তুমি আসবে বলেছে হৃদয় পর্ব -১৩

#তুমি_আসবে_বলেছে_হৃদয়
#পর্ব-১৩
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

অন্ধকার ঘরে কি নিদারুন নিস্তব্ধতা। দুজন মানব মানবী বাঁধা অবস্থায় বসে আছে চেয়ারে। ফাঁকা ঘরটাতে দুজনের নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ভুতুড়ে শব্দ তৈরি করছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ সামনে মুখ তুলে তাকায় দুজনেই। সামনের মানুষটার এমন রূপ দেখে মুহূর্তেই আতঙ্ক‌ ছড়িয়ে যায় মেয়েটার চোখে। সে কখনোই এই মানুষটার এমন রূপ দেখেনি। যা দেখেছে তা ছিলো নির্মল ভালোবাসা। ছেলেটার মুখে ভাবান্তর দেখা দিলো না। সে এখন রেগে আছে কারণ তার লোকেরা রিদিশাকে জীবিত ছেড়ে দিয়েছে। মনে মনে আবারো ছক তৈরি করছে হয়তো‌। ফেলিক্স সশব্দে ঘরের মধ্যে ঢোকে। পায়ের উপর পা তুলে সামনের চেয়ারে বসে। উৎকট বিশ্রী গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। ফেলিক্সের হাতের চকচকে বস্তুটার দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে ফিওনা। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ‌। যখন রিদিশাকে মা|রার চিন্তা করছিলো তখন এই ভয়ের ছাপ কই ছিলো, যখন আমার ভালোবাসা ভুলে আমাকে ধোঁকা দিয়ে প্রতারণা করলে এই ভয়ের ছাপ কোথায় ছিলো? জানতে বড় ইচ্ছে হলো ফেলিক্সের। ইথানের নিরবতা সহ্য হচ্ছে না ফেলিক্সের। ফেলিক্স ফিওনার দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বসে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসে ফিওনা। ঢোক গিলে আবারো ফেলিক্সের হাতের চকচকে ছু|ড়ির দিকে তাকালো ফিওনা। দু দিকে মাথা নাড়িয়ে ছটফট করে বলল-

-” ক্ষমা করো ফেলিক্স, আমায় ক্ষমা করো। বিশ্বাস করো তোমার ভাইকে যে ইথান মে|রেছে তা আমি জানতাম না। জানলে কখনো ওর ফাঁদে পা দিতাম না।

ফেলিক্স অগ্নিচোখে তাকালো ফিওনার দিকে। ওর প্রাণ পাখি যায় যায় পালা। এতদিন সম্পত্তির লোভে এতই অন্ধ ছিলো যে পরবর্তীতে কি হবে ভেবে দেখেনি। ওর ভুল হয়েছে ইথানের কথায় ওর ফাঁদে পা দিয়ে। ফিওনা ইথানের দিকে তাকালো‌। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলছে। ফিওনার বোঝার বাকি নেই ইথান তাকে শুধু গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফিওনা আর কোন পথ খুঁজে পায়না। ফেলিক্স ডান হাত দিয়ে ফিওনার চোয়াল চেপে ধরে। ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে ফিওনা‌। পুরুষ মানুষের হাত এমনিতেই শক্ত। ফেলিক্স দাঁত কিড়মিড় করে বলে-

-” তা না হয় জানতি না। কিন্তু তুই আমাকে ঠকালি কি করে? এত বড় গেম খেললি আমার সাথে? তোকে আমি কোন দিক দিয়ে অপূর্ণ রেখেছিলাম? যখন যা চেয়েছিস তাই দিয়েছি। শারীরিক, আর্থিক সকল চাহিদা পূরণ করেছি। নাকি আমাকে দিয়ে তোর পোষায়নি? তাই ঐ বিশ্বাসঘাতক ইথানের সাথে মিলেছিস?

মেয়েটির চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। এই কথাগুলো শুনতেই গা রি রি করে উঠছে। সেও তো ভালোবাসতো ফেলিক্স কে। মেয়েটি কেঁদে দিয়ে বলে-

-” ফেলিক্স ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি। আমি কি তোমাকে কম ভালোবাসতাম? তুমি কেন আমেরিকা চলে গিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে। তোমার প্রেমিকা বেলার কাছে?

ফেলিক্স ফিওনার চোয়াল ছেড়ে দেয়। দুই ঠোঁট নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়। কে বলেছে সে আমেরিকা প্রেমিকার কাছে গিয়েছিলো? বেলা তো তার বাল্যকালের বান্ধবী। যাকে সে বোনের মতোই ভালোবাসে। ইথান মুচকি মুচকি হাসছে। ফেলিক্স রাগান্বিত চোখে ইথানের দিকে তাকায়। রেগে ইথানের হাঁটুর উপরে ছুঁ|ড়ি বসিয়ে দেয়। ফিওনা রক্ত দেখে ভয়ে সেন্সলেস হয়ে যায়। ইথান ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে। রেগে ফেলিক্সের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” বা|স্টার্ড! পারলে হাত খুলে দে, তারপর আঘাত কর। কাপুরুষের মতো হাত পা বেঁধে আঘাত করছিস কেন?

ইথানের কথা শুনে ফেলিক্স রাগে ছুঁ|ড়িটা ক্ষতস্থানের ওপর মোচড় মারে। ইথানের মনে হয় কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যাথায়। তবুও তার দু চোখে ভয় নেই। নেই কোন বাঁচার আকুতি। দু চোখে কেবল ক্রোধ। ফেলিক্স ফিওনার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ছু|ড়িটা উঠিয়ে নিচে ফেলে দেয়। নিজেকে শান্ত করে ফেলিক্স প্রশ্ন করে –

-” তুই ওকে মিথ্যা বলেছিস কেন? আমি বেলাকে বোনের মতো ভালোবাসি এটা তুই জানিস। তবে বেলাকে নিয়ে আমার নামে কেন মিথ্যা বললি ওর কাছে?

ইথানের চোখজোড়া জ্বলে উঠলো। ক্ষুদ্ধ গলায় বলল-

-” তোর জন্য! এই তোকেই আমার মোটেও পছন্দ নয় বুঝলি! যখন ছোটবেলায় বেলাকে পছন্দ করতাম তখন ওকে তুই আগলে রেখেছিস বোনের মতো। ও যখন আমাকে ভাই ডাকতো খুব খারাপ লাগতো। কখনো তোর জন্য ওকে পাইনি‌। এরপর যখন ফিওনা কে দেখি তখন ওকে পছন্দ করি। কিন্তু হায় বিধিরাম তোকে ওর সাথে দেখে সে আশাও ভঙ্গ হয়। স্কুলে সবসময় আমাকে তোর নিচে রাখতি। তোর জন্য কখনো প্রথম হতে পারিনি‌। তোর জন্য এরিকের সম্পত্তি হাসিল করতে পারলাম না। এই তুই আমার জীবনটা নরক করে দিয়েছিস‌। ঘৃণা করি তোকে আমি। দুই দুইবার আমার হৃদয় তোর জন্য ভেঙেছে। ভেবেছিলাম এবার ফিওনা কে পেয়ে গেছি কিন্তু ও বিশ্বাস করছিলো না। তোর আর ফেলার কিছু ছবি দেখাতেই কাজ করলো। ওকে সম্পত্তির কথা বলার পর আমার সাথে রিলেশনে আসলো। কিন্তু সেই তুই আবার বাঁধা হয়ে চলে এলি, ম|রার উপর খাড়ার ঘা হয়ে।

ফেলিক্স এবার আর অবাক হলো না। আর কিই বা অবাক হবে। তার ভাগ্যটাই হয়তো এমন! ভালোবাসার সব মানুষ গুলো ছেড়ে যায়। প্রথমে পিটার তারপর ফিওনা আর এই বেষ্টফ্রেন্ড ইথান ও। সত্যিই কি বেষ্ট? পাগলের মতো ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো ফেলিক্স। ইথান তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ফেলিক্সের দিকে। ফেলিক্স হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে-

-” আমি ঘৃণা করি এই ইথান কে। এ আমার বেষ্টফ্রেন্ড নয়। এ আমার নিষ্পাপ ভাইটার হ|ত্যাকারি, এ একজন প্রতারক, বেইমান। তোকে আমি শাস্তি দেবো, মা।রবো না , আমি তোর চোখে যতক্ষনে ভয় না দেখবো ততক্ষনে মা|রবো না। তুই যতক্ষনে নিজে মৃত্যু না চাইবি ততক্ষন তুই বেঁচে থাকবি। আমার ছোট ভাইটা তোর কাছে না জানি কত আহজারি করেছিল বাঁচার জন্য। একটুও মায়া হয়নি তোর। আমি তোকে ততক্ষন বাঁচিয়ে রাখবো যতক্ষন তুই বেঁচে থাকতে চাস।

ফেলিক্স উঠে দাঁড়াল, ফিওনার কথা খুব মনে পড়ছে। মেয়েটা কে ও কিভাবে শাস্তি দেবে। ওর অচেতন মুখের দিকে ঝুকলো ফেলিক্স। কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে উঠে এলো। আর তাকাবে না ওর মুখে। তাহলে আবার মায়ায় পড়ে যাবে। ফেলিক্স গলা উঁচিয়ে কাউকে ডাকলো। মাস্ক পড়া দুইজন ছেলে এসে দাঁড়ায়। ফেলিক্স তাদের কে বলল-

-” এই মেয়েটাকে ঐ রুমটায় আটকিয়ে রাখবি। ঠিকমত খাবার দিবি। আগে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে আয়। আর এই হারামি ( ইরানের দিকে আঙুল তাক করে) ওকে ভালো করে খাতির যত্ন করিস‌। পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিস। মারবিনা ওকে আমিনা বলা পর্যন্ত। মেয়েটার গায়ে যেনো ফুলের টোকাও না লাগে।

ছেলেদুটো বাধ্যের মতো মাথা নাড়লো। ফেলিক্স প্রস্থান করে ওখান থেকে। হসপিটালে যেতে হবে। এরিকের অনুরোধে এসেছে এখানে। আর ক্ষোভ তো ওরও ছিলো। ফেলিক্স রাতের আকাশে দিকে তাকালো। আজ আর তাঁরা নেই। নেই কোন চাঁদের আলো। তার জীবনটাও হয়তো এইভাবে হারিয়ে যাবে অন্ধকারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠলো।

______________

এরিক দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে রয়ে গেছে তাঁর দাদী ময়ূরী। সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য জোড় করলেও তারা যায়নি। একজন নার্স এসে এরিকের সামনে দাঁড়ালো। প্রসন্ন হেসে বলল-

-” প্রেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে আপনারা দেখা করতে পারেন।

এরিকের ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতর র|ক্তক্ষরণ হচ্ছে সকাল থেকেই। আজকের দিনটাই আনলাকি। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রিদিশার কেবিনের দিকে। বাহির থেকে দেখে একবার। নিঃশব্দে ভেতরে ঢোকে এরিক। যতই সামনে আগাচ্ছে বুকের ভেতর ছটফটানি বাড়ছে। এরিকের নিজের পা দুটোকে ভারি মনে হচ্ছে। বহু কষ্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সামনে। আস্তে গিয়ে রিদিশার পায়ের কাছে বসলো। রিদিশার পায়ের উপর তরল কিছু অনুভুত হতেই চোখ খুলে তাকালো। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখলো ওটা এরিক। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল-

-” আ-রেএ আ-মা-র পাআ-য়ে-র উ-প-রে কে-ন তু-মি? স-রে এ-সো। এ-রি-ক!

শেষের কথাটা একটু জোড়েই বলে রিদিশা। এরিক তাড়াতাড়ি করে মাথা তোলে। তার ঘোলা চোখদুটো জলে টুইটুম্বুর। রিদিশার মুখে নিজের নাম শুনে বড্ড খুশি লাগছে এরিকের। মনের ভেতর ভালোলাগার ঢেউ খেলে গেলো। রিদিশা ইশারায় কাছে ডাকে। এরিক এসে মাথার কাছে বসে। রিদিশা তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে।

-” আই এম সরি রিদিমনি। সব দোষ আমার। আমার জন্যই তোমার এই অবস্থা। কেন তোমাকে ভালোবাসলাম? তাহলে তো এই ক্ষতি হতো না। কেন কেন তোমাকে ভালোবাসলাম?

রিদিশা ক্লান্ত চোখদুটো মেলে তাকায়। এরিকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে-

-” ভালোবেসেছো বলে কি অনুশোচনা হচ্ছে? আমি কি খুব খারাপ?

এরিক চকিতে তাকায়। তার রিদিমনি কি বলল? এরিক দ্রুত মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে-

-” না না অনুশোচনা হচ্ছে না। তুমি তো পবিত্র রিদিমনি। তুমি কেন খারাপ হবে। ওকথা মুখেও এনোনা। ভালোবাসি তো।

রিদিশা নিরবতা ভেঙে বলে-

-” এই ভালোবাসা থাকবে তো?

এরিক রিদিশার চোখে চোখ রাখে। বুকের ভেতর কাঁপন ধরে দুজনেরই। তবুও রিদিশা চোখ সরায় না। আর কত পালাবে নিজের থেকে। পালিয়ে কি অনুভুতি থেকে বাঁচা যায়?‌ সে তো সেই প্রথম দিনই হারিয়েছিলো এই ঘোলা চোখে। নিজেকে সংযত রাখতে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেও এড়াতে পারলো না। এরিক রিদিশার দুই হাত ধরে বলে-

-” থাকবে রিদি থাকবে। এই যে হাত ধরেছি তোমার, আজরাইল জান কবজ করবে তখনই এভাবে হাত ধরে রাখবো।

রিদিশা দু চোখ বন্ধ করে। চোখের কোণে জলের ধারা নামে। এরিক দুচোখের জল মুছে দেয়। মাথায় ব্যান্ডেজ করা তবুও সুন্দর লাগছে খুব। এরিক মাথায় ব্যান্ডেজের উপর ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। রিদিশা অভিভূত হয়। বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যায়। বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে। এরিক কি শুনে ফেলবে। রিদিশা মনে মনে বলল- ওরে থাম থাম এই জুনিয়রের একটা চুমুতে এমন করছিস যেন, এখন বেড়িয়েই ওকে জড়িয়ে ধরবি। গ্লাসের বাইরে থেকে এই সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী হয় দুজন মানুষ। কিন্তু একজনের ভাবনা অন্যকিছু। কি হতে চলেছে সামনে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here