তুমি আমার প্রাণ পর্ব -২৫

#তুমি আমার প্রাণ
#পর্বঃ২৫
#Mitu-মিতু

কষ্ট কিংবা আঘাতে মানুষ বদলায় না। মানুষ তো পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে পথ চলা শুরু করে। প্রেমে পড়তে বছর লাগে না। মিনিটের মধ্যেই একজনের প্রেমে পড়া যায়। আর রায়হান তো তিনদিন ধরে রিশার আশেপাশে আছে। প্রেমে পরার জন্য এটা অনেক সময়। মায়ায় আবদ্ধ হয়ে রিশার নাম রাখলো মায়াকন্যা। সুন্দর হাসিখুশি মুখটাই রায়হান কে কাবু করেছে। বিয়ের দিন ভোরবেলা রিশা ঘুম থেকে উঠে সোজা ছাদে চলে আসে। গতরাতে তাসরিফের ওমন আক্রমণে সে ঝিমিয়ে গিয়েছিলো। ছাদ থেকে নেমে এসে সোজা নিজের ঘরে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরেছিলো। দেরি করে ঘুমানোর ফলে ঘুম কম হয়েছে। ভোরের স্নিগ্ধতা গায়ে মাখানোর জন্যই মূলত ছাদে আসা।চিলেকোঠার রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া। তাসরিফ আযানের সাথে সাথেই বিছানা ছেড়েছে। বিয়ের দিন ব্যস্ততায় ভরপুর। মতিন সাহেবের সাথে মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে এসে রান্নার জায়গায় বাবুর্চিদের সাথে খাবার নিয়ে কথা বলছে। রসুলপুর গ্রাম থেকে ইরফানদের বাড়ি অনেকটা দূরে। বরপক্ষ বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হবে দুপুরে।তবে সকালেই বউয়ের সাজের সকল কিছু পৌছে গেছে চেয়ারম্যান বাড়ি। আত্নীয়রা সকলেই ঘুম থেকে উঠে পরেছে। হাতে হাতে কাজ করার মজাই আলাদা। বাড়ির প্রত্যেক মহিলা সদস্য মেহমান তদারকির জন্য সকালের নাস্তা তৈরি করছে। বাড়ির উঠোনে পাতা চুলায় সকলের জন্য খিচুড়ি চরিয়েছে বাবুর্চি। রায়হান রাহেলা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে ছাদের দরজা পেরুলো। রিশাকে দেখে ফোন কেটে দিয়ে ভাবলো এখন একটু কথা বলে পরিষ্কার করে নেওয়া যায় বিয়ের বিষয়টা।

“রিশা! আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। একটু সময় দিবে প্লিজ”

হঠাৎ পেছন থেকে অল্প পরিচিত পুরুষ কন্ঠে চমকে গেলো রিশা। পেছন ফিরে রায়হানকে বললো

“কি বলবেন ভাইয়া? ”

অস্বস্তি হলেও রায়হানের করুন কন্ঠে রিশা না করতে পারলো না। কোনো ভণিতা ছাড়াই রায়হান রিশাকে বললো

“আমি তোমাকে ভালোবাসি। বউ হিসেবে পেতে চাই তোমাকে। তাই আম্মাকে এনেছিলাম বিয়ের কথা বলার জন্য। এতে তোমার কি মতামত? আমি কোনোভাবেই চাই না আমায় খালি হাতে ফিরিয়ে দেও তুমি। ”

রিশা কি উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। তাসরিফের সাথে ওর বিয়ে কথা শুনলে নিশ্চয়ই রায়হান শক খাবে। কিন্তু রিশার এতে কোনো হাত নেই। ভুলটা রায়হানের তবে এটা একেবারে সত্য না। ভালোবাসা মানে না মন,,মানেনা কোনো বাধা। ভালোবাসা তো সেই শক্তি যার দ্বারা প্রেয়সীকে জিতে নেওয়া যায়। রায়হান জিতটা চাইলেও তার আগেই অন্য কেউ জিতে নিয়েছে তার ভালোবাসা।

“আসলে ভাইয়া! কথাটা যে আপনাকে কিভাবে বলবো? ”

রিশার অস্বস্তিতে ঢেকে যাওয়া মুখ দেখে রায়হান শুকনো ঢোক গিললো। সে ভয় পাচ্ছে।

“যা বলার তা নিঃসংকোচে বলতে পারো।”

“ওর কিছু বলা লাগবে না। আমি তোমাকে বলছি সবকিছু। ”

তাসরিফের কন্ঠে এবার ভয় পেলো রিশা। উঠোন থেকে রেলিংয়ের সাথে লেগে দাড়িয়ে থাকা রিশাকে প্রথম থেকেই খেয়াল করেছিলো সে। বাবুর্চিদের সাথে কথা শেষে ছাদেই আসছিলো তাসরিফ। রায়হানকে রিশার সাথে দেখে রিশার ওপর রেগে যায়। রায়হানের প্রশ্নে রিশার উত্তর দেওয়াতে দেরি হলে সে নিজেই এগিয়ে আসে ওদের কাছে। তাসরিফ কে দেখে রায়হানের মাঝে জড়তা আসে। বলে

“আসলে ভাইয়া! আমাকে বিয়ে করতে রিশা রাজি নাকি তা শুনতে এসেছিলাম। ”

“রায়হান আমি সবকিছু কাটকাট বলতে ভালোবাসি। শুনে তোমার খারাপ লাগবে তাও বলছি রিশা আর আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।কালকেই তোমাকে জানানো উচিত ছিলো তবে দেরি করার জন্য দুঃখীত। এছাড়াও বড় কথা হলো আমি ওকে ভালোবাসি সেই ১৭ বছর বয়স থেকে। নিজ হাতে যতটুকু পেরেছি ওকে গড়ে তুলেছি। আর পুতুলও আমায় ভালোবাসে।ও আমার প্রাণ। আমি কোনো মহান ব্যক্তি না যে প্রাণকে দান করে নিজে নিঃশ্ব হবো। তুমি একজন এডাল্ট ছেলে। বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিবে আশা করি।”

তাসরিফের কথায় রায়হান কেঁপে উঠলো। ওর করা ধারনাই ঠিক। সে ভুল মানুষের মায়ায় জরিয়েছে। এ মায়া সে কেটে উঠবে কি করে? ছেলে মানুষের নাকি কাঁদতে নেই তবে পরিস্থিতি তাদেরকেও কাঁদিয়ে ছাড়ে। রায়হানের চোখে টলমল পানি।তাসরিফের খারাপ লাগলেও রিশার ব্যপারে সে একচুল ও ছাড় দেবে না। শান্তনা দেওয়ার জন্য রায়হানের কাঁধে হাত রাখলে তাসরিফ কে জরিয়ে ধরে কেঁদে ফেলে সে।এত
আদরের ছেলে না পাওয়ার যন্ত্রণা উপহার পেলো।রিশা রায়হানের অবস্থা দেখে অবাক হলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো

“হে আল্লাহ! এমনটা না হলেও পারতো। রায়হান ভাইয়ার মন থেকে তুমি আমার নাম মুছে দেও। তাকে কষ্ট দিও না তুমি। তার ভালো থাকার সকল ব্যবস্থা তুমি করো।”

রায়হান একটু পরেই তাসরিফ কে ছেড়ে কোনো কথা না বলে সোজা নিচে নেমে গেলো।তাসরিফেরও খারাপ লেগেছে রায়হানের জন্য তবে এখানে সে কিছু করতে পারবে না। রিশাকে বললো

“তানিয়ার সাথে সাথে থাকবি। অনেক মানুষজন আসবে লাফালাফি টা কম করবি।আজকে আমি ব্যস্ত থাকবো। তবে তোর খেয়াল আমি ঠিকই রাখবো।নিচে যা। ”

তাসরিফের উপদেশে রিশা ভেংচি কাটলো।

“তোমার কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে। ”

“তর্ক না করে যা বলেছি তাই করবি। আচ্ছা তুই কি এমন করলি যে রায়হান তোর জন্য পাগল হলো? ”

“সেটা তুমি ভালো জানো। তোমার সাথে কিছু করেছি নাকি তোমাকে পাগল করার জন্য?”

“কথা না বলে নিচে যা। আজকে আমার কিছু বন্ধু আসবে।ওদের সামনে কোনো রং-ঢং করবি না বলে দিলাম। ”

রিশা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে। তাসরিফ রিশার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো

“আমাকে পাগল করার জন্য তুই কিছু না করলেও আমি তোর জন্য পাগল। আমার ঘুমন্তপরী #তুমি আমার প্রাণ। ”

____________

দুপুরবেলা………

বরযাত্রী সহ বর চেয়ারম্যান বাড়িতে হাজির।গ্রামে বিয়ে বাড়ির গেট ধরার প্রচলন না থাকলেও তানিয়ার মামাতো ভাই-বোন,, বন্ধু -বান্ধবী গেট ধরেছে।রিশা জুইও সেখানে উপস্থিত আছে তবে তাসরিফের আদেশে তাদের বেশি লাফালাফি মানা। দেনাপাওনার কথায় কনে পক্ষের সাথে বর পক্ষের তুমুল ঝগড়ার পর তাদের এস.আই দুলাভাই থেকে পনেরো হাজার টাকা খসিয়ে গেট ছেড়েছে। বিয়েতে মজার বিষয় হলো ছেলেদের সুন্দরী মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য তুমুল আগ্রহ। বরযাত্রীদের আসার পর আমন্ত্রিত এমপি সাহেব উনার ছোট মেয়েকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হাজির হোন। এমপি সাহেবের সকল কিছু তদারকির দায়িত্ব তাসরিফের ওপর। তাসরিফের সাথে ওর ছোটকালের বন্ধুরাও আছে। রায়হান রিশা আর তাসরিফ এর সম্পর্কের কথা জেনে কষ্ট পেলেও সে প্রকাশ করছে না। তার কৃত্রিম হাসি কেউ ধরতে না পারলেও অয়ন ঠিকই ধরে ফেলেছে। বিয়ের প্যান্ডেলের এককোণে রায়হানকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে

“তোর কি হয়েছে রায়হা তুই স্বাভাবিক থাকতে চাইলেও তোকে অস্বাভাবিক লাগছে। এমন লাগছে কেনো তোকে আমায় বল। সকাল থেকে তোকে আমি হাতের নাগালেই পেলাম না।”

প্রিয় বন্ধুর কথায় রায়হানের নাক ফুলে উঠা শুরু করেছে।

“আমার মায়াকন্যাকে আনার আগেই কেউ নিজের করে পেয়েছে অয়ন।আমি আমার মায়াকন্যাকে এ জীবনে আর পাবো না। সে অন্য কারো। ”

অয়ন রায়হান কে জরিয়ে ধরলো।

“রায়হান! তুই ভেঙ্গে পরছিস কেনো? রিশা তোর জন্য মরিচীকা। তুই চাইলেই ওকে ভুলতে পারবি ওর মায়া কেটে উঠতে পারবি। ভেঙ্গে না পরে চেষ্টা কর।

___________

তানিয়ার বন্ধুরা ইরফানের সাথে মজা করছে। বরযাত্রীদের খাওয়া-দাওয়া শেষে বিয়ে পড়ার জন্য কাজী সাহেব মতিন সাহেব সহ মুরব্বিদের সাথে কনের ঘরে উপস্থিত হলেন।বেদনাদায়ক এক মূহুর্তের মুখোমুখি তানিয়া। কাজীর সকল কথা শেষে তানিয়া কবুল বলতে অনেকটা সময় নেয়। মতিন সাহেব মেয়ের কান্নায় নিজেও কেঁদে ফেললেন। মেয়েকে জরিয়ে ধরেন। কনের কবুল বলার পর কাজী সাহেব বরের জন্য তৈরি মঞ্চে গেলেন। চার বছর অপেক্ষার ফলস্বরূপ ইরফান আজ তানিয়াকে নিজের নামে পাবে। দেরি না করে ফটাফট কবুল বলে দেয়। ইরফানের কবুল বলার তাড়াহুড়ো দেখে উপস্থিত সবাই হেসে উঠে।

___________

বর-কনে মঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে। তাদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান সবাই উপভোগ করছে। নুপুর আর অয়নের কাপল ডান্স-এ হাততালির বন্যা বইছে। এমপি মহোদয়কে বিদায় দিয়ে তাসরিফ আর মতিন সাহেব অনুষ্ঠানের জায়গায় আসলেন। সবার হৈ-হুল্লোড় আরো বাড়িয়ে দিলো মতিন সাহেবের বলা কথা। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন

” আজকে আরেক জোড়া বিয়ে হবে। আমার মেয়ের এতোদিনের চাওয়া তার খুশীর দিনেই পূরন করতে চাই। আজকে শুধু তানিয়া নয় তাসরিফের-ও বিয়ে। ”

তানিয়া ভাইয়ের হঠাৎ বিয়ের কথায় অবাক হলেও বেশ খুশি। তার অনেকদিনের সখ তার ভাইয়ের বউয়ের সাথে বন্ধুত্ব করা। এবার সেই সুযোগ এলো।মঞ্চ থেকে নেমে মতিন সাহেবের সামনে দাড়িয়ে বললো

“আব্বু! আমার ভাইয়ুর হবু বউ কোথায়?”

“সে আর কেউ না তোমার ফুপির মেয়ে। আমাদের পুতুল। তোমার ভাই নাকি তাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। আমায় বলেছে আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে সে তুলে নিয়ে যাবে আমার মামনীকে।”

মামার মুখে হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে রিশার মুখ রক্তশূন্য হয়ে ওঠে। জুইয়ের হাত খামচি দিয়ে ধরে। তবে শেষে মামার রসিকতায় রিশার কলিজায় পানি আসে। চারিদিকে তাকিয়ে তাসরিফ কে খুজতে থাকে। তাসরিফ ও প্রস্তুত ছিলো না এমনটার জন্য। এটা রিতীমত তার জন্য বছরের সেরা সারপ্রাইজ। মতিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন

“কেমন দিলাম সারপ্রাইজ! রাতে তোমার কথায় অবাক হলেও আমি খুশি হয়েছিলাম। সেই খুশিতে তোমাকে একটু চমকে দিলাম।”

তাসরিফ তো মহাখুশী। বাবাকে জরিয়ে ধরে। জুইয়ের পাশে দাড়িয়ে থাকা রিশাকে দেখে চোখ মারে। রিশা তাসরিফের দিকেই তাকিয়ে ছিলো বিধায় তাসরিফের কাজে লজ্জা পেয়ে জুইয়ের পেছনে লুকায়। একের পর এক সারপ্রাইজ তানিয়া পেয়ে যাচ্ছে। অবশেষে তাদের পুতুল তার ভাবি হবে। জুইয়ের পেছন থেকে রিশাকে টেনে এনে জরিয়ে ধরে বলে

“ভাবি।”

তানিয়ার উচ্ছ্বাসে সবাই খুশি। অবশেষে মতিন সাহেবের হুকুমে একই বিয়ের আসরে তাসরিফ রিশার বিয়েও সম্পন্ন হয়। দুজনের মুখের প্রাপ্তির প্রশান্তি। ঠোঁটে সুখের হাসি। তাসরিফ পাশে বসা রিশার দিকে একটু ঝুকে গিয়ে কানে কানে বলে

“অবশেষে পেলাম তোমায়। তোমাকে স্বাগতম আমার জীবনে এসে আমাকে তোমার মায়ায় জড়ানোর জন্য। ”

রিশা নড়াচড়া বাদ দিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। সবকিছু তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তাসরিফ রিশার হাতের ওপর হাত রাখলে রিশা কেপে উঠে। দুষ্টু হাসি দিয়ে তাসরিফ বলে

“শুধু হাত রাখতেই কাঁপা-কাঁপি। আজ তো অনেককিছু হবে। রাতের জন্য প্রস্তুত থেকো প্রাণপাখি।কেঁপে ওঠারও সুযোগ পাবে না।”

শিউরে উঠে রিশা। লজ্জায় পুরো মুখ লাল হয়ে উঠে। রায়হানের মন পুড়ছে। আর একমুহূর্ত ওর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। অয়ন উপলব্ধি করছে রায়হানের ব্যথা। বন্ধুকে স্বাভাবিক করতে সে বিয়ে বাড়ি থেকে রায়হান কে নিয়ে বেরিয়ে আসে।

চলবে……

[কেমন হয়েছে বলবেন কিন্তু সবাই 🥰 আমার সাথে থাকার জন্য সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ 🥰🥰]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here