তুমি আমার পর্ব -০৫+৬

#তুমি_আমার
#পর্ব_০৫
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

গ্রীষ্মকাল পড়ন্ত বিকেলবেলা।রিয়া এদিক সেদিক ঘুরে কেনাকাটাতে ব্যস্ত।কিছু কসমেটিক্স আর ড্রেস কিনতে এসেছে সাথে ওর কাজিন তিহানা।অত্যন্ত সুন্দরী।ব্যবহারও বেশ মার্জিত।হলুদ রঙের একটি থ্রি পিস পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।গায়ের রঙের সাথে হলুদ রঙ খুব সুন্দর ফুটে উঠেছে।দুজনে মিলে এটা সেটা দেখছে।কিন্তু কিছুই পছন্দ করতে পারছে না।হঠাৎ রিয়া একটা হ্যান্ড ওয়াচ দেখে ওটাতে হাত দিতে গেলো আরেকটি বলিষ্ঠ হাত সেটা তাঁর আগেই কেড়ে নিলো।হাতে নিয়ে ঘড়িটিকে ভালোভাবে দেখতে লাগলো সে।লোকটিকে দেখে বেশ রেগে গেলো রিয়া।রাগী কন্ঠে বলল

-‘আপনি!এখানেও চলে এসেছেন’?ভ্রুকুটি করে রিয়ার দিকে তাকালো সিয়াম।আরে এটা ত সিরাতের পাগল বন্ধু সেই ঝগড়ুটে।সেদিনের কথা মনে হতেই ঢোক গিললো সে।আজও যদি রাস্তার মত আবোল তাবোল বকতে থাকে তাহলে আমার মান সম্মান সব শেষ।তবুও সাবলীল ভাবে জবাব দিল….

-‘কেন আমার আসা বারণ নাকি’।

-‘বারণ বলিনি!যাগগে আপনি আমার জিনিস নিয়েছেন কেন’?সিয়াম অবাক হয়ে বলল….

-‘আপনার জিনিস?আপনার জিনিস আমি কখন নিলাম’?ঘড়িটিকে দেখিয়ে রিয়া বলল….

-‘এই তো এটাই আমার ছিল।আগে আমি চুজ করে হাত দিতে যাব অমনি আপনি কেড়ে নিয়েছেন।আমার জিনিস আমাকে ফেরত দেন’।

ওর কথায় এবার হাসতে লাগলো সিয়াম বলল….

-‘তাহলে এটা আপনার জিনিস কি করে হলো।এটার পিল পে করেছেন করেন নি।তাছাড়া আগে হাতে আমি নিয়েছি তাই এটা আমার।সো বাই মিস ঝগড়ুটে’।বলে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে ইনোসেন্ট লুক নিয়ে রিসেপশনে চলে গেলো।ওদিকে রিয়া রাগে ফুস ফুস করে বকাবকি করতে ব্যস্ত। রিসেপশনিষ্টকে হুবহু দুটো প্যাক করে দিতে বলল।সে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানালো এটা একটাই আছে আর নেই।তাই সিয়াম ভাবলো মিস ঝগড়ুটে কে দিয়ে দেবে। আবার রিয়ার কাছে গেলো।ওখানে যেতেই রিয়া বলল….

-‘কি হলো পিছু ছাড়ছেনই না।এখনই না এখান থেকে গেলেন।আবার এসেছেন কেন’?

-‘এই এখন সব কথার কাজের কৈফত কি আপনাকে দিতে হবে।যত্তসব আমার ইচ্ছে হলে আমি এখানে সারাদিন ঘুরব তাতে আপনার কি’।তিহানাকে উদ্দেশ্য করে বলল’তুমি খুব ভদ্র এবং সুইট!পাশের টা মারাত্মক অভদ্র আর ঝগড়াটে’!আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে।মেজাজ টাই খাটাপ করে দিলো।যত চাই বোনের ফ্রেন্ড বাজে ব্যবহার করব না ততই করতে বাধ্য করে।রিয়া এখনও রেগে আছে পাশ থেকে তিহানা বলল….

-‘আপু ছেলেটা কিন্তু জোশ’!

🍁🍁🍁

আজ পুরো দশ দিন পর কলেজ এসেছি।আজকেও আসতাম না কিন্তু আজকে আবেশ স্যারের ক্লাস টেস্ট আছে।এতদিন বন্ধুদের কাছ থেকে নোটস নিয়ে পড়েছি। আম্মুর বকাবকি এতদিন আমলে না নিলেও গতকাল হেড কোয়ার্টার থেকে আদেশ এসেছে কলেজে যাওয়ার।ব্যস হয়ে গেলো এবার কলেজ না গিয়ে উপায় নেই।আম্মুর শত কটু কথা বকাবকি কাজে না দিলেও আব্বুর ঠান্ডা মাথার একটা কথাই যথেষ্ট।আমরা এমনই মা’কে উপেক্ষা করার শক্তি থাকলেও বাবার একটা কথা উপেক্ষা করার শক্তি বা সাহস কোনোটাই নেই।কলেজ এসেই সবার কথার তলে জ্বলসে মরছি।আরু ফুলে বম হয়ে আছে।আয়েশা সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে।ওদের সাথে সব ঝামেলা চুকিয়ে ক্লাসে যাচ্ছি।মনে মনে একটাই প্রার্থনা আর যেন খারাপ কিছু না হয়।এবার যেন উনি উনার মত আর আমি আমার মত থাকতে পারি।আট দশটা টিচার স্টুডেন্টের মত আমার সাথে বিহেভ করেন তিঁনি।ক্লাসে এসে ঢুকলেন আবেশ স্যার।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।ঘেমে সাদা শার্ট একদম শরীরের সাথে লেপ্টে লেগে হয়তো কলেজ ঢুকেই ক্লাসে চলে এসেছেন।আমার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেই চোখ সরিয়ে নিলেন উনি।সকলের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলে এক্সাম নিতে শুরু করলেন।লিখার মধ্যেখানে আচমকা আমার নাম ধরে ডাকলেন উনি।উনার মুখে আমার নাম শুনে চমকে উঠলাম।আজকে আবার কি হলো আমি তো কোনো ব্লান্ডার করিনি তাহলে।নিজেকে ধাতস্থ করে অসহায় মুখ করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।আমার দিকে নজর না দিয়ে পেছনে একটি সিট দেখিয়ে বললেন….

-‘ তুমি তোমার খাতা নিয়ে এখানে এসো’।আমি কোনো কথা না বলে সকলের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসলাম।একে একে আমাদের সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে বসালেন তিনি।এর অর্থ ইতিমধ্যে সকলের কাছে জলের মত পরিষ্কার।আমরা টুকলি করতে না পারি তাই এই ব্যবস্থা।উনার মীর জাফরি বুদ্ধি দেখে হতাশার শ্বাস ফেললাম আমি।

আজ আরুর বাসায় এসেছি।আবিদ ভাইয়ার বিয়ের আর মাএ তিন দিন বাকী।যদিও আমার এক সপ্তাহ আগে আসার কথা ছিল কিন্তু উনার সাথে ঝামেলার জন্য এই বাসায় আর আসতে চাই নি।কিন্তু আরু আর আন্টির জেদ আর গাল ফুলানো দেখে অনিচ্ছা স্বও্বেও আসতে হলো।এসেও শান্তি নেই আন্টির শত কথা শুনতে হলো।যত যাইহোক উনারা আরুর থেকে কম ভালোবাসেন না আমায়।বাসার কেউ বাড়িতে নেই।উনিও আসেন নি এখনও।সবাই যার যার কাছে বাইরে আছে।আরু বাগানে গেছে আমার ভালো লাগছিলো না তাই আন্টির পাশে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছি।আন্টি আমাকে বললেন…..

-‘শুনলাম আবেশ নাকি তোকে অনেক কথা শুনায় ক্লাসে।সেদিন কি নিয়ে নাকি বিচ্ছিরি একটা কান্ড ঘটিয়েছে।সেজন্য কি তুই এখানে আসতে চাস নি’?

আন্টির কথায় বিপাকে পরে গেলাম।এখন কি বলব আমি।যতই হোক উনি আমার টিচার সেই অর্থে তাঁর চোখে খারাপ কিছু লাগলে তিনি আমাকে শাসন করতেই পারেন।তাই বলে এটা নিয়ে বাসায় উনার মাকে বলা মানায় না।আমার শব্দ ভান্ডারে উপযুক্ত বাক্য পেতে ব্যর্থ হওয়ায় চুপ করে রইলাম।আমাকে চুপ থাকতে দেখে আন্টি বললেন….

-‘মা রে ওর ব্যবহারে রাগ করিস না।এমনিতেই খুব ঠান্ডা মেজাজ কিন্তু রাগ উঠলে কি বলে মাথায় থাকে না।আজ আসুক বাসায় খুব বকে দেব’বলে মুচকি হাসলেন তিনি।আমি বাধা প্রধান করলাম….

-‘না আন্টি এই নিয়ে উনাকে কিছু বলবেন না।কারণ কলেজে আমার আর উনার সম্পর্ক টিচার স্টুডেন্টের তাই এইগুলো বাসায় না টানাই ভালো’।আমরা কথা বলছি তখনই হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ঢুকলেন উনি।রান্নাঘরে দৃষ্টিপাত না করেই বললেন….

-‘আরু আমার রুমে পাঁচ মিনিটে এক কাপ কফি নিয়ে আয়’।

ছেলের এমন হুকুম দেখে ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লেন তিনি।মেজাজ ভালো নেই বুঝা যাচ্ছে তাঁর।তাই চট করে কফি করে নিলেন।এবার মসিবতে পরলাম আমি।সবাই বাঘের সামনে খাবার দেওয়ার জন্য আমাকেই পায় নাকি ভেবে কুল পাই না আমি।আন্টি অনুনয়ের স্বরে বললেন….

-‘সিরাত এই কফিটা ওকে দিয়ে আসো না।আমি এখন তরকারি বসাচ্ছি দেরী হলে রাগ করবে প্লিজ!উনার করুন চাহনী উপেক্ষা করে না বলার সাহস যোগাতে অক্ষম হলাম আমি।বাংলার পাঁচের মত মুখ করে কাপটা হাতে তুলে নিলাম।উনি হয়তো বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন তাই মিষ্টি হেসে বললেন….

-‘কিচ্ছু হবে না দেখিস’।উনার কথায় কিছুটা ভরসা খুঁজে পেলাম।অরণা মাথায় দিয়ে ধীর পায়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।কিন্তু কি করবো ডাকবো নাকি না।দরজায় হাত দিতেই দরজা ফাঁক হয়ে গেলো।বিছানায় মুখ গুঁজে উল্টো হয়ে সটান শুয়ে আছেন তিনি।উনাকে দেখে হাসি থামছে না আমার।একটা ধামড়া ছেলে কি করে এভাবে শুতে পারে।বিনা শব্দে কিছুক্ষণ হেসে রুমে ঢুকলাম।বিছানার পাশের ছোট্র টেবিলটায় কাপটা রাখতেই হালকা স্বরে বললেন….

-‘ওখান থেকে গিয়ে মোভ নিয়ে আয়।গো ফাস্ট মাথা ব্যাথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।মেডিসিনেও কাজ হয় নি’।

এই কোন মসিবতে পরলাম আমি এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে আমার।ওদিক খুঁজে মোভ হাতে উনার সামনে দাঁড়িয়ে ধরলাম কিন্তু উনি কোনো রেসপন্স করলেন না।ছোট্র করে বললেন ম্যাসাজ করে দে।ততক্ষণে যদি ঘুম চলে আসে ঘুমাব।এবার অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালাম।এটা কি বলছেন উনি আমি পারব না।তাই মোভ টা উনার পাশে রেখে চলে যেতে উদ্যত হলে বিরক্তির সুরে বললেন….

-‘হ্যাঁ এখন তো দিবি না।কারণ কোনো ঘুষ পাস নি।মাঝে মাঝে মনে হয় তুই আমার বোন না।নইলে কি করে সবসময় সুদ আসলের হিসেব কষিস।যাইহোক ড্রেসিং টেবিলে দেখ চকলেট বক্স রাখা আছে।এবার ত হাত লাগা’।

আমি এখনও স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে আছি।এটা আমি পারব না কিছুতেই না।আমার পক্ষে কেন আমার আত্মার পক্ষে অসম্ভব।তাই মুখ ফুটে বলেই ফেললাম…..

-‘সরি আমি পারব না’।

-‘ঘুষেও কাজ হয়নি নাকি আরও কিছু চাস বল’।

-‘দেখুন ঘুষ সুদ এসব কিছুর আমার প্রয়োজন নেই।আমি আরু নই যাচ্ছি ওকে পেলে পাঠিয়ে দেবো’

এতক্ষণে খেয়াল হলো আমার।আচ্ছা সিরাতের গলা শুনলাম মনে হলো।এটা নিজের কল্পনা নাকি সত্যি।নিজের ভাবনায় সুতো কেটে বিছানায় উঠে বসলাম।সামনে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম সত্যি এটা সিরাত।এতক্ষণ আরু ভেবে সিরাতের সাথে কথা বলছিলাম ও মাই গড।তা আমি কি করে জানবো এটা কে ইডিয়ট একটা।তাছাড়া আমি ত তাকাই নি এই বাড়িতে আরু ছাড়া এমন পিচ্চি আর কেউ নেই।তাই ও ধরে নিয়েছিলাম বিস্মিত হয়ে বললাম….

-‘তুমি!তুমি এখানে কি করছো’?ভ্রু কুটি করে তাকালাম আমি এতক্ষণ এত কাজ করিয়ে এখন বলছেন ‘তুমি এখানে কি করছো’ নিজের মনে কথাগুলো আওড়াতে লাগলাম।তারপর উনাকে সবটা বলে বের হচ্ছি তখন পেছন থেকে কিছু কথা কর্ণপাত হলো কিন্তু কিছু বললাম না!

-‘এই জেনারেশন গুলো বড্ড অদ্ভুত টাইপের।কাজের সময় মুখে খুলো পেতে থাকবে আর অকাজে মুখ থেকে কথার খই ফুটবে।এইজন্যই এদের বলে কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা আর কথার বেলা ঠিক’।
#তুমি_আমার
#পর্ব_০৬
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

আজকের সকালটা অনেকটা অন্যরকম মনে হচ্ছে সিরাতের কাছে।কোনো এক কারণে খুব বেশিই ভালো লাগছে তাঁর।কিন্তু কেন এমন ফিলিংস হচ্ছে সেই জিনিস নিজেরই অজানা।সকাল সকাল উঠে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে।আরু মাএ ফ্রেশ হতে ঢুকেছে ওয়াশরুমে।কাল থেকে এই বাড়ীতে ওদের সকল বান্ধবী আসবে।আগামীকাল তাঁর পরেরদিন আবিদ ভাইয়ার বিয়ে।সেই সুবাধে চার দিন কলেজ আসবে না তাঁরা।অবশ্য তাতে দ্বিমত করেনি কেউ।আজকে ক্লাস টেস্টের খাতাগুলো দেওয়ার কথা।কিন্তু কেউই যে খুব একটা ভালো করবে না সে সম্পর্কে অবগত সবাই।কারণ কারোরই প্রিপারেশন ছিল না তেমন।সে যাইহোক এটা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ঢের ভাল।কিন্তু তবুও সিরাতের মনের খচখচ দূর হচ্ছে না।।আবেশ ছুটি নেবে আজ।কারণ বিয়ের সকল কাজ কর্ম ওকেই দেখতে হবে।ভাই তো আর নিজের বিয়ের সব কিছু করতে পারবে না।কলেজ সামলে বিয়ে এটেন্ড করাও কষ্টসাধ্য।সিরাত রেডি হয়ে নিচে গেলো সেখানে আবেশের মা ব্রেকফাস্ট রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে।আবেশের বা রোজকার নিয়ম অনুযায়ী নিউজ পেপার পড়তে ব্যস্ত।আবেশ তাঁর পাশে বসে টুকটাক কথা বলছে হয়তো বিয়ে ঘটিত কিছু।তিনি হ্যাঁ হু করছেন। চশমার ফাঁকে সিরাতের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,

-‘গুড মর্নিং সিরাত!এখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ত মা’? এই মানুষ গুলোর অতিরিক্ত ভালোবাসা আর আন্তরিকতা মারাত্মক রকম ভালো লাগে মন ছুয়ে যায় সিরাতের।শুধু মাঝে মাঝে এটা ভেবে পায় না আবেশের মত তিতা করলা কি করে উনাদের সন্তান হলো।আবেশ উনার কথা অনুসরণ করে সিরাতের দিকে একবার তাকালো।একেবারে রেডি হয়ে নিচে নেমেছে সে।কালো আর সাদা থ্রি পিস।মাথায় সাদা হিজাব।ফর্সা শরীরে সাদা কালো রঙটা দারুন মানিয়েছে।সিরাত মুখের হাসি প্রশ্বস্ত করে প্রতিওোরে বলল,

-‘জ্বী না আঙ্কেল আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না’।আবেশ আড়চোখে একবার ওকে দেখলো।সেটা নজর এড়ায় নি সিরাতের।কিছুক্ষণ পর আবিদ আর আরু একসাথে নিচে নামলো।আরু বারবার কিছু বলার চেষ্টা করছে আর আবিদ বার বার ওকে বারণ করছে।কিন্তু আরু বলবেই বলবে।ওকে কেউ আটকাতে পারবে না।হাসতে হাসতে বলল,

-‘জানো ছোট ভাইয়া বড় ভাইয়া এতক্ষণ রুমে কি করছিলো’?সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।আবেশ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কি করছিল’?আবিদের দিকে একবার তাকালো আরু।চোখ রাঙিয়ে ওকে বলতে কড়াভাবে নিষেধ করছে।আরু ক্যাবলাকান্তের মত হেসে বলল,

‘ভাবীর সাথে কথা বলছিল।উনার সাথে দেখার জন্য নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে।বিকেলে শপিংমলে যেন আলাদা একটা স্পেস পায় সেই নিয়ে আলোচনা চলছিল’।

গরগর করে সব বলে দিলো সে।সকলের সামনে আবিদের মাথা কাটা গেলো।এভাবে মা বাবার সামনে বেইজ্জত করতে পারলো।অসহায় ফেস করে ওর দিকে তাকাতেই ফিক করে উঠলো ও সহ সবাই।আবেশও হাসছে প্রাণ খোলা হাসি।এতদিনে আবেশকে আজ প্রথম এতটা হাসতে দেখলো সিরাত।হাসলে লোকটাকে মারাত্মক সুন্দর লাগে।কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে।এই হাসিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাহস ওর নেই।তাই অতি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো সে।ওর বাবা বললেন,

-‘আরু এটা ঠিক নয়।কারো পার্সোনাল কথা এভাবে সকলের সামনে না বলাই শ্রেয় আবার বললে এক দিক দিয়ে ভাল এই ফাঁকে কিছুটা মজাও নেওয়া যায়।বাবা এত লজ্জা পাওয়ার কিচ্ছু নেই।বিয়ের আগে তোমার মা’কেও দেখতে’কথাটা বলে শেষ করতে পারলেন না তিনি।মিসেস খান চোখ গরম করে ওখানেই থামিয়ে দিলেন তাঁকে।সকলে চোখ বড় করে তাকালো কিন্তু শেষটা শুনতে পেলো না।কারণ ততক্ষণে উঠে চলে গেছেন তিঁনি।আরু হাসতে হাসতে বলল,

-‘যা এটা কি হলো বাবা সিক্রেট বলতে বলতে থেমে গেলো’!সোফা থেকে উঠে আরুর মাথায় চাপড় দিয়ে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে আবেশ বলল,

-‘অন্যের সিক্রেট শোনে দাঁত কেলানো বন্ধ করে আজ কি হবে সেই চিন্তা কর’।এই একটা কথা এখানে উপস্থিত দুজনের মুখের রঙ বদলে গেলো।মুখের হাসি উবে থমথম হয়ে গেলো।

ক্লাসে ঢুকতে না ঢুকতেই চিন্তা ভাবনাগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো সিরাতকে।যদি একেবারে খারাপ হয় তাহলে মান সম্মান সব শেষ।অন্য কোনো স্যার হলে তাও ঠিক ছিল কিন্তু এই সাবজেক্ট স্বয়ং আবেশের।আবার একজন ভালো লাগার মানুষও তার সামনে মান সম্মান যাওয়া মানে শুধু লজ্জা নয়!চুড়ান্ত পর্যায়ের লজ্জা।আরুও সেই টেনশনে আছে কারণ খারাপ করলে আবেশ ছাড়বে না তাঁকে।বাসাশুব্ধ সকলের কাছে ধাম ধোলাই খেতে হবে।মিনার,আয়েশা আর আয়ান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে আছে।ওরা এ নিয়ে একেবারে মাথা ঘামাচ্ছে না।রিয়া একটু আধটু চিন্তা করছে ত আবার হাওয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে।আয়ান সিরাত আর আরুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘কি শুরু করেছিস বল ত।এটা কি ফাইনাল এক্সাম নাকি যে ফেইল করলে সব শেষ।তোদের এই সামান্য ক্লাস টেস্ট নিয়ে এত আধিক্যেতা এবার রাগ লাগছে’।দুজনেই ওর দিকে তাকালো কথাটা ভুল কিছু বলে নি।আর কোনো দিন এটা নিয়ে মাথাও ঘামায় নি।কিন্তু আজ ঘামাতে হচ্ছে।ততক্ষণে আবেশ ক্লাসে ঢুকে গেছে।সবাই চুপ হয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর পিয়ন একগাদা কাগজ দিয়ে গেলো।আবেশ এক এক করে প্রায় সকলের খাতা দিল কিন্তু আরুদের কেউ এখনও খাতা পায় নি।এতে টেনশন আরও বেড়ে গেলো।একেবারে শেষে এক এক করে সকলের খাতা দিল।ক্লাসের টপ করেছে এলিনা মেয়েটা সিরাত আরুর দিকে তাকিয়ে একটা বিশ্ব জয়ের হাসি দিল।।দুজনে ওর হাসি দেখে ভেংচি কাটলো।কারণ এই তিনজনই পরপর একই ভাবে থাকে।হয়তো সিরাত নয় আরু আর নয় ত এলিনা।এলিনা পেয়ছে বিশে আঠেরো,আরু সতেরো,সিরাত পনেরো।আয়ান নয়, মিনার ষোলো, রিয়া চৌদ্দ, আয়েশা দশ।আরু সেকেন্ড লিস্টে থাকলেও ওর সাথে আরো এক জন আছে।এখন স্বস্তি পাচ্ছে আরু কিন্তু সিরাতের জন্য খারাপ লাগছে।ফার্স্ট ইয়ারের টপ মেয়েটা ক্লাস টেস্টে এতটা পিছিয়ে।সিরাত মুখ কালো করে বসে আছে।আজ সবটা আবেশের জন্য হয়েছে।যদি ওইদিন ওরকম কিছু না হত তাহলে রেগুলার ক্লাস করত আর পড়ালেখায় মন বসত কিন্তু সেদিনের পর ত পড়তে গেলেও কথাগুলো অগ্নি শিখার অনলে দগ্ধ করেছে তাঁকে।যার ফল এই রেজাল্ট।আয়ান দিব্য হাসছে ডবল জিরো পায় নি এই ঢের।এবার আবেশ বলল,

-‘ফার্স্ট ইয়ারে টপ করেছিল কে?আর সেকেন্ড, থার্ড কে কে’?এবার আরু সহ সবাই চুপ।কারণ ক্লাসের সবাই এবার সিরাতকে দেখাবে।সবাই মনে রেখেছে এটা ওর বড় প্রাপ্তি।সকলের সাথে সাথে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’সিরাত,আরু,এলিনা।

-‘স্ট্যান্ড আপ সিরাত,আরু এন্ড এলিনা’?সিরাত মাথানিচু করে দাঁড়ালো।ক্লাসের টপ গার্ল শেষে কিনা ফুস করে একটা শ্বাস ছাড়লো সে।এলিনার মুখ থেকে হাসি যেন সরছেই না।যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছেন তিনি আরু একটা ভেংচি কাটলো।আবেশ বলল,

-‘আঠারো,সতেরো,পনেরো।এলিনা কনগ্রেচুলেশন!আরু তোমাকে আরও ভাল করতে হবে। আরু ডুয়েটলি নিজের পজিশনে আছে। ।সিরাত তুমি এতটা পেছনে কেন?নিজের জায়গায় স্ট্রিক্ট থাক।হোক ক্লাস টেস্ট বা বোর্ড এক্সাম।তোমার কাছে এটাই লক্ষ্য থাকতে হবে আমার জায়গা আমারই সেখানে কাউকে পৌঁছাতে দেবো না।আর অন্যদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা থাকতে হবে সিরাতের জায়গায় পোঁছাবই আমি।পৌঁছাতে আমাকে হবেই।আশা করি আগামীতে ভাল করবে।ওকে সিট ডাউন বেস্ট অফ লাক’।

আজ আবেশের সাথে বাসায় ফিরছে সিরাত আর আরু।সিরাত যেতে চায় নি কিন্তু মিঃ খান জরুরি তলব করেছেন।আধ ঘন্টার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে আর এই সময় রিকশা পাওয়াও দুষ্কর।তাই একরকম বাধ্য হয়েই ফিরছে সে।এখনও সিরাতের মুখ ভার কিছুক্ষণ পরপর উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরছে।লুকিং ক্লাসে কয়েকবার তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখে নিয়েছে আবেশ।আরু ওর পাশের সিটে বসেছে আর সিরাত পেছনে।চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে।আরু এটা ওটা বলছে বিয়েতে কি কি করবে সেই বিষয়ে আলোচনা করছে।আবেশও টুকটাক কথা বলছে কিন্তু সিরাত!সিরাত একদম চুপ।আরু বলল,

-‘সিরাত কি হয়েছে কথা বলছিস না কেন’?দাঁত খিঁচে মৃদু হেসে বলল,’কই কিছু না ত’!

-‘তাহলে এভাবে মুখ কালো করে আছিস কেন’?

-‘এমনি’!

-‘তুই কি রেজাল্ট নিয়ে এখনও আপসেট’।

-‘তুই ভাল করে জানিস আমি ফেলে আসা সময়কে নিয়ে ভেবে মন খারাপ করে সারাদিন বসে থাকি না।পেছনে কি হয়েছে ভুলে যাই সামনে কি করব সেটা নিজের মনে সেট করে নেই এই জেদ টাই আমার সফলতার কারণ’।আবেশ কোনো বাক্য ব্যয় করল না।আপন মনে ড্রাইভ করতে লাগলো।একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ওদের রেখে কোনো এক ফার্মেসীতে ঢুকলো।কিছুক্ষণ পর কিছু মেডিসিন আর এক বোতল পানি সাথে নিয়ে ফিরলো সে।গাড়িতে বসতেই আরু বলল,

-‘এটা কিসের ঔষধ ভাইয়া’?

-‘মাথা ব্যাথার’!

-‘ভাইয়া তোমার মাথা ব্যাথা করছে বুঝি’?মাথা নেড়ে না বলল আবেশ।আরু অবাক হয়ে বলল,

-‘তাহলে কার’?বোতল আর মেডিসিন ওর হাতে ধরিয়ে সাবলীলভাবে বলল,

-‘সিরাতের।এগুলো ওকে দে খেয়ে রেস্ট নিলে ভাল লাগবে’। কথাটা কানে আসতেই ফট করে চোখ খুলে চোখ বড় বড় করে তাকাল সিরাত।কোনোদিক না তাকিয়ে ড্রাইভিং নজর আবেশের।যেন অতি স্বাভাবিক একটা কথা বলেছে সে।কিন্তু এই সহজ সত্যিটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার।’উনি কি করে জানলেন আমার মাথা ব্যাথা’।প্রশ্নটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বারং বার।মনে একটা ভালো লাগার ঢেউ উপছে পরলো নিমিষেই।যে ঢেউয়ে বিরাজমান শুধু মুগ্ধতা!আর মুগ্ধতা।আরু এখনও থ হয়ে আছে।নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ওর।হাতে বোতল আর মেডিসিন নিয়ে স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকতে দেখে বিরক্তি নিয়ে আবেশ বলল,

-‘এভাবে হা হয়ে বসে না থেকে যেটা বলেছি সেটা কর।এই তোদের এক সমস্যা সহজে কিছু হজম হয় না।সব বদ হজম হয়ে গরগর করে বেড়িয়ে যায়’।ভাইয়ের কথায় আরু নিজেেকে স্বাভাবিক করে পেছনে সিরাতের দিকে এগিয়ে দেয়।সিরাত মুখ ঘুরিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

-‘আমি খাব না আরু।তুই এগুলো রেখে দে’।

-‘কেন খাবে না কেন’?নির্লুপ্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুড়লো আবেশ।

-‘এমনি আমার ভাল লাগে না।এমনি একটু পর সেরে যাবে’।আরু ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘কেন এরকম করছিস সিরাত খেয়ে নে না।তাছাড়া বাসায় গিয়েই আমাদের শপিংয়ে বেরুতে হবে মেডিসিন খেলে ততক্ষণে সেরে যাবে।প্লিজ খেয়ে নে’।

-‘আমিও সেটা ভেবেই এগুলো এনেছি।নইলে তো আবার আমাদের যাওয়াটা পেন্ডিং থাকবে।খেয়ে নাও ভালো লাগবে’!কথাটা লুকিং গ্লাসে একদম সিরাতের চোখে চোখ রেখে বলল আবেশ।ওই করুন চোখের চাহনি করুন স্বর উপেক্ষা করার শক্তি সিরাতের নেই তাই আর না করতে পারেনি।আরু অনেক্ষণ ধরে আসফাস করছে কিছু বলার জন্য।কিন্তু কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না।ওকে এরকম করতে দেখে আবেশ বলল,

-‘এভাবে মোচড়া মোচড়ি না করে বলে ফেল’?

এই কথাটার অপেক্ষায় যেন এতক্ষণ ছিল সে।মুখের হাসিটা প্রশ্বস্ত করে বলল,

-‘সিরাতের মাথা ব্যাথা তুমি জানলে কি করে?যেখানে আমি বেস্টু হয়ে বুঝলাম না সেখানে তুমি কি করে বুঝলে’?বিপরীতে মৃদু হাসলো সে।সিরাতেরও প্রশ্নটা মাথায় আসছে কিন্তু কি করে করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।অবশেষে তার সুপ্ত মনের প্রশ্নখানা আরু করে তার উপকারই করলো।উৎসুকভাবে উওরটা জানার জন্য কান খাড়া করে আছে সিরাত।কপালের চুলগুলো একহাতে সরিয়ে আবেশ বলল,

-‘ভেরী সিম্পল!কারণ তোর মাথায় গোবর ভরা তাই’।নিমিষেই অমাবস্যার কালো আধারে ছেয়ে গেলো আরুর মুখ।উওেজিত কন্ঠে বলল,

-‘খবরদার ভাইয়া বাজে বকে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে না’।

-‘আমি কোনোকিছু ধামাচাপা দিচ্ছি না।মাথা খাটা দেখ কি করে বুঝলাম।যদিও জানি পারবি না শুধু তুই না কেউই বুঝবি না।কারণ মাথায় কিছু নেই ওই যে গোবর ভরা’।আরু আর সিরাত হ্যাবলার মত তাকিয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।সিরাত সরু চোখে তাকালো ওর দিকে।এখনও ওর ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে।যে হাসির মানে কোনো এক সুখের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সে।সিরাত সত্যি মাথা খাটিয়ে জানার বুঝার চেষ্টা করলো কিন্তু সর্বশেষ সেই শূন্যতেই ফিরতে হলো তাকে।অজানা অজানাই থেকে গেলো।জানা আর হয়ে উঠলো না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here