাইয়া।ভাইয়ার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ মনে মনে এটাই আওড়ালাম এটা আমার ভাই নাকি মীরজাফর।
কর্মব্যস্ততায় মুখর সকালের সিলেট।এইসময় বেলা ভীর ভাট্রা লেগেই থাকে।তখন কলেজ যাওয়ার রিকশা বা সিএনসি পাওয়া বড্ড দুষ্কর।বিরক্তিকর চাহনী দিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে রিয়া।কিন্তু কোথাও রিকশার ছিটেফোঁটাও নেই।ক্লাসেরও লেইট হচ্ছে।তাই ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছে।হঠাৎ কেউ একজন সজোরে ধাক্কা মারলো ওকে।ধাক্কা খেয়ে নিচে পরতে পরতে কোনো মতে বেঁচে গেছে সে।এমনিতেই মেজাজ গরম তাঁর উপর এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যার দরুন রাগ দপদপ করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।বিপরীত পাশের লোকটাকে কোনো বাক্য খরচ করার সুযোগ না দিয়েই বললো….
-‘এই যে মিঃ দেখতে হ্যান্ডসাম বলেই কি মেয়ে দেখলেই তাঁদের গায়ের উপর ঢলে পরতে ইচ্ছে করে নাকি?পোষাক পরিচ্ছেদ ভালোই মনে হচ্ছে কিন্তু ব্যবহার এত খারাপ কেন?’
মেয়েটার কথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো সিয়ামের মাথায়।কি বলে এই পুচকি ছানা।যেহেতু দোষটা নিজের তাই নিজেকে শান্ত করে মিহি সুরে বলল….
-‘দেখুন মিস আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ধাক্কা দেইনি।একটু তাড়া ছিলো তাই আপনাকে খেয়াল করিনি।তার জন্য সরি’!
-‘একটা সরি সাত খুন মাফ।আপনাদের মত ছেলেদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।ইচ্ছে করে এমন করেন পরে আবার মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্য সাধু সাজেন’।
-‘আরে মহা ঝামেলা।বললাম ত ভুল হয়ে গেছে।এখানে ইমপ্রেস করার কথা আসছে কোথা থেকে’।
-‘থাক আর শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।আমি যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।এখন আর উল্টা পাল্টা বোঝাতে আসবেন না’।
-‘ আরে এত মহা মুশকিল রে বাবা!এখন ত আমার মনে হচ্ছে আপনি ইচ্ছে করে ছেলেদের সাথে এরকম করেন।এতে আপনার ভালো লাগে।মুখে শয়তানি হাসি টাঙিয়ে তা এরকম আর কয়টা ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছেন’?
-‘হোয়াট!কি বললেন আপনি’?
-‘শুনতে পান নি নাকি বয়ড়া।আসলে আপনাদের মতো মেয়েদের সাথে ভালো ভাবে কথাই বলতে নেই।তখন বাজে ভাবে টাচ করে চলে যেতাম সেটা ঠিক হতো।বাই দ্যা ওয়ে আসছি’।
-‘এই শুনুন আপনি আমাদের মত মেয়ে বলতে কি মিন করলেন?আর পরের কথাগুলো ছি ছি তাহলে আমি আপনাকে যা ভেবেছি আপনি তাই প্রমাণ হলো ত’।
-‘ঘোড়ার ডিম হলো।এই আপনার মাথায় গোবর ছাড়া কিছু নেই না।একটা সাধারণ বিষয়কে এত জটিল করে কোথা থেকে কেথায় নিয়ে গেলেন?আচ্ছা রোজ এইভাবে রাস্তায় ছেলেদের অপদস্থ করাই আপনার পেশা নাকি’?
ছেলেটার কথায় এবার চুড়ান্ত অপমাণিত বোধ করলো রিয়া।এক নিমিষে তাঁকে নিয়ে কোথায় পৌঁছে দিলো।চোখগুলো জ্বালা করা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।নিজের কান্না আটকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল….
-‘দেখুন এবার কিন্তু এর মধ্যেই সিরাত এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে।রিয়ার পাশে ভাইকে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর।আর সিয়ামের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।রিয়া ওকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো।তারপর সিয়ামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক এক করে সব বলতে শুরু করলো।সবটা শুনে সিয়ামের দিকে তাকালো সিরাত।সে মৃদু হাসছে যার অর্থ এবার বোন এই অপবাদের হাত থেকে রক্ষা করবে। ওকে কোনোকিছু বলে দোষ ঢাকতে হবে না।তাই ও চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।সিয়ামকে অবাক করে দিয়ে সিরাত বলল….
-‘এই যে ভাইয়া বিয়ের বয়স ত প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে তাই রাস্তায় কাউকে ডিস্টার্ব না করে বাসায় থেকে বিয়ে দিতে বলুন এতে অন্যের মা বোন একটু ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারবে।আপনিও বাড়িতে বউ রেখে অন্যের সাথে ফ্লাট করার কথা চিন্তা করতে পারবে না’।
হতভম্ব বিস্মিত সিয়াম।বোনের মুখে এমন কথা শুনে চোখ দুটো বেড়িয়ে আসার উপক্রম।আর সিরাতের মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি।সিয়ামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল…..
-‘রিয়া তুই উনাকে বুঝিয়ে দে আমরা মেয়েরা অবলা নই।আমি ততক্ষণে দেখি রিকশা পাই কিনা।রাস্তায় এক বজ্জাত কলেজে আছে আরেক বজ্জাত লেইট হলে রেহাই নেই বলে চলে যেতে উদ্যত হলো।যাওয়ার সময় একদম সিয়ামের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল….
-‘কেমন দিলাম ভাইয়ু!একেই বলে টিট ফর ট্যাট।তুমি বন্ধুকে দিয়ে আমায় শায়েস্তা করেছো আর আমি বান্ধবী দিয়ে হিসাব সমান সমান’।
[এটা আমার লেখা প্রথম গল্প।আপনাদের এত এত ভালোবাসা পাবো ভাবিনি।ভাবনার চাইতেও বেশি পেয়েছি।আশা করি সামনেও একই পাবে ভালোবাসা পাবো।রমজান মাস কোন সময় গল্প দিলে আপনাদের সুবিধা হবে কমেন্ট করে জানাবেন প্লিজ!]
.
#চলবে
.
#তুমি_আমার🍁
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত