তুমি আসবে বলেছে হৃদয় পর্ব -১২

#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-১২
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

মাঝেমাঝে প্রিয় কিছু জিনিস ও আমাদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই যে জলপ্রপাত এটা ছিল এরিকের কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান। সে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতো কানাডাতে জন্মগ্রহণ করে। এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বারবার ছুটে এসেছে নায়াগ্রাতে। কিন্তু আজ এই সৌন্দর্য তার চোখে লাগছে না। আজ চোখে কোন মুগ্ধতা নেই। আছে কোন না হওয়া প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট‌। চোখ দুটো শুধু একজনকে দেখার অপেক্ষাতেই অস্থির হয়ে আছে। ফেলিক্স বুঝতে পারছে এরিকের অস্থিরতা। কিন্তু করবে টা কি? তারও খুব চিন্তা হচ্ছে মেয়েটার জন্য। এরিক সকালের কথা চিন্তা করে-

এরিক কেবিনে ঢুকতেই দেখলো ইথান আর ফিওনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর ফেলিক্স এসে এরিকের কাঁধে হাত রেখে বলল-

-” এরিক আমি কখনো চাই না তোর জায়গা দখল করতে। আমি চাই তুই ভালো থাক ভাই‌। নিরাপদে থাক‌। এই ইথান আর ফিওনা তোর জন্য নিরাপদ নয়। তাই আমি এসেছি আবারো‌। কিন্তু তুই তে রিদিশার উপর দূর্বল হয়ে পড়েছিস, সেটার ও সুযোগ নিতে চাইছে ওরা।

এরিক রেগে ফেলিক্সের দিকে তাকায়। ফেলিক্সের হাত ঝটকা মে|রে সরিয়ে দিলো। এরিক তার মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-

-“দেখো তোমরা দেখো। খুব ভালোবাসো তাই না এই ফেলিক্স কে? সে আজ আমার সামনে ইথান ভাইকে খারাপ প্রমান করতে চাইছে। আরে ইথান ভাই এই কম্পানির পিছে কম পরিশ্রম করেনি। এই ফেলিক্স তো কম্পানিতে রাজত্ব করতে চায়, তাই আমাদের মধ্যে ঝামেলা বাঁধাতে চাইছে। দেখো আবার বলছে কি ইথান ভাই রিদিশার ও ক্ষতি করবে। আচ্ছা ফেলিক্স ভাইয়া তোমার লজ্জা করেনা নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ড এর সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতে? আর ফিওনা ওকে তো তুমি ভালোবাসো, ওর নামেও মিথ্যা বলছো? ওর সাথে তুমি চিট করতে চাইছো? ছিহ ফেলিক্স ব্রো তোমার থেকে এটা আশা করিনি‌।

উপস্থিত সবাই এরিকের দিকে তাকিয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। ছেলেটা কত বিশ্বাস করে ইথান কে। অথচ ইথান এই প্রতিদান দিলো? এই বিশ্বাস যখন ভাঙবে এরিক সইতে পারবে তো? ওর ছোট মনটা ভেঙে যাবে না তো? ফেলিক্স জানে ইথান কে কতটা মানে এরিক মুখের কথা বিশ্বাস করবেনা। তাই সে কিছু ভিডিও ক্লিপ অন করে এরিকের সামনে রাখে। এরিক দেখলো ভিডিও তে ইথান আর ফিওনার চুম্বনরত অবস্থা। থমকে গেলো। এটা ইথান ভাইয়া? সে কি করে এমন করলো, চোখ তুলে ইথান আর ফিওনার দিকে অনুভূতি শূন্য চোখে তাকালো। তারপর ফিওনার ঐদিন অপমানের পর এসে ফেলিক্সের কলার চেপে ধরা। সবকিছু দেখে শুনে এরিক স্তব্ধের মতো বসে পড়ে‌। ইথানের সম্পর্কে এসব তার হজম হচ্ছে না।

-” এরিক।

চমকে ওঠে এরিক ফেলিক্সের কথায়। ভাবনা থেকে সরে আসে। অনুভূতিশূন্য চোখে তাকায় ফেলিক্সের দিকে। ফেলিক্স শুকনো হেসে বলে-

-” আবার ঐসব নিয়ে ভাবছিস? এখন নাম গাড়ি থেকে। রিদিশার লোকেশন আশেপাশেই সো করছে।

এরিক শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নেয়।
চোখদুটো তে এসে আবারো ভয় হানা দেয়। রিদিশার সাথে যেনো খারাপ কিছু না হয়। কোনমতে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামে এরিক আর ফেলিক্স। গাড়ি থেকে নামতেই সামনে কিছু লোকের জটলা দেখে এগিয়ে যায় ওরা। মানুষ ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই স্তব্ধ হয়ে যায় এরিক। হাত পা অসম্ভব ভাবে কাঁপছে। একি অবস্থা তার কিউট সিনিয়রের? সারা মুখে ছোপ ছোপ র|ক্ত। মাথার ডান পাশটা থেকে ফিনকি দিয়ে র|ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চোখ বুজে পড়ে আছে মেয়েটা। এরিকের এই অবস্থা দেখে ফেলিক্স দিশেহারা হয়ে পড়ে। উপায় না পেয়ে নিজেই রিদিশা কে কোলে তুলে নেয়। মেয়েটার এই নি|র্মম অবস্থা দেখে বুক কাঁপছে ফেলিক্সের। ওর সাথে খারাপ কিছু করেনি তো? মাথা দু দিকে নাড়িয়ে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে ফেলিক্স। রিদিশা কে নিয়ে পা বাড়িয়ে দ্রুত এরিক কে বলে-

-” ভাই আমার তাড়াতাড়ি আয়। ওকে হসপিটালে নিতে হবে।

এরিক সম্বিৎ ফিরে পায় ফেলিক্সের কথায়। দ্রুত গিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসে। ফেলিক্স রিদিশাকে এরিকের কাছে দিয়ে দ্রুত ড্রাইভিং করতে থাকে। এরিকের হাত দুটো কাঁপছে আবারো‌। রিদিশার দিকে তাকাতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে। কি নিষ্পাপ মেয়েটা। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। আজ তার জন্যই ওর এই অবস্থা। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিচ্ছে এরিক। কাঁপা ঠোঁটজোড়া রিদিশার কপালে ছুঁইয়ে দেয় এরিক। যদি সজ্ঞানে থাকতো কখনো কি এরিক কে এই কাজ করতে দিতো রিদিশা? জানা নেই। এরিক কাঁপা হাতটা রিদিশার নাকের কাছে নিলো। মুহূর্তেই তার হৃদস্পন্দন থেমে যায়‌।
নিঃশ্বাস খুব ধীরে পড়ছে। এরিক চেঁচিয়ে ফেলিক্স কে বলে-

-” ব্রো তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করো, ওর নিঃশ্বাস পড়ছে খুব ধীরে।

ফেলিক্স যতদ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে হসপিটালে আসে। এরিক রিদিশাকে কোলে করে নিয়ে দৌড়ে হসপিটালে ঢোকে। রিদিশাকে অপারেশন থিয়েটারে এ নেয়া হয় দ্রুত। ফেলিক্স হসপিটালের সব ফর্মালিটিজ পূরণ করে আসে। বাসার সবাইকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে এতক্ষনে। এরিক চুপ করে তাকিয়ে আছে ওটির বদ্ধ দরজার দিকে। ফেলিক্স এসে এরিকের কাঁধে হাত রাখে। এরিক ঘুরে তাকায় ফেলিক্সের দিকে, ছলছল করছে ওর চোখদুটো। ফেলিক্স কি বলে স্বান্তনা দেবে জানা নেই। এর মধ্যেই ছুটে আসে মিসেস ময়ূরী, এলেন, এলিজা, এলিনা আর এরিকের বাবা মেহতাব তাহসান। মিসেস ময়ূরী কে দেখে যেনো এরিকের কান্নার বাঁধ ভাঙলো। ছুটে গিয়ে দাদিকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো এরিক। এরিক কে এভাবে কাঁদতে হয়তো তার দাদি ছাড়া কেউ দেখেনি‌। তাই সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মিসেস ময়ূরী কাঁদতে কাঁদতে বললেন-

-” আমি পারলাম না ওকে আগলে রাখতে। ওর নানী মাকে আমি কি জবাব দেবো‌। সে কত ভরসা করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলো। আজ আমাদের জন্য তার নাতনির এই অবস্থা। আমি কি জবাব দেবো।

তখন ওটি থেকে একজন নার্স বেরিয়ে আসে। সবাই উতলা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্স মাস্ক খুলে বলল-

-” প্রেশেন্টের ব্লা|ড লস হয়েছে অনেক। ইমার্জেন্সি ও পজেটিভ ব্লা|ড লাগবে।

এরিক বাচ্চাদের মতো গিয়ে বলল-

-” নার্স আমার সব র|ক্ত নিয়ে নিন কিন্তু আমার রিদি কে বাচিয়ে দিন প্লিজ।

নার্স অবাক হয়ে এতবড় ছেলের বাচ্চার মত কান্না করা দেখে। এই সূদর্শন ছেলে ও মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদছে। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে-

-” আপনার ব্লা|ড গ্রুপ কি ও পজেটিভ।

এরিকের হুশ হয়। সে মাথা দু দিকে নাড়িয়ে বলে-

-” না বি নেগেটিভ।

নার্স বিরক্ত হয় এরিকের উপর। শুধু সময় নষ্ট করছে। কিন্তু এতো সুন্দর ছেলেকে সে কিছু বলতে পারছেনা কেন জানি। ফেলিক্স এগিয়ে এসে বলে-

-” ব্লা|ড আমি দেবো চলুন। আমার ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ।

নার্সটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভেতরে যায়। যাওয়ার আগে ফেলিক্স কে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে যায়। এরিক জানেনা ফেলিক্সের ঋণ সে কিভাবে শোধ করবে। সে কিনা এতদিন বিশ্বাসঘাতক বেইমান ইথানের জন্য ফেলিক্স কে অসম্মান করতো। মুহূর্তেই রাগে দপ করে জ্বলে ওঠে এরিক। রিদিশার এই অবস্থা করেছে। ওকে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবো। মৃ|ত্যু ভিক্ষা চাইবে আমার কাছে। রিদিশা একবার সুস্থ হোক। মিসেস ময়ূরী এসে নাতির কাঁধে হাত রেখে বলে-

-” এখন কি করবি ভাবছিস?

দাদির কথায় চুপ করে থাকে এরিক। ময়ূরী জানে তার নাতি সহজে কাউকে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু এখন এইসব আর ভালো লাগেনা। তিনি গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলে-

-” ওদের পুলিশের হাতে তুলে দে।

এরিক দাদির দিকে তাকিয়ে বলে-

-” পুলিশ ওদের কি শাস্তি দেবে। ওদের আমি শাস্তি দেবো। আমার ভাইকে ঠকনোর শান্তি। আমার ভাইদের মা|রার শাস্তি, আমার কলিজায় হাত দেয়ার শাস্তি। দাদি এবার তুমি কিছু বলতে পারবেনা। আমি এই লাস্টবার ওকেই শাস্তি দেবো‌। প্রমিজ তারপর একেবারে ভালো হয়ে যাবো‌।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here