তুমি আমার পর্ব -০৩+৪

#তুমি_আমার
#পর্ব_০৩
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

কলেজ এসেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে গেছি।ইতিমধ্যে সকলেই এসে পরেছে।মন মেজাজ এখন ফুড়ফুড়ে।আজ আর ধামড়া ছেলে মেয়েদের কান ধরে ক্লাসে দাঁড়াতে হবে না।রিয়া এখনও রাস্তার ব্যাপারটা নিয়ে বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছে আমার।আমি কিছু বলছি না শুধু শুনেই যাচ্ছি।আজ কিছু বলবো না মেয়ে কারণ বললে মজাটাই মাটি হয়ে যাবে।আমি জানি এরপর ভাইয়ার সাথে দেখা হলে আজকের ব্যাপারটা তুই টানবিই টানবি।তাই ভাইয়াকে জ্বালানোর জন্য হলেও চুপ থাকতে হবে আমায়।তবে আমার ভাইয়া এমন না।তুই মাথা মোটা মেয়ে বেশি বুঝিস। একদিন ভাইয়াকে দেখিয়ে তোকে পুরো চমকে দিব।

ক্লাসে বসে আছি স্যারের অপেক্ষায়।এরমাঝে আয়ান বলল….

-‘জানিস আরু কাল তোর বার্থডে পার্টিতে কি হয়েছে’?

আয়ানের কথা শুনেই বিষম খেলাম আমি।এবার আমার মান সম্মান সব শেষ।সবকয়টা মিলে দফারফা করে ছাড়বে।আয়ানকে চোখের ইশারায় থামতে বলছি কিন্তু সেদিকে তাঁর কোনো হেলদোলই নেই।সে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।ওর কথার পিঠে আয়েশা সিরিয়াস ভাব নিয়ে বলল….

-‘কি হয়েছে কোনো মেয়ে তোকে প্রপোজ করেছে বুঝি’?

এবার হাসির রুল পরে গেলো সবার মাঝে।আয়ানের মুখখানা একেবারে চুপসে গেলো।আয়ান মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরে কিন্তু কেউ ওকে পাওা দেয় না।তবুও সর্বএ বলে বেড়ায় ওকে অনেক মেয়ে প্রপোজ করে কিন্তু ও তাঁদের পাওা দেয় না।আমাদের কথার মাঝেই আবেশ স্যার রুমে ঢুকলেন।উনাকে দেখে সবাই চুপ আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

চুপচাপ বসে ক্লাস করছি একবারও আবেশ স্যারের দিকে তাকাচ্ছি না।আবেশও নিজ মনে ক্লাস করাচ্ছে।আর মাএ কিছু সময় তারপরই আমরা সেইফ।কিন্তু আমার এই খুশিটা বেশিক্ষণ টিকলো না।হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে চমকে উঠলাম আমি।আমার দৃষ্টি এখন বেঞ্চের কর্ণারে যেখানে সকলের ব্যাগ জড়ো করে রাখা সেখানে।মূলত লেখার সুবিধার্থে সবমসময় আমরা এরকম রাখি।পুরো ক্লাসের সকলের দৃষ্টি এখন আমাদের বেঞ্চের দিকে নিবদ্ধ।আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছি কারণ আমি ফোন আনি না।হঠাৎ আবেশ স্যার আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।উনাকে দেখে কিছুটা অস্বস্তিতে পরলাম আমি।ওদিকে আয়ান আর আয়েশা মিলে ফুসুরফুসুর করছে আর আমাকে কিছু দেখানোর চেষ্টায় আছে কিন্তু সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই।আজ আমি বাঁশ খাচ্ছি না।আয়েশা সেই লেভেলের বাঁশ খাবে।জানু মনু বলে লোকের সাথে পিরিত করা আজকে তোমার পিরিতি ছুটাবেন।আবেশ স্যার স্থির চাহনী দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..

-‘কার ফোন বাজছে?’

উনার কথার বিপরীতে কোনো শব্দ খরচ করলাম না আমি।কালকের অপমান ভুলিনি আমি।আমাকে চুপ থাকতে দেখে আরু বলল ‘আমাদের না স্যার কারণ’হাতের ইশারায় আরুকে থামিয়ে দিলেন উনি।আয়ানকে ব্যাগ থেকে ফোন বের করার জন্য বললেন।আয়ান ভদ্র বালকের ন্যায় উপরের ব্যাগ নামিয়ে নিচের টা থেকে ফোন বের করলো।আমি এক নজর ওদিকে তাকালাম।স্যার ব্যাগটা আমার সামনে ধরে বললেন….

-‘এই ব্যাগটা কার’? ফট করে জবাব দিলাম আমার।ব্যাস হয়ে গেলো।তখনও জানতাম ন। আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।আমার হাতে ফোন দিয়ে উনি বললেন লক খুলে দাও।ওর লক আমরা সবাই জানি ‘সোনা’ তাই আমিও ভদ্র বাচ্চার ন্যায় লক খুলে দিলাম।স্যার কিছুক্ষণ ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর আমার হাতে দিতে যাবেন তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো।উনি সময় ব্যয় না করে কলটা রিসিভ করে লাউডে দিলেন।পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা।ওপাশের ব্যাক্তিটি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো….

-‘এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এই সব অশ্লীল টেক্সট পাঠানোর।আরেকবার যদি টেক্সট পাঠিয়েছো ত তোমার হাত পা আমি ভেঙ্গে দেবো’।টুট টুট টুট!ফোন কাটতেই সবাই অট্রহাসিতে ফেটে পরলো।কথাগুলো শুনে স্যার একটি লম্বা শ্বাস ছাড়লেন।ওদিকে আয়েশার অবস্থা করুন।মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।আমি আর আরু অসহায় ফেস নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।চোখের ভাষায় এটাই বোঝাচ্ছি আজ আর ওর রক্ষ্যে নেই।সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন…..

-‘কলেজ আসার নাম করে ছেলেদের অশ্লীল টেক্সট করে ডিস্টার্ব করে বেড়াও সিরাত’?

উনার কথাটা কানে যেতেই উনার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললাম আমি।এতক্ষণ উনার দিকে না তাকালেপ এখন ভালোভাবে খেয়াল করছি।ব্যাপারটায় উনি রেগে আছেন বেশ বুঝতে পারছি।রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠছে।আমি একটা ঢোক গিলে বললাম….

-‘আমি কেন এসব করতে যাবো স্যার’।

-‘তাহলে লোকটা কি মিথ্যে বলছে।নাকি আমি তোমার ফোন দিয়ে এসব কাউকে পাঠিয়েছি’।

-‘স্যার কিসব বলছেন।আমি তো কলেজে ফোন আনিনা’।

এবার উনার রাগের মাএাটা বেড়ে গেলো।চেঁচিয়ে বলে উঠলেন….

-আজকাল মিথ্যা বলাও শিখে যাচ্ছ।তাহলে তোমার ব্যাগে কি অন্য কারো ফোন ঢুকানো ছিল।নাকি ফোনের হাত পা গজিয়েছে যে উড়ে উড়ে তোমার ব্যাগে চলে এসেছে।তুমি নিজেই বললে ওটা তোমার ব্যাগ।ফোনের পাসওয়ার্ড ও তোমার জানা তবুও বলবে কলেজে তুমি ফোন ইউজ করো না।এত বড় মিথ্যাবাদী হয়ে গেছো’।

এবার আয়ানের দিকে তাকালাম আমি।আয়ান ইশারায় বুঝালো আয়েশা ওর ফোন আমার ব্যাগে রেখেছে।আর সেখান থেকেই ফোনটা বেড়িয়েছে।আয়েশা ক্ষমা চাচ্ছে।ওকে বাঁচানোর জন্য চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।আজ পুরো ক্লাসের সামনে আমার মান সম্মান নিয়ে খেলছেন উনি।বিষয়টা বুঝতেই নেএদ্বয়ে জলে চিকচিক করে উঠলো।পাশ থেকে আরু কিছু বলতে যাবে তার আগেই উনি বললেন….

-‘ থাক কাউকে আর চামচামি করতে হবে না।হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়ার পর মন গড়া গল্প বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।পুরো ফোনেই একই ধরণের চ্যাটিং ফ্লাটিং ছি বলতে আমার রুচিতে বাধছে।মাএ এইচ এস সি ক্যান্ডিডেট এর মধ্যেই ভিতরে নোংরামি বাসা বেঁধেছে।আজ মানতে কষ্ট হচ্ছে তুমি সিয়ামের বোন।এক্ষুণি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাও’।মাথানিচু করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম।আরু হয়তো কিছু বলছে উনাকে কিন্তু সেগুলো শুনবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে এলো আবেশ।গাড়িতে বসে স্টিয়ারিংয়ে একটা ঘুষি মারলো।কলেজে আর মন টিকছে না।এটা কি করলো মেয়েটা।এই বয়সে এত বাজে ম্যাসেজ।’বাবু একটা কিস দাও না’।’একা বসে আছি যদি পাশে থাকতে তাহলে’ প্রত্যেকটা ম্যাসেজ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আর নিজের হাত মুষ্টি বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতেই পারছে না।এখন মেয়েটাকে খুন করতে ইচ্ছে করছে ওর। যদি ক্লাস রুম না হয়ে অন্য কোথাও হতো তাহলে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিতাম।

বাসায় এসেছি অনেক্ষণ হলো।ক্লাস থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ী এসেছি।আজকে আবেশ ভাইয়ার বড় ভাই আবিদ ভাইয়ার বিয়ের পাকা কথা।তাই আব্বু আম্মু গেছেন।ভাইয়াও হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছেন।সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আমিও ওখানেই থাকতাম।কিন্তু আজ তা হওয়ার নয়।।শাওয়ার নিয়ে নিজের রুমে শুয়ে আছি।কিছুই ভালো লাগছে না আজ।যদি ব্যাপারটা ভাইয়ার কানে যায় তাহলে কি হবে সবাই কি ভাববে যতটা আয়েশার উপর রাগ তারচেয়ে বেশি রাগ উনার উপর হচ্ছে।কিন্তু উনাকেও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না।ফোনে যা ছিলো তাই নিয়েই কথা বলেছেন উনি।আমার জায়গায় আয়েশা হলে খুশিই হতাম কারণ অন্তত আজকের অপমানের পর এসব ছেড়ে দিতো।কিন্তু সবসময় উনার সামনে ঝড়ের মুখোমুখি আমিই হই।যে ঝড় সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।পুরো ক্লাসের সামনে মুখ দেখাবো কি করে সবাই কি ভাববে।আপনি আমাকে এত কষ্ট কেন দিচ্ছেন ভাইয়া।এইগুলো সবার অগোচরোও তো সলভ করা যেত।এভাবে পাবলিকলি অপমান করার কি খুব প্রয়োজন ছিলো।তাছাড়া আমার উপর এতদিনেও কি এতটুকু বিশ্বাস জন্মেনি।একবারও ভাবলেন না সিরাত এরকম কিছু করবে না।করতে পারে না।চোখের দেখায়ও ভুল থাকে।আরেকটু যাচাই করলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো।

আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে কলেজ যাই না।কলেজ থেকে এক রকম ছুটি নিয়েছে।মান সম্মান বাঁচানোর ছুটি।আব্বু কলেজ না যাওয়া নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছেন।কিন্তু কোনো কাজ হয় নি।ভাইয়াও জোর করেছে কিন্তু কারো কথা কানে যায় নি।এরইমধ্যে আরু, আয়েশা, রিয়া, আয়ান এসে দেখা করে গেছে।আবিদ ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের সপ্তাহে।দুইদিন পর ওদের বাসায় যাওয়ার জন্য বলেছে কিন্তু আমি তো যাব না।উনার মুখোমুখি হতে চাই না আমি।আয়েশা ক্ষমা চেয়ে কলেজ যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেছে।এখন সবাই সবটা জানে ফোনটা আমার নয় আয়েশার ছিলো।সেদিনই আয়েশা উনাকে সবটা জানাতে চেয়েছিলো কিন্তু উনি কারো কোনোকথা শুনেন নি।পুরনো কথাগুলো যখনই ভাবি তখনই নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না।পাগল পাগল অনুভূত হয়।সন্ধ্যায় ফোন হাতে নিয়ে ফেইসবুক স্কল করছি তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।আম্মু ঘুমোচ্ছে খালাও বাসায় নেই।এই সময় কে আসবে হয়ত ভাইয়া ভেবে অলস পায়ে দরজা খুলে দিলাম।দরজা সামনে লোকটাকে দেখে খানিকটা অবাক হলাম আমি।তারপর আবার নিজেকে ধাতস্থ করলাম হয়তো ভাইয়ার খোঁজে এসেছেন উনি।যত ভাবি উনার সামনে যাবো না তত ভাগ্য আমায় উনার সামনে বার বার দাঁড় করিয়ে দেয়।উনাকে দেখেই সেদিনের কথা মনে পরে গেলো।চোখ দুটো ভিজে গেলো।কিন্তু সেগুলোকে ঝরে পরার আগেই অতি সন্তর্পণে সেগুলো লুকিয়ে নিলাম।যার কাছ আমার মান সম্মানের দাম নেই তার কাছে চোখের জল দেখানো মানে নিজেকে অপমান করা।
#তুমি_আমার
#পর্ব_০৪
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

এক সপ্তাহ পর উনাকে দেখছি।উনাকে সরে যাওয়া উচিৎ নাকি মুখের উপর দরজা বন্ধ করা উচিৎ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।হয়তো এসব করলে খারাপ দেখাবে ব্যাপারটায়।উনার দৃষ্টি আমার দিকে স্থির।খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে।নিজের অস্বস্তি কে পাওা না দিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বললাম…..

-‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।ভিতরে আসুন আমি আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি’।

কথাটা বলেই পেছন ফিরলাম আমি।আমার স্যার ডাকটায় যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন সেটা মুখ দেখে ঠিক অনুমান করতে পারছি।উনি ধীর পায়ে আস্তে আস্তে সোফায় বসলেন।আমি আম্মুর রুমের দিকে পা বাড়াতে যাব উনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন….

-‘কলেজ যাচ্ছ না কেন? কোনো সমস্যা’?

উনার কথায় পেছনে ফিরে তাকালাম আমি।উনার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির।ভ্রু জোড়া খানিক কুচকে গেলো আমার।মনে মনে শ’খানেক গালি দিতে লাগলাম আমি।শালা রাম ছাগল আমার মান সম্মান নিয়ে টানা হ্যাচড়া করে কেন জিজ্ঞেস করছিস ‘কলেজ যাচ্ছ না কেন’ জানিস না কেন যাচ্ছি না।তোর জন্য হ্যাঁ শুধু মাএ তোর ওই অপমানের জন্য মুখ লুকিয়ে আছি।আমাকে কিছু বলতে না দেখে বসা থেকে উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন উনি।তারমধ্যে কলিংবেল বেজে উঠলো।আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলে দিলাম।ভাইয়া এসেছে ভিতরে না তাকিয়ে জুতো খুলতে ব্যস্ত সে।আমাকে গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাইয়া বললেন…..

-‘কিরে এমন পেঁচা হনুমানের মত মুখ করে আছিস কেন?কলেজ যাস না বলে শাস্তি স্বরূপ আম্মু তোকে চাকরানি কাটিয়ে সত্যি দুপুরে খেতে দেয় নি’?

ভাইয়ার কথায় চোখ দুটো বড় বড় তাকালাম তাঁর দিকে।সে আমার মাথায় চাপড় দিয়ে দিব্যি হাসছে।কিন্তু আমি ত হাসছি না।কারণ যম যে ঘরের ভিতরে।এই মূহুর্তে মায়ের ভয়ংকর শাস্তির কথা না বললে কি এমন হতো।পেছন থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে গেলাম…..

-‘যদি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে হয় সেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে তাই মুখটা এমন’।

উনাকে ভাইয়ার মুখের হাসিটা আরও প্রশ্বস্ত হলো।হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে উচ্ছাসিত কন্ঠে বললেন…..

-‘হেই ম্যান হোয়াট এ্যা সারপ্রাইজ!তুই কখন আসলি’।

-‘ এই তো আধ ঘন্টা হবে।তোর বোন এত কিপ্টা কি করে ভাই?এতক্ষণ হলো এসেছি অথচ এক কাপ কফি পর্যন্ত দিলো না।আরে না দিলেও ভদ্রতার খাতিরে একবার বলতে তো পারে কিন্তু তাও করলো না।ব্যাপারটা বিচ্ছিরি।দুই বছর পর এসেও যদি এক কফি না পাই তবে রোজ রোজ এলে কি বসার জায়গা পাবো।ভাইয়ের বন্ধু নিজের টিচার বেস্টুর ভাই এতগুলো সম্পর্ক থাকার পরও আমার এই দূর অবস্থা।বলে গাল ফুলালেন তিনি।ভাইয়ার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন….

-‘কিরে সিরাত এটা কি তুই ঠিক করলি।যতই হোক সে তোর টিচার মানুষ তাঁকে আপ্যায়নে এত ত্রুটি এটা কিন্তু একদম উচিৎ নয়’।

সকলের অগোচরে মুখ ভেংচি কাটলাম আমি।টিচার না ছাই।আর এতগুলো সম্পর্ক হুহ নিকুচি করেছে।তখন কোথায় ছিলো আপনার এতগুলো সম্পর্ক যখন আমাকে অপমান করেছিলেন।কিন্তু মুখের উপর এই তেতোঁ সত্যিটা বলে উঠতে পারলাম না।কোনো বাক্য ব্যয় না করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।দুই বন্ধু মিলে এতক্ষণে আড্ড জমিয়ে দিয়েছে।এরই মধ্যে আম্মুও উঠে পরেছেন।এসেই এই বহুরূপী কে দেখে আনন্দে আত্মহারা তিনি।আমি বুঝি না এই ছেলে আমার ফ্যামিলির উপর কি এমন জাদু করেছে যে উনি বলতে সবাই অজ্ঞান।

আমি কফি করতে করতে আম্মু ততক্ষণে ডিনারের ব্যবস্থায় বসে পরেছেন।উনি এতবছর পর এলেন খাওয়াতে হবে না।আমার মায়ের আচরণে খুবই ক্ষীপ্ত আমি।যেন জামাই ভোজন হবে নতুন জামাই আধিক্যেতা।কিন্তু কিছু বলা যাবে না তাহলে উল্টে বিনা সার্ফএক্সেলে আমাকে ধুয়ে দেবে।কফি নিয়ে এসে দেখি ভাইয়া নেই উনি বসে বসে মৃদু হাসছেন আর ফোন গুতাচ্ছােন।ফোন হাতে নিয়ে হাসা ভালো লক্ষণ নয় খুবই খারাপ।কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছেন নাকি কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি দিয়ে কিছু ঠাহর করতে ব্যর্থ হলাম।তাই কফিটা সেন্টার টেবিলে রেখে যেতে পা বাড়ালাম।তখনই উনি বললেন……

-‘কাপটা হাতে দিয়ে যাও’।পা দিয়ে ধুম ধুম শব্দ করে উনার হাতে তুলে দিলাম উনি এখনও হাসছেন।কিছু বললাম না হঠাৎ সেন্টার টেবিলে ফোন দেখিয়ে বললেন….

-‘ফোনটা কার’?এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে বললাম..

-‘আয়েশার’!আমার কথায় বিষম খেলেন উনি।তবুও মুখে হাসি লেগেই আছে তাঁর।ফোন হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

-‘ওর ফোন তোমার কাছে কি করছে? ওয়ালপেপারে তোমার এমন পেত্নী মার্কা পিক কেন’?

-‘বেড়াতে এসেছে। বান্ধবী বান্ধবীর পিক দিতেই পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়’।

সিরাত যে ওর উপর রেগে ইচ্ছে এসব বলছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছে সে।কিন্তু সিরাতকে বুঝতে দেবে না।তাই আবারও প্রশ্ন করলো…..

-‘তা একে ইন্টারটেইন করার জন্যই বুঝি কলেজ কামাই করছো?কলেজ আর গেস্ট দুটোকে একসাথে সময় দিতে কষ্ট হচ্ছে হিমশিম খাচ্ছ।তবে এটা জেনে রেখো ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’লেখাপড়ার চেয়ে বড় কিছু নেই এমন কি বয়ফ্রেন্ডও না’।

শেষের কথাটা আমার চোখ বরাবর বললেন।লোকটা কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেলো।অবশ্য এর বাইরে ভালো কিছু ভাববেন না উনি ভাবার কথাও না।তাই কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে প্রস্থান করাই উওম।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি পেছন থেকে শুনতে পেলাম

-‘আমাক ভাব দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।আমি যথাসময় সময় যথাস্থানে এন্ট্রি নিতে জানি’।কথাটা ফোন কানে নিয়ে বলছেন কাকে বলছেন কে জানে।

🍁🍁🍁

চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।মিনার ছুটেছে বাইক নিয়ে অজানা উদ্দেশ্যে।রাএে বাইক নিয়ে ঘোরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।রাতের শহর গ্রাম সবকিছু নিজ চক্ষে দেখতে অতি মোহনীয় লাগে।তবে একা জার্নিটা ঠিক জমে না। রাস্তা থেকে আয়ানকে পিক আপ করে নেবে।লোকজন থেকে কিছুটা দূরে একটা গাছতলায় বসে আছে একটি মেয়ে।অন্ধকারের দরুন প্রথমে না দেখলেও বাইকের আলো গিয়ে মেয়েটার শরীরে পরায় এখন স্পষ্ট।গুটিশুটি মেরে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে সে।আলোর ছটা দেখে কিছুটা হাসি ফুটলেও আবার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো।মিনার কি ভেবে বাইক থামালো। একদম মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।মেয়েটির চোখে মুখে ভয় ফুটে উঠলো।মিনার বললো…..

-‘এই মেয়ে এত রাতে এভাবে এখানে বসে আছো কেন’?

মেয়েটি একবার ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভীত কন্ঠে বলল….

-‘আমি এখানে কিছুই চিনি না।খালামনির বাসায় বেড়াতে এসেছি।সন্ধ্যায় বাইরে বেড়িয়ে ছিলাম এখন আর বাসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না’ বলে ফুঁপিয়ে উঠলো।মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে মিনারের মনের আকাশে কালো আধারে চেয়ে গেলো।ওর জন্য খারাপ লাগা কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।মিনার ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল….

-‘কেঁদো না।আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো।তোমার ঠিকানা মনে আছে’?

-‘হ্যাঁ মনে আছে।কিন্তু এখানে তো আমি নতুন কাউকে চিনি না।তাছাড়া সবাইকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে’?

মেয়েটি চোখে মুখে ভয়ের চাপ স্পষ্ট।কান্নার ফলে চোখগুলো ফুলে উঠেছে।ওর কথার মানে বুঝতে পেরে মিনার ভরসা দিয়ে বলল….

-‘বিশ্বাস রাখো তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।সসম্মানে তোমাকে তোমার আত্মীয়দের কাছে পৌঁছে দেবো’!মেয়েটি ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো কান্না মিশ্রিত গলায় বলল….

-‘ঠিক তো’!মিনার মুচকি হেসে বলে ‘হুম।মেয়েটিকে নিজের পেছনে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে তাঁর আগেই কল আসায় ফোন বের করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়ানের রাগী কণ্ঠস্বর শোনা গেলো….

-‘ওই শালা হারামি আমাকে লেনে দাঁড় করিয়ে এখন তোর কোনো পাওা নেই।কোথায় তুই কোনো মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিস’?

-‘সরি দোস্ত!আজ আসতে পারব না তুই বরং বাড়ী চলে যা আমরা কালকে বের হবো।আজ আমার একটা ইমপর্ট্যান্ট কাজ পরে গেছে’ ওপাশের ব্যাক্তিটিকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।এখন আয়ান ওকে আচ্ছামতো বকাঝকা করবে তাতেও যেন কোনো আক্ষেপ নেই তাঁর।বাইক নিয়ে মেয়েটির ঠিকানা অনুযায়ী একটি মোড়ের মাথায় থামলো ফট করে মেয়েটি বাইক থেকে নেমে সামনে হাঁটতে লাগলো।একবারও থ্যাংকস পর্যন্ত বললো না আজব!

🍁🍁🍁
তখন উনার সামনে থেকে আসার পর রুম বন্ধ হয়ে বসে আছি।আর বের হচ্ছি না।খাওয়া দাওয়া করে তবেই এ বাসা ছাড়ছেন উনি।ইতিমধ্যে বাসায় আব্বু এসে হাজির।ব্যস সবাই মিলে এখন খোশগল্পে বিজি।আম্মু গলা ফাটিয়ে অনেকবার ডেকেছেন কিন্তু পড়ার বাহানায় যাই নি।পড়ছি শোনেও ভাইয়া আর উনি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি করেছেন সেটা খালা নিশ্চিত করে গেছেন আমায়।তাতে আমার কি যা ভাবার ভাববেন।আমার এত দ্বায় নেই উনাকে এটেন্ড করার।ভাইয়ার বন্ধু ভাইয়া বুঝে নেবে।খাওয়ার জন্য অনেক্ষণ ধরে চিল্লাচিল্লি করছেন আম্মু কিন্তু উনার মুখোমুখি হতে চাই না তাই যাচ্ছি না।ঘুমের ভান ধরে পরে আছি।শেষমেশ আমাকে ছাড়াই খাওয়া শেষ করলেন তারা।আম্মু আমার খাবার রুমে রেখে চলে গেলেন।ক্ষিধে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে তাই চট করে উঠে খেতে বসলাম।হঠাৎ গলায় খাবার আটকে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম কিন্তু ঘরে পানি নেই।চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে ঢকঢক করে গ্লাস সাবাড় করে দিলাম।কিন্তু চোখের সামনে উনাকে দেখে চমকিত আমি।

-‘একি আপনি’

-‘হুম!ভালো লাগছে এখন’?

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম।এখন খানিকটা লজ্জা অনুভূত হচ্ছে।কেমন করে খাচ্ছিলাম উনি কি ভাবলেন ভাবলেই লজ্জায় লাল হচ্ছি।আমার ভাবনার মাঝেই উনি বললেন….

-‘তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো কথা আছে’।উনি গিয়ে বিছানায় বসে পরলেন।আমি আড়চোখে একবার দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে খেতে লাগলাম।দুই লোকমা খেয়ে আর পারলাম না গিলতে খাওয়া শেষ সবকিছু গুছিয়ে উনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম…

-আপনি এখানে বসে আছেন কেন’?আমার কথা শেষ হতেই ফট করে দাঁড়িয়ে পরলেন উনি।উনার শার্ট ঠিক করলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকার দরুন দুজনের চোখাচোখি হলো।আমি তড়িঘড়ি করে চোখ নামিয়ে নিলাম।বাঁকা হাসলেন উনি।মোহনীয় কন্ঠে ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললেন….

-‘আমার সাথে এত লুকোচুরি এত অভিমান।ক্লাসে বকেছি বলে এত ইগনোর।বাড়িতে এসেও দেখা পাওয়া দুষ্কর।একজন স্যারের উপর এতটা রাগ করা কি মানায় সিরাত?’হতভম্ব বিস্মিত আমি।উনি কি কিছু টের পেয়েছেন সর্বনাশ।উনার কথাগুলো শুনে পুরো জমে গেছি।দু হাতে জামা খামছে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত।যেন নিজেকে ঠিক রাখতে অক্ষম সে।এরইমধ্যেই সিয়াম রুমে ঢুকলো।সিয়ামকে দেখে আবেশ বলল…..

-‘আগামীকাল থেকে যেন আর মিস না হয়’।কথাটা হুমকির সুরে বললেন নাকি আদেশসূচক বাণী এখনও বোধগম্য হলো না আমার।তবে একবার মনে হচ্ছে এটা ঠান্ডা মাথায় হুমকি।ভাইয়াও উনার কথায় তাল মিলালেন।আমি এখনও স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছি।উনি দরজা অব্দি গিয়ে ভাইয়া একটু এগুতেই আবার আমার কাছে ফিরে এলেন চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বললেন ‘সরি’ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেলেন।সরি এই একটা ছোট্র শব্দ সারা শরীরে শিহরণ জাগিয়ে তুললো আমার।মূহুর্তেই মনের আকাশে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে শুরু করে দিলো।ভালোবাসা বুঝি এমনই সুন্দর মনোমুগ্ধকর।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here